মা’আরেফুল কোরআন - ৭৮ || সূরা আল-বাকারাহ, ২১৩ || মুসলমান ও অমুসলমান ব্যতিত পৃথিবীতে অন্য কোন জাতি নেই







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ২১৩


 کَانَ النَّاسُ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً ۟ فَبَعَثَ اللّٰهُ النَّبِیّٖنَ مُبَشِّرِیۡنَ وَ مُنۡذِرِیۡنَ ۪ وَ اَنۡزَلَ مَعَهُمُ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَ النَّاسِ فِیۡمَا اخۡتَلَفُوۡا فِیۡهِ ؕ وَ مَا اخۡتَلَفَ فِیۡهِ اِلَّا الَّذِیۡنَ اُوۡتُوۡهُ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡهُمُ الۡبَیِّنٰتُ بَغۡیًۢا بَیۡنَهُمۡ ۚ فَهَدَی اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لِمَا اخۡتَلَفُوۡا فِیۡهِ مِنَ الۡحَقِّ بِاِذۡنِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ یَهۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۲۱۳

সূরা আল-বাকারাহ ২১৩ নং আয়াতের অর্থ

(২১৩) সকল মানুষ একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ্ তা'আলা পয়গম্বর পাঠালেন সু-সংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসাবে। আর তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করলেন সত্য কিতাব, যাতে মানুষের মাঝে বিতর্কমূলক বিষয়ে সীমাংসা করতে পারেন। বস্তুত কিতাবের ব্যাপারে অন্য কেউ মতভেদ করেনি ; কিন্তু পরিষ্কার নির্দেশ এসে যাবার পর নিজেদের পারস্পরিক জেদবশত তারাই করেছে, যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল ! অতঃপর আল্লাহ্ ঈমানদারদেরকে হিদায়েত করেছেন সেই সত্য বিষয়ে, যে ব্যাপারে তারা মতভেদে লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা, সরল পথ বাতলে দেন।

সূরা আল-বাকারাহ ২১৩ নং আয়াতের যোগসূত্র

যোগসূত্রঃ পূর্ববর্তী বর্ণনায় সত্য ধর্মের বিরুদ্ধাচরণই দুনিয়াতে অশান্তির কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে এ বিষয়ের সমর্থনে বলা হয়েছে, পূর্বকাল হতেই এই রীতি প্রচলিত রয়েছে যে, আমরা ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রকাশ্য দলীল ও প্রমাণ উপস্থাপন করে আসছি। আর দুনিয়াদারগণ স্বীয় পার্থিব স্বার্থে এর বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে।

সূরা আল-বাকারাহ ২১৩ নং আয়াতের তাফসীর

   

তাফসীরের সার-সংক্ষেপ
(এককালে) সকল মানুষ একই মত ও পথের অনুসারী ছিল। [কারণ, সর্বপ্রথম হযরত আদম (আ) বিবি হাওয়াসহ দুনিয়াতে তশরিফ আনেন এবং যেসব সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তাদেরকে সত্য ধর্মের শিক্ষা দিতে থাকেন, আর তারা সে শিক্ষানুযায়ী আমল করতে থাকে। এমনিভাবে অতিবাহিত হয়ে যায় সুদীর্ঘ সময়। অতঃপর মানুষের স্বভাবগত পার্থক্যের দরুন তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে আরম্ভ করে। তারপর দীর্ঘকাল পরে কর্মধারা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও পার্থক্য ও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়]। অতঃপর (এই মতবিরোধ সমাধানকল্পে) আল্লাহ্ তা’আলা (বিভিন্ন) নবী (আ)-গণকে প্রেরণ করেন। তাঁরা (সত্যের সমর্থকদিগকে) পুরস্কার লাভের সু-সংবাদ দিতে থাকেন এবং অমান্যকারীদিগকে শাস্তির ভয় প্রদর্শন করতে থাকেন এবং নবীগণের (অর্থাৎ নবীগণের সামগ্রিক দলের) সাথে (আসমানী) গ্রন্থও নিয়মিত অবতীর্ণ করা হয়েছে। (নবীগণকে প্রেরণ করা এবং আসমানী কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করার পেছনে) উদ্দেশ্য (ছিল এই ) যে, আল্লাহ্ তা’আলা (সেই রসূলগণ এবং আসমানী গ্রন্থরাজির মাধ্যমে মতানৈক্যকারী) লোকদের মাঝে তাদের বিরোধীয় বিষয়সমূহের মীমাংসা করে দেখেন। (কারণ, রসূলগণ এবং কিতাবসমূহ প্রকৃত বিষয়ই প্রকাশ করে থাকে। আর প্রকৃত বিষয় সাব্যস্ত হয়ে গেলে তার বিপরীত বিষয়টি যে ভুল, তা স্বাভাবিকভাবেই সাব্যস্ত হয়ে যায়। আর একটা হচ্ছে সিদ্ধান্ত বা মীমাংসা। কাজেই রাসূলগণের সাথে গ্রন্থ প্রেরিত হওয়ার পর তাদের এটাই উচিত ছিল তাকে গ্রহণ করা এবং এরই ভিত্তিতে নিজেদের বিরোধীয় বিষয়গুলোর সমাধান করে নেওয়া, কিন্তু তারা তা না করে বরং কেউ কেউ সে গ্রন্থকে অমান্য করে বসে এবং তাতে নিজেরাই মতানৈক্য আরম্ভ করে দেয় এবং) এ গ্রন্থে (এই) মতানৈক্য অন্য কেউ করেনি-(করেছে) একমাত্র ঐ সমস্ত লোকই যারা এ গ্রন্থ লাভ করেছিল (অর্থাৎ বিদ্বান ও বুদ্ধিমান জ্ঞানী মানুষগণ। কারণ এ গ্রন্থে প্রথম তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়। অন্যান্য সাধারণ মানুষ তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর মতানৈক্যও কেমন সময় করেছে অর্থাৎ ) তাদের নিকট প্রমাণ পৌঁছবার পরে (অর্থাৎ তাদের মধ্যে একথা গাঢ়ভাবে প্রমাণিত হওয়ার পর) এবং মতানৈক্য করেছে শুধু পারস্পরিক জেদের বশবর্তী হয়ে । (জেদাজেদির প্রকৃত কারণ, দুনিয়ার লোভ, ধন-সম্পদের মোহ এবং মনের অভিলাষ পূর্বেও একথা বলা হয়েছে।) পরে কাফিরদের এ মতানৈক্য মু’মিনদের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। বরং আল্লাহ্ তা’আলা ঈমানদারগণকে (রসূল ও কিতাবের মাধ্যমে) সে সমস্ত সত্য বিষয় বাতলে দিয়েছেন, যাতে বিরুদ্ধবাদীরা মতানৈক্য করতো। বস্তুত আল্লাহ্ তা’আলা যাকে ইচ্ছা সৎ ও সরল পথ দেখান।

সূরা আল-বাকারাহ ২১৩ নং আয়াতের বিষয় বস্তু

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়
এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কোন এককালে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ একই মতাদর্শ ও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সবাই একই ধরনের বিশ্বাস ও আকীদা পোষণ করত। তা ছিল প্রকৃতির ধর্ম। অতঃপর তাদের মধ্যে আকীদা, বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিভিন্নতা দেখা দেয়। ফলে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করা বা পরিচয় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই আল্লাহ্ তা’আলা সত্য ও সঠিক মতবাদকে প্রকাশ করার জন্য এবং সঠিক পথ দেখাবার লক্ষ্যে নবী ও রসূলগণকে প্রেরণ করেন, তাঁদের প্রতি আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেন। নবীগণের চেষ্টা, পরিশ্রম ও তবলীগের ফলে মানুষ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল আল্লাহর প্রেরিত রাসূল এবং তাঁদের প্রদর্শিত সত্য-সঠিক পথ ও মতকে গ্রহণ করে নেয়। আর একদল তা প্রত্যাখ্যান করে নবীগণকে মিথ্যা বলেছে। প্রথমোক্ত দল নবীগণের অনুসারী এবং মু’মিন বলে পরিচিত, আর শেষোক্ত দলটি নবীগণের অবাধ্য ও অবিশ্বাসী এবং কাফির বলে পরিচিত। এ আয়াতের প্রথম বাক্যে ইরশাদ হয়েছেঃ

كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً

ইমাম রাগেব ইস্পাহানী ‘মুফরাদাতুল কোরআন’-এ বলেছেন, আরবী অভিধান অনুযায়ী এমন মানবগোষ্ঠীকে উম্মত বলা হয়, যাদের মধ্যে কোন বিশেষ কারণে সংযোগ, ঐক্য ও একতা বিদ্যমান থাকবে। সে ঐক্য মতাদর্শ ও বিশ্বাসজনিতই হোক অথবা একই যুগে একই এলাকা বা দেশের অধিবাসী হওয়ার দরুনই হোক অথবা অন্য কোন অঞ্চলের বংশ, বর্ণ ও ভাষার সমতার কারণেই হোক, তাতে কিছুই আসে যায় না।


‘কোন এককালে সকল মানুষ পরস্পর একতাবদ্ধ ছিল। এতে দু’টি কথা প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত ’একতা’ বলতে কোন ধরনের একতাকে বোঝানো হয়েছে ? দ্বিতীয়ত এই একতা কখন ছিল? প্রথম বিষয়ের মীমাংসা এ আয়াতের শেষ বাক্যটির দ্বারা হয়ে যায়। এতে একতার মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ার এবং বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে হক ও সত্য মতবাদ নির্ধারণের ব্যাপারে নবী ও রাসূল প্রেরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, এ মতাদর্শের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য নবী ও রাসূলগণের প্রেরণ এবং আসমানী কিতাব অবতরণ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, সে মতবিরোধ বংশ, ভাষা, বর্ণ বা অঞ্চল অথবা যুগের মতানৈক্য ছিল না, বরং মতাদর্শ, আকায়েদ ও ধ্যান-ধারণার পার্থক্য ছিল। এতেই বোঝা যায় যে, এ আয়াতে একত্ব বলতে ধ্যান-ধারণা, চিন্তা এবং আকীদার একত্বকেই বোঝানো হয়েছে।

সুতরাং এ আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় যে, এমন এক সময় ছিল, যখন প্রতিটি মানুষ একই মত ও আদর্শ এবং একই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রশ্ন উঠে, সে মত ও বিশ্বাসটি কি ছিল ? এতে দু’টি সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল। (১) হয় তখনকার সব মানুষই তওহীদ ও ঈমানের বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ ছিল। নতুবা (২) সবাই মিথ্যা ও কুফরীতে ঐক্যবদ্ধ ছিল। অধিকাংশ তফসীরকারের সমর্থিত মত হচ্ছে যে, সে আকীদাটি ছিল সঠিক ও যথার্থতাভিত্তিক অর্থাৎ তওহীদ ও ঈমানের উপর ঐকমত্য। এ মর্মে সূরা ইউনুসের এক আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَمَا كَانَ النَّاسُ إِلَّا أُمَّةً وَاحِدَةً فَاخْتَلَفُوا وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِنْ رَبِّكَ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ فِيمَا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ

অর্থাৎ সকল মানুষ একই উম্মত ছিল। তারপর তাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়ে যায়। যদি আল্লাহ্ তা’আলার এটাই স্থায়ী সিদ্ধান্ত হতো ( যে এ জগতে সত্য ও মিথ্যা একত্রিত হয়ে চলবে, তবে) এসব বিবাদের এমন মীমাংসা তিনিই করে দিতেন, যাতে মতানৈক্যকারীদের নাম-নিশানাই বিলুপ্ত হয়ে যেত। 

সূরা আম্বিয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ

إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ

“তোমাদের এই জাতি একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত এবং আমি তোমাদের পালনকর্তা, এজন্য তোমরা সবাই আমারই ইবাদত কর।" 

সূরা মু’মিনে ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَإِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ

“তোমাদের এই জাতি একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত এবং আমি তোমাদের পালনকর্তা ; কাজেই তোমরা আমাকেই ভয় কর।" 

এ আয়াতগুলোর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, ‘একত্ব’ শব্দটি দ্বারা আকীদা ও তরীকার একত্ব এবং সত্য-ধর্ম, আল্লাহর একত্ববাদ ও ঈমানের ব্যাপারে ঐকমত্যের কথাই বলা হয়েছে।

এখন দেখতে হবে, এ সত্য দীন ও ঈমানের উপর সমস্ত মানুষের ঐকমত্য কোন্ যুগে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তা কোন্ যুগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল ? তফসীরকার সাহাবীগণের মধ্যে হযরত উবাই ইবনে কা’আব এবং ইবনে যায়েদ (রা) বলেছেন যে, এ ঘটনাটি ’আলমে-আযল’ বা আত্মার জগতের ব্যাপার। অর্থাৎ সমস্ত মানুষের আত্মাকে সৃষ্টি করে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ (আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই ?) তখন একবাক্যে সব আত্মাই উত্তর দিয়েছিল, নিশ্চয়ই আপনি আমাদের পালনকর্তা। সে সময় সকল মানুষ একই আকীদাতে বিশ্বাসী ছিল, যাকে ঈমান ও ইসলাম বলা হয়। –(কুরতুবী)

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন যে, এই একত্বের বিশ্বাস তখনকার যখন হযরত আদম (আ) সস্ত্রীক দুনিয়াতে আগমন করলেন এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততি জন্মাতে আরম্ভ করল আর মানবগোষ্ঠী বুদ্ধিপ্রাপ্ত হতে শুরু করলো। তাঁরা সবাই হযরত আদম (আ)-এর ধর্ম, তাঁর শিক্ষা ও শরীয়তের অনুগত ছিল। একমাত্র কাবীল ছাড়া সবাই তওহীদের সমর্থক ছিলেন।

‘মসনাদে বাযযার’ গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাসের উদ্ধৃতির সাথে সাথে একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, একত্বের ধারণা হযরত আদম (আ) হতে আরম্ভ হয়ে হযরত ইদ্রিস (আ) পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। সে সময় সবাই মুসলমান এবং একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এতদুভয় নবীর মধ্যবর্তী সময় হলো দশ ’করন’। বাহ্যত এক ’করন’ দ্বারা এক শতাব্দী বোঝা যায়। সুতরাং মোট সময় ছিল এক হাজার বছর।

কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে, এই একক বিশ্বাসের যুগ ছিল হযরত নূহ (আ)-এর তুফান পর্যন্ত। নূহ (আ)-এর সাথে যারা নৌকায় আরোহণ করেছিলেন, তারা ব্যতীত সমগ্র বিশ্ববাসী এতে ডুবে মরেছিল। তুফান বন্ধ হওয়ার পর যারা জীবিত ছিলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন মুসলমান; সত্য ধর্ম ও একত্ববাদে বিশ্বাসী।

বাস্তব পক্ষে এ তিনটি মতামতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। তিনটি যুগই এমন ছিল, যেগুলোতে সমস্ত মানুষ একই মতবাদ ও একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সত্য ধর্মের ওপর কায়েম ছিল। এ আয়াতের দ্বিতীয় বাক্যে ইরশাদ হয়েছেঃ

فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ

অর্থাৎ অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা নবীগণকে প্রেরণ করলেন যারা সুসংবাদ শোনাতেন এবং ভীতি প্রদর্শন করতেন। আর তাদের নিকট যথাযথভাবেই আসমানী কিতাব নাযিল করা হয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক মানুষের মতানৈক্যের বিষয়সমূহের মীমাংসা দান করা। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আলোচ্য বাক্যটিতে সমস্ত মানব জাতিকে একই মত ও ধর্মের অনুসারী বলে উল্লেখ করার পর মতবিরোধের কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-“আমি নবী-রাসূলগণ ও কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছি, যাতে মতবিরোধের মীমাংসা করা যায়।” 

এ দু’টি বাক্যে আপাতদৃষ্টিতে গরমিল মনে হয়। কারণ, নবীগণ এবং কিতাবসমূহ প্রেরণের কারণ ছিল মানুষের মতানৈক্য। পক্ষান্তরে সে সময় কোন মতপার্থক্য ছিলই না।

অবশ্য এর অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার। মূলত আয়াতটির অর্থ হচ্ছে এই যে, প্রথমে সমস্ত মানুষ একই বিশ্বাসী ছিল, কিন্তু ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ার দরুনই নবী ও কিতাব প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দেয়। এখানে আরো একটি বিষয় ব্যাখ্যাসাপেক্ষ যে আয়াতে একই উম্মত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু মতানৈক্য সৃষ্টির কোন কারণ বলা হয়নি। যারা কোরআনের বর্ণনাভঙ্গি সম্পর্কে একটু চিন্তা করেন, তাদের জন্য এর মর্ম উপলব্ধি করা মোটেই কঠিন নয়। কারণ, কোরআন কখনও অতীতের বর্ণনা দিতে গিয়ে গল্প, কাহিনী এবং ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে উল্লিখিত যাবতীয় কাহিনীরই অবতারণা করেনি। বরং মধ্য থেকে সেসব অংশ বাদ দিয়ে দিয়েছে, যা এই কালামের প্রেক্ষাপটের দ্বারা বোঝা যায়। যেমন ইউসুফ (আ)-এর কাহিনীতে উল্লিখিত হয়েছে যে, যে কয়েদি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিল সে বাদশাহর স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার উদ্দেশ্যে বাদশাহ্‌কে বলেছিল যে, আমাকে ইউসুফের নিকট প্রেরণ করুন। কোরআন এ কয়েদির কথা উল্লেখ করার পর পুনরায় আলোচনা আরম্ভ করেছে يُوسُفُ أَيُّهَا الصِّدِّيقُ অর্থাৎ বলুন, হে সত্যবাদী ইউসুফ ! কিন্তু একথা বর্ণনা করেনি যে, হযরত ইউসুফের ব্যাখ্যা বাদশাহর পছন্দ হয়েছে এবং তাকে জেলখানায় হযরত ইউসুফ (আ)-এর নিকট প্রেরণ করেছে এবং সে সেখানে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছে। কেননা, অগ্র-পশ্চাতের বাক্যদ্বয়ে এসব কথা এমনিতেই বোঝা যায়। সুতরাং একত্বের কথা বলার পরে এখানে মতানৈক্যের কথা বলার কোন প্রয়োজনই মনে করা হয়নি। তার কারণ হচ্ছে যে, মতানৈক্যর বিষয় তো বিশ্ববাসী এমনিতেই জানে; সব সময়ই দেখা যায়। বরং প্রয়োজন হচ্ছে একথা জানা যে, মতানৈক্যর পূর্বে এমন এক যুগ ছিল, যাতে সব মানুষ একই উম্মত একই মতাদর্শের অনুসারী ছিল। ফলে তা-ই বর্ননা করা হয়েছে। অতঃপর যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে তা বিশ্ববাসী স্বচক্ষে দেখেছে। তাই এর পুনরালোচনা ছিল নিষ্প্রয়োজন। তবে এতটুকু বলা হয়েছে যে, এসব মতানৈক্যের মীমাংসা করার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা কি ব্যবস্থা করেছেন। ইরশাদ হয়েছেঃ

فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ

অর্থাৎ “আল্লাহ্ তা’আলা নবীগণকে প্রেরণ করলেন।” তাঁরা সত্য ধর্মের অনুসারীদেরকে স্থায়ী আরাম ও সুখ-শান্তির সুসংবাদ দিতেন আর তা থেকে যারা বিমুখ হয়েছিল, তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির ভয় দেখাতেন। আর তাদের নিকট ওহী ও আসমানী গ্রন্থ অবতীর্ণ করলেন, যা বিভিন্ন মতাদর্শের নিরসন করে সত্য ও সঠিক মতাদর্শ জানিয়ে দেয়। অতঃপর ইরশাদ হয়েছে, নবী-রাসূল এবং আসমানী গ্রন্থের মাধ্যমে প্রকাশ্য ও অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করার পরেও বিশ্ববাসী দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। কিছু লোক এ হেদায়েতকে গ্রহণ করেনি। আরো আশ্চর্যের বিষয় যে, যাদের কাছে নবীগণ ও দলীলসমূহ এসেছে, তাদেরই একদল তা অগ্রাহ্য করেছে; অর্থাৎ ইহুদী ও নাসারাগণ। আরো বিস্ময়কর বিষয়, আসমানী কিতাবে কোন সন্দেহ-সংশয়ের আশংকা ছিল না যে, তা বোঝা যায় না বা বুঝতে ভুল হয়। বরং প্রকৃতপক্ষে জেনে-বুঝেও শুধু গোঁড়ামি ও জেদবশত তারা এসবের বিরুদ্ধাচরণ করেছে।

দ্বিতীয় দল হচ্ছে তাদের, যারা আল্লাহর দেয়া হেদায়েতকে গ্রহণ করেছে এবং নবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবসমূহের মীমাংসাকে সর্বান্তকরণে মেনে নিয়েছে। এই দু’দলের কথাই কোরআনের সূরা ’তাগাবুন’-এর এক আয়াতে এভাবে ইরশাদ হয়েছেঃ خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কিছু কাফির আর কিছু মু’মিন হয়েছে।

كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً

এর সারমর্ম হচ্ছে এই যে, প্রথমে বিশ্বের সমস্ত মানুষ সত্য ও সঠিক ধর্মের মধ্যে ছিল। অতঃপর মতের পার্থক্য ও উদ্দেশ্যের বিভিন্নতার দরুন মতানৈক্য আরম্ভ হয়। দীর্ঘদিন পর আমল ও বিশ্বাসের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হতে থাকে, এমনকি সত্য-মিথ্যার মধ্যেও সংমিশ্রণ আরম্ভ হয়। সবাইকে সঠিক ধর্মের ওপর পুনর্বহাল করার জন্য প্রকাশ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ তা মেনে নিয়েছে আবার কেউ কেউ জেদবশত অস্বীকার করেছে এবং বিপরীত পথ অবলম্বন করেছে।

নবী-রাসুল ও কিতাব প্রেরণের উদ্দেশ্য

মাস’আলাঃ এ আয়াতের দ্বারা কয়েকটি বিষয় জানা যায়। প্রথমত এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা যে অসংখ্য নবী-রাসূল ও আসমানী কিতাব প্রেরণ করেছেন, তার উদ্দেশ্য ছিল ‘মিল্লাতে-ওয়াহেদা’ ত্যাগ করে যে মানব সমাজ বিভিন্ন দল ও ফেরকাতে বিভক্ত হয়েছে, তাদেরকে পুনরায় পূর্ববর্তী ধর্মের আওতায় ফিরিয়ে আনা। নবীগণের আগমনের ধারাটিও এভাবেই চলেছে। যখনই মানুষ সৎপথ থেকে দূরে সরে থেকেছে, তখনই হেদায়েতের জন্য আল্লাহ্ তা’আলা কোন না কোন নবী প্রেরণ করেছেন এবং কিতাব নাযিল করেছেন, যেন তাঁর অনুসরণ করা হয়। আবার যখন তারা পথ হারিয়েছে, তখন অন্য আর একজন নবী পাঠিয়েছেন এবং কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। এর উদাহরণ হচ্ছে এই যে, শারীরিক সুস্থতা একটি আর রোগ অসংখ্য । কখনও একটি রোগ দেখা দিলে সে রোগের ঔষধ ও পথ্য নির্ধারণ করা হয়, অতঃপর আর একটি রোগ দেখা দিলে সে রোগের ঔষধ ও পথ্য নির্ধারণ করা হয়। সবশেষে এমন এক ব্যবস্থা দেওয়া হয়, যাতে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত রোগ হতে নিরাপদ থাকা যায়। এ ব্যবস্থাটি স্থায়ী বা চিকিৎসা জগতে পূর্ববর্তী সমস্ত ব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত এবং পরবর্তী কালের জন্য নিশ্চিন্ত করে দেয়। তা-ই হচ্ছে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা, যার জন্য শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে এবং শেষ কিতাব কোরআন পাঠানো হয়েছে।

আর যেহেতু পূর্ববর্তী কিতাবগুলোতে পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মাধ্যমে সেসব নবী-রাসূলের শিক্ষাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল বলেই আরো নবী-রাসূল এবং কিতাব প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, সেহেতু কোরআনকে পরিবর্তন হতে হেফাজতে রাখার দায়িত্ব আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং গ্রহণ করেছেন এবং কোরআনের শিক্ষাকে কিয়ামত পর্যন্ত এর প্রকৃতরূপে বহাল রাখার জন্য উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্য হতে এমন এক দলকে সঠিক পথে কায়েম রাখার ওয়াদা করেছেন, যে সব দল সব সময় সত্য ধর্মে অটল থেকে মুসলমানদের মধ্যে কোরআন ও সুন্নাহর সঠিক শিক্ষা প্রচার ও প্রসার করতে থাকবে। কারো শত্রুতা বা বিরোধিতা তাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। এজন্যই তাঁর পরে নবুয়ত ও ওহীর দ্বার বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী বিষয়। এ বাস্তবতার প্রেক্ষিতেই সর্বোপরি খমে-নবুয়ত ঘোষণা করা হয়েছে।

সারকথা এই যে, বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন নবী ও রসূল এবং তাঁদের উপর বিভিন্ন কিতাব অবতীর্ণ করার ফলে কেউ যেন এমন ধোঁকায় না পড়ে যে, নবী এবং কিতাব প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করা। বরং বারবার নবী ও কিতাব প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল যেভাবে প্রথম মানুষ একই সত্য ধর্মের অনুসারী হয়ে একই জাতিভুক্ত ছিল, তেমনিভাবে যেন আবার সবাই সত্য ধর্মে একত্রিত হয়ে যায়।

মুসলমান ও অমুসলমান- পৃথিবীতে দুটিই জাতি

মাসা’আলাঃ দ্বিতীয়ত বোঝা গেল যে, ধর্মের ভিত্তিতেই জাতীয়তা নির্ধারিত হয়। মুসলমান ও অমুসলমানকে দু’টি জাতিতে চিহ্নিত করাই এর উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ আয়াতটিও একটি প্রমাণ। এতদসঙ্গে একথাও পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল যে, ইসলামের মধ্যে এ দু’টি জাতীয়তা সৃষ্টির ব্যবস্থাও একটি একক জাতীয়তা সৃষ্টি করার জন্যই যা সৃষ্টির আদিতে ছিল। যার বুনিয়াদ দেশ ও ভৌগোলিক সীমার সঙ্গে সংযুক্ত , বরং একক বিশ্বাস ও একক ধর্মের অনুসরণের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইরশাদ হয়েছেঃ كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً সৃষ্টির আদিতে সঠিক বিশ্বাস এবং সত্যধর্মের অনুসারীরূপে একক জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু পরে মানুষ বিভেদ সৃষ্টি করেছে। নবীগণ মানুষকে এ প্রকৃত একক জাতীয়তার দিকে আহবান করেছেন। যারা তাঁদের এ আহবানে সাড়া দেয়নি, তারা এই জাতীয়তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং স্বতন্ত্র জাতি গঠন করেছে।

বিপদাপদে ধৈর্যধারণের উপদেশ

মাস’আলাঃ এ আয়াতের দ্বারা একথাও বোঝা গেল যে, মন্দ লোকেরা প্রেরিত নবীগণের এবং আল্লাহর কিতাবের বিরুদ্ধাচরণ করাকে পছন্দ করেছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। সুতরাং ঈমানদারদের পক্ষে তাদের এহেন দুরাচারের জন্য মনোকষ্ট নেওয়া উচিত নয়। যেভাবে কাফিররা তাদের পূর্বপুরুষদের পথ অবলম্বন করে নবীগণের বিরুদ্ধাচরণের পথ ধরেছে, তেমনিভাবে মু’মিন ও সালেহীনগণের উচিত নবীগণের শিক্ষা অনুসরণ করা, তাঁদের অনুসরণে বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করা এবং যুক্তিগ্রাহ্য মনোমুগ্ধকর ওয়াজ এবং নম্রতার মাধ্যমে বিরুদ্ধবাদীদেরকে সত্য ধর্মের প্রতি আহ্বান করতে থাকা। আর সে জন্যই মুসলমানগণকে পূর্ববর্তী আয়াতে বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে।





**************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url