মা’আরেফুল কোরআন - ৭২ || সূরা আল-বাকারাহ, ১৮৯-১৯১ || চন্দ্র ও সৌরপঞ্জী , জিহাদ এবং হরমে-মক্কার বিষয়ে আলোচনা







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৮৯-১৯১


  یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الۡاَهِلَّۃِ ؕ قُلۡ هِیَ مَوَاقِیۡتُ لِلنَّاسِ وَ الۡحَجِّ ؕ وَ لَیۡسَ الۡبِرُّ بِاَنۡ تَاۡتُوا الۡبُیُوۡتَ مِنۡ ظُهُوۡرِهَا وَ لٰکِنَّ الۡبِرَّ مَنِ اتَّقٰیۚ وَ اۡتُوا الۡبُیُوۡتَ مِنۡ اَبۡوَابِهَا ۪ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۸۹   وَ قَاتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ الَّذِیۡنَ یُقَاتِلُوۡنَکُمۡ وَ لَا تَعۡتَدُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الۡمُعۡتَدِیۡنَ ﴿۱۹۰   وَ اقۡتُلُوۡهُمۡ حَیۡثُ ثَقِفۡتُمُوۡهُمۡ وَ اَخۡرِجُوۡهُمۡ مِّنۡ حَیۡثُ اَخۡرَجُوۡکُمۡ وَ الۡفِتۡنَۃُ اَشَدُّ مِنَ الۡقَتۡلِ ۚ وَ لَا تُقٰتِلُوۡهُمۡ عِنۡدَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ حَتّٰی یُقٰتِلُوۡکُمۡ فِیۡهِ ۚ فَاِنۡ قٰتَلُوۡکُمۡ فَاقۡتُلُوۡهُمۡ ؕ کَذٰلِکَ جَزَآءُ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۱۹۱

সূরা আল-বাকারাহ ১৮৯-১৯১ নং আয়াতের অর্থ

(১৮৯) তোমার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলে দাও যে, এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ এবং হজ্জের সময় ঠিক করার মাধ্যম। আর পেছনের দিক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে কোন নেকী বা কল্যাণ নেই। অবশ্য নেকী হলো আল্লাহকে ভয় করার মধ্যে। আর তোমরা ঘরে প্রবেশ কর দরজা দিয়ে এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা নিজেদের বাসনার কৃতকার্য হতে পার। 
(১৯০) আর লড়াই কর আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না। 
(১৯১) আর তাদেরকে হত্যা কর যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে, যেখান থেকে তারা বের করেছে তোমাদেরকে। বস্তুত ধর্মীয় ব্যাপারে ফেতনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। আর তাদের সাথে লড়াই করো না মসজিদুল হারামের নিকটে, যতক্ষণ না তারা তোমাদের সাথে সেখানে লড়াই করে অবশ্য যদি তারা নিজেরাই তোমাদের সাথে লড়াই করে তাহলে তাদেরকে হত্যা কর। এই হলো কাফিরদের শাস্তি।

সূরা আল-বাকারাহ ১৮৯-১৯১ নং আয়াতের পূর্বাপর যোগসূত্র

যোগসূত্রঃ لَيْسَ الْبِرَّ আয়াতের আওতায় বর্ণিত হয়েছে যে, এরপর সূরা বাকারার শেষ পর্যন্ত ’বির’ বা সৎকাজ বিষয় আলোচিত হচ্ছে, যা শরীয়তের একান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এগুলোর মধ্যে প্রথম হুকুমটি ছিল ’কিসাস’ বা খুনের বদলে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে। দ্বিতীয়টি ওসীয়ত সম্পর্কে, তৃতীয় ও চতুর্থটি রোযা এবং তৎসম্পর্কিত মাস্আলা-মাসায়েল সংক্রান্ত, পঞ্চমটি ই’তিকাফ এবং ষষ্ঠটি হারাম মাল ভোগ থেকে বেঁচে থাকা সম্পর্কিত। অতঃপর আলোচ্য এ দু’টি আয়াতে হজ্জ ও জিহাদের আহ্কাম বর্ণনা করা হয়েছে। আর হজ্জ সংক্রান্ত বিধি-বিধান আলোচনার পূর্বে বাতলে দেয়া হয়েছে যে, রোযা ও হজ্জ প্রভৃতি বিষয়ে চান্দ্র-মাস ও চান্দ্র-দিবসের হিসাব ধরা হবে। শব্দ বিশ্লেষণঃ اَهَلَّةٌ (আহিল্লাতুন) হলো هِلَالٌ -এর বহুবচন। চান্দ্র-মাসের প্রাথমিক কয়েকটি রাতকে هِلَالٌ (হিলাল) বলা হয়। مَوَاقِيْتٌ হলো ميقات এর বহুবচন। এর অর্থ সময় বা অন্তিম সময়।-(কুরতুবী)

চান্দ্র মাসের হিসাব ও হজ্জ

   

সপ্তম নির্দেশঃ চান্দ্র মাসের হিসাব ও হজ্জ প্রভৃতিঃ (হে রাসূল)। কেউ কেউ আপনার কাছ থেকে (প্রতি মাসে) চন্দ্রের (হ্রাস-বৃদ্ধির) অবস্থা (এবং এই হ্রাস-বৃদ্ধির মধ্যে যেসব উপকারিতা রয়েছে, সেসব উপকারিতা সম্পর্কিত তত্ত্ব ও তথ্য) জানতে চাচ্ছে। আপনি তাদেরকে জানিয়ে দিন যে, (এর উপকারিতা হলো) চন্দ্র (তার হ্রাস-বৃদ্ধি হিসাবে ঐচ্ছিক অথবা বাধ্যতামূলকভাবে) মানুষের (স্বেচ্ছামূলক ব্যাপারে যেমন ইদ্দত), প্রাপ্য আদায় এবং বাধ্যতামূলক বিষয়ে যেমন হজ্জ, রোযা ও যাকাত ইত্যাদির জন্য সময় নির্ধারণের মাধ্যম।

অন্ধকার যুগের কুসংস্কারের সংস্কার

অষ্টম নির্দেশঃ অন্ধকার যুগের কুসংস্কারের সংস্কার সাধনঃ (প্রাক-ইসলাম-যুগের কিছু সংখ্যক লোক হজ্জের ইহরাম বাঁধার পর কোন প্রয়োজনে যদি গৃহে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা করতো, তখন ঘরের দরজা দিয়ে ঢোকাকে নিষিদ্ধ বলে মনে করতো। কাজেই পিছনের দেয়াল ভেঙ্গে তাতে ছিদ্র করে ঘরে প্রবেশ করতো। এই কাজটিকে তারা ফযীলতপূর্ণ কাজ বলে মনে করতো। আল্লাহ্ তা’আলা হজ্জের আলোচনা শেষে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেছেনঃ) এবং এতে কোন ফযীলত নেই যে, পিছন দিয়ে ঘরে প্রবেশ কর। তবে এতে ফযীলত আছে, যে কেউ হারাম (বস্তু বা কর্ম) হতে আত্মরক্ষা করবে। (যেহেতু দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকা হারাম নয়, সেহেতু তা থেকে আত্মরক্ষা করার আবশ্যকতাও নেই। কাজেই যদি গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে হয়, তবে) ঘরের দরজা দিয়েই প্রবেশ কর। (প্রকৃত মূলনীতি হলো এই যে,) আল্লাহকে ভয় করতে থাক (তাতে অবশ্যই আশা করা যায় যে,) তোমরা (ইহকাল ও পরকালে) সফলকাম হবে।

কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধ

নবম নির্দেশঃ কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধঃ হিজরী ষষ্ঠ সনের যিলকদ মাসে রসূলুল্লাহ্ (সা) ওমরাহ্ আদায়ের নিয়তে মক্কা শরীফের দিকে রওয়ানা হলেন। সে সময় মক্কা নগরী মুশরিকদের অধীনে ও মুশরিক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুশরিকগণ রসূলুল্লাহ্ (সা) এবং তাঁর সহযাত্রীগণকে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করতে বাধা দিল। ফলে ওমরাহ্ স্থগিত রয়ে গেল। পরিশেষে অনেক আলাপ-আলোচনার পর এই মর্মে এক সাময়িক সন্ধি-চুক্তি হলো যে আগামী বছর এসে ওমরাহ্ সম্পাদন করবেন। সে হিসাবে হিজরী সপ্তম সনের যিলকদ মাসে পুনরায় তিনি এতদুদ্দেশ্যে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন। কিন্তু হযরত (সা)-এর সঙ্গী মুসলমানগণের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হলো যে, সম্ভবত মুশরিকরা তাদের সন্ধিচুক্তি লংঘন করে সংঘাত ও যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যদি মুশরিকরা আক্রমণ করে, তবে তাঁরা তো চুপ করে বসে থাকতে পারবেন না বা বসে থাকা সমীচীনও হবে না। কিন্তু যদি মুশরিকদের মুকাবিলা ও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, তবে সে যুদ্ধ সংঘটিত হবে যিকদ মাসে। এই মাসটি তো সে চার মাসের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলোকে ‘আশহুরে হারাম’ বা সম্মানিত মাস বলা হয়। এই চার মাসে তখনও পর্যন্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ হারাম ও নিষিদ্ধ ছিল। এই চারটি সম্মানিত (হারাম) মাস ছিল যিলকদ, যিল্‌হজ্জ, মুহররম ও রজব। যা হোক, মুসলমানগণ এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে অত্যন্ত পেরেশান ছিলেন। এমন সময় আল্লাহ্ তা’আলা আয়াতগুলো নাযিল করলেন যে, সন্ধি চুক্তিকারীদের সঙ্গে পারস্পরিক চুক্তির কারণে তোমাদের পক্ষ থেকে প্রথমে হামলা করার অনুমতি নেই। কিন্তু তারা যদি চুক্তি ভঙ্গ করে তোমাদের উপর আক্রমণ চালায় (তখন তোমরা অন্তরে কোনরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের স্থান দিও না) এবং (নিঃশঙ্কচিত্তে) তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। অর্থাৎ এই নিয়তে যে, এরা দীন-ইসলামের বিরোধিতা করছে এবং চুক্তি ভঙ্গ করে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছে। (কিন্তু নিজেরা চুক্তির) সীমা অতিক্রম করো না, (চুক্তি ভঙ্গ করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ো না)। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ (শরীয়তের আইনের) সীমালংঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না। আর (যে অবস্থায় তারা নিজেরাই চুক্তি ভঙ্গ করে, সে অবস্থায় তোমরা নিঃশঙ্কচিত্তে) তাদেরকে যেখানে পাও হত্যা কর, আর (না হয়) তাদেরকে (মক্কা থেকে) বহিষ্কার কর, যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে (নানারূপ দুঃখ-কষ্ট দিয়ে) বহিষ্কৃত হতে (এবং হিজরত করতে) বাধ্য করছে। আর (তোমাদের এই হত্যা ও বহিষ্কারের পরেও বিবেকের বিচারে অপরাধের বোঝা তাদেরই কাঁধে থেকে যাবে। কেননা, তাদের তরফ থেকে যে চুক্তি ভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা হবে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। আর এরূপ) গর্হিত কাজ (অনিষ্টের দিক দিয়ে) হত্যা (ও বহিষ্কার) অপেক্ষাও মারাত্মক। (কারণ, সে হত্যা ও বহিষ্কারের সুযোগ সে অপকর্মের কারণেই ঘটে থাকে)। আর (সন্ধিচুক্তি ছাড়াও তাদের সাথে প্রাথমিক পর্যায়ে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মাঝে আরও একটি অন্তরায় রয়েছে। আর তা হলো এই যে, হরম শরীফ অর্থাৎ মক্কা ও মক্কার পার্শ্ববর্তী এমন একটি এলাকা রয়েছে, যার সম্মান করা অপরিহার্য। সেখানে যুদ্ধ করা এ স্থানের সম্মানের পক্ষে হানিকর। কাজেই নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে যে,) তাদের সঙ্গে মসজিদুল হারামের নিকটবর্তী (যা হারাম বলে নির্ধারিত) এলাকায় যুদ্ধ করো না, যে পর্যন্ত না তারা স্বয়ং তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তবে যদি তারা (কাফিররা) যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে, তখন (তোমাদের প্রতিও তাদেরকে হত্যা করার অনুমতি রয়েছে) তোমরাও তাদেরকে আঘাত কর। যারা এহেন কাফির (যারা হরমের ভিতরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়) তাদের এমন শাস্তিই প্রাপ্য।

সূরা আল-বাকারাহ ১৮৯-১৯১ নং আয়াতের বিষয় বস্তু

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়
প্রথম আয়াতে সাহাবায়ে কেরাম (রা)-এর একটি প্রশ্ন এবং আল্লাহ্ তা’আলার তরফ থেকে তার জওয়াবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুফাসসিরকুল শিরোমণি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, সাহাবায়ে কেরামের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রতি সম্ভ্রম ও সমীহ বোধের কারণে খুব কমই প্রশ্ন করতেন। তাঁরা এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী যমানার উম্মতদের ব্যতিক্রম ছিলেন। পূর্ববর্তী উম্মতগণ এ আদবের প্রতি সচেতন ছিল না। তারা সব সময় নানা অবান্তর প্রশ্ন করতো। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, সাহাবীগণের যেসব প্রশ্নের উল্লেখ কোরআন মজীদে বিদ্যমান রয়েছে, তা সংখ্যায় মাত্র চৌদ্দটি । এই চৌদ্দটি প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي  (যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্পর্কে তোমার কাছে প্রশ্ন করে) দ্বিতীয় প্রশ্নটি আলোচ্য চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কিত প্রশ্ন। এই দু’টি প্রশ্ন ছাড়া সূরা বাকারায় আরও ছয়টি প্রশ্নের উল্লেখ রয়েছে। বাকি ছয়টি প্রশ্ন পরবর্তী বিভিন্ন সূরায় বিদ্যমান।

উল্লিখিত আয়াতে বর্ণিত রয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরাম (রা) হযরত রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ‘আহিল্লা’ বা নতুন চাঁদ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। কারণ, চাঁদের আকৃতি-প্রকৃতি সূর্য থেকে ভিন্নতর। সেটা এক সময় সরু বাঁকা রেখার আকৃতি ধারণ করে এবং অতঃপর ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে; অবশেষে সম্পূর্ণ গোলকের মত হয়ে যায়। এরপর পুনরায় ক্রমান্বয়ে হ্রাসপ্রাপ্ত হতে থাকে। এই হ্রাস-বৃদ্ধির মূল কারণ অথবা এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে তাঁরা প্রশ্ন করেছিলেন। এই দুই প্রকার প্রশ্নেরই সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু যে উত্তর প্রদান করা হয়েছে, তাতে এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কেই বর্ণিত হয়েছে। যদি প্রশ্নই এই হয়ে থাকে যে, চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি ? তবে তো প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর হয়েই গেছে। আর যদি প্রশ্নে এই হ্রাস-বৃদ্ধির অন্তর্নিহিত মূল তত্ত্ব জানবার উদ্দেশ্য থেকে থাকে, যা ছিল সাহাবায়ে কেরামের স্বভাব-বিরুদ্ধ, তবে চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধির মৌলতত্ত্ব বর্ণনার পরিবর্তে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণনার দ্বারা এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আকাশের গ্রহ-উপগ্রহ ও নক্ষত্রমণ্ডলী মৌলিক উপাদান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা মানুষের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। আর মানুষের ইহলৌকিক বা পারলৌকিক কোন বিষয়ই এই জ্ঞান লাভের উপর নির্ভরশীল নয়। কাজেই চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধির মূল কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা নিরর্থক। এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা ও জবাব এই যে, চন্দ্রের এরূপ হ্রাস-বৃদ্ধি এবং উদয়ার্ল্ডের মধ্যে আমাদের কোন্ কোন্ মঙ্গল নিহিত ? সেজন্য আল্লাহ্ তা’আলা প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ওহীর মাধ্যমে বলে দিয়েছেন যে, আপনি তাদেরকে বলে দিন, চাঁদের সঙ্গে তোমাদের যেসব মঙ্গল ও কল্যাণ সম্পৃক্ত তা এই যে, এতে তোমাদের কাজ-কর্ম ও চুক্তির মেয়াদ নির্ধারণ এবং হজ্জের দিনগুলোর হিসাব জেনে রাখা সহজতর হবে।

চন্দ্র ও সৌর হিসাবের গুরুত্ব

শরীয়তের দৃষ্টিতে চন্দ্র ও সৌর হিসাবের গুরুত্বঃ এ আয়াতে এতটুকু বোঝা গেল যে, চন্দ্রের দ্বারা তোমরা তারিখ ও মাসের হিসাব জানতে পারবে যার উপর তোমাদের লেন-দেন, আদান-প্রদান এবং হজ্জ প্রভৃতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। এ প্রসঙ্গটি সূরা ইউনুসে বিবৃত হয়েছেঃ

وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ (يونس) 

এই আয়াত দ্বারা জানা গেল যে, বিভিন্ন পর্যায় ও বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে চন্দ্রের পরিক্রমণের উপকারিতা এই যে, এর দ্বারা বর্ষ, মাস ও তারিখের হিসাব জানা যায়। কিন্তু সূরা বনী ইসরাঈলের আয়াতে বর্ষ, মাস ও দিন-ক্ষণের হিসাব যে সূর্যের সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত তাও বিবৃত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

فَمَحَوْنَا آيَةَ اللَّيْلِ وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِتَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ وَلِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ

অর্থাৎ “অতঃপর আমি রাতের চিহ্ন তিরোহিত করে দিনের চিহ্নকে দর্শনযোগ্য করলাম, যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহের দান রুযী-রোযগারের অনুসন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বর্ষপঞ্জী ও দিন-ক্ষণের হিসাব অবগত হতে পার।”-(বনী ইসরাঈল, বারো আয়াত)

এই আয়াত দ্বারা যদিও প্রমাণিত হলো যে বর্ষ, মাস ইত্যাদির হিসাব সূর্যের আহ্নিক গতি এবং বার্ষিক গতি দ্বারাও নির্ণয় করা যায়, (রূহুল মাআনী) কিন্তু চন্দ্রের ক্ষেত্রে কোরআন যে ভাষা প্রয়োগ করেছে, তাতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী শরীয়তে চান্দ্রমাসের হিসাবই নির্ধারিত। রমযানের রোযা, হজ্জের মাস ও দিনসমূহ, মহররম, ঈদ, শবে-বরাত ইত্যাদির সঙ্গে যেসব বিধি-নিষেধ সম্পৃক্ত, সেগুলো সবই ’রুইয়াতে-হেলাল’ বা নতুন চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল । কেননা, এই আয়াতে এই আয়াতে هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ -(এটি মানুষের হজ্জ ও সময় নির্ধারণের উপায়) বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, যদিও এই হিসাব সূর্যের দ্বারাও অবগত হওয়া যায়, তবুও আল্লাহর নিকট চান্দ্রমাসের হিসাবই নির্ভরযোগ্য।

ইসলামী শরীয়ত কর্তৃক চান্দ্রমাসের হিসাব গ্রহণ করার কারণ এই যে, প্রত্যেক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিই আকাশে চাঁদ দেখে চান্দ্রমাসের হিসাব অবগত হতে পারে। পণ্ডিত, মূর্খ, গ্রামবাসী, মরুবাসী, পার্বত্য উপজাতি ও সভ্য-অসভ্য জনগণ নির্বিশেষে সবার জন্যই চান্দ্রমাসের হিসাব সহজতর। কিন্তু সৌরমাস ও সৌরবছর এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এর হিসাব জ্যোতির্বিদদের ব্যবহার্য দূরবীক্ষণ যন্ত্রসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি এবং ভৌগোলিক, জ্যামিতিক ও জ্যোতির্বিদ্যার সূত্র ও নিয়ম-কানুনের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এই হিসাব প্রত্যেকের পক্ষে সহজে অবগত হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে চান্দ্রমাসের হিসাব বাধ্যতামূলক করা হলেও সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এ হিসাবেরই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। চাঁদ ইসলামী ইবাদতের অবলম্বন। চাঁদ এক হিসাবে ইসলামের প্রতীক বা শি’আরে ইসলাম। ইসলাম যদিও সৌরপঞ্জী ও সৌর হিসাবকে এই শর্তে না-জায়েয বলেনি, তবুও এতটুকু সাবধান অবশ্যই করেছে, যেন সৌর হিসাব এত প্রাধান্য লাভ না করে যাতে লোকেরা চন্দ্রপঞ্জী ও চান্দ্রমাসের হিসাব ভুলেই যায়। কারণ এরূপ করাতে রোযা, হজ্জ ইত্যাদি ইবাদতে ত্রুটি হওয়া অবশ্যম্ভাবী । অধুনা যেভাবে সাধারণ অফিস-আদালতে ব্যবসায়-বাণিজ্যে এমনকি একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় চিঠিপত্রে পর্যন্ত সৌরপঞ্জীর এমন বহুল প্রচলন ঘটেছে যে, অনেকেরই ইসলামী মাসগুলো পর্যন্ত স্মরণ থাকে না। এই অবস্থা শরীয়তের দৃষ্টিকোণ ছাড়াও জাতীয় মর্যাদায় এবং সম্মানের ক্ষেত্রে বিরাট অবক্ষয়ের পরিচায়ক। আমরা যদি কেবল সে সমস্ত অফিস ও দফতরের কাজ সৌরপঞ্জী হিসাবে চালাই যেগুলোর সঙ্গে অমুসলিমদের সম্পর্ক বিদ্যমান, আর ব্যক্তিগত চিঠিপত্র এবং দৈনন্দিন আচার-অনুষ্ঠানে ইসলামী চন্দ্রপঞ্জীর তারিখ ব্যবহার করি, তবে তাতে একটা ফরযে কেফায়া আদায়ের সওয়াবও হবে এবং ইসলামের প্রতীক বা শি’আরে ইসলামেরও হেফাজত হবে।

জায়েজকে নাজায়েজ এবং নাজায়েজকে জায়েজ মনে করা পাপ

মাস’আলাঃ وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَنْ تَأْتُوا الْبُيُوتَ مِنْ ظُهُورِهَا (ঘরের পিছন দিক দিয়ে প্রবেশ করাতে তোমাদের জন্য কোন পুণ্য নেই) এই আয়াত দ্বারা এই মাস’আলা জানা গেল যে, যে বিষয়কে ইসলামী শরীয়ত প্রয়োজনীয় বা ইবাদত বলে মনে করে না, তাকে নিজের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় বা ইবাদত মনে করা জায়েয নয়। এমনিভাবে যে বিষয় শরীয়তে জায়েয রয়েছে, তাকে পাপ মনে করাও গোনাহ্। মক্কার কাফিররা তাই করছিল। তারা ঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করা শরীয়তসম্মতভাবে জায়েয থাকা সত্ত্বেও দরজা দিয়ে প্রবেশ করা না-জায়েয মনে করতো। তারা শরীয়তসম্মতভাবে ঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করাকে পাপ বলে গণ্য করতো এবং ঘরের পিছন দিক দিয়ে দেয়াল ভেঙ্গে বা বেড়া কেটে বা সিঁধ কেটে ঘরে প্রবেশ করাকে (শরীয়তে যার কোন আবশ্যকতাই ছিল না) নিজেদের জন্য অপরিহার্য ও অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করেছিল। এ ব্যাপারে তাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। ’বেদ’আত’-এর না-জায়েয হওয়ার বড় কারণও তাই যে, এতে অপ্রয়োজনীয় বিষয়সমূহকে ফরয-ওয়াজিবের মতই অত্যাবশ্যকীয় মনে করা হয় অথবা কোন কোন জায়েয বস্তুকে না-জায়েয ও হারাম বলে গণ্য করা হয়। আলোচ্য আয়াতে এরূপ শরীয়ত-বহির্ভূত নিয়মে জায়েযকে না-জায়েয মনে করা অথবা হারামকে হালাল মনে করা বা ’বেদাআত’-এর প্রচলন করার নিষেধাজ্ঞা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আয়াতের দ্বারা বেশ কিছু সংখ্যক হুকুম-আহকামও জানা গেছে।

জিহাদ বা ন্যায়ের সংগ্রাম

দশম নির্দেশঃ জিহাদ বা ন্যায়ের সংগ্রামঃ গোটা মুসলিম উম্মত এ ব্যাপারে একমত যে, মদীনায় হিজরতের পূর্বে কাফিরদের সঙ্গে ’জিহাদ’ ও ’কেতাল’ (যুদ্ধ-বিগ্রহ) নিষিদ্ধ ছিল। সে সময়ে অবতীর্ণ কোরআন মজীদের সব আয়াতেই কাফিরদের অন্যায়-অত্যাচার নীরবে সহ্য করে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শনের শিক্ষা দেওয়া হয়। রবী’ ইবনে আনাস প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম (রা)-এর উক্তি অনুসারে মদীনায় হিজরতের পর সর্বপ্রথম কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে উপরোক্ত আয়াতটি নাযিল হয় তবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর এক বর্ণনা অনুযায়ী কাফিরদের বিপক্ষে যুদ্ধের নির্দেশ সম্পর্কিত এটিই সর্বপ্রথম আয়াত যথাঃ أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا কিন্তু অধিকাংশ সাহাবী (রা) এবং তাবেয়ীন (র)-এর মতে এ প্রসঙ্গে সূরা বাকারার উপরোল্লিখিত আয়াতই প্রথম আয়াত। তবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যে আয়াতটিকে এ প্রসঙ্গে নাযিলকৃত প্রথম আয়াত বলে মত প্রকাশ করেছেন, সে আয়াতটিকেও এ প্রসঙ্গে প্রথম দিকে নাযিলকৃত আয়াতসমূহের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে প্রথম আয়াত বলা চলে।

এই আয়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, মুসলমানগণ কেবল সে সব কাফিরের সঙ্গেই যুদ্ধ করবে যারা তাদের বিপক্ষে সম্মুখ সমরে উপস্থিত হবে। এর অর্থ এই যে, নারী, শিশু, বৃদ্ধ ধর্মীয় কাজে সংসার ত্যাগী উপাসনারত সন্ন্যাসী-পাদ্রী প্রভৃতি এবং তেমনিভাবে অন্ধ, খঞ্জ, পঙ্গু, অসমর্থ অথবা যারা কাফিরদের অধীনে মেহনতী মজদুরী করে, কিন্তু তাদের সঙ্গে যুদ্ধে শরীক না হয়—সেসব লোককে যুদ্ধে হত্যা করা জায়েয নয়। কেননা, আয়াতের নির্দেশে কেবল তাদেরই সঙ্গে যুদ্ধ করার হুকুম রয়েছে, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, কিন্তু উল্লিখিত শ্রেণীর লোকদের কেউই যুদ্ধে যোগদানকারী নয়। এজন্য ফিকহ-শাস্ত্রবিদ ইমামগণ বলেন, যদি কোন নারী, বৃদ্ধ অথবা ধর্মপ্রচারক বা ধর্মীয় মিশনারীর লোক কাফিরদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অথবা কোন প্রকারে যুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করতে থাকে, তবে তাদেরকেও হত্যা করা জায়েয। কারণ, তারা الَّذِينَ يُقَاتَلُونَكم “যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে”-এই আয়াতের আওতাভুক্ত-(মাযহারী, কুরতুবী ও জাসসাস)। যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তরফ থেকে মুজাহিদদেরকে যেসব উপদেশ দেওয়া হতো, সেগুলোর মধ্যে এ নির্দেশের বিস্তারিত ব্যাখ্যার উল্লেখ রয়েছে। সহীহ্-বুখারী ও সহীহ্-মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা) বর্ণিত এক হাদীসে আছেঃ

نَهَى رَسُوْلُ اللَّهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ قَتْلِ النِّسَاءِ وَالصِّبْيَانِ

-রাসূলুল্লাহ্ (সা) নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।

অনুরূপভাবে সহীহ আবূ দাউদ গ্রন্থে হযরত আনাস (রা) বর্ণিত এক হাদীসে যুদ্ধযাত্রী সাহাবীগণের উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ (সা)-এর নিম্নলিখিত উপদেশাবলী উদ্ধৃত রয়েছেঃ -“তোমরা আল্লাহর নামে এবং রাসূলের মিল্লাতের উপর জিহাদে যাও! কোন দুর্বল, বৃদ্ধ এবং শিশুকে অথবা কোন স্ত্রীলোককে হত্যা করো না।” -(মাযহারী) হযরত আবূ বকর (রা) যখন ইয়াযীদ ইবনে আবূ সুফিয়ানকে সিরিয়া অভিযানে প্রেরণ করেন, তখন যুদ্ধ সম্পর্কিত বিধি-বিধান বর্ণনা প্রসঙ্গে হুবহু এ উপদেশগুলোর কথাই উল্লেখ করেছিলেন। এতদসঙ্গে তিনি আরও উপদেশ দিয়েছিলেন যে, “উপাসনারত রাহেব বা সন্ন্যাসী, কাফিরদের শ্রমিক এবং চাকরদেরকেও হত্যা করো না, যদি না তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।"-(কুরতুবী)

আয়াতের শেষাংশে وَلَا تَعْتَدُوْا (এবং সীমা অতিক্রম করো না)-বাক্যটির অর্থ অধিকাংশ তফসীরকারের মতে এই যে, নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করে সীমা অতিক্রম করো না।

وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأَخْرِجُوهُمْ مِنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْ

-(আর তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা কর এবং যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে, তোমরাও তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দাও।)

সার-সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি-চুক্তির শর্ত মোতাবেক হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রা)-সহ সেই ওমরাহর কাযা আদায়ের উদ্দেশ্যে যাত্রার নিয়ত করেন, আগের বছর মক্কার কাফিররা যে ওমরাহ্ উদযাপনে বাধা প্রদান করেছিল। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের মনে তখন সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, কাফিররা হয়তো তাদের সন্ধি ও চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করবে না। যদি তারা এ বছরও তাঁদেরকে বাধা দেয়, তবে তাঁরা কি করবেন ? এ প্রসঙ্গেই উল্লিখিত আয়াতে অনুমতি প্রদান করা হলো যে, যদি তারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, তবে তোমাদেরও তার সমুচিত জবাব দেওয়ার অনুমতি থাকলো—“তোমরা যেখানে তাদেরকে পাবে, হত্যা করবে এবং যদি সম্ভব হয়, তাহলে তারা যেমন তোমাদেরকে মক্কা নগরী থেকে বের করে দিয়েছে, তোমরাও অনুরূপভাবে তাদেঅপনোদনকল্পেরকে বহিষ্কার করবে।”

পুরো মক্কী যিন্দেগীতে মুসলমানদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে বাধা দান করা হয়েছিল এবং সর্বদা ক্ষমা ও উদারতার শিক্ষা প্রদান করা হয়েছিল। কাজেই এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর সাহাবীগণের ধারণা হয়েছিল যে, হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে কাফিরদেরকে হত্যা করা নিষিদ্ধ ও দূষণীয় হয়ে থাকবে। এ ধারণার  ইরশাদ হলোঃ

وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ

-(এবং ফিতনা বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যা অপেক্ষা কঠিন অপরাধ)। অর্থাৎ একথা তো অবশ্যই সত্য ও সর্বজনবিদিত যে, নরহত্যা নিকৃষ্ট কর্ম, কিন্তু মক্কার কাফিরদের কুফরী ও শিরকের উপর অটল থাকা এবং মুসলমানদেরকে ওমরাহ্ ও হজ্জের মত ইবাদতের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা অতি গুরুতর ও কঠিন অপরাধ। এরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কারণেই তাদেরকে হত্যা করার অনুমতি প্রদান করা হলো। আলোচ্য আয়াতে উল্লিখিত فِتْنَةُ (ফিতনাহ্) শব্দটির দ্বারা কুফর, শিরক এবং মুসলমানদের ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাকেই বোঝানো হয়েছে। (জাসসাস, কুরতুবী প্রমুখ)

অবশ্য এ আয়াতের ব্যাপকতার দ্বারা বোঝা যায় যে, কাফিররা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদেরকে হত্যা করা শরীয়তসিদ্ধ। আয়াতের এই ব্যাপকতাকে পরবর্তী বাক্যে এই বলে সীমিত করা হয়েছেঃ

وَلَا تُقَاتِلُوهُمْ عِنْدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّى يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ 

অর্থাৎ “মসজিদুল হারামের পার্শ্ববর্তী এলাকা তথা পুরো হরমে মক্কায় তোমরা তাদের সঙ্গে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করো না, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই তোমাদের উপর আক্রমণোদ্যত হয়।”

হরমে-মক্কায় প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ

মাস’আলাঃ হরমে-মক্কায় বা সম্মানিত এলাকায় মানুষ তো দূরের কথা, কোন হিংস্র পশু হত্যা করাও জায়েয নয়। কিন্তু এই আয়াত দ্বারা জানা গেল যে, যদি কেউ অপরকে হত্যায় প্রবৃত্ত হয়, তখন তার প্রতিরোধকল্পে যুদ্ধ করা জায়েয। এ মর্মে সমস্ত ফিকবিদ একমত।

মাস’আলাঃ এ আয়াত দ্বারা আরও বোঝা যাচ্ছে যে, প্রথম অভিযান আক্রমণ বা আগ্রাসন কেবল মসজিদুল হারামের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বা ’হরমে-মক্কায়’ই নিষিদ্ধ। অপরাপর এলাকায় যেমন প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ অপরিহার্য তেমনি প্রথম আক্রমণ বা অভিযানও জায়েয।




****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url