মা’আরেফুল কোরআন - ৮০ || সূরা আল-বাকারাহ, ২১৫ || আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করার হুকুম এবং কাকে দান করা হবে
یَسۡـَٔلُوۡنَکَ مَا ذَا یُنۡفِقُوۡنَ ۬ؕ قُلۡ مَاۤ اَنۡفَقۡتُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ فَلِلۡوَالِدَیۡنِ وَ الۡاَقۡرَبِیۡنَ وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ ابۡنِالسَّبِیۡلِ ؕ وَ مَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ فَاِنَّ اللّٰهَ بِهٖ عَلِیۡمٌ ﴿۲۱۵
সূরা আল-বাকারাহ ২১৫ নং আয়াতের অর্থ
(২১৫) আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, কি তারা ব্যয় করবে ? বলে দিন—যে বস্তুই তোমরা ব্যয় কর, তা হবে পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়-আপনজনের জন্য, এতিম অনাথদের জন্য, অসহায়দের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। আর তোমরা যে কোন সৎ কাজ করবে, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে।
সূরা আল-বাকারাহ ২১৫ নং আয়াতের তাফসীর
তাফসীরের সার-সংক্ষেপ
মানুষ আপনার কাছে জানতে চায়, (সওয়াবের জন্য) কি জিনিস ব্যয় করবে ( এবং কিভাবে ব্যয় করেবে ?) আপনি তাদেরকে জানিয়ে দিন, যেসব বস্তু তোমরা খরচ করতে চাও, (তার নির্ধারণের বিষয়টি তো তোমাদের সৎ সাহসের ওপরেই নির্ভরশীল। তবে খরচ করার স্থানগুলো আমি বলে দিচ্ছি। তা হলো এই যে) তাতে অধিকার রয়েছে মাতা-পিতার, আত্মীয়-স্বজনের, পিতৃহারা এতীম শিশুদের, অনাথ-অসহায় ও মুসাফিরদের, আর তোমরা যা কিছু নেক কাজ করবে (চাই তা আল্লাহর পথে ব্যয়ের ক্ষেত্রে হোক কিংবা অন্য কোন স্থানে) সে ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলা সম্পূর্ণ অবগত (এতে তিনি নেকী দান করবেন)।
সূরা আল-বাকারাহ ২১৫ নং আয়াতের বিষয় বস্তু
আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়
প্রথমোক্ত আয়াতগুলোতে স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি একান্ত গুরুত্ব ও তাকীদের সাথে বলা হয়েছে যে, কুফরী ও মোনাফেকী ত্যাগ করে পুরোপুরিভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। আল্লাহর আদর্শের পরিপন্থী হলে কারো কথাই মানবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জানমাল কোরবান করে দাও এবং যাবতীয় দুঃখ-কষ্টে ধৈর্যধারণ কর। এখান থেকে সে নির্দেশের আনুগত্য এবং আল্লাহর রাস্তায় জানমাল কোরবান করার ছোট-খাটো বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হচ্ছে, যা জানমাল এবং বিয়ে-তালাক প্রভৃতিসহ জীবনের অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। পূর্ব থেকে যে বর্ণনাপদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে এখানেও সে রীতিই রক্ষা করা হয়েছে।
আনুষঙ্গিক এ বিষয়গুলোর আলোচনাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এবং এরও একটা বিশেষ রীতি রয়েছে। এসব বিষয়ের অধিকাংশই হচ্ছে এমন, যার সম্পর্কে সাহাবীগণ রাসূলে করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন এবং সেগুলোর উত্তর রাসূল (সা)-এর মাধ্যমে সরাসরি আরশে মোয়াল্লা থেকে আল্লাহ্ তা’আলাই দিয়েছেন। সেমতে এসব ফতোয়া বা প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং আল্লাহ্ই দিয়েছেন বলেও যদি মনে করা হয়, তাও ভুল হবে না। কোরআন শরীফে রয়েছেঃ
قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِيهِنَّ - এতে পরিষ্কারভাবে আল্লাহ্ তা’আলা ফতোয়া দেওয়ার কাজটিকে নিজেরই সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। কাজেই এতে কোন প্রকার রূপক বিশ্লেষণ চলে না। তাছাড়া বলা যেতে পারে যে, এ ফতোয়া রাসূল (সা) দিয়েছেন, যা তাঁকে ওহীর মাধ্যমে শেখানো হয়েছে। এ রুকূতে শরীয়তের যেসব হুকুম-আহকাম সাহাবীগণের প্রশ্নের উত্তরে বর্ণনা করা হয়েছে, তা একান্তই গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র কোরআনে এমনিভাবে প্রশ্নোত্তরের আকারে বিশেষ বিধানের বর্ণনা প্রায় সতেরটি জায়গায় রয়েছে। তন্মধ্যে সাতটি হচ্ছে সূরা বাকারায়, একটি সূরা মায়েদায়, একটি সূরা আনফালে। এ নয়টি স্থানে প্রশ্ন করা হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া সূরা আ’রাফে দুটি এবং সূরা বনী ইসরাঈল, সূরা কাহাফ, সূরা তা-হা ও সূরা নাযেআতে একটি করে ছয়টি স্থানে কাফিরদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন ছিল যার উত্তরে কোরআনে করীমে উত্তরের আকারেই দেওয়া হয়েছে। মুফাসসির হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন, মুহাম্মদ (সা)-এর সাহাবীগণের চাইতে কোন উত্তম দল আমি দেখিনিঃ ধর্মের প্রতি তাঁদের অনুরাগ ছিল অত্যন্ত গভীর আর হুযূরে আকরাম (সা)-এর প্রতি তাঁদের এহেন ভালবাসা ও সম্পর্ক সত্ত্বেও তাঁরা প্রশ্ন করতেন খুব অল্প। তাঁরা সর্বমোট তেরটি বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করেছিলেন। সেগুলোর উত্তর কোরআন করীমে দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁরা প্রয়োজন ছাড়া কোন প্রশ্ন করতেন না। (কুরতুবী)
আলোচ্য আয়াতগুলোর প্রথমটিতে সাহাবীগণের প্রশ্নের বিষয়টি নিম্নলিখিতভাবে উদ্ধৃত হয়েছে يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ -অর্থাৎ মানুষ কি ব্যয় করবে এ সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করবে। এ প্রশ্নই রুকূতে দু’টি আয়াতের পর পুনরায় একই বাক্যের মাধ্যমে করা হয়েছেঃ
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ - কিন্তু প্রথমবার এই প্রশ্নের যে উত্তর উল্লিখিত আয়াতে দেওয়া হয়েছে, দু’আয়াতের পর এর উত্তর অন্যভাবে দেওয়া হয়েছে। এজন্য বুঝতে হবে যে, একই রকম প্রশ্নের দু’টি উত্তরের একটি তাৎপর্য অবশ্যই রয়েছে। আর সে তাৎপর্যটি সে সমস্ত অবস্থা ও ঘটনার বিষয়ে চিন্তা করলেই বোঝা যায়, যেগুলোর প্রেক্ষিতে আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়েছিল। যেমন, আলোচ্য আয়াতের শানে-নুযুল হচ্ছে এই যে, আমর ইবনে নূহ রাসূল (সা)-কে প্রশ্ন করেছিলেনঃ ما ننفق من أموالنا واين نضعها অর্থাৎ আমাদের সম্পদ হতে কি পরিমাণ ব্যয় করব এবং কোথায় ব্যয় করব? ইবনে জরীরের বর্ণনা মতে এ প্রশ্নটির দু’টি অংশ রয়েছে। একটি হচ্ছে, অর্থ-সম্পদের মধ্য থেকে কি বস্তু এবং কত পরিমাণ খরচ করা হবে ? দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এই দানের পাত্র কারা ?
দু’আয়াত পরে যে একই প্রশ্ন করা হয়েছে, তার শানে নুযুল ইবনে হাতেমের বর্ণনা অনুযায়ী এই যে, মুসলমানগণকে যখন বলা হলো যে, তোমরা স্বীয় সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় কর, তখন কয়েকজন সাহাবী রসূল (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, আল্লাহর পথে ব্যয় করার যে আদেশ আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে, আমরা এর বিস্তারিত আলোচনা শুনতে চাই । কি বস্তু কি পরিমাণে আল্লাহর পথে ব্যয় করব ? এ প্রশ্নের একটি মাত্র অংশ বিদ্যমান। অর্থাৎ কি ব্যয় করা হবে। এভাবে এ দু’টি প্রশ্নের ধারা ও রূপের কিছুটা বিভিন্নতা দেখা দিয়েছে। প্রথম প্রশ্নে কি ব্যয় করবে এবং কোথায় ব্যয় করবে বলা হয়েছে। দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে কি ব্যয় করবে। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে কোরআন মজীদ যা বলেছে, তাতে বোঝা যায় যে, প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ ’কোথায় ব্যয় করবে’ একে অধিক গুরুত্ব দিয়ে পরিষ্কারভাবে এর উত্তর দেওয়া হয়েছে এবং প্রথম অংশ ’কি খরচ করব’-এর উত্তর দ্বিতীয় উত্তরের আওতায় বর্ণনা করা যথেষ্ট বলে মনে করা হয়েছে। এখন কোরআন মজীদে বর্ণিত দু’টি অংশের প্রতি লক্ষ্য করা যাক । প্রথম অংশে অর্থাৎ কোথায় ব্যয় করবে সে সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছেঃ
مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ
অর্থাৎ আল্লাহ্ রাস্তায় তোমরা যা-ই ব্যয় কর,তার হকদার হচ্ছে তোমাদের পিতা-মাতা, নিকট আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম-মিসকিন ও মুসাফিরগণ।
আর দ্বিতীয় অংশের জবাব অর্থাৎ কি ব্যয় করবে ? এ প্রশ্নের উত্তর প্রাসঙ্গিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে ইরশাদ করা হয়েছেঃ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ অর্থাৎ ’তোমরা যেসব কাজ করবে তা আল্লাহ্ তা’আলা জানেন।’ বাক্যটিতে ভাল ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য কোন পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি যে, এতটুকু বাধ্যতামূলকভাবেই তোমাদের ব্যয় করতে হবে এবং স্বীয় সামর্থ্যানুযায়ী যা কিছু তোমরা ব্যয় কর, আল্লাহর নিকট এর প্রতিদান পাবে।
মোটকথা, প্রথম আয়াতে হয়তো প্রশ্নকারীদের প্রতি লক্ষ্য রেখেই এই প্রশ্নের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, আমরা যা ব্যয় করবো তা কাকে দেব ? কাজেই উত্তর দিতে গিয়ে দানের ’মাসরাফ’ বা পাত্র সম্পর্কে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া দানের বস্তু ও পরিমাণ নির্ণয়ের ব্যাপারটিকে প্রাসঙ্গিক বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী প্রশ্নে শুধু জিজ্ঞাসা ছিল যে, কি খরচ করব ? এর উত্তরে বলা হয়েছেঃ قُلِ الْعَفْوَ -অর্থাৎ “আপনি বলে দিন যে, যা অবশিষ্ট থাকে অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা থাকে তা-ই খরচ কর।” এ দু’টি আয়াতে আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করা সম্পর্কিত কয়েকটি মাস’আলা অবহিত হওয়া গেল।
আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা সম্পর্কিত ৩টি মাস’আলা
মাস’আলা ১ঃ এ দু’টি আয়াত ফরয যাকাত সম্পর্কিত নয়। কেননা, ফরয যাকাতের বেলায় নেসাব বা পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে এবং কি পরিমাণ ব্যয় করতে হবে তাও নির্ধারিত রয়েছে। রাসূল (সা)-এর মাধ্যমেই পরিপূর্ণভাবে সেই হিসাব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আয়াতে নেসাব ও ব্যয়ের পরিমাণ কোনটিরই উল্লেখ নেই। তবে বোঝা যায় যে, আয়াত দু’টি নফল সাদকা সম্পর্কিত। এতে আরো বোঝা যাচ্ছে যে, হিসাবে পিতা-মাতাকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে অথচ মাতা-পিতাকে যাকাতের মাল দেওয়া রাসূল (সা)-এর শিক্ষা মতে জায়েয নয়। এ কারণেই এ আয়াতের সম্পর্ক ফরয যাকাতের সঙ্গে নয়।
মাসা’আলা ২ঃ এতে আরো বোঝা গেল যে, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনকে যা দেওয়া হয় বা আহার করানো হয় তাতেও যদি আল্লাহর আদেশ পালনেরই উদ্দেশ্য থাকে, তবে সওয়াব তো পাওয়া যাবেই, তদুপরি তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার শামিল হবে।
মাস’আলা ৩ঃ এতে আরো বোঝা গেল যে, নফল সাদকার বেলায় নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা থাকে, তা-ই ব্যয় করতে হবে। নিজের সন্তানদিগকে কষ্টে ফেলে, তাদেরকে অধিকার হতে বঞ্চিত করে সাদকা করার কোন বিধান নেই। এতে সওয়াব পাওয়া যাবে না। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত, ঋণ পরিশোধ না করে তার পক্ষে নফল সদকা করাও আল্লাহর পছন্দ নয় । অবশ্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাল সাদকা করার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাকে হযরত আবূ যর গিফারী (রা) ও অন্যান্য কতিপয় সাহাবী ওয়াজিব বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের মতে স্বীয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত মালের যাকাত ইত্যাদি প্রদান করার পর যা থাকবে, তা নিজের হাতে জমা করে রাখা জায়েয নয়, সব দান করে দেওয়া ওয়াজিব। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ী ইমামগণের মতে কোরআনের আলোচ্য এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহর রাস্তায় যা ব্যয় করতে হয়, তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হতে হবে। পক্ষান্তরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা কিছুই থাকবে, তার সবই দান করে ফেলা ওয়াজিব নয়। সাহাবীগণের আমল দ্বারাও তা-ই প্রমাণিত হয়।
******************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url