দ্বীনি জিজ্ঞাসা ও জবাব | ইসলামিক প্রশ্ন ও উত্তর (পর্ব - ১৪)


যাকাতের টাকা চুরি হলে করণীয়


প্রশ্ন-১২১: আমি যাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা আলাদা করে রেখেছিলাম। কিন্তু টাকাটা চুরি হয়ে গেছে । এখন আমাকে কি আবার যাকাত দিতে?

উত্তর: জি। আপনাকে যাকাত দিতে হবে। যেটা চুরি হয়েছে ওটা আপনার ভাগ থেকে চুরি হয়েছে। আর দরিদ্রদের পাওনা আপনার অবশিষ্ট টাকার মধ্যে এখনো রয়ে গেছে । যাকাত দিতে হবে ।

আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে উপার্জিত টাকা


প্রশ্ন-১২২: আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে উপার্জিত টাকা হালাল হবে কি না দয়া করে জানাবেন ।

উত্তর: এখানে দুটো বিষয় আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। যে সময়টা আমি আউট সোর্সিং-এ কাটাচ্ছি, এটা কি আমার সময় না অন্যের সময়? অর্থাৎ যারা কোনো কাজে চুক্তিবদ্ধ, যে কোনো কাজ হোক, আপনি ৮ টা থেকে ৩ টা বা ৫ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত একটা কোম্পানিতে চুক্তিবদ্ধ- এর ফাঁকে বসে যদি আপনি আউট সোর্সিং করেন, তাহলে এটা বৈধ নয় । এই সময়টা আপনি বিক্রি করে দিয়েছেন। এটা অন্য কাউকে দিতে পারবেন না। এক্ষেত্রে আমরা, মুসলিমরা অনেক অবহেলা করি । আমরা অফিসে বসে আছি, কুরআন পড়ছি, সেবাগ্রহীতা আসছে তাদের সেবা দিচ্ছি না, এটা কঠিন গোনাহের কাজ । কারণ আমি তো এই সময়টা বিক্রয় করে দিয়েছি সেবাগ্রহীতাদের সেবা দেয়ার জন্য। এর বিনিময়ে পয়সা নিচ্ছি। কাজেই আপনি যে সময় আউট সোর্সিং করবেন, এটা আপনার সময় হতে হবে। অন্যের কাছে বিক্রয় করা সময়ে আপনি এটা করতে পারবেন না। দ্বিতীয় হল, যে কাজটা আপনি করছেন এটা বৈধ হতে হবে। এমন কাজ যেন না হয়, যেটা ইসলামের ক্ষতি করে। মানবতার ক্ষতি করে । এই দুটো শর্ত পূরণ করলে ইনশাআল্লাহ আপনার আউট সোর্সিং বৈধ।

দাসীদেরকে স্ত্রীর মতো ব্যবহার


প্রশ্ন-১২৩: আমি জেনেছি যে ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফেরদের শাস্তিস্বরূপ তাদের নারীদের দাসী বানানো হত । বিবাহ ছাড়া কি দাসীদেরকে স্ত্রীর মতো ব্যবহার করা যাবে?

উত্তর: দাসী শব্দটা ঠিক দাসী নয়; ক্রীতদাসী । দাসব্যবস্থা প্রাচীন যুগ থেকেই ছিল । আরব দেশেও এটা ছিল। তৎকালীন অর্থব্যবস্থা দাসব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল ছিল। দাসরা ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কাজগুলো করত। ইসলাম দাসব্যবস্থাকে সংকুচিত করে । দাসীকে বিবাহ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে মূলত তার মুক্তির জন্য । তার মুক্তির বিভিন্ন পদ্ধতির একটা পদ্ধতি হল বিবাহ। দাসীকে বিবাহ করার শর্ত অন্যান্য নারীর বিবাহের মতোই । তিনি স্বামীহীন হবেন, বিধবা হবেন, তার বিবাহের অন্য কোনো বাধা থাকবে না । এই রকম দাসীকে ক্রয়চুক্তির মাধ্যমে স্ত্রী হিসেবে স্বামী ব্যবহার করতে পারবেন । এর কারণে ওই দাসীর যখন সন্তান হবে, তিনি আজীবনের জন্য মুক্ত হয়ে যাবেন । আর তাকে বিক্রি করা যাবে না। এটা দাস মুক্তির একটা পদ্ধতি । এটা ওই সময় যারা ক্রীতদাসী ছিল তাদের জন্য প্রযোজ্য। কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করা, ক্রয় করা এটা সম্পূর্ণ হারাম। ইসলাম বিরোধী কাজ। অত্যন্ত শাস্তিযোগ্য অপরাধ ।

নামাযের ঘুম আসলে করণীয়


প্রশ্ন-১২৪: নামাযের মধ্যে অনেক সময় আমাদের ঘুম আসে, উদাসীনতা তৈরি হয়। এই সময় আমরা কী করব? নামায ছেড়ে দেব?

উত্তর: এখানে দুটো বিষয়। ঘুম আসা আর অমনোযোগ। অমনোযোগের ব্যাপারে হাদীস আছে। এক সাহাবি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে এসে বলছেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, নামাযের মধ্যে মনোযোগ চলে যায়। কী করব? তিনি বললেন, এটা শয়তানের কাজ। শয়তান মনোযোগ নষ্ট করে। তুমি সালাতরত অবস্থায় 'আউযু বিল্লাহি মিনাশ শায়তনির রাজীম' বলে বামদিকে থুতু ফেলার মতো করবে। এতে শয়তান চলে যাবে । এজন্য অন্যদিকে মন চলে গেলে এই আমলটা করতে পারেন। এতে মনোযোগ ফিরে আসবে । আর মনোযোগের সবচে' বড় যে বিষয় হল, আমরা সালাত গতানুগতিকভাবে পড়ব না । একই দুআ একই তাসবীহ, এটা পড়লে মনোযোগ আসবে না । সানা যেটা আমরা পড়ি, একেক সময় একেক সানা পড়বেন। সিজদার দুআ রুকুর দুআ, একেক সময় একেকটা পড়বেন । তাহলে মনোযোগ খুব ভালো থাকবে । এবং আল্লাহর সাথে কথা বলার চেতনা বেড়ে যাবে। আসলে আমরা সালাতে আল্লাহর সাথে কী কথা বলছি এটা বুঝতে হবে । প্রতিটি শব্দের অর্থ না হলেও অন্তত বাক্যের অর্থ শেখা, এটা অতি সহজ ব্যাপার। আমরা সালাতে যে দুআগুলো যিকিরিগুলো বলি, এর দ্বারা আমরা আল্লাহর সাথে কথা বলি। সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম, রাব্বিয়াল আলা- এই কথার দিকে যখন আমার মনোযোগ যাবে তখন আমার মনোযোগ নষ্ট হবে না। বরং সালাতের পরে দেখবেন আপনার মনের দুশ্চিন্তা, হতাশা সব দূর হয়ে গেছে । আর দ্বিতীয়ত ক্লান্তির ব্যাপার। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নফল ইবাদতের ব্যাপারে বলেছেন:

خُذُوا مِنَ الْأَعْمَالِ مَا تُطِيقُونَ، فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَمَلُ حَتَّى تَلُوا

তোমরা সাধ্যে কুলানোর মতো ইবাদত করো। যেটুকু আনন্দ উৎফুল্লতার সাথে করতে পারো সেটুকু করো । তোমরা ক্লান্ত না হলে আল্লাহ ক্লান্ত হন না *। কাজেই আপনি যে সালাতের কথা বলছেন, এটা যদি ফরয সালাত হয়, তাহলে সময় মতো আদায় করতে হবে । ক্লান্তি দূর করে আদায় করতে হবে। আর যদি তাহাজ্জুদ নফল ইত্যাদি হয়, তাহলে আপনি উদ্দীপনার সাথে আদায় করার চেষ্টা করবেন। বেশি ক্লান্ত হলে ঘুমিয়ে পড়ে পরে উঠে ইবাদত করবেন । এরপরেও যদি সালাতে দাঁড়িয়ে ঘুম এসে যায়, তন্দ্রা লাগে আপনি এর ভেতরেই নিজের অনুভূতি ফিরিয়ে নিয়ে ইবাদত করতে পারেন । বিশ মিনিট আধা ঘণ্টার ইবাদতে আপনার দুচার মিনিট মনোযোগ নষ্ট হতে পারে, এ জন্য দুশ্চিন্তা করবেন না ।

* সহীহ বুখারি-৫৮৬১; মুসলিম-৭৮৫

নামযের ভেতর যদি কান্না আসে


প্রশ্ন-১২৫: নামযের ভেতর যদি আবেগে কান্না আসে, স্বশব্দে কাঁদলে নামাযের কোনো ক্ষতি হবে কি না?

উত্তর: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজেও সালাতে কাঁদতেন । তাহাজ্জুদের সালাতে এমনভাবে কাঁদতেন, কান্নার শব্দকে মনে হত রান্নার হাঁড়ি গড়গড় শব্দ করছে । তবে শব্দ করা থেকে বিরত থাকতে হবে । চোখে পানি আসবে, তিলাওয়াত না করতে পারলে থেমে যেতে হবে । চিৎকার করা বা শব্দ করা এটা ঠিক নয় ।

ওষুধের মাধ্যমে পিরিয়ড বন্ধ রেখে রোযা রাখা


প্রশ্ন-১২৬: ওষুধের মাধ্যমে রমাযান মাসে পিরিয়ড বন্ধ রেখে রোযা রাখা জায়েয হবে কি না জানাবেন ।

উত্তর: কেউ যদি ওষুধ খেয়ে তার সুস্থতা জারি রাখেন এবং রামাযানের সব রোযা রাখেন তাহলে তার রোযা হয়ে যাবে । এই রোযা আর কাযা করতে হবে না। তবে এই ধরনের ওষুধ ব্যবহারের আগে আপনারা চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।

স্বর্ণ এবং টাকা একসাথে হিসাব করে যাকাত দেয়া


প্রশ্ন-১২৭: কারো যদি কিছু স্বর্ণ থাকে এবং কিছু টাকা থাকে, উভয়কে একসাথে হিসাব করে যাকাত দেয়া সহীহ হবে কি না জানতে চাই ।

উত্তর: জি, যদি স্বর্ণের নিসাব হয়, টাকার নিসাব হয় তাহলে উভয়কে একসাথে হিসাব করে যাকাত দেবেন। অথবা মনে করেন সোনা আছে পাঁচ ভরি আবার টাকা আছে দুলাখ, দুটোকে একসাথে মিলিয়ে নিসাব পূর্ণ করবেন। এটাই সঠিক এবং নিরাপদ মত । প্রত্যেক বিষয় আলাদা করারও একটা মত আছে। তবে সহীহ কথা হল আপনার কিছু সোনা, কিছু টাকা থাকলে একসাথে মিলিয়ে নিসাব হয়ে গেলে আপনি যাকাত দিয়ে দেবেন ।

তামাক কোম্পানিতে চাকরি


প্রশ্ন-১২৮: আমি তামাক কোম্পানিতে চাকরি করি । আমার চাকরি হালাল হবে কি না?

উত্তর: তামাকের বৈধ ব্যবহার নেই। এর ব্যবহারটা অবৈধ। তামাকের মাধ্যমে যা উৎপন্ন করা হয় বা তৈরি করা হয়, প্রায় সকল আলেম একমত, এটা হারাম বা মাকরুহে তাহরীমি । কাজেই এটার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা, চাষ করা বা বিক্রয় করা- প্রায় সকল আলেম, অল্পকিছু আলেম বাদে, সবার নিকট এটা অবৈধ ।

জামাআতের নামাযে উচ্চস্বরে আমীন বলা


প্রশ্ন-১২৯: জামাআতের নামাযে ইমামের সুরা ফাতেহা পড়ার পরে উচ্চস্বরে আমীন বলা জায়েয কি না?

উত্তর: আমীন জোরে বলার সহীহ হাদীস রয়েছে। সাহাবিরা আমীন জোরে বলতেন । তাবেয়িরাও বলতেন। আবার আমীন আস্তে বলারও হাদীস আছে। সনদগতভাবে অত্যন্ত সহীহ হাদীস রয়েছে। তবে মুহাদ্দিসগণ এটাকে শায বলেছেন। সর্বাবস্থায় আমীন বলাটা একটা মুস্তাহাব কাজ । আমীন না বললেও সালাতের কোনো ক্ষতি হবে না । আমীন জোরে বা আস্তে দুভাবেই বলা যেতে পারে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের আশেপাশের মুসল্লিদের যেন কষ্ট না হয়। যে মসজিদে সবাই আস্তে বলেন, আমি যদি এমন জোরে বলি যে, পাশের মুসল্লি ভয় পেয়ে যান, নামাযের মনোযোগ নষ্ট হয়, মোবাইলের রিঙটোন বাজার মতো একটা অসুবিধা হয়- তাহলে এতে আমার সোয়াব হবে না, গোনাহ হবে। যদি জোরে বলাকে কেউ উত্তম মনে করেন, তাহলে সামান্য জোরে আমীন বলবেন, এটাই যথেষ্ট। উভয় কর্মেরই হাদীস আছে। হাদীসের গ্রহণযোগ্যতার বিচারে ফকীহগণ এবং মুহাদ্দিসগণের মতভেদ আছে । আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা জোরে আমীন বলি অথবা আস্তে, উভয় ক্ষেত্রে আমরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে চাচ্ছি। এমন যেন না হয়, অমুক আস্তে বলছে আমি জোরে বলব । অথবা অমুক জোরে বলে তাই আমি জোরে বলব না। আবার এমনও হয়, কেউ জোরে বললে আমরা মনে করি মহাপাপ হয়ে গেল । মসজিদ থেকে তাকে আমরা বের করে দিচ্ছি। এটা খুব দুঃখজনক। যেটা সুন্নাতে আছে, সাহাবিরা করেছেন, এটা অথবা ওটা, আমরা দুটোর যেটাকেই ঘৃণা করি, প্রকারান্তরে রাসূলের হাদীসকে ঘৃণা করছি। সাহাবিদের কর্মকে ঘৃণা করছি। আমার অনুরোধ হল, আমাদের মসজিদে মহাপাপীরা নামায পড়ে, কিছুই বলি না। কিন্তু জোরে আমীন বললে রাগ করি । অথচ আমলটা সহীহ সুন্নাহসম্মত । আবার মসজিদের ভেতর নামায হচ্ছে না এমন পাপ করা হচ্ছে, যেটা হাদীসেই বলা হয়েছে নামায হবে না, রুকু সিজদা হচ্ছে না; তাদেরকে কিছু বলছি না। আমীন আস্তে বললে বলছি যে, তোমার নামাযই হয় নি । এটা খুবই দুঃখজনক ।

নামাযের ভেতর দ্রুত কুরআন পড়ার বিধান কী


প্রশ্ন-১৩০: তারাবীহ নামাযে হাফেয সাহেবরা খুব দ্রুত কুরআন পড়েন। মুসল্লিরা ভালো মতো শব্দগুলো বুঝতেও পারে না। নামাযের ভেতর এমন দ্রুত কুরআন পড়ার বিধান কী?

উত্তর: আমরা কুরআন খতম করি । খতম করার দুটো অর্থ আছে। একটা হল পূর্ণ করা । আরেকটা হল হত্যা করা। আমরা তারাবীহতে কুরআন হত্যা করি। তারাবীহ পড়া আমাদের জন্য সুন্নাহ ইবাদত। কুরআন শোনা সুন্নাতের একটা মুস্তাহাব ইবাদত । যতটুকু শুনব ততটুকুই আমি ছওয়াব পাব। প্রত্যেকটা অক্ষর, তার সিফাত, মাদ, গুন্নাহসহ শুনলে আমি শোনার ছওয়াব পাব। কিন্তু হাফেয সাহেব যদি দ্রুত পড়েন, অনেক অক্ষর স্পষ্ট হয় না, এমনকি অনেক শব্দও বোঝা যায় না; এমন হলে খতম তো হবেই না বরং গোনাহ হবে কুরআন বিকৃত করার কারণে। আর সহীহভাবে, সুন্দর করে কুরআন পড়ে তারাবীহ পড়তে সর্বোচ্চ ৬০ মিনিট লাগে। আর নষ্ট করে হত্যা করে পড়লে ৪০ মিনিট লাগে। এই ২০ মিনিটের জন্য আমরা কুরআনকে হত্যা না করি । যদি একান্তই সময় আপনার না থাকে, আপনি সূরা তারাবীহ পড়েন । অন্তত কুরআন ধ্বংস করবেন না ।

💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url