আল আকসার ইতিকথা-৭ | হযরত যাকারিয়া, ইয়াহইয়া এবং হযরত ঈসা (আঃ) এর যুগে মসজিদে আকসা
আল আকসা মসজিদের ইতিকথা শীর্ষক এই প্রবন্ধগুলো এ এন এম সিরাজুল ইসলামের লেখা “আল আকসা মসজিদের ইতিকথা” গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। সুন্দর তথ্যবহুল এই গ্রন্থটি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত।
হযরত যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (আঃ) এর যুগে মসজিদে আকসা
যাকারিয়া (আঃ) এর আমলে মসজিদে আকসা বর্তমান ছিল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, যখন ইমরানের স্ত্রী আল্লাহর কাছে একটি নেক সন্তান কামনা করে তাকে মসজিদে আকসার সেবার জন্য দান করার নিয়ত করেন, তখন আল্লাহ তাকে মরিয়ম নামক একটি মেয়ে সন্তান দান করেন। মরিয়মকে মসজিদে আকসায় দিয়ে দেয়া হয় এবং তিনি তাঁর নিকটাত্মীয় নিঃসন্তান হযরত যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠেন। হযরত যাকারিয়া (আঃ) ছিলেন হাইকালের প্রধান। তিনি শিশু মরিয়মের জন্মে আশাবাদী হয়ে মসজিদে আকসার মেহরাবে নিজের জন্য আল্লাহর কাছে একটি নেক সন্তানের দোয়া জানান। কঠোর বার্ধক্যে আল্লাহ তাঁকে একটি ছেলে সন্তান দান করেন। তাঁর নাম হচ্ছে ইয়াহইয়া (আঃ)। হযরত ইয়াহইয়া নবী ছিলেন।
ইহুদীরা হযরত যাকারিয়াকে (আঃ) করাত দিয়ে চিরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে । তারপর তারা হযরত ইয়াহইয়াকে (আঃ)ও হত্যা করেন ।
হযরত ঈসা (আঃ) এর যুগে মসজিদে আকসা
কুমারী মরিয়মের ঘরে হযরত ঈসা (আঃ)-এর জন্ম হয়। যৌবনে পদার্পণ করার পর তিনি মসজিদে আকসাকে দাওয়াহ কেন্দ্র বানান। তাঁর সময় বনি ইসরাইল অগণিত অপরাধ করে। এমনকি, তারা মসজিদে আকসার পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করে এবং একে সুদখোরদের বাজার ও খেল-তামাশার কেন্দ্রে পরিণত করে। ঈসা (আঃ) তাদেরকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, তারা যদি এইভাবে নিজেদের অন্যায় ও অপরাধ অব্যাহত রাখে এবং মসজিদে আকসার পবিত্রতা নষ্ট করতে থাকে, তাহলে তাদেরকে এই মসজিদ থেকে বহিষ্কৃত করা হবে। তিনি বলেন, আল্লাহ এই মহান ইবাদতের স্থানটি ধ্বংস করে দেবেন এবং এর নাম-নিশানা পর্যন্ত মিটিয়ে দেবেন। খৃস্টানরা এটাকে গীর্জা হিসেবে ব্যবহার করে।
২য় দফা মসজিদে আকসার ইবাদতগাহের ধ্বংস
হযরত যাকারিয়া এবং ইয়াহইয়া (আঃ) এই দুইজন নবীকে হত্যা করার পর বনি ইসরাইল ঈসা (আঃ)-কেও হত্যার উদ্যোগ নেয়। তখন আল্লাহ রোমান সম্রাট তাইতুসকে বনি ইসরাইলের উপর বিজয় দান করেন। ৬৬ খৃস্টাব্দে রোমান বাহিনীর সাথে বনি ইসরাইলের সংঘর্ষ শুরু হয় এবং তা দীর্ঘ ৫ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তখন ইহুদীদেরকে ব্যাপকহারে হত্যা করা হয়। ৭০ খৃষ্টাব্দে রোমান বাহীন জেরুজালেম শহরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং অজস্র ইহুদীকে দাস বানিয়ে নিয়ে যায়। জেরুজালেম শহর ধ্বংস্তূপে পরিণত হয় এবং কিছু সংখ্যক ইহুদী মিসর ও সিরিয়া পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
তাইতুস জেরুজালেম শহরের নাম পরিবর্তন করে ‘ঈলিয়া' রাখেন। পরে সম্রাট কনস্ট্যানটাইন খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করে শহরের জেরুজালেম নাম পুনর্বহাল করেন। তখন হযরত ঈসা (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী পুরো সত্য প্রমাণিত হয় এবং জেরুজালেম শহর ও মসজিদে আকসা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। বখতে নসরের পর ২য় দফা মসজিদে আকসার বিনাশ সাধন করা হয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন : “তারপর ২য় বারের প্রতিশ্রুতির
সময় উপস্থিত হলে আমরা তোমাদের উপর অন্য লোকদেরকে বিজয়ী করবো, যেন তারা তোমাদেরকে মেরে চেহারা পরিবর্তন করে দেয়, প্রথমবারের মত তারাও যেন মসজিদে আকসায় প্রবেশ করে এবং বিজিত লোকদের সবকিছু ধ্বংস করে দেয়া।' (সূরা ইসরা ৪-৫)
আয়াতে বর্ণিত ২য় বারের প্রতিশ্রুতি হচ্ছে হযরত ঈসা (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আকসা ও জেরুজালেমের ধ্বংস সাধন
মসজিদে আকসার স্থানে মন্দির নির্মাণ
৭০ খৃস্টাব্দে তাইতুস কর্তৃক মসজিদে আকসা ধ্বংস হওয়ার পর আদরিয়াস নামক আরেক রোমান শাসকের আগমন ঘটে। তিনি জেরুজালেম শহরের সকল চিহ্ন এবং মসজিদে আকসার হাইকালের সকল ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলেন। ১৩৫ খস্টাব্দে তিনি মসজিদের স্থানে প্রতিমা পূজার জন্য মন্দির তৈরি করেন। মূর্তিপূজারী রোমানদের ঈশ্বর প্রভু 'গোয়েবতারে'র নামানুসারে এর নামকরণ করেন। দেবতা পূজার নামে তারা সেখানে কি শুরু করে ।
গোয়েবতার মন্দির বিধ্বংস
রোমানগণ খৃস্টধর্মকে স্বীকৃতি না দিয়েই ‘গোয়েবতার' নামক মন্দির তৈরি করে। ফিলিস্তিনে খৃস্টধর্ম প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকে। খৃষ্টস্টন ধর্ম প্রতিষ্ঠার পর মন্দিরটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। সম্রাট কনস্টান্টস্ট্যাইন মন্দির ধ্বংসের পর সেখানে খৃস্টান ধর্মের বিকৃতি সাধন করে ত্রিত্ববাদ চালু করেন। ফলে, মসজিদে আকসা থেকে এক আল্লাহর ইবাদতের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় এবং শিরকী ত্রিত্ববাদের চর্চা চলতে থাকে ।
জেরুজালেমে খৃস্টান গণহত্যা
৬১০ খৃস্টাব্দে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যে খৃস্টান সম্রাট হিরাক্লিয়াস ক্ষমতায় আসেন। সেই সময় পারস্য সম্রাট ২য় খসরু খৃষ্টান শাসকদের কাছ থেকে সিরিয়া দখল করেন এবং ৬১৪ খৃস্টাব্দে জেরুজালেমে পৌঁছে তাও জয় করেন । তখন তিনি ‘কেয়ামহা’ গীর্জাসহ খৃস্টানদের সকল গীর্জা ধ্বংস করেন এবং জেরুজালেম শহরের ৯০ হাজার খৃস্টানকে হত্যা করেন। এতে করে খৃস্টানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দুর্বল হয়ে আসে।
কিন্তু, পরে হিরাক্লিয়াস দখলদার পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেন এবং ৬২৯ খৃস্টাব্দে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন ।
এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেছেন :
الم غُلِبَتِ الرُّومُ فِي أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُمْ مِنْ بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ فِي بضع سنين .
অর্থ : 'নিকটবর্তী যমীনে রোম বাহিনী পরাজিত হয়েছে এবং অল্প কয়েক বছরের মধ্যে তারা আবার জয়লাভ করবে।' (সূরা রূম-১)
হিরাক্লিয়াস জেরুজালেম থেকে পারস্য বাহিনী কর্তৃক ছিনিয়ে নেয়া ক্রুশসহ পুনরায় শহরে প্রবেশ করেন। তাঁর সাথে ফিলিস্তিন বিজয়ী বিরাট বাহিনীও আনন্দ সহকারে জেরুজালেম শহরে প্রবেশ করে ।
জেরুজালেমে ইহুদীবাদ ও খৃস্টবাদের অবসান
হিরাক্লিয়াসের এই খুশীক্ষণে একজন আরব মুসলিম গিয়ে তাঁর কাছে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি হস্তান্তর করেন । চিঠিতে বলা হয়, চিঠিটি মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহর কাছ থেকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। হে হিরাক্লিয়াস! আমি তোমাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। তুমি ইসলাম গ্রহণ কর, আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ সওয়াব দান করবেন। নতুবা প্রজাসাধারণের সকল গুনাহর দায়-দায়িত্ব তোমার উপর অর্পিত হবে। হে আহলে কিতাব! এমন একটি কালেমার বিষয়ে একমত হও, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। আর সেটি হচ্ছে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারুর ইবাদাত করবো না। তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করবো না এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে প্রতিপালক মানবো না ।
হিরাক্লিয়াস ইসলাম কবুল করার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু দরবারের লোকদের বিরোধিতার কারণে শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করতে পারেননি। (বুখারী) মদীনায় হিজরাতের সামান্য আগে মসজিদে আকসায় মে'রাজের মাধ্যমে সেখানে ইসলামী যুগের সূচনা হয়। হিরাক্লিয়াস ৬৪১ খৃঃ পর্যন্ত জেরুজালেম শাসন করেন। তখন মসজিদে আকসার এলাকায় চার দেয়াল ছাড়া আর কিছু ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সা) যে দেয়ালের সাথে নিজ বোরাক বেঁধেছিলেন সেটাকে ‘হায়েত আল-বোরাক' বা বোরাক দেয়াল বলা হয়। রাসূলুল্লাহর (সা) সময় থেকেই জেরুজালেমের উপর ইহুদী ও খৃস্টানদের আধিপত্যের সমাপ্তির পয়গাম দেয়া হয় ।
💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url