মা’আরেফুল কোরআন - ৭০ || সূরা আল-বাকারাহ, ১৮৭ || রোযার হুকুম আহকাম সম্পর্কে বর্ণনা







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৮৭


  اُحِلَّ لَکُمۡ لَیۡلَۃَ الصِّیَامِ الرَّفَثُ اِلٰی نِسَآئِکُمۡ ؕ هُنَّ لِبَاسٌ لَّکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لِبَاسٌ لَّهُنَّ ؕ عَلِمَ اللّٰهُ اَنَّکُمۡ کُنۡتُمۡ تَخۡتَانُوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ فَتَابَ عَلَیۡکُمۡ وَ عَفَا عَنۡکُمۡ ۚ فَالۡـٰٔنَ بَاشِرُوۡهُنَّ وَ ابۡتَغُوۡا مَا کَتَبَ اللّٰهُ لَکُمۡ ۪ وَ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَکُمُ الۡخَیۡطُ الۡاَبۡیَضُ مِنَ الۡخَیۡطِ الۡاَسۡوَدِ مِنَ الۡفَجۡرِ۪ ثُمَّ اَتِمُّوا الصِّیَامَ اِلَی الَّیۡلِ ۚ وَ لَا تُبَاشِرُوۡهُنَّ وَ اَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ ؕ تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰهِ فَلَا تَقۡرَبُوۡهَا ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ اٰیٰتِهٖ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ یَتَّقُوۡنَ ﴿۱۸۷

সূরা আল-বাকারাহ ১৮৭ নং আয়াতের অর্থ


(১৮৭) রোযার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ্ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্মপ্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন । অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ্ দান করেছেন, তা আহরণ কর। আর পানাহার কর, যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোষা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা ই'তিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, তফসীরে মা'আরেফুল ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ্ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন, আল্লাহ্ নিজের আয়াতসমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে।

সূরা আল-বাকারাহ ১৮৭ নং আয়াতের তাফসীর

   

যোগসূত্রঃ পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে রমযানের হুকুম-আহ্কাম ও ফযীলতের বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর একটি সুদীর্ঘ আয়াতে রোযা ও ই’তিকাফের বিবরণ বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে মাঝখানে বর্তমান সংক্ষিপ্ত আয়াতটিকে বান্দাদের অবস্থার প্রতি মহান পরওয়ারদেগারের অনুগ্রহ এবং তাদের প্রার্থনা শ্রবণ ও কবূল করার বিষয় আলোচনা করে নির্দেশ পালনে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ রোযা-সংক্রান্ত ইবাদতে অবস্থা বিশেষে অব্যাহতি দান এবং বিভিন্ন সহজতা সত্ত্বেও কিছু কষ্ট বিদ্যমান রয়েছে। এ কষ্টকে সহজ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, আমি আমার বান্দাদের সন্নিকটে রয়েছি, যখনই তারা আমার কাছে কোন বিষয় প্রার্থনা বা দোয়া করে, আমি তাদের সে দোয়া কবূল করে নেই এবং তাদের বাসনা পূরণ করে দেই।

এমতাবস্থায় আমার হুকুম-আহ্কাম মেনে চলা বান্দাদেরও একান্ত কর্তব্য—তাতে কিছুটা কষ্ট হলেও তা সহ্য করা উচিত। ইমাম ইবনে কাসীর দোয়ার প্রতি উৎসাহ দান সংক্রান্ত এই মধ্যবর্তী বাক্যটির তাৎপর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, এ আয়াতের দ্বারা রোযা রাখার পর দোয়া কবূল হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সে জন্যই রোযার ইফতারের পর দোয়ার ব্যাপারে বিশেষ তৎপরতা অবলম্বন করা উচিত। মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেনঃ

لِلصَّائِمِ عِنْدَ فِطْرِهِ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ

অর্থাৎ রোযার ইফতার করার সময় রোযাদারের দোয়া কবূল হয়ে থাকে। (আবু দাউদ)

সেজন্যই হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা) ইফতারের সময় বাড়ির সবাইকে সমবেত করে দোয়া করতেন। 

আয়াতের তফসীর হলো এই-
আর [হে মুহাম্মদ (সা)] ! যখন আপনার কাছে আমার বান্দাগণ আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে (যে, আমি তাদের নিকটে কি দূরে,) তখন (আমার পক্ষ থেকে তাদেরকে বলে দিন,) আমি তো নিকটেই রয়েছি। (আর অসঙ্গত প্রার্থনা ছাড়া সমস্ত) প্রার্থনাকারীর প্রার্থনাই গ্রহণ করে নেই, যখন সে নিবেদন করে আমার দরবারে। সুতরাং (যেভাবে আমি তাদের আবেদন নিবেদন মঞ্জুর করে নেই, তেমনিভাবে) আমার হুকুম-আহকামগুলো (আনুগত্য সহকারে) মেনে নেওয়াও তাদের কর্তব্য। আর যেহেতু আমার সে সমস্ত হুকুম-আহ্কামের কোনটিই অসঙ্গত নয়, সেহেতু তাতে কোন একটিও বাদ দেওয়ার মত নেই। আর (তাদেরকে বলে দিন, তারা যেন) আমার উপর নিঃসংশয়ে বিশ্বাস রাখে। (অর্থাৎ আমার সত্তাই যে একচ্ছত্র হাকেম সে ব্যাপারেও।) আশা করা যায়, (এভাবে) তারা হেদায়েত ও সরল পথ লাভে সমর্থ হবে।


আস্তে আস্তে দোয়া করার হুকুম

মাস’আলাঃ এ আয়াতে إِنِّي قَرِيبٌ (আমি নিকটেই রয়েছি) বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ধীরে-সুস্থে ও নীরবে দোয়া করাই উত্তম, উচ্চৈঃস্বরে দোয়া করা পছন্দনীয় নয়। ইমাম ইবনে কাসীর (রা) এ আয়াতের শানে-নুযুল বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন, কোন গ্রামের কিছু অধিবাসী রসূলে করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিল, “যদি আমাদের পরওয়ারদেগার আমাদের নিকটেই থেকে থাকেন, তবে আমরা আস্তে আস্তে দোয়া করব। আর যদি দূরে থেকে থাকেন, তবে উচ্চৈঃস্বরে ডাকব।” এরই প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয়েছে।

রোযার আহকামসমূহ

এ আয়াতে রোযার অন্যান্য আহ্কামের কিছুটা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

তোমাদের জন্য রোযার রাতে নিজেদের স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হওয়া হালাল করে দেওয়া হয়েছে। (আর ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা রহিত হয়ে গেছে)। কারণ (তাদের সাথে তোমাদের ঘনিষ্ঠতা ও নৈকট্যের দরুন) তারা তোমাদের পরিধেয় পোশাকের ন্যায় এবং তোমরাও তাদের পোশাকের ন্যায়। আল্লাহ্ তা’আলা জানতেন যে, তোমরা (এই খোদায়ী হুকুমটির ব্যাপারে) খেয়ানত করে নিজেদেরকে গোনাহে লিপ্ত করেছিলে। (তবে যখন তোমরা লজ্জিত হয়েছ, তখন) আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তোমাদের থেকে সে গোনাহ্ ধুইয়ে দিয়েছেন। সুতরাং (যখন অনুমতি দেওয়া হলো, তখন) এখন তাদের সাথে মেলামেশা করা এবং (এ অনুমতি সম্পর্কিত বিধানের প্রেক্ষিতে) যা তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করা হয়েছে, (বিনা দ্বিধায় এজন্য ব্যবস্থা কর এবং যেভাবে রমযানের রাতে স্ত্রী-সহবাসের অনুমতি রয়েছে, তেমনিভাবে সমগ্র রাত্রির মধ্যে যখন ইচ্ছা তখনই লিপ্ত হওয়ারও অনুমতি রয়েছে।) খেতেও পার (এবং) পানও করতে পার সে সময় পর্যন্ত, যে পর্যন্ত না তোমাদের সামনে প্রভাতের সাদা রেখা (সুবহে সাদেকের আলোকচ্ছটা) স্পষ্ট হয়ে উঠবে কালো রেখা থেকে (অর্থাৎ রাতের অন্ধকার থেকে)। অতঃপর (সুবহে সাদেক থেকে) রাত (আসা পর্যন্ত) রোযা পূর্ণ কর।

(রাতের কালো রেখা থেকে প্রভাতের সাদা রেখা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠার অর্থ, সুবহে-সাদেকের উদয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া )

ই’তিকাফের মাস’আলা

পঞ্চম হুকুম-ই’তিকাফঃ এবং এ সময় স্ত্রীদের (দেহ) থেকে নিজেদের দেহকেও (কামভাবের সাথে) একত্র হতে দিও না, যে সময় তোমরা ইতিকাফ অবস্থায় থাক (যা) মসজিদে (হয়ে থাকে)। (উল্লিখিত) এসব (নির্দেশসমূহ) আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান। সুতরাং এসব (বিধান) থেকে (বের হয়ে যাওয়া তো দূরের কথা) বের হয়ে আসার নিকটবর্তীও হয়ো না। (এবং যেভাবে আল্লাহ্ তা’আলা এসব নির্দেশ বর্ণনা করেছেন ঠিক) তেমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা তাঁর (আরো) নির্দেশ লোকদের (সংশোধনের) জন্য বর্ণনা করে থাকেন এ আশায় যে, এসব লোক (বিধানসমূহের প্রতি অনুগত হয়ে এসব নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণের ব্যাপারে) বিরত থাকবে।

রোযা ফরযের পর প্রথম রমযান

أُحِلَّ لَكُمْ - বাক্যাংশটি দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, যে বিষয়টিকে এ আয়াত দ্বারা হালাল করা হয়েছে, তা ইতিপূর্বে হারাম ছিল। বোখারী এবং অন্যান্য হাদীসের কিতাবে সাহাবী হযরত বারা ইবনে আ’যেরের বর্ণনায় উল্লিখিত যে, প্রথম যখন রমযানের রোযা ফরয করা হয়েছিল, তখন ইফতারের পর থেকে শয্যা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত খানাপিনা ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি ছিল। একবার শয্যা গ্রহণ করে ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথেই এ সবকিছু হারাম হয়ে যেতো। কোন কোন সাহাবী এ ব্যাপারে অসুবিধায় পড়েন। কায়স-ইবনে-সারমাহ্ আনসারী নামক জনৈক সাহাবী একবার সমগ্র দিন কঠোর পরিশ্রম করে ইফতারের সময় ঘরে এসে দেখেন, ঘরে খাওয়ার মত কোন কিছুই নেই। স্ত্রী বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি কোনখান থেকে কিছু সংগ্রহ করে আনার চেষ্টা করি। স্ত্রী যখন কিছু খাদ্য সংগ্রহ করে ফিরে এলেন ততক্ষণে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইফতারের পর ঘুমিয়ে পড়ার দরুন খানাপিনা তাঁর জন্য হারাম হয়ে যায়। ফলে পরদিন তিনি এ অবস্থাতেই রোযা রাখেন। কিন্তু দুপুর বেলায় শরীর দুর্বল হয়ে তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান।-(ইবনে কাসীর)

অনুরূপভাবে কোন কোন সাহাবী গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গার পর স্ত্রীদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়ে মানসিক কষ্টে পতিত হন। এসব ঘটনার পর এ আয়াত নাযিল হয়, যাতে পূর্ববর্তী হুকুম রহিত করে সূর্যাস্তের পর থেকে শুরু করে সুবহে সাদেক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র রাতেই খানাপিনা ও স্ত্রী সহবাস বৈধ করা হয়েছে। ঘুমাবার পূর্বে কিংবা ঘুম থেকে ওঠার পর সম্পর্কে কোন বাধ্যবাধকতাই এতে আর অবশিষ্ট রাখা হয়নি। এমনকি হাদীস অনুযায়ী শেষ রাতে সেহরী খাওয়া সুন্নত সাব্যস্ত করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে এ সম্পর্কিত নির্দেশই প্রদান করা হয়েছে।

رَفَثُ -এর শাব্দিক অর্থ সেসব কথা বা কর্ম, যা কিছু একজন পুরুষ স্ত্রী সহবাসের উদ্দেশ্যে করে বা বলে। সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী, আয়াতে উল্লিখিত رَفَثُ শব্দ দ্বারা সহবাসই বোঝানো হয়েছে। 

হাদীসও কোরআনেরই সমপর্যায়ভুক্ত

শরীয়তের হুকুম নির্ণয়ে হাদীসও কোরআনেরই সমপর্যায়ভুক্তঃ এ আয়াত দ্বারা যে নির্দেশটি রহিত করা হয়েছে অর্থাৎ ইফতারের পর একবার ঘুমিয়ে পড়লে খানাপিনা ইত্যাদি সবকিছু অবৈধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি কোরআনের কোন আয়াতে উল্লিখিত হয়নি, বরং সাহাবীগণ হুযূর (সাঃ)-এর নির্দেশেই এরূপ আমল করতেন। -(মসনদে-আহমদ)

কোরআনের এ আয়াত রাসূল (সাঃ)-এর সে নির্দেশটিকেই আল্লাহর হুকুম-রূপে স্বীকৃতি দিয়ে এর উপর আমল রহিত করেছে। আয়াতের বর্ণনাভঙ্গীই প্রমাণ করছে যে, নির্দেশটিকে কোরআন প্রথমে আল্লাহর নির্দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পরে উম্মতের জন্য এ নিয়মের কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করার উদ্দেশ্যে একে মনসূখ বা রহিত করেছে। এর দ্বারা এ তথ্যও প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রতিষ্ঠিত সুন্নতকেও কোরআনের আয়াত দ্বারা মনসূখ বা রহিত করা যেতে পারে।—(জাসসাস)

সেহরী খাওয়ার শেষ সময়সীমা

حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ আয়াতে রাতের অন্ধকারকে কালো রেখা এবং ভোরের আলো ফোটাকে সাদা রেখার সাথে তুলনা করে রোয়ার শুরু এবং খানাপিনা হারাম হওয়ার সঠিক সময়টি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। অধিকন্তু এ সময়সীমার মধ্যে বেশ-কম হওয়ার সম্ভাবনা যাতে না থাকে সেজন্য حَتَّى يَتَبَيَّنَ শব্দটিও যোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে যে, সন্দেহপ্রবণ লোকদের ন্যায় সুবহে সাদেক দেখা দেওয়ার আগেই খানাপিনা হারাম মনে করো না অথবা এমন অসাবধানতাও অবলম্বন করো না যে, সুবহে সাদেকের আলো ফুটে ওঠার পরও খানাপিনা করতে থাকবে। বরং খানাপিনা এবং রোযার মধ্যে সুবহে সাদেকের সঠিকভাবে নির্ণয়ই হচ্ছে সীমারেখা। এ সীমারেখা উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খানাপিনা বন্ধ করা জরুরী মনে করা যেমন জায়েয নয়, তেমনি সুবহে সাদেক হওয়ার ব্যাপারে একীন হয়ে যাওয়ার পর খানাপিনা করাও হারাম এবং রোযা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ, তা এক মিনিটের জন্য হলেও। সুবহে সাদেক সম্পর্কে একীন হওয়া পর্যন্তই সেহরীর শেষ সময়। এক শ্রেণীর লোক কোন কোন সাহাবীর আমল উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, তাঁদের সেহরী খাওয়া অবস্থাতেই ভোরের আলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা গেছে। তাদের সে বর্ণনা যথার্থ নয়। সাহাবীগণের কারো কারো বেলায় এরূপ ঘটনা ঘটা সম্পর্কে যেসব রেওয়ায়েত করা হয়, সেগুলো সুবহে সাদেক হওয়ার একীন না হওয়ার কারণেই ঘটেছে। সুতরাং যারা এ ধরনের কথা বলে তাদের সেসব দায়িত্বহীন মন্তব্যে প্রভাবান্বিত হওয়া সঙ্গত হবে না।

এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন যে, বেলালের আযান শুনতেই তোমরা সেহরী খাওয়া বন্ধ করে দিও না, কেননা, সে কিছুটা রাত থাকতেই আযান দিয়ে ফেলে। সুতরাং তোমরা বেলালের আযান শোনার পরেও খেতে পার, যে পর্যন্ত না ইবনে উম্মে মাকতুমের আযান শুরু হয়। কেননা, সে ঠিক সুবহে সাদেক হওয়ার পরই আযান দিয়ে থাকে। -(বুখারী ও মুসলিম)

হাদীসটির অসম্পূর্ণ বিবরণের মাধ্যমে সমসাময়িক কোন কোন লেখকের এরূপ ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, ফজরের আযান হয়ে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ সেহরী খেতে কোন অসুবিধা নেই। তাছাড়া যদি কারো দেরিতে ঘুম ভাঙ্গে এবং ততক্ষণে ফজরের আযান হতে থাকে, তবুও তার পক্ষে তাড়াহুড়া করে কিছু খেয়ে নেওয়া উচিত। অথচ এ হাদীসেই ঠিক ফজরের সময় হওয়ার সাথে সাথেই যেহেতু হযরত ইবনে উম্মে মাকতুমের আযান যা সুবহে সাদেক হওয়ার সাথে সাথে দেওয়া হতো, সে আযান শুরু হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খানাপিনা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি, কোরআন শরীফের সুস্পষ্ট নির্দেশে যে সর্বশেষ সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তা নিশ্চিতরূপেই সুবহে সাদেক হওয়া সম্পর্কে একীন হওয়া। এরপর এক মিনিটের জন্যও খানাপিনা করার অনুমতি দেওয়া কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ ছাড়া আর কিছু নয়।

সাহাবায়ে কেরাম এবং পূর্ববর্তী বুযুর্গগণের মধ্যে কারো কারো সেহরী এবং ইফতারের ব্যাপারে সময়ের কড়াকড়ি না করা সম্পর্কিত যেসব বর্ণনা উদ্ধৃত করা হয়, সেগুলোর অর্থ এই হতে পারে যে, কোরআনের নির্দেশ অনুসারে সুবহে সাদেক হওয়া সম্পর্কে একীন না হওয়া পর্যন্ত অতিসাবধানী ভূমিকা গ্রহণ করে যতটুকু সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সে সময়সীমার ব্যাপারেও বেশি বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। তাঁরা তা করতেন না। ইমাম ইবনে কাসীরও সংশ্লিষ্ট বর্ণনাগুলোকে এ অর্থেই গ্রহণ করেছেন। অন্যথায়, কোরআনের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ কোন মুসলমানই যে চোখ বুজে মেনে নিতে রাযী হবে না, তা অত্যন্ত স্বাভাবিক কথা। কাজেই সাহাবায়ে কেরাম ইচ্ছাকৃতভাবে এ সময়সীমা লঙ্ঘন করবেন, এমনটা কল্পনাও করা যায় না। বিশেষত কোরআন শরীফে বিশেষভাবে এ আয়াতের শেষভাগেই যেখানে বলা হয়েছে যে, تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا অর্থাৎ এটা আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা, সুতরাং এর নিকটবর্তীও হয়ো না। 

‘সুবহে সাদেক’ বিষয়ে মাস’আলা

মাস’আলাঃ উপরোক্ত আলোচনাগুলো শুধু সেসব লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যাদের নিজের চোখে ‘সুবহে সাদেক’ দেখে সময় নির্ধারণ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন, আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে সময় সম্পর্কেও যদি তাদের সঠিক জ্ঞান থেকে থাকে। কিন্তু যাদের তেমন সুযোগ নেই অর্থাৎ আকাশ ঠিকমত দেখবার সুযোগ নেই, সুবহে সাদেক সম্পর্কে ধারণাও নেই কিংবা আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তবে এ ক্ষেত্রে সেসব লোকের পক্ষে অন্যান্য লক্ষণ কিংবা জ্যোতির্বিদ্যার সাহায্য নিয়ে সেহরী-ইফতারের সময় নির্ধারণ করতে হবে। অবশ্য এসব হিসাবের মধ্যেও এমন সময় আসতে পারে, যে সময়সীমার মধ্যে সুবহে সাদেক হওয়ার ব্যাপারে একীন বা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় না। এমতাবস্থায় সন্দেহযুক্ত সময়ে কি করা উচিত, এ সম্পর্কে ইমাম জাসসাস ’আহ্কামুল-কোরআন’ গ্রন্থে বলেন—এরূপ ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে খানাপিনা না করাই কর্তব্য, তবে এরূপ সন্দেহপূর্ণ সময়ের মধ্যে অর্থাৎ সুবহে সাদেক হওয়ার পূর্বক্ষণে যদি কেউ প্রয়োজনবশত খানাপিনা করে ফেলে, তবে সে গোনাহগার হবে না। কিন্তু পরে তাহকীক বা যাচাই করে যদি দেখা যায়, যে সময় সে খানাপিনা করেছে সে সময়ের মধ্যে সুবহে-সাদেক হয়ে গিয়েছিল, তবে তার পক্ষে সেদিনের রোযার কাযা করা ওয়াজিব হবে। যেমন রমযানের এক তারিখে চাঁদ না দেখার কারণে লোকেরা রোযা রাখল না, কিন্তু পরে জানা গেল যে, ২৯শে শাবানই রমযানের চাঁদ উদিত হয়েছিল। তবে এমতাবস্থায় যারা সে দিনটিকে ৩০শে শাবান মনে করে রোযা রাখেনি, তারা গোনাহগার হবে না, তবে তাদের এ দিনের রোযা সকল ইমামের মতেই কাযা করতে হবে। অনুরূপভাবে মেঘলা দিনে কেউ সূর্য অস্ত গেছে মনে করে ইফতার করে ফেললো, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সূর্য দেখা দিল—এমতাবস্থায় এ ব্যক্তিও গোনাহগার হবে না সত্য, তবে তার উপর ঐ রোযা কাযা করা ওয়াজিব হবে।

ইমাম জাসসাসের উপরোক্ত বর্ণনার দ্বারা বোঝা যায় যে, কোন ব্যক্তি যদি ঘুম ভাঙার পর শুনতে পায় যে, ফজরের আযান হচ্ছে, তখন তার পক্ষে সুব্‌হে-সাদেক হওয়া সম্পর্কে নিঃসন্দেহ একীন হয়ে যায়। এরপরও যদি সে জেনেশুনে কিছু খেয়ে নেয় তবে সে গোনাহ্গারও হবে এবং তার উপর সেই রোযা কাযা করাও ওয়াজিব হবে। অপরপক্ষে যদি সে সন্দেহযুক্ত সময়ে খায় এবং পরে সুবহে সাদেক এ সময়েই হয়েছিল বলে জানতে পারে, তবে তার উপর থেকে গোনাহ্ রহিত হয়ে যাবে বটে, কিন্তু রোযার কাযা করতে হবে।

ই’তিকাফের মাস’আলা

ই’তিকাফঃ ই’তিকাফ-এর শাব্দিক অর্থ কোন এক স্থানে অবস্থান করা। কোরআন-সুন্নাহর পরিভাষায় কতকগুলো বিশেষ শর্তসাপেক্ষে একটা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট মসজিদে অবস্থান করাকে ই’তিকাফ বলা হয় । فِي الْمَسَاجِدِ এ বাক্যের দ্বারা বোঝা যায় যে, ই’তিকাফ যে কোন মসজিদেই হতে পারে। কেননা, এখানে মসজিদ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

শুধুমাত্র যেসব মসজিদে নিয়মিত জামাত হয়, সেসব মসজিদেই ই’তিকাফ করা দুরস্ত। অন্যান্য মসজিদ যেখানে নিয়মিত জামাত হয় না, সেগুলোতে ই’তিকাফ না হওয়ার ব্যাপারে ফিকহবিদগণ যে শর্ত আরোপ করে থাকেন, তা ‘মসজিদ’ শব্দের সংজ্ঞা থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। কেননা, যেখানে নিয়মিত জামাতে নামায হয়, তাকেই কেবল মসজিদ বলা যেতে পারে। বাসস্থান বা দোকান-পাট সর্বত্রই বিচ্ছিন্নভাবে নামায পড়া জায়েয এবং তা হয়েও থাকে, কিন্তু তাই বলে সেগুলোকে মসজিদ বলা হয় না।

মাস’আলাঃ রমযানের রাতে খানাপিনা, স্ত্রী সহবাস প্রভৃতি হালাল হওয়ার বিষয় ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। ই’তিকাফ অবস্থায় খানা-পিনার হুকুম সাধারণ রোযাদারদের প্রতি প্রযোজ্য নির্দেশেরই অনুরূপ। তবে স্ত্রী সহবাসের ব্যাপারে এ অবস্থায় পৃথক নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে যে—ই’তিকাফ অবস্থায় এটা রাতের বেলায়ও জায়েয নয়। এ আয়াতে সে নির্দেশই ব্যক্ত হয়েছে।

মাস’আলাঃ ই’তিকাফের অন্যান্য মাস’আলা—যথা এর সাথে রোযার শর্ত, শরীয়তসম্মত কোন প্রয়োজন অথবা প্রকৃতিগত প্রয়োজন ব্যতীত ই’তিকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয না হওয়া প্রভৃতি বিষয়ের কোন কোনটি ই’তিকাফ শব্দ থেকে নির্ণয় করা হয়েছে। আর অবশিষ্ট অংশ রাসূল (সা)-এর কওল ও আমল থেকে গৃহীত হয়েছে।

রোযার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন

রোযার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করার নির্দেশঃ সর্বশেষ আয়াত تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا বলে ইশারা করা হয়েছে যে, রোযার মধ্যে খানাপিনা এবং স্ত্রী-সহবাস সম্পর্কিত যেসব নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, এগুলো আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা, এর ধারে-কাছেও যেয়ো না। কেননা, কাছে গেলেই সীমা লংঘনের আশংকা দেখা দিতে পারে। একই কারণে রোযা অবস্থায় কুলি করতে বাড়াবাড়ি করা, যদ্দরুন গলার ভিতরে পানি প্রবেশ করতে পারে; মুখের ভিতর কোন ঔষধ ব্যবহার করা, স্ত্রীর অতিরিক্ত নিকটবর্তী হওয়া প্রভৃতি মকরূহ্। তেমনিভাবে সময় শেষ হওয়ার সম্ভাবনা এড়ানোর জন্য সময়ের কিছুটা আগেই সেহরী খাওয়া শেষ করে দেওয়া এবং ইফতার গ্রহণে দু’চার মিনিট দেরি করা উত্তম। এসব ব্যাপারে অসাবধানতা এবং শৈথিলা প্রদর্শন আল্লাহর এই নির্দেশের পরিপন্থী।






*****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url