মা’আরেফুল কোরআন - ৮১ || সূরা আল-বাকারাহ, ২১৬-২১৮ || জিহাদ, সম্মানিত মাস, নিয়ত ও মুরতাদ সম্পর্কে আলোচনা







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ২১৬-২১৮


 کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الۡقِتَالُ وَ هُوَ کُرۡهٌ لَّکُمۡ ۚ وَ عَسٰۤی اَنۡ تَکۡرَهُوۡا شَیۡئًا وَّ هُوَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ ۚ وَ عَسٰۤی اَنۡ تُحِبُّوۡا شَیۡئًا وَّ هُوَ شَرٌّ لَّکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ وَ اَنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۱۶   یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الشَّهۡرِ الۡحَرَامِ قِتَالٍ فِیۡهِ ؕ قُلۡ قِتَالٌ فِیۡهِ کَبِیۡرٌ ؕ وَ صَدٌّ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ کُفۡرٌۢ بِهٖ وَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ٭ وَ اِخۡرَاجُ اَهۡلِهٖ مِنۡهُ اَکۡبَرُ عِنۡدَ اللّٰهِ ۚ وَ الۡفِتۡنَۃُ اَکۡبَرُ مِنَ الۡقَتۡلِ ؕ وَ لَا یَزَالُوۡنَ یُقَاتِلُوۡنَکُمۡ حَتّٰی یَرُدُّوۡکُمۡ عَنۡ دِیۡنِکُمۡ اِنِ اسۡتَطَاعُوۡا ؕ وَ مَنۡ یَّرۡتَدِدۡ مِنۡکُمۡ عَنۡ دِیۡنِهٖ فَیَمُتۡ وَ هُوَ کَافِرٌ فَاُولٰٓئِکَ حَبِطَتۡ اَعۡمَالُهُمۡ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ۚ وَ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۲۱۷   اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ الَّذِیۡنَ هَاجَرُوۡا وَ جٰهَدُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ۙ اُولٰٓئِکَ یَرۡجُوۡنَ رَحۡمَتَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۲۱۸

সূরা আল-বাকারাহ ২১৬-২১৮ নং আয়াতের অর্থ

(২১৬) তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। আর হয়তো বা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর + বস্তুত আল্লাহ্ জানেন, তোমরা জান না ! 
(২১৭) সম্মানিত মাস সম্পর্কে আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে যে, তাতে যুদ্ধ করা কেমন ? আপনি বলে দিন, এতে যুদ্ধ করা ভীষণ বড় গোনাহ্ ! আর আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা এবং কুফরী করা মসজিদে হারামের পথে বাধা দেওয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বহিষ্কার করা আল্লাহ্র নিকট তার চেয়েও বড় গোনাহ্। আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহাপাপ । বস্তুত তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদেরকে দীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যদি তা সম্ভব হয়। তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দীন থেকে ফিরে দাঁড়াবে এবং কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো দোযখবাসী । তাতে তারা চিরকাল বাস করবে। 
(২১৮) আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে আর আল্লাহর পথে লড়াই (জিহাদ) করেছে, তারা আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী। আর আল্লাহ্ হচ্ছেন ক্ষমাকারী, করুণাময় ।

   

সূরা আল-বাকারাহ ২১৬-২১৮ নং আয়াতের তাফসীর

তাফসীরের সার-সংক্ষেপ
ত্রয়োদশ নির্দেশঃ 

জিহাদ ফরয হওয়া সংক্রান্ত

জিহাদ করা তোমাদের উপর ফরয করা হলো এবং তা তোমাদের জন্য (স্বভাবত) ভারী (মনে) হবে। (পক্ষান্তরে) তোমাদের কাছে যা ভারী মনে হয়, তাই তোমাদের জন্য প্রকৃতপক্ষে মঙ্গলজনক হতে পারে। আর এমনও (তো) সম্ভব যে, তোমরা কোন বিষয়কে ভাল মনে কর (অথচ প্রকৃতপক্ষে) তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর এবং (প্রত্যেক বস্তুর প্রকৃত অবস্থা) আল্লাহ্ তা’আলাই জানেন। কিন্তু তোমরা (পুরোপুরি) জান না। (সুতরাং ভালমন্দের মীমাংসা তোমরা স্বীয় পছন্দমত করো না। যা আল্লাহর আদেশ তাতেই মঙ্গল মনে করে কাজ করতে থাক)।

চতুর্দশ নির্দেশঃ 

সম্মানিত মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পর্কে

রাসূল (সা)-এর কয়েকজন সাহাবা কোন এক সফরে ঘটনাচক্রে কাফিরদের সাথে একটি খণ্ড যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সে যুদ্ধে একজন কাফির নিহত হয়। দিনটি ছিল রজব চাঁদের পহেলা তারিখ। কিন্তু সাহাবীগণ মনে করেছিলেন যে, সেদিন জমাদিউস্ সানীর ত্রিশ তারিখ। যেহেতু ঘটনাটি নিষিদ্ধ মাসে সংঘটিত হয়েছিল, তাই কাফিররা মুসলমানদেরকে দোষারোপ করতে লাগল যে, মুসলমানরা নিষিদ্ধ মাসের সম্মান পর্যন্ত করে না। তাতে মুসলমানগণ চিন্তিত হয়ে রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেন। কোন কোন বর্ণনামতে আছে যে, কাফিররা উপস্থিত হয়ে এর প্রতিবাদ জানালে তারই উত্তরে ইরশাদ হয়েছেঃ মানুষ আপনার নিকট নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে থাকে। আপনি উত্তরে বলে দিন যে, এ মাসে (বিশেষভাবে ইচ্ছাপূর্বকভাবে) লড়াই করা বড়ই অন্যায়। কিন্তু মুসলমানগণ এ কাজ ইচ্ছাপূর্বক করেনি, তারিখ সম্পর্কে খোঁজ-খবর না রাখার দরুনই তা হয়েছে। এটি হচ্ছে যুক্তিগ্রাহ্য জবাব। অভিযোগাত্মক উত্তর হচ্ছে এই যে, কাফির ও মুশরিকদের পক্ষে মুসলমানগণের উপর প্রশ্ন করার কোন সুযোগই ছিল না, যদিও নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা মারাত্মক অপরাধ কিন্তু কাফিরদের সে কার্যপদ্ধতি) আল্লাহর পথ (ধর্ম) হতে (মানুষকে) বিরত রাখা (ইসলাম গ্রহণের অভিযোগে তাদেরকে কষ্ট দেওয়া, যাতে ভয়ে কেউ ইসলাম গ্রহণ না করে ;) আল্লাহর সাথে নাফরমানী করা এবং মসজিদুল হারাম যিয়ারত থেকে বঞ্চিত রাখা, (এর সাথে বেআদবী করা, সেখানে তখন মূর্তিপূজা ও সে সবের তওয়াফ করা হতো।) আর যারা মসজিদুল হারামের যোগ্য পাত্র ছিল (অর্থাৎ রাসূল এবং অন্যান্য মু’মিন) তাদেরকে (উত্ত্যক্ত করে) সেই মসজিদুল হারামের প্রতিবেশ থেকে বের হতে বাধ্য করা (যার ফলে হিজরত বা দেশত্যাগের প্রয়োজন দেখা দিল ; এসব কাজ নিষিদ্ধ মাসে নরহত্যার চাইতেও জঘন্য,) আল্লাহর নিকট মহা অন্যায়। (কেননা, এসব কাজ সত্য ধর্মে ফেতনা ও ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্যই করা হয়। এবং এরূপ) বিভেদ সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও (যা মুসলমানদের দ্বারা হয়ে গেছে) অনেক বেশি (এবং মন্দ-কর্মের দিক দিয়ে) বড় দোষ ও পাপ । (কেননা, এ হত্যা দ্বারা সত্য ধর্মের কোন ক্ষতি হয়নি। বেশির চাইতে বেশি জেনে-শুনে এমন কাজ করলে সে নিজে পাপী হবে। কিন্তু কাফিরদের কার্যকলাপে সত্য ধর্মের অগ্রগতি বিঘ্নিত হয়ে যায়। কাফিররা সর্বদা তোমাদের সাথে লড়াই করতে থাকবে। এই উদ্দেশ্যে যে, যদি (আল্লাহ্ না করুন) তোমাদের উপর কৃতকার্যতা অর্জন করতে পারে, তবে (তোমাদেরকে) এই ধর্ম (ইসলাম) থেকে ফিরে যেতে বাধ্য করবে (তাদের এ কার্যকলাপে ধর্মের প্রতি হস্তক্ষেপই প্রকাশ পায়)।


মুরতাদ হওয়ার পরিণাম

আর তোমাদের মধ্যে যে নিজের ধর্ম (ইসলাম) থেকে ফিরে যাবে এবং পরে কাফির অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করবে, এসব মানুষের (নেক) আমল ইহকাল ও পরকাল সম্পূর্ণ বরবাদ হয়ে যাবে। (এবং) তারা চিরদিন জাহান্নামেই অবস্থান করবে।

(নিষিদ্ধ মাসে হত্যার দরুন মুসলমানগণের গোনাহ না হওয়ার কথা শুনে স্বস্তিবোধ করলেও তাঁরা এই ভেবে ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়েছিলেন যে, সওয়াব তো হলো না। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে সান্ত্বনা দেওয়া হলো)।

নিয়তের অকৃত্রিমতার জন্যে সওয়াব দানের প্রতিশ্রুতি

প্রকৃতপক্ষে যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় দেশ ত্যাগ করেছে এবং জিহাদ করেছে, তারা তো আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ পাওয়ার আশা রাখে। (তোমাদের মধ্যেও তো এ আশা রয়েছে। ঈমান এবং হিজরতের সওয়াব তো সুনির্দিষ্ট, তবে এই বিশেষ জিহাদের বেলায় সন্দেহ হতে পারে। সুতরাং তোমাদের নিয়ত যেহেতু জিহাদেরই ছিল, তাই আমার নিকট তাও জিহাদের মধ্যেই শামিল। তাহলে এই বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও তোমাদের নৈরাশ্য কেন ?) আর আল্লাহ্ তা’আলা (এ ভুল ) ক্ষমা করবেন এবং (ঈমান, জিহাদ ও হিজরতের দরুন তোমাদের উপর) রহমত করবেন।

সূরা আল-বাকারাহ ২১৬-২১৮ নং আয়াতের বিষয় বস্তু

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়
মাস’আলাঃ উল্লিখিত আয়াতের প্রথমটিতে জিহাদ ফরয হওয়ার আদেশ নিম্নলিখিত শব্দগুলো দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছেঃ

كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُতোমাদের উপর জিহাদ ফরয করা হলো।" এ শব্দগুলোর দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক মুসলমানের উপর সব সময়ই জিহাদ করা ফরয। তবে কোরআনের কোন কোন আয়াত ও রাসূল (সা)-এর হাদীসের বর্ণনাতে বোঝা যায় যে, জিহাদের এ ফরয, ফরযে আইন-রূপে প্রত্যেক মুসলমানের উপর সাব্যস্ত হয় না; বরং এটা ফরযে কিফায়াহ্। যদি মুসলমানদের কোন দল তা আদায় করে, তবে সমস্ত মুসলমানই এ দায়িত্ব থেকে রেহাই পায়। তবে যদি কোন দেশে বা কোন যুগে কোন দলই জিহাদের ফরয আদায় না করে, তবে ঐ দেশের বা ঐ যুগের সমস্ত মুসলমানই ফরয থেকে বিমুখতার দায়ে গোনাহগার হবে। রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেনঃ الجهاد ماض إلى يوم القيامة এর মর্ম হচ্ছে এই যে, কিয়ামত পর্যন্ত এমন একটি দল থাকা আবশ্যক, যারা জিহাদের দায়িত্ব পালন করবে। কোরআনের অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ

فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى

অর্থাৎ- ‘আল্লাহ্ তা’আলা জানমাল দ্বারা জিহাদকারিগণকে জিহাদ বর্জনকারীদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন এবং উভয়কে পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন।

এতে যেসব ব্যক্তি কোন অসুবিধার জন্য বা অন্য কোন ধর্মীয় খেদমতে নিয়োজিত থাকার কারণে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, তাদেরকেও আল্লাহ্ তা’আলা সুফল দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, জিহাদ যদি ফরযে আইন হতো তবে তা বর্জনকারীদেরকে সুফল দানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হতো না।’

এমনিভাবে অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ

فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ

অর্থাৎ- “কেন তোমাদের প্রত্যেক সম্প্রদায় হতে একটি ছোট দল ধর্মীয় ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করার দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য বেরিয়ে গেলো না।" এ আয়াতে কোরআন নিজেই ধর্মীয় কাজের দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়ে বলছে যে, কিছুসংখ্যক মুসলমান জিহাদের ফরয আদায় করবে, আর কিছুসংখ্যক মুসলমান মানুষকে ধর্মীয় তা’লীম দানে নিয়োজিত থাকবে। আর এটা তখনই সম্ভব যখন জিহাদ ফরযে আইন না হয়ে ফরযে-কিফায়াহ্ হবে।

তাছাড়া বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে রয়েছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (সা)-এর নিকট জিহাদে অংশগ্রহণ করার অনুমতি চাইলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমার পিতা-মাতা কি বেঁচে আছেন ? উত্তরে সে বললো, জী, বেঁচে আছেন। তখন রাসূল (সা) তাকে উপদেশ দিলেন তুমি পিতা-মাতার খেদমত করেই জিহাদের সওয়াব হাসিল কর। এতেও বোঝা যায় যে, জিহাদ ফরযে-কিফায়াহ। যখন মুসলমানদের একটি দল জিহাদের ফরয আদায় করে, তখন অন্যান্য মুসলমান অন্য খেদমতে নিয়োজিত হতে পারে। তবে যদি মুসলমানদের নেতা প্রয়োজনে সবাইকে জিহাদে অংশগ্রহণ করার জন্য আহবান করেন, তখন জিহাদ ফরযে-আইন হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে কোরআন হাকীমের সূরা তওবায় ইরশাদ হয়েছেঃ

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ

অর্থাৎ- “হে মুসলমানগণ ! তোমাদের কি হয়েছে যে, যখন তোমাদেরকে বলা হয় যে, তোমরা আল্লাহর পথে বেরিয়ে যাও, তখনই তোমরা মনমরা হয়ে পড়।

এ আয়াতে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার সার্বজনীন আদেশ দেওয়া হয়েছে। এমনিভাবে আল্লাহ্ না করুন, যদি কোন হসলামী দেশ অমুসলমান দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং সেদেশের লোকের পক্ষে এ আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব না হয়, তবে পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশবাসীর উপরেও সে ফরয আপতিত হয়। তারাও যদি প্রতিহত করতে না পারে, তবে এর নিকটবর্তী মুসলিম দেশের উপর, এমনি সারা বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের উপর এ ফরয পরিব্যাপ্ত হয় এবং ফরযে আইন হয়ে যায়। কোরআনের আলোচ্য আয়াতসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ ফকীহ্ ও মুহাদ্দিস এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, জিহাদ স্বাভাবিক অবস্থায় সাধারণভাবে ফরযে-কিফায়াহ্।

মাস’আলাঃ যতক্ষণ পর্যন্ত জিহাদ ফরযে-কিফায়াহ্ পর্যায়ে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তানদের পক্ষে পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত জিহাদে অংশগ্রহণ করা জায়েয নয়।

মাস’আলাঃ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে ঋণ পরিশোধ করার পূর্ব পর্যন্ত এ ফরযে-কিফায়াহতে অংশগ্রহণ করা জায়েয নয়। আর যখন এ জিহাদ প্রয়োজনের তাকীদে ফরযে আইনে পরিণত হয়, তখন পিতা-মাতা, স্বামী বা স্ত্রী অথবা ঋণদাতা কারোরই অনুমতির অপেক্ষা রাখে না।

আলোচ্য আয়াতের শেষে জিহাদের প্রতি উৎসাহ দানের জন্য ইরশাদ হয়েছে যে, “যদিও জিহাদ স্বাভাবিকভাবে বোঝা মনে হয় কিন্তু স্মরণ রেখো, মানুষের বিচক্ষণতা, বুদ্ধি-বিবেচনা ও চেষ্টা পরিণামে অনেক সময় অকৃতকার্য হয়। ভালকে মন্দ এবং মন্দকে ভাল মনে করা বিজ্ঞ ও বড় বুদ্ধিমানের পক্ষেও আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রতিটি মানুষই তার জীবনের যাবতীয় ঘটনার প্রতি লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে যে, তার জীবনেই অনেক ঘটনা রয়েছে, যাতে সে কোন কাজকে অত্যন্ত লাভজনক ও উপকারী মনে করেছিল, কিন্তু পরিণামে তা অত্যন্ত অনিষ্টকর হয়েছে। অথবা কোন বস্তুকে অত্যন্ত ক্ষতিকর মনে করেছিল এবং তা থেকে দূরে সরেছিল, কিন্তু পরিণামে দেখা গেল, তা অত্যন্ত লাভজনক ও উপকারী ছিল। মানুষের বুদ্ধি ও চেষ্টার অশুভ পরিণাম অনেক ব্যাপারেই ধরা পড়ে। তাই বলা হয়েছেঃ

خویش را دیدم در رسوایی خویش .

অনেক সময় নিজেকে আত্ম-অবমাননায় নিয়োজিত দেখেছি।" কাজেই বলা হয়েছে জিহাদ ও ধর্মযুদ্ধে যদিও আপাতদৃষ্টিতে জান ও মালের ক্ষতির আশংকা মনে হয়, কিন্তু যখন পরিণাম সামনে আসবে, তখন বোঝা যাবে যে, এ ক্ষতি বাস্তবে মোটেও ক্ষতি ছিল না; বরং সোজাসুজি লাভ, উপকার এবং চিরস্থায়ী শান্তির ব্যবস্থা ছিল।

নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ সংক্রান্ত নির্দেশাবলী

আলোচ্য আয়াতের দ্বারা দ্বিতীয় যে বিষয়টি প্রমাণিত হচ্ছে, তা হলো নিষিদ্ধ মাস অর্থাৎ রজব, যিলকদ, যিলহজ্জ এবং মুহাররম মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা হারাম। এমনিভাবে কোরআনের অনেকগুলো আয়াতেই এ চার মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষেধ করা হয়েছে। যথা- مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ এবং বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে হুযূর (সা) ঘোষণা করেছেনঃ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَ ثلاث متواليات ورجب এসব আয়াত ও বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, উল্লিখিত চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহের এ নিষেধাজ্ঞা সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য।

ইমামে-তফসীর আতা ইবনে আবী রাবাহ কসম খেয়ে বলেছেন যে, এ আদেশ সর্বযুগের জন্য। তাবেয়ীগণের অনেকেও এ আদেশকে স্থায়ী আদেশ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহ্ এবং ইমাম জাসাসের মতে এ আদেশ রহিত হয়ে গেছে। ফলে এখন কোন মাসেই প্রয়োজনীয় যুদ্ধ নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোন্ আয়াত দ্বারা এ আদেশ রহিত করা হয়েছে ? এ সম্পর্কে ফকীহগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেনঃ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً আয়াতটি উল্লিখিত আয়াতের নির্দেশ রহিতকারী । আবার অধিকাংশের মতে রহিতর্কারী সেই আয়াত হচ্ছেঃ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ.

 حَيْثُ শব্দটি এ স্থলে কালবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ মুশরিকদের যে মাসে এবং যে কালেই পাও, হত্যা কর। কারো কারো মতে, এ আদেশ রাসূল (সা)-এর কর্ম দ্বারা রহিত হয়েছে। তিনি নিষিদ্ধ মাসেই তায়েফ অবরোধ করেছিলেন এবং নিষিদ্ধ মাসেই হযরত ’আমের আশ’আরী (রা)-কে আউতাসের যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ ফকীহগণ এ আদেশকে রহিত বলে উল্লেখ করেছেন। জাসসাস বলেছেনঃ وهو قول فقهاء الامصار অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের ফকীগণেরই সম্মিলিত অভিমত।

কিন্তু রূহুল-মা’আনী এ আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে এবং বায়যাবী সূরায়ে বরা’আতের প্রথম রুকুর তফসীর প্রসঙ্গে এ আদেশ রহিত হওয়ার ব্যাপারে এজমায়ে উম্মতের কথা উল্লেখ করেছেন।-(বয়ানুল-কোরআন)

কিন্তু তফসীরে মাযহারী এসব দলীলের জবাবে বলেছেন যে, নিষিদ্ধ মাসের বিস্তারিত আলোচনা এ আয়াতে রয়েছে। একে বলা হয় ’আয়াতুস-সাইফ’ অর্থাৎ—

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ 

পরন্তু এ আয়াতটি জিহাদ বা যুদ্ধ-সংক্রান্ত আয়াতগুলোর মধ্যে সর্বশেষে অবতীর্ণ হয়েছে। হুযূর (সা)-এর ওফাতের মাত্র আশি দিন পূর্বে প্রদত্ত বিদায় হজ্জের ভাষণেও নিষিদ্ধ মাসের বিস্তারিত আলোচনা ও ব্যাখ্যা বিদ্যমান। কাজেই এর দ্বারা আলোচ্য আয়াতকে রহিত বলা চলে না। তাছাড়া রাসূল (সা)-এর তায়েফ অবরোধ যিলকদ মাসে নয়, বরং শাওয়াল মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাই এ অভিযানের দ্বারাও উল্লিখিত আয়াতকে মনসূখ বলা যায় না। অবশ্য একথা বলা যায় যে, নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহের নিষেধাজ্ঞা থেকে এ ব্যাপারটি স্বতন্ত্র যে, যদি কাফিররা এসব মাসেই আক্রমণ করে, তবে প্রতিরক্ষামূলক আক্রমণ মুসলমানদের জন্যও বৈধ হবে। কাজেই আয়াতের শুধুমাত্র এ অংশটুকুকেই রহিত বলা যেতে পারে, যার ব্যাখ্যা রয়েছে- الشَّهْرُ الْحَرَامُ بِالشَّهْرِ الْحَرَامِ আয়াতটিতে।

মোটকথা, এসব মাসে নিজে থেকে যুদ্ধ আরম্ভ করা সর্বকালের জন্যই নিষিদ্ধ। তবে কাফিররা যদি এসব মাসে আক্রমণ করে, প্রতিরক্ষামূলক প্রতি-আক্রমণ করা মুসলমানদের জন্যও জায়েয। যেমন, ইমাম জাসসাস হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, রাসূল (সা) নিষিদ্ধ মাসে যতক্ষণ পর্যন্ত কাফিরদের দ্বারা আক্রান্ত না হতেন, ততক্ষণ আক্রমণ করতেন না।

মুরতাদের পরিণাম

উল্লিখিত আয়াত- يَسْأَلُونَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ এর শেষে মুসলমান হওয়ার পর তা ত্যাগ করা বা মুরতাদ হয়ে যাওয়ার হুকুম বলা হয়েছে।

حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ

অর্থাৎ- ‘তাদের আমল দুনিয়া ও আখিরাতে বা ইহ ও পরকালে বরবাদ হয়ে গেছে।’ এ বরবাদ হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে যে, পার্থিব জীবনে তাদের স্ত্রী তাদের বিবাহ বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদি তার কোন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু হয় তাহলে সে ব্যক্তির উত্তরাধিকার বা মিরাসের অংশ থেকে বঞ্চিত হয়, ইসলামে থাকাকালীন নামায-রোযা যত কিছু করেছে সব বাতিল হয়ে যায়, মৃত্যুর পর তার জানাযা পড়া হয় না এবং মুসলমানদের কবরস্থানে তাকে দাফনও করা হবে না।

আর পরকাল বরবাদ হওয়ার অর্থ হচ্ছে ইবাদতের সওয়াব না পাওয়া এবং চিরকালের জন্য জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া।

মুরতাদের পূনরায় মুসলমান হওয়া সম্পর্কে মাস’আলা

যদি এ ব্যক্তি পুনরায় মুসলমান হয়, তবে পরকালে দোযখ থেকে রেহাই পাওয়া এবং দুনিয়াতে তার উপর পুনরায় শরীয়তের হুকুম জারি হওয়া নিশ্চিত। তবে যদি সে প্রথম মুসলমান থাকা অবস্থায় হজ্জ করে থাকে, তবে সামর্থ্যবান হয়ে থাকলে দ্বিতীয়বার তা ফরয হওয়া না হওয়া, পূর্বের নামায-রোযার পরকালে প্রত্যাবর্তন হওয়া না হওয়া প্রভৃতি বিষয়ে ইমামগণ মতানৈক্য পোষণ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা (র) দ্বিতীয়বার হজ্জকে ফরয বলেন এবং পূর্বের নামায-রোযার সওয়াব পাবে না বলে মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী (র) দু’টি বিষয়েই মতানৈক্য প্রকাশ করেছেন।

মাস’আলাঃ যদি কোন ব্যক্তি প্রথম থেকেই কাফির হয়ে থাকে এবং সে অবস্থায় কোন কাজ করে থাকে, কোনদিন ইসলাম গ্রহণ করলে তার পূর্বকৃত যাবতীয় সৎকর্মের সওয়াবই সে পাবে। আর যদি সে কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তবে সবই বরবাদ হয়ে যাবে। 

 أسلمت على ما أسلفت من خير - হাদীসটি এ অর্থেই এসেছে।

মাস’আলাঃ মোটকথা, মুরতাদের অবস্থা কাফিরদের অবস্থা হতেও নিকৃষ্টতর। এজন্য কাফিরদের থেকে জিযিয়া কর গ্রহণ করা যায়, কিন্তু পুনরায় ইসলাম গ্রহণ না করলে মুরতাদকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। আর যদি মুরতাদ স্ত্রীলোক হয়, তবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কেননা, মুরতাদের কার্যকলাপের দরুন সরাসরিভাবে ইসলামের অবমাননা করা হবে। কাজেই তারা সরকার অবমাননার শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।





********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url