আল আকসার ইতিকথা-৬ | দাউদ (আঃ) এর যুগে আল আকসা | সুলাইমান (আঃ) এর যুগে আল আকসা

আল আকসা মসজিদের ইতিকথা শীর্ষক এই প্রবন্ধগুলো এ এন এম সিরাজুল ইসলামের লেখা “আল আকসা মসজিদের ইতিকথা” গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। সুন্দর তথ্যবহুল এই গ্রন্থটি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত।

হযরত দাউদ (আঃ) এর যুগে আল আকসা


হযরত দাউদ (আঃ) খৃস্টপূর্ব ৯৭৭ সালে জেরুজালেম শহর জয় করে সেখানে সিন্ধুক নিয়ে যান। তাতে হযরত মূসা ও হারুন (আঃ)-এর নিদর্শন ছিল । তিনি আল্লাহর নির্দেশে জেরুজালেম শহরে পবিত্র ইবাদতের স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য একটি প্রশস্ত জায়গা প্রস্তুত করেন এবং নির্মাণ কাজের জন্য সকল প্রয়োজনীয় জিনিস মওজুদ করেন। কিন্তু একজন ইয়াতীমের সম্পত্তি মসজিদের স্থানে অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছার কারণে আল্লাহ তাঁকে মসজিদ নির্মাণ করতে নিষেধ করেন। কেননা, অবৈধ সম্পত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ইবাদতখানায় আল্লাহর পবিত্র ইবাদত করা যায় না।২৫ তারপর দাউদ প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে দিয়ে তা নির্মাণ করাও। আল্লাহ বলেন, ঠিক আছে, তোমার সন্তানই তা তৈরি করবে। হযরত দাউদ (আঃ) সাহইউন পাহাড়ে নিজ দফতর স্থাপন করেন এবং সেখানে একটি দুর্গ তৈরি করেন। জেরুজালেমে রাজধানী স্থাপনের আগে ৭ বছর পর্যন্ত, আল-খলীল ছিল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী ।

হযরত সুলাইমান (আঃ) এর যুগে আল আকসা


সুলাইমান (আঃ) জেরুজালেমে জন্মগ্রহণ করেন। বাপের ইন্তিকালের পর তিনি জেরুজালেমের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনকাল ছিল খৃস্টপূর্ব ৯৬৩-৯২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৪০ বছর। তাঁর আমলে জেরুজালেমে বাণিজ্য ও শিল্প প্রকল্প জোরদার হয়। আরাবাহ উপত্যকার খনি থেকে লোহা ও তামা উত্তোলনের ফলে রাষ্ট্রের আয় অনেক বৃদ্ধি পায়। কুরআনের তাফসীরকারগণ বলেছেন, তিনি ক্ষমতার মসনদ থেকে ৪০ দিন অনুপস্থিত থাকার পর পুনরায় ফিরে আসেন। তাঁকে আল্লাহ এমন বিশাল বাদশাহী দিয়েছিলেন যা তাঁর পরে আর কাউকে দেয়া হয়নি।

তিনি মা'বাদে সুলাইমান তৈরির উদ্যোগ নেন। অর্থাৎ তাঁর তৈরি ইবাদতগাহকে তাঁর নামের সাথে যুক্ত করে মা'বাদে সুলাইমান বলা হয়। এর অপর নাম হচ্ছে হাইকালে সুলাইমানী। এটাকেই কুরআন মসজিদে আকসা বলে উল্লেখ করেছে। এই মসজিদ নির্মাণে ৩০ হাজার শ্রমিকের ৭ বছর সময় লেগেছিল। তিনি খুবই সুন্দর ডিজাইনে মসজিদটি তৈরি করেন। ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, ‘হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর যুগেই মসজিদে আকসা তৈরি হয়েছিল, তবে হযরত সুলাইমান (আঃ) তাকে বড় ও মজবুত করে তৈরি করেন। ২৬

সুলাইমন (আঃ) এর পরবর্তী যুগে আল আকসা


হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর পরে তাঁর সাম্রাজ্য দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি হচ্ছে দক্ষিণ সাম্রাজ্য। এর অপর নাম হচ্ছে 'ইহুজা' বা ইয়াহুদা । রাজধানী জেরুজালেম। সম্ভবতঃ পরবর্তীতে ইহুদী নামকরণের সাথে ঐ ইয়াহুদা নামের সম্পর্ক রয়েছে। হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর ছেলে রাহাবআম হচ্ছেন ইয়াহুদা রাজ্যের রাজা।

২য়টি হচ্ছে, উত্তর সাম্রাজ্য। এর অপর নাম ইসরাইল এবং রাজধানী হচ্ছে নাবলুস কিংবা শাকীম। এই সাম্রাজ্যের রাজা হলেন সুলাইমান (আঃ)-এর প্রধান সেনাপতি ইউরিআম। উত্তর সাম্রাজ্য অর্থাৎ ইসরাইল দক্ষিণ সাম্রাজ্য তথা ইয়াহুদা থেকে অপেক্ষাকৃত বড় ছিল এবং অধিকাংশ ইহুদী বংশ ইসরাইলেই বাস করত।

ইসরাইল ও ইয়াহুদা সাম্রাজ্যের অবসান এবং মা’বাদে সুলাইমান ধ্বংস


ইসরাইল ও ইয়াহুদার মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় খৃস্টপূর্ব ৯৭০ সালে মিসরের ফেরআউন শাইশাক জেরুজালেমসহ ইয়াহুদা সাম্রাজ্য দখল করে। ফেরাউন মা'বাদে সুলাইমানীতে সংরক্ষিত মূল্যবান জিনিসপত্র এই বলে আত্মসাত কর যে, এগুলো হযরত সুলাইমানের মিসরীয় স্ত্রী তথা রাণীর সম্পত্তি।

খৃস্টপূর্ব ৭২১ সালে আশুরীয় বাদশাহ সারজন ইসরাইল দখল করে সর্বশেষ ইসরাইলী রাজাকে আটক করে, রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে তাড়িয়ে দেয় এবং সেখানে নিজের গভর্নর নিযুক্ত করে। পরে মিসরের ফেরআউন শাইশাক মাশুরীয় বাদশাহর কবল থেকে ইসরাইল দখল করে।

এই সকল রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ফলে ব্যাবিলনের বাদশাহ বখতেনসর উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কেননা, দাজলা উপত্যকার আশুরীয় শাসক ব্যাবিলনের রাজার প্রভাব বলয়ে ছিলেন। তিনি মিসরীয় ফেরআউনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে ইয়াহুদা ও ইসরাইল দখল করেন এবং মিসরের ফেরআউন শাইশাককে পরাজিত করেন। তিনি খৃস্টপূর্ব ৫৮৭ সালে মসজিদে আকসা ধ্বংস করেন। বহু বনি ইসরাইলকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যান। কিছুসংখ্যক বনি ইসরাইল মিসরসহ অন্যান্য দেশের দিকে পালিয়ে যায়। ইতিহাসে এটাকে 'ব্যালিবনের বন্দী' যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোরআন মজীদে এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে।

وقَضَيْنَا إِلى بَنِي إِسْرَائِيلَ فِى الكِتَابِ لَتُفْسِدُنَّ فِي الْأَرْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَ عُلُوا كَبِيرًا ، فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ أَوْلاهُمَا بَعَثْنَا عَلَيْكُمْ عِبَادًا لَّنَا أُولِي بَأْسٍ شَدِيدِ فَجَاسُوا خِلالَ الدِّيَارِ وَ كَانَ وَعْدًا مَفْعُولاً

অর্থ : “আমরা কিতাবের মধ্যে বনি ইসরাইলকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, তোমরা যমীনে দুইবার বিশৃংখলা ও ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং বড় ধরনের বাড়াবাড়ি করবে। যখন ঐ দুই ফেতনার প্রথমটার সময়-কাল উপস্থিত হবে তখন আমরা তোমাদের উপর আমাদের এমন জঙ্গী শক্তিশালী লোককে বিজয়ী করবো, যারা তোমাদের ঘরে ঢুকে পড়বে। এটা এমন এক ওয়াদা ও ভবিষ্যদ্বাণী যা অবশ্যই সংঘটিত হবে।” (সূরা ইসরা : ৪-৫)

১০. বন্দীদের প্রত্যাবর্তন ও মসজিদে আকসা পুনঃ নির্মাণ ব্যাবিলনের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয়। কেননা, পারস্য সম্রাট কাওরাস এখমিনী যুদ্ধের মাধ্যমে ব্যাবিলন দখল করে নেন। ফলে ইয়াহুদা এবং ইসরাইল তার দখলে চলে আসে। কাওরাস বন্দীদেরকে ইয়াহুদায় পুনঃ ফেরত পাঠান এবং তাদের ইহুদী ধর্ম পালনের সুযোগ দেন। তখন থেকে 'ইহুদী' শব্দের অর্থ দাঁড়ায়, ইহুদী ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তি। সেজন্য বনি ইসরাইল হওয়া জরুরী নয়। ইহুদীরা ব্যাবিলন থেকে ফিরে আসার পর জেরুজালেম শহর এবং হাইকালে সুলাইমানী পুনঃনির্মাণ করে। কিন্তু জেরুজালেমে তাদের অবস্থা হল দেশবিহীন জাতির অবস্থা। কেননা, জেরুজালেম পারস্য সম্রাটের অধীন ছিল। যাই হোক, তখন ৪২ হাজার বনি ইসরাইল, আরো ৭ হাজার শিশু ও কুমারী মেয়ে সহকারে জেরুজালেম ফিরে আসে।

জেরুজালেমে গ্ৰীক আক্রমণ

খৃস্টপূর্ব ৩২২ সালে মূর্তিপূজারী গ্রীকরা বাইতুল মাকদিস দখল করে। গ্রীক শাসক আলেকজান্ডার মাকদুনীর আদেশে ঐ আক্রমণ পরিচালিত হয়। তারা জেরুজালেমে পারস্য শাসনের অবসান করে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাইতুল মাকদিসে কর্তৃত্ব করে। এরপর জেরুজালেমে বাতালিসা শাসনের সূচনা হয় এবং রোমান শাসনের আগ পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকে ।

রোমানদের বাইতুল মাকদিস আক্রমণ

খৃস্টপূর্ব ২৩ সালে রোমান শাসক হিরোদ (Herod) জেরুজালেম দখল করেন । ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি অবস্থা স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেন। তিনি ইহুদীদের সাথে সমঝোতায় পৌঁছেন এবং খৃস্টপূর্ব ২০-১৮ সালে হাইকালে সুলাইমানী পুনঃনির্মাণ করার সুযোগ দেন। পরবর্তীতে হাইকালটি হযরত যাকারিয়া, তাঁর ছেলে হযরত ইয়াহইয়া এবং ঈসা বিন মরিয়ম পর্যন্ত ঐভাবেই বিদ্যমান ছিল।

তথ্যসূত্রঃ
২৫. অফা আল-আফা-নূরুদ্দিন সামহুদী।
২৬. মাজমাউল ফাতাওয়া ১৭শ' খণ্ড, ৩৫১ পৃঃ


💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url