আল আকসার ইতিকথা-৯ | ওসমানী আমল ও বৃটিশ আমলে মসজিদে আকসা | মসজিদে আকসার ভূমিকা

আল আকসা মসজিদের ইতিকথা শীর্ষক এই প্রবন্ধগুলো এ এন এম সিরাজুল ইসলামের লেখা “আল আকসা মসজিদের ইতিকথা” গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। সুন্দর তথ্যবহুল এই গ্রন্থটি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত।

ওসমানী শাসনামলে মসজিদে আকসা

১৫২০ খৃঃ থেকে ১৫৬০ খৃঃ পর্যন্ত তুর্কী সুলতান সুলাইমান কানুনী মসজিদে আকসার চার দেয়াল সংস্কার করেন। মসজিদের পার্শ্বে অবস্থিত দুর্গ, কূপ ও হারাম শরীফের দরজা ও দেয়াল পুনঃনির্মাণ করেন এবং মাকামে দাউদ সংস্কার করেন। ওসমানী শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীরা জেরুজালেমের প্রতি শ্যেন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। তুর্কী সুলতান জার্মানীর পক্ষে এবং বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। ফলে বিজয়ী বৃটেন তুর্কী শাসনের অবসান ঘটায় এবং জেরুজালেম দখল করে নেয়। পাঁচ বছর পর ১৯২২ খৃঃ জাতিসংঘ জেরুজালেমের উপর বৃটেনকে ম্যান্ডেট দেয় এবং বৃটেন জেরুজালেমের উপর অসি নিযুক্ত হয়। তখন জেরুজালেমে মুসলিম শাসনের অবসান হয়।

বৃটিশ শাসনামলে মসজিদে আকসা

২রা নবেম্বর, ১৯১৭ খৃঃ, বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর কুখ্যাত ‘বেলফোর ঘোষণায়' ইহুদী নেতা লর্ড রথচাইল্ডকে জানান যে, বৃটেন ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। ১৯২২ খৃঃ জাতিসংঘ ফিলিস্তিনে পৃথক ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে। ১৯২২ খৃঃ থেকে ১৯৬৭ খৃঃ পর্যন্ত বিশ্ব ইহুদী সংস্থা বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিনে এনে পুনর্বাসন করে। জার্মানীর নাৎসী নির্যাতনের ফলে বহু ইহুদী ফিলিস্তিনে চলে আসে। ১৯৪৭ খৃঃ জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে ২ ভাগ করে একভাগে আরব রাষ্ট্র এবং অন্যভাগে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ১৫ই মে বৃটেন ফিলিস্তিন এবং জেরুজালেম থেকে নিজ শাসনের অবসান এবং পৃথক ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।

বৃটেন, ১৯৪৮ সালের ২৬শে মে গাজ্জাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মিসরের কাছে এবং ১৯শে মে জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমকে জর্দানের কাছে হস্তান্তর করে।

জর্দানের মুসলিম শাসনামলে মসজিদে আকসা 

দীর্ঘ ৩১ বছর বৃটিশ শাসনে থাকার পর জেরুজালেম পুনরায় জর্দানের আরব মুসলমানদের শাসনে ফিরে আসে। জেরুজালেম ১৯৬৭ খৃঃ পর্যন্ত জর্দানী শাসনাধীন থাকে ।

ইসরাইলী শাসনামলে মসজিদে আকসা

১৯৬৭ খৃঃ জুন মাসে ইসরাইল একযোগে মিসর, সিরিয়া এবং জর্দানের উপর আক্রমণ করে। ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল, জর্দানের মুসলিম শাসন থেকে জেরুজালেম দখল করে নেয়। এছাড়া ইসরাইল মিসরের সিনাই উপত্যকা এবং সিরিয়ার গোলান হাইট দখল করে। এরপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৪২ নং প্রস্তাব গ্রহণ করে এতদঞ্চলের সকল রাষ্ট্রের প্রতি স্বীকৃতি এবং অধিকৃত আরব এলাকা থেকে ইসরাইলী বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানায় কিন্তু সেই প্রস্তাব আজও কার্যকর হয়নি। তাই জেরুজালেম এখন পর্যন্ত ইসরাইলী জবরদখলে রয়েছে। ইসরাইল জেরুজালেমকে তার স্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে বলেছে, সে কখনও জেরুজালেম হাতছাড়া করবে না ।

লক্ষণীয় বিষয়ঃ
জেরুজালেম বিগত ১৪শ' বছরের মধ্যে প্রায় ১ হাজার বছর যাবত মুসলমানদের শাসনাধীন ছিল। মাত্র ২বার খৃস্টান শাসন ও সর্বশেষবার ইহুদী শাসনের যাঁতাকলে ঐ মুসলিম শহরটি নিষ্পেষিত হয়। আজ দীর্ঘ ৫৫ বছর যাবত জেরুজালেম ইসরাইলের জবরদখলে রয়েছে। ইসরাইলের মাত্র ৯৭ লাখ ইহুদীর কাছে আজ জেরুজালেম বন্দী। পক্ষান্তরে, ইসরাইলের পার্শ্ববর্তী আরব দেশসমূহের মুসলিম জনসংখ্যা হচ্ছে ৩১ কোটি এবং গোটা দুনিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা হচ্ছে ২০০ কোটির উপরে।

আজ মুসলমানদের এই অসহায়ত্ব দূর করার জন্য জেরুজালেম বিজয়ী আবু ওবায়দাহ বিন জাররাহ ও সালাহউদ্দীন আইউবীর মত নেত্বত্ব ও ব্যক্তিত্ব দরকার।

মসজিদে আকসার ভূমিকা

মসজিদে আকসা ইসলামের সুমহান নেতৃস্থানীয় মসজিদসমূহের অন্যতম। অতীতে এই মসজিদ বহুমুখী ভূমিকা পালন করেছে। শিক্ষা, রাজনীতি ও সামাজিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে মসজিদটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবীদার। হযরত ইবরাহীম (আ) কর্তৃক পুনঃনির্মাণের পর হাজার হাজার বছর ধরে এটি ছিল বহুসংখ্যক আম্বিয়ায়ে কেরামের দীনি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কেন্দ্র। তদানীন্তন যুগের জন্য এটি ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ কেন্দ্র, যাকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন নবী ও বাদশাহরা এখান থেকেই জেরুজালেম-ভিত্তিক রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। মসজিদে আকসা মূলতঃ সভ্যতা ও তমদ্দুনের উজ্জ্বল নিদর্শন এবং ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির অনন্য প্রতীক। এটি ইসলামী কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের ধারক। মসজিদে আকসায় ইসলামী শিক্ষাদান করা হত এবং তা আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। বরং এর চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা ও লাইব্রেরী। অর্থাৎ সেখানে রয়েছে দারুল কুরআন, দারুল হাদীস ও বোর্ডিং। সেগুলোতে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট পর্যায়ে শিক্ষাদান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও তাতে আরবী ভাষা, ইসলামী আইন, ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দেয়া হয় ৷

মোটকথা, মসজিদে আকসায় দীনি শিক্ষার সাথে সাথে ইতিহাস, অংক, তর্কশাস্ত্র ও দর্শনসহ অন্যান্য দুনিয়াবী বিদ্যা শিক্ষা দেয়া হত।

উলামায়ে কেরাম, বিচারকমণ্ডলী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মসজিদে আকসায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধানের বিষয়ে আলোচনা করতেন। এই মসজিদ থেকেই তদানীন্তন শাসকরা জনগণের উদ্দেশ্যে সরকারী পয়গাম ও বক্তৃতা বিবৃতি প্রকাশ করতেন। সেগুলো সেখানে পাঠ করার পর তা জনগণের জন্য বাধ্যতামূলক করা হত ।

মসজিদে আকসার ভেতর অবস্থিত বিভিন্ন মাদ্রসায় বহু প্রখ্যাত আলেম ও পণ্ডিত ব্যক্তি শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের মধ্যে মাদ্রাসা নাসারিয়ায় শেখ আবুল ফাতহ নাসার বিন ইবরাহীম আল-মাকদেসী অন্যতম । ইমাম গাজালী এবং আবু বাক্ বিন আল-আরাবী তাঁর সাথে সেখানে সাক্ষাত করেন।

পরবর্তীতে ইমাম গাজালী মসজিদে আকসায় বসে একটি বই লেখন। বইটির নাম হচ্ছে, 'আর-রিসালাতুল কুদসিয়াহ্ ফি কওয়ায়েদিল আকায়েদ'। এ বিষয়টি তিনি 'এহইয়াউলুমিদ্দিন' বইতে উল্লেখ করেছেন।

আজ মসজিদে আকসা ইসরাইলের ইহুদীদের জবরদখলে রয়েছে। তাই সেখানে মসজিদের পূর্বের ভূমিকা এখন আর নেই। মসজিদ ইহুদীদের জবরদখল থেকে মুক্তি লাভ করার পর আবার তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে, ইনশাআল্লাহ ।

💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url