মা’আরেফুল কোরআন - ৬৪ || সূরা আল-বাকারাহ, ১৭৭ || সত্যিকারের মুমীনদের পরিচয়







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৭৭


 لَیۡسَ الۡبِرَّ اَنۡ تُوَلُّوۡا وُجُوۡهَکُمۡ قِبَلَ الۡمَشۡرِقِ وَ الۡمَغۡرِبِ وَ لٰکِنَّ الۡبِرَّ مَنۡ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ وَ الۡکِتٰبِ وَ النَّبِیّٖنَ ۚ وَ اٰتَی الۡمَالَ عَلٰی حُبِّهٖ ذَوِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنَ وَ ابۡنَ السَّبِیۡلِ ۙ وَ السَّآئِلِیۡنَ وَ فِی الرِّقَابِ ۚ وَ اَقَامَ الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَی الزَّکٰوۃَ ۚ وَ الۡمُوۡفُوۡنَ بِعَهۡدِهِمۡ اِذَا عٰهَدُوۡا ۚ وَ الصّٰبِرِیۡنَ فِی الۡبَاۡسَآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ حِیۡنَ الۡبَاۡسِ ؕ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ صَدَقُوۡا ؕ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُتَّقُوۡنَ ﴿۱۷۷

সূরা আল-বাকারাহ ১৭৭ নং আয়াতের অর্থ


(১৭৭) সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রাসূলদের উপর, আর ব্যয় করবে সম্পদ তাঁরই মুহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম-মিস্কীন মুসাফির এবং ভিক্ষুকদের জন্য এবং মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং বিপদাপদে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী, তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার ।

সূরা আল-বাকারাহ ১৭৭ নং আয়াতের পূর্বাপর যোগসূত্র

   

বয়ানুল কোরআন থেকে উদ্ধৃত যোগসূত্রঃ শুরু থেকে এ পর্যন্ত সূরা বাকারার প্রায় অর্ধেক। এ পর্যন্ত আলোচনার বেশীর ভাগেরই লক্ষ্য ছিল ’মুনকের’ সম্প্রদায়। কারণ, সর্বাগ্রে কোরআন করীমের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে তার মান্যকারী ও অমান্যকারী সম্প্রদায়ের আলোচনা করা হয়েছে। অতঃপর ’তওহীদ’ বা আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদ প্রমাণ করা হয়েছে। তারপর وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ আয়াত পর্যন্ত হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সন্তানদের প্রতি যে অনুগ্রহ ও নিয়ামতসমূহ দেওয়া হয়েছে তা বিবৃত করা হয়েছে। সেখান থেকেই আরম্ভ হয়েছে কেবলা সংক্রান্ত আলোচনা। আর তার সমাপ্তি টানা হয়েছে ’সাফা’ ও ‘মারওয়ার’ আলোচনার মাধ্যমে। অতঃপর তওহীদ প্রমাণ করার পর শিরকের মূল ও শাখা-প্রশাখাগুলোর খণ্ডন করা হয়। বলা বাহুল্য, এ সমস্ত বিষয় মুনকেরীনদের প্রতিই তাম্বীহ ছিল অধিক। আর প্রসঙ্গক্রমে কোন কোন ব্যাপারে মুসলমানদেরও সম্বোধন করা হয়েছে। এখন সূরা বাক্বারার প্রায় মধ্যবর্তী আয়াতসমূহে মুসলমানগণকে মৌলিক সৎকর্মসমূহ ও আনুষঙ্গিক নীতিমালার শিক্ষা দানই মুখ্য উদ্দেশ্য। অবশ্য প্রসঙ্গক্রমে অমুসলিমদের প্রতিও সম্বোধন থাকতে পারে। আর এ বিষয়টি সূরার শেষ পর্যন্তই ব্যাপ্ত। বিষয়টি আরম্ভ করা হয়েছে بر (বিররুন) সংক্ষিপ্ত শিরোনামে। তা’ হলো ’বা’ বর্ণের মধ্যে ’যের’ স্বরচিহ্নক্রমে بر (বিররুন) শব্দের সাধারণ অর্থ হয় মঙ্গল, যা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যাবতীয় ইবাদত ও সৎকাজেই ব্যাপক। বস্তুত এভাবে প্রাথমিক আয়াতগুলোতে একটি শব্দের মাধ্যমে সামগ্রিক ও নীতিগত বিষয়ের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যেমন, কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, ধন-সম্পদ দান করা, ওয়াদা পালন, বিপদে ধৈর্যধারণ প্রভৃতি। এতে সমগ্র কোরআনী বিধি-বিধানের মৌলিক নীতিগুলো এসে গেছে। কারণ, শরীয়তের সমগ্র আহ্কাম বা বিধি-বিধানের সারনির্যাস হলো তিনটিঃ (১) আকায়েদ বা বিশ্বাস, (২) ’আমাল বা আচার-আচরণ ও কাজকর্ম, (৩) চরিত্র। আর বাকি যা কিছু, সবই হলো এগুলোর শাখা-প্রশাখা এবং এই তিনটির অন্তর্ভুক্ত। আলোচ্য আয়াতে উল্লিখিত তিনটি বিষয়ের বিশেষ বিশেষ দিকগুলোও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। পরবর্তীতে بر-এর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে প্রসঙ্গক্রমে স্থান-কাল-পাত্রের চাহিদানুযায়ী শরীয়তের বহু বিধি-বিধান যথা— কিসাস, ওসীয়ত, রোযা, নামায, জিহাদ, হজ্জ, ক্ষুধার্তকে অনুদান, ঋতুস্রাব, ঈলা, কসম খাওয়া, তালাক, বিয়ে-শাদী, ইদ্দত, মোহরানা, জিহাদের পুনরালোচনা, আল্লাহর কাজে ব্যয় করা, ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত কোন কোন বিষয় এবং সাক্ষ্যদান প্রভৃতি বিষয় প্রয়োজনানুযায়ী আলোচনা করে ওয়াদা, সুসংবাদ, রহমত ও ক্ষমা সংক্রান্ত আলোচনায় সমাপ্তি টানা হয়েছে। সুবহানাল্লাহ্! কি চমৎকার সুবিন্যস্ত ধারাবাহিকতা ! যা হোক, যেহেতু এ সমস্ত বিষয়ের মুখ্যই হলো بر বা কল্যাণ কাজেই সামগ্রিকভাবে এ আলোচ্য বিষয়টিকে ابواب البر বা কল্যাণ-পরিচ্ছেদ নামে অভিহিত করা যেতে পারেকল্যাণ পরিচ্ছেদঃ পূর্ব অথবা পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়ানোতেই সকল পুণ্য সীমিত নয়। আসল পুণ্য হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি (সত্তা ও সকল গুণাবলীসহ) ঈমান (দৃঢ় আস্থা) পোষণ করা এবং (একইভাবে) কিয়ামতের (আগমন) সম্পর্কে এবং ফেরেশতাগণের প্রতি (যে, তাঁরা আল্লাহর অনুগত বান্দা, নূরের সৃষ্টি, নিষ্পাপ মাসুম, খাদ্য-পানীয় এবং মানবীয় কাম প্রভৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত) এবং (সমগ্র আসমানী) কিতাবের প্রতি এবং (সমগ্র) পয়গম্বরগণের প্রতিও। এবং (পুণ্যবান সেই ব্যক্তি যে মাল-সম্পদ দেয় আল্লাহর মহব্বতে (অভাবী) আত্মীয়-স্বজন এবং (অসহায়) ইয়াতীমদেরকে (অর্থাৎ যেসব শিশুকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক রেখে পিতার মৃত্যু হয়েছে) এবং (অন্যান্য দরিদ্র) মুখাপেক্ষীগণকেও এবং (পাথেয়হীন) মুসাফিরকে আর (অনন্যোপায়) সাহায্যপ্রার্থীদেরকে এবং (কয়েদী ও ক্রিতদাসদের) মুক্ত করার জন্য। এবং (সে ব্যক্তি) নিয়মিত নামায পড়ে এবং (নির্ধারিত পরিমাণ) যাকাতও প্রদান করে। এবং যেসব লোক (উপরোক্ত আমল ও আখলাকের সাথে সাথে) স্ব স্ব অঙ্গীকারও পূরণ করে থাকে, যখন কোন (বৈধ ব্যাপারে) অঙ্গীকার করে। আর (এসব গুণের পর বিশেষভাবে) যেসব লোক ধীরচিত্ত হয় অভাবে পতিত হলে, (দ্বিতীয়ত) রোগাক্রান্ত হলে (তৃতীয়ত) (কাফিরদের মোকাবেলায়) তুমুল যুদ্ধেও (অর্থাৎ এমতাবস্থাতেও যারা অস্থিরচিত্ত কিংবা হিম্মতহারা হয় না) সেসব লোকই (পরিপূর্ণতার গুণে গুণান্বিত) সত্যপন্থী এবং এসব লোকই (প্রকৃত) মোত্তাকী (নামে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্য। মোটকথা দীনের প্রকৃত লক্ষ্য এবং পরিপূর্ণতা হচ্ছে উপরোক্ত আমলসমূহ। নামাযের মধ্যে বিশেষ একদিকে মুখ করে দাঁড়ানোও সে সমস্ত মহত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে বিশেষ একটি। কেননা, কেবলামুখী হয়ে দাঁড়ানো নামায কায়েম করার শর্তাবলীর অন্তর্গত। সুতরাং সুষ্ঠুভাবে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়ানোর দ্বারা নামাযে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়। অন্যথায়, যদি নামাযই না হতো তবে কোন বিশেষ দিকের প্রতি রুখ করে দাঁড়ানো ইবাদত বলেই গণ্য হতো না)।


মুসলমানদের কিবলা যখন বায়তুল মুকাদ্দাসের দিক থেকে পরিবর্তিত করে বায়তুল্লাহর দিকে নির্ধারণ করা হলো, তখন ইহুদী, খৃস্টান, পৌত্তলিক প্রভৃতি যারা সর্বদা মুসলমানদের মধ্যে ত্রুটি তালাশ করার ফিকিরে থাকতো, তারা তৎপর হয়ে উঠলো এবং নানাভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও ইসলামের প্রতি অবিরামভাবে নানা প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করতে শুরু করল। এসব প্রশ্নের জবাব পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয়েছে।

আলোচ্য একটি আয়াতে একটা বিশেষ বর্ণনাভঙ্গীর মাধ্যমে এ বিতর্কের মধ্যে যতি টেনে দেওয়া হয়েছে, যার সারমর্ম হচ্ছে, নামাযে পূর্ব দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে কি পশ্চিম দিকে—এ বিষয়টা নির্ধারণ করাই যেন তোমরা দীনের একমাত্র লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছ এবং এ ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করেই তোমাদের সকল আলোচনা-সমালোচনা আবর্তিত হতে শুরু করেছে। মনে হয়, তোমাদের ধারণায় শরীয়তের অন্য কোন হুকুম-আহকামই যেন আর নেই।

অন্য অর্থে এ আয়াতের লক্ষ্য মুসলমান, ইহুদী, নাসারা নির্বিশেষে সবাই হতে পারে। এমতাবস্থায় আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, প্রকৃত পুণ্য বা নেকী আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্যের মধ্যে নিহিত। যে দিকে রুখ করে তিনি নামাযে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন সেটাই শুদ্ধ ও পুণ্যের কাজে পরিণত হয়ে যায়। অন্যথায়, দিক হিসাবে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণের কোনই বৈশিষ্ট্য নেই। দিক বিশেষের সাথে কোন পুণ্যও সংশ্লিষ্ট নয়। পুণ্য একান্তভাবেই আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করার সাথে সম্পৃক্ত। তাই আল্লাহ্ তা’আলা যতদিন বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রতি রুখ করে নামায পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন, ততদিন সেদিকে রুখ করাতেই পুণ্য ছিল। আবার যখন মসজিদুল হারামের দিকে রুখ করে দাঁড়ানোর হুকুম হয়েছে, তখন এ হুকুমের আনুগত্য করাই পুণ্যে পরিণত হয়েছে।

আয়াতের যোগসূত্র বর্ণনা প্রসঙ্গে আগেই বলা হয়েছে যে, আলোচ্য আয়াতটি থেকে সূরা বাকারার একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে। এ অধ্যায়ে মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে তালীম ও হেদায়েত প্রদানই মুখ্য লক্ষ্য। প্রসঙ্গত বিরুদ্ধবাদীদের উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবও দেওয়া হয়েছে। সেমতে আলোচ্য এ আয়াতটিকে ইসলামের বিধি-বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক অর্থবহ আয়াত বলে অভিহিত করা যায়।

সূরা আল-বাকারাহ ১৭৭ নং আয়াতের তাফসীর

অতঃপর সূরার শেষ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে এ আয়াতেরই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আলোচ্য এ আয়াতে ই’তিকাদ বা বিশ্বাস, ইবাদত, মোয়ামালাত বা লেনদেন এবং আখলাক সম্পর্কিত বিধি-বিধানের মূল নীতিসমূহের আলোচনা মোটামুটিভাবে এসে গেছে। প্রথম বিষয়ঃ ইতিকাদ বা মৌল বিশ্বাস সম্পর্কিত আলোচনা مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ শীর্ষক আয়াতে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইবাদত এবং মোয়ামালাত সম্পর্কিত। তার মধ্যে ইবাদত সম্পর্কিত আলোচনা وَآتُوا الزَّكَاةَ পর্যন্ত উল্লিখিত হয়েছে। অতঃপর মোয়ামালাতের আলোচনা وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ শীর্ষক আয়াতে করা হয়েছে। এরপর আখলাক সম্পর্কিত আলোচনা وَالصَّابِرِينَ থেকে বর্ণিত হয়েছে।

“সর্বশেষে বলা হয়েছে যে, সত্যিকার মু’মিন ঐ সমস্ত লোক, যারা সে সমস্ত নির্দেশাবলীর পরিপূর্ণ অনুসরণ করে এবং এ সমস্ত লোককেই প্রকৃত মোত্তাকী বলা যেতে পারে।

এ সমস্ত নির্দেশ বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক উন্নত বর্ণনাভঙ্গী এবং সালঙ্কার ইশারা-ইঙ্গিত ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, সম্পদ ব্যয় সম্পর্কিত নির্দেশটির সঙ্গে عَلَى حُبِّهِ অর্থাৎ তাঁর মহব্বতে কথাটি শর্ত হিসেবে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এতে তিন ধরনের অর্থ হওয়া সম্ভব। প্রথমত, حُبِّهِ শব্দের শেষে সংযুক্ত ه সর্বনামটি যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে ধরা যায়, তবে অর্থ দাঁড়াবে, তার সেই সম্পদ ব্যয় করার পেছনে কোন আত্মস্বার্থ, নাম-যশ অর্জন প্রভৃতির উদ্দেশ্যের লেশমাত্রও থাকে না। বরং পরিপূর্ণ ইখলাসের সাথে শুধু আল্লাহ্ তা’আলার মহব্বতই হয় এ ব্যয়ের পেছনে মূল প্রেরণা।

দ্বিতীয়ত, সর্বনামটি যদি ধন-সম্পদের প্রতি সম্পর্কযুক্ত ধরা হয়, তবে অর্থ হবে আল্লাহর রাস্তায় ঐ সম্পদ ব্যয় করাই পুণ্যের কাজ, যে ধন-সম্পদ তার নিকট অত্যন্ত প্রিয়। ফেলে দেওয়ার মত বেকার বস্তু কাউকে দিয়ে সে দানকে সাদকা মনে করা প্রকৃত প্রস্তাবে ’সাদকা’ নয়, যদিও ফেলে দেওয়ার চাইতে অন্যের কাজে লাগতে পারে—এ ধারণায় কাউকে দিয়ে দেওয়াই উত্তম।

তৃতীয়ত, যদি সর্বনামকে آتَى শব্দের দিকে সম্পর্কযুক্ত ধরা হয়, তবে অর্থ হবে, সম্পদ ব্যয় করার সময় মানসিক সন্তুষ্টি ও আন্তরিকতার সাথে তা ব্যয় করে ; ব্যয় করার সময় অন্তরে কষ্ট অনুভূত হয় না।

ইমাম জাসসাস বলেন, আয়াতের উপরোক্ত তিনটি অর্থই নেওয়া যেতে পারে। অতঃপর আলোচ্য আয়াতে প্রথম ধন-সম্পদ ব্যয় করার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ খাত বর্ণনা করে পরে যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, এ দু’টি খাত যাকাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রথমেই এ দু’টি খাতের কথা বর্ণনা করার পরে যাকাতের কথা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য এমনও হতে পারে যে, সাধারণত মানুষ আলোচ্য দু’টি খাতে অর্থ ব্যয় করার ব্যাপারে কুণ্ঠাবোধ করে, কিন্তু তা উচিত নয় । শুধু যাকাত প্রদান করেই সম্পদের যাবতীয় হক পূরণ হয়ে গেল বলে ধারণা করে।

ধন-সম্পদের ফরয আদায়

মাস’আলাঃ এ আয়াতের বর্ণনাভঙ্গীর দ্বারাই এ তথ্যও সাব্যস্ত হয়ে যায় যে, ধন-সম্পদের ফরয শুধু যাকাত প্রদানের মাধ্যমেই পূর্ণ হয় না, যাকাত ছাড়া আরও বহু ক্ষেত্রে সম্পদ ব্যয় করা ফরয ও ওয়াজিব হয়ে থাকে। (জাসসাস, কুরতুবী)

যেমন, রুযী-রোযগারে অক্ষম আত্মীয়-স্বজনের ব্যয়ভার বহন করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কারো সামনে যদি কোন দরিদ্র ব্যক্তির জীবন বিপন্ন হয়, তবে যাকাত প্রদান করার পরেও সে দরিদ্রের জীবন রক্ষার্থে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা ফরয হয়ে পড়ে। 

অনুরূপ, যেসব স্থানে প্রয়োজন রয়েছে, সেখানে মসজিদ তৈরি করা এবং দীনি শিক্ষার জন্য মক্তব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করাও আর্থিক ফরযের অন্তর্গত। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, যাকাতের একটা বিশেষ বিধান রয়েছে, সে বিধান অনুযায়ী যে কোন অবস্থায় যাকাত প্রদান করতে হবে, কিন্তু অন্যান্য খরচের বেলায় প্রয়োজন দেখা দেওয়া শর্ত। যেখানে প্রয়োজন রয়েছে সেখানে খরচ করা ফরয, যদি প্রয়োজন দেখা না দেয়, তবে খরচ করাও ফরয হবে না।

বিশেষ জ্ঞাতব্যঃ নিকটাত্মীয়, মিসকীন, মুসাফির, দরিদ্র প্রার্থী প্রভৃতি সম্পর্কে যাদের জন্য ধন-সম্পদ ব্যয় করতে হবে, তাদের কথা একসাথে বর্ণনা করার পর وَفِي الرِّقَابِ -এর মধ্যে فِي শব্দটি যোগ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, অন্যের মালিকানাভুক্ত ক্রীতদাসদেরকে সম্পদের মালিক বানানো উদ্দেশ্য নয়, বরং তাদের মুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করাই এখানে লক্ষ্য।

এরপর وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ অর্থাৎ নামায কায়েম করা এবং যাকাত প্রদান করার কথা পূর্ববর্তী অন্যান্য বিধান সম্পর্কিত বর্ণনার মতই বলা হয়েছে।

অতঃপর পূর্ববর্তী বর্ণনাভঙ্গী পরিবর্তন করে অতীতকাল বাচক শব্দের স্থলে وَالْمُوفُونَ بِالْعَهْدِ বাক্যটি ইসমে ফায়েল (কারক পদ) ব্যবহার করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মু’মিন ব্যক্তির মধ্যে ওয়াদা অঙ্গীকার পূর্ণ করার অভ্যাস সব সময়ের জন্য থাকতে হবে, ঘটনাচক্রে কখনো কখনো অঙ্গীকার পূরণ করলে চলবে না। কেননা, এরূপ মাঝে-মধ্যে কাফির-গোনাহগাররাও ওয়াদা-অঙ্গীকার পূরণ করে থাকে। সুতরাং এটা ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না।

তেমনিভাবে মোয়ামালাতের বর্ণনায় শুধু অঙ্গীকার পূরণ করার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যায় যে, ক্রয়-বিক্রয়, অংশীদারিত্ব, ভাড়া-ইজারা প্রভৃতি বৈষয়িক দিকের সুষ্ঠুতা ও পবিত্রতাই অঙ্গীকার পূরণের উপর নির্ভরশীল।

সবরই সকল আমনের প্রাণস্বরূপ

এরপরই আখলাক বা মন-মানসিকতার সুস্থতা বিধান সম্পর্কিত বিধি-বিধানের আলোচনায় একমাত্র ’সবর’-এর উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, সবর-এর অর্থ হচ্ছে মন-মানসিকতা তথা নফসকে বশীভূত করে অন্যায়-অনাচার থেকে সর্বতোভাবে সুরক্ষিত রাখা। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, মানুষের হৃদয়-বৃত্তিসহ অভ্যন্তরীণ যত আমল রয়েছে, সবরই সেসবের প্রাণস্বরূপ। এরই মাধ্যমে সর্বপ্রকার অন্যায় ও কদাচার থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হয়।

বর্ণনাভঙ্গীর আরো একটি পরিবর্তন এখানে লক্ষণীয়। পূর্ববর্তী বাক্যে وَالْمُوفُونَ বলার পর এখানে وَالصَّابِرُوْنَ না বলে وَالصَّابِرِينَ বলা হয়েছে। মুফাসসিরগণ বলেন, এখানে مدح বা প্রশংসা কথাটা উহ্য রাখার ফলেই এ’রাবে এ পরিবর্তন এসেছে। তাঁদের পরিভাষায় একে বলা হয় نصب على المدح এখানে صَابِرِينَ কথাটা মফউল বা কর্ম হয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থ দাঁড়ায় যে, যাঁরা উপরোক্ত সৎকর্ম সম্পাদন করেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রশংসার যোগ্য হলেন সবরকারীগণ। কেননা, সবরই এমন এক শক্তি ও যোগ্যতা, যদ্দ্বারা উপরোক্ত সব সৎ কাজেই সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

এমনিভাবে আলোচ্য আয়াত ক’টিতে যেমন দীনের গুরুত্বপূর্ণ সব বিধানের মূলনীতি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে, তেমনিভাবে অত্যন্ত অলঙ্কারপূর্ণ ইঙ্গিতের মাধ্যমে প্রত্যেকটি বিধানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরও স্তরবিন্যাস করে দেওয়া হয়েছে।






********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url