কুরআনের গল্পঃ হযরত নূহ (আঃ)-এর নৌকা নির্মাণ এবং নৌকায় কওমের প্রস্রাব পায়খানার কাহিনী



নূহ (আঃ) এর নৌকার ঘটনা


অতি কষ্টে এলাকা থেকে দ্রুত চলে আসলেন। অতঃপর আল্লাহ তা'য়ালার দরবারে ফরিয়াদ করে বললেন, হে খোদা! তোমার ন্যস্ত করা দায়িত্ব পালন করতে আমি অবহেলা করিনি। কিন্তু কোন ক্রমে জাতিকে তোমার পথে আনা সম্ভব হল না। উপরন্তু অত্যাচার ও প্রহারে আমার শরীর জর্জরিত হয়েছে। এখন তুমি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন কর ।



নবীর ফরিয়াদের সঙ্গে সঙ্গে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) সেখানে অবতীর্ণ হয়ে নবীকে বললেন, আমি কয়েক বছর পূর্বে যে গাছের ডালটি আপনাকে দিয়েছিলাম আপনি উহা রোপণ করেছিলেন। সে ডালটি এখন একটি বৃহৎ বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। আপনি উক্ত বৃক্ষটি কেটে তক্তা করুন। অতঃপর উহা দ্বারা একটি জাহাজ তৈরি করুন। জাহাজ তৈরি হলে আপনার ভক্তবৃন্দকে নিয়ে তাতে আরোহণ করবেন। বাকি যারা আপনার অবাধ্য হিসেবে পৃথিবীতে থাকবে তাদেরকে আল্লাহ তা'য়ালা এক মহাপ্লাবন দিয়ে ধ্বংস করে দিবেন। আল্লাহর এ গজব থেকে কেউ রেহাই পাবে না। আপনি আপাতত সমস্ত কাজ-কর্ম বন্ধ করে অতি সত্ত্বর জাহাজ নির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করুন ।

নূহ (আঃ)-এর নৌকা নির্মাণের কাহিনী


হযরত নূহ (আঃ) আল্লাহ তা'য়ালার তরফ থেকে জাহাজ তৈরির কড়া নির্দেশ পেয়ে হয়রান হয়ে গেলেন। তিনি চতুর্দিকে ছুটাছুটি করতে আরম্ভ করলেন। কোথায় লোকজন, কোথায় প্রয়োজনীয় মালপত্র, কিছুই তার জোগাড় নেই। তবুও আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশ যথা সত্তর কার্যকরী করতে হবে । তাই তিনি তাঁর গুটি কয়েক অনুসারীকে খবর দিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশ সম্বন্ধে অবগত করলেন। তৎপর তাদেরকে সহযোগিতা করতে বললেন। সকলে আল্লাহর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে সর্ব রকম সাহায্য সহানুভূতির আশ্বাস প্রদান করলেন। হযরত নূহ (আঃ) তাঁর রোপন করা গাছটির নিকট গিয়ে অবাক হলেন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সে ক্ষুদ্র ডালটি এক বিশাল বৃক্ষে রূপ নিয়েছে। গাছটি ছয় শত গজ লম্বা এবং চার শত গজ বিস্তৃত হয়ে মানুষের একটি প্রদর্শনী বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসে গাছটি দর্শন করত।

হযরত নূহ (আঃ)-এর ভক্ত উম্মতের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিল অসাধারণ শক্তির অধিকারী, তার নাম ছিল আহাম। সে এক সাথে কয়েক শত মানুষের সাথে লড়তে ভয় পেত না। হযরত নূহ (আঃ) যখন গাছ কাটার জন্য সেখানে উপস্থিত হলেন তখন আহামও তাঁর সাথে ছিল। গাছটি কাটার সময় এলাকার বহু লোক এসে গাছটি কাটতে বাধা প্রদান করল। হযরত নূহ (আঃ) বললেন, গাছ কাটার জন্য তিনি আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশ পেয়েছেন। অতএব গাছটি তাকে কাটতে হবে। তখন কতিপয় ছেলে এসে হযরত নূহ (আঃ)এর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিল । আহাম এ দৃশ্য দেখে পাঁচটি ছেলেকে মেরে ফেলল এবং নিজ হাতে অস্ত্র ধরে অল্প সময়ের মধ্যে গাছটি ভূপাতীত করল। এ অবস্থা দেখে স্থানীয় লোকেরা আর কেউ বাধা প্রদান করতে সাহস পেল না।

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-

১১:৩৭ وَ اصۡنَعِ الۡفُلۡکَ بِاَعۡیُنِنَا وَ وَحۡیِنَا وَ لَا تُخَاطِبۡنِیۡ فِی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ۚ اِنَّهُمۡ مُّغۡرَقُوۡنَ
১১:৩৮ وَ یَصۡنَعُ الۡفُلۡکَ ۟ وَ کُلَّمَا مَرَّ عَلَیۡهِ مَلَاٌ مِّنۡ قَوۡمِهٖ سَخِرُوۡا مِنۡهُ ؕ قَالَ اِنۡ تَسۡخَرُوۡا مِنَّا فَاِنَّا نَسۡخَرُ مِنۡکُمۡ کَمَا تَسۡخَرُوۡنَ
১১:৩৯ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ ۙ مَنۡ یَّاۡتِیۡهِ عَذَابٌ یُّخۡزِیۡهِ وَ یَحِلُّ عَلَیۡهِ عَذَابٌ مُّقِیۡمٌ

অর্থঃ বরং আমার তত্তাবধানের এবং আমার ওহী অনুসারে একটি নৌকা বানানোর কাজ শুরু করো। আর মনে রেখা, যারা জুলুম করেছে, তাদের অনুকূলে তুমি আমার কাছে কোনো সুপারিশ করবে না। এরা সবাই এখন নিমজ্জিত হবে। নূহ কিশতী প্রস্তুত করছিল আর তাঁর জাতির নেতৃবৃন্দের মধ্য হতে যে-ই এর কাছ দিয়ে যাচ্ছিল, সে এর ওপর বিদ্রুপ করছিল। সে বলেছিল, তোমরা যদি আমাদেরকে বিদ্রুপ করো, তাহলে আমরাও তোমাদেরকে বিদ্রুপ করবো। অতি শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে, কার ওপরে অপমানকর আযাব আসে আর কার প্রতি আসে স্থায়ী আযাব। (সূরা হূদ : ৩৭-৩৯)

হযরত নূহ (আঃ) কয়েক দিন বসে গাছ কেটে তক্তা বের করলেন এবং ছোট শাখা কেটে পেরেগ বানিয়ে নিলেন। অতঃপর নবীর সারা জীবনের হেদায়েতের ফসল মাত্র চল্লিশ জন উম্মত নিয়ে জাহাজ তৈরির কাজে হাত দেন । এক হাজার গজ লম্বা ও চারশ গজ প্রস্থ এক জাহাজ তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ আরম্ভ করলেন। নবী তাঁর উম্মতদেরকে নিয়ে দিবারাত্র কাজ করতেন। এ জাহাজ তৈরির কাজে নবী ও তাঁর সঙ্গীরা এত সাফল্য লাভ করলেন যাতে সাধারণ মানুষ অবাক হয়ে গেল। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'য়ালা হয়ত ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করেছিলেন। যাতে করে প্রতি দিন কয়েক শত মানুষের পক্ষে যা করা সম্বব ছিল না, তা তারা সমাধা করে ফেলতেন। চল্লিশ দিন কাজ করার পর দেখা গেল জাহাজের কাজ প্রায় শেষ। তবে কিছু তক্তার অভাব পড়েছে। তখন নবী আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বললেন, তাদের কাঠের অভাব যেন তিনি অনতি বিলম্বে দূর করে দেন ।

এ সময় হযরত জিব্রাঈল (আঃ) হাজির হয়ে নবীকে বললেন, নীল নদের তল দেশে কিছু গাছ আছে তা উত্তোলন করে উহা দ্বারা অপুরন তক্তার কাজ সমাধা করুন।

হযরত নূহ (আঃ) জিব্রাঈলের কথা শুনে আর এক সমস্যার সম্মুখীন হলেন। নদীর তলদেশ থেকে কিভাবে সে কাঠ সংগ্রহ করবেন। উম্মতদেরকে নিয়ে পরামর্শে বসলেন। উম্মতের মধ্য থেকে একজনে প্রস্তাব দিলেন, উজবিন ওনক বর্তমানে আমাদের দেশে আছে। সে সর্বদা সমুদ্র থেকে অনায়াসে মাছ ধরে খায়। অতএব তাকে কিছু খাবার দিলে সে সহজে কাঠগুলো তুলে দিতে সম্মত হবে।

আদম (আঃ)-এর পৌত্র উজবিন উজের কাহিনী


উজবিন ওনক হযরত আদম (আঃ)-এর এক অপ্রতিদ্বন্দী পৌত্র। তার সম্পর্কে অনেক গল্প আছে। সে ছিল অত্যাধিক লম্বা ও ভীষণ শক্তিশালী। সে নাকি লম্বায় ছিল তিন হাজার গজ এবং তার দেহ ছিল আনুপতিক স্বাভাবিক। স্বাস্থ্য ছিল ভাল। চেহারা ছিল উজ্জ্বল। তার খাদ্য ছিল একত্রে পাঁচ মন থেকে দশ মন। খাদ্যের অভাব ছিল তার জীবনের প্রধান সংকট। ব্যবহার ছিল অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র। মানুষের সাথে চাল-চলনের ক্ষেত্রে ছিল অমায়িক। মানুষ তাকে অত্যন্ত ভাল বাসত, আদর করত এবং সামর্থ পরিমাণ খাদ্য-দ্রব্য তাকে প্রদান করত। উজের প্রধান খাদ্য ছিল গম ও মাছ। গম মানুষ তাকে দিত, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে তার খাদ্যের জন্য কিছু বরাদ্দ থাকত। দ্বিতীয়ত, নদী ও সমুদ্রে নেমে সে মাছ ধরে খেত। কথিত আছে, সে মাছ ধরে সূর্যের তাপে সেকে নিয়ে খেয়ে ফেলত। বুদ্ধি-জ্ঞানে ছিল খুব সাদাসিদা। ধূর্ততা সে অদৌ বুঝত না অন্যায় কাজ বা অন্যায় আচরন করার অভ্যাস তার ছিল না। শুধু একটি বদ অভ্যাস ছিল, সেটা হল ক্ষুধার তাড়নায় মাঝে মাঝে সে চুরি করে অনেকের ঘর থেকে খাবার খেয়ে ফেলত, আবার তাকে জিজ্ঞেস করলে সে চুরির কথা স্বীকার করত। এ সরলতার জন্য তাকে কেউ খারাপ জানত না। মানুষের উপকারের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব চেষ্টা করত। মানুষের নদী পারাপার বা দূর-দূরান্তে যাতায়াতের ক্ষেত্রে হাতে করে মানুষদেরকে তুলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দিত। কোন কোন সময় সমুদ্র থেকে বড় বড় মাছ ধরে এনে মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিত। ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে সে ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। আল্লাহ তা'য়ালার উপর তার মোটামুটি বিশ্বাস ছিল। তবে তা কোন ধর্ম অনুসরণের মাধ্যমে নয়।

এখানে তার বাকি জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটুকু তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করি। উজবিন ওনক একধারে ছয় মাস ঘুমাত এবং ছয় মাস ঘুরে-ফিরে খাদ্য সংগ্রহে ব্যস্ত থাকত। সে কয়েকজন নবীর যুগ পর্যন্ত বেঁচেছিল। শেষদিকে হযরত মুছা (আঃ) তার কয়েকজন উম্মতকে উজের নিকট প্রেরণ করেছিলেন তাকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে। যদি সে কবুল না করে তবে তারা তার সাথে যুদ্ধ করবে। উম্মতেরা উজের নিকট গিয়ে বলল, আমাদের হযরত মুছা (আঃ) আপনাকে দ্বীনের দাওয়াত দিবার জন্য প্রেরণ করেছেন। যদি আপনি এ দাওয়াত কবুল না করেন তবে আমরা আপনার সাথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হব। উজ বলল, ওটা তোমাদের নবীকে করতে বল, ওটা করার সময় আমার নেই। আমি আমার আহার জুটিয়ে সময় পাচ্ছি না। তার উপর আবার ধর্মের কাজ করি কখন। এই বলে সে পথ চলতে আরম্ভ করল। তখন নবীর উম্মতেরা তার উপর আক্রমণ চালাল। তখন উজ সকল উম্মতকে ধরে পকেটে পুরে ফেলল এবং সোজা নিজ স্ত্রীর কাছে গিয়ে বলল, দেখ মুছার উম্মতেরা আমার সাথে যুদ্ধ করতে এসেছিল, আমি তাদেরকে ধরে পকেটে করে এখানে নিয়ে এসেছি। এখন তোমার সম্মুখে ওদেরকে পিশে পিশে মেরে ফেলব। এই বলে উম্মতদেরকে পকেট থেকে বের করল। উম্মতেরা উজের পকেটে প্রস্রাব পায়খানা করে একেবারে দুর্গগন্ধময় করে ফেলেছিল।

অনেকে অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছিল। উজের স্ত্রী নবীর উম্মতদেরকে দেখে দয়াদ্র হয়ে বলল, তুমি ওদেরকে মেরো না, ওরা তোমার সাথে যুদ্ধ করার কি ক্ষমতা রাখে। মুখে বলেছে তাতে তুমি রাগান্বিত হয়েছ? আসলে ওরা যুদ্ধ করতে আসে নি। এসেছে শুধু মুছার হুকুম তামীল করতে। অতএব তোমার মত একজন মহৎ ব্যক্তির পক্ষে ওদেরকে ছেড়ে দেয়াই সমীচিন ও সঙ্গত হবে। তখন উজ ওদেরকে বলল, যাও তোমরা নিরাপদে দেশে চলে যাও। আমার সাথে যুদ্ধ করতে হলে খোদ মুছাকে আসতে বল। উজের স্ত্রী তখন তার জামার পকেট ধুয়ে দিয়ে তাকে শান্ত করল। উজের জামা ছিল গণ্ডার ও মহিষের চামড়া দ্বারা তৈরি এক জামা দিয়ে সে নিচের পাজামার কাজও সমাদান করত। কারণ এগুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রস্তুত করা সহজ সাধ্য ছিল না।

উজের স্ত্রী ছিল সে যুগের সর্বোচ্চ মহিলা। তবুও উজের তুলনায় সে ছিল হাটু বরাবর। স্ত্রীকে সে খুব ভালবাসত। শুধু খাবার নিয়ে তার সাথে মাঝে মাঝে ঝগড়া-ঝাটি হত। কারণ স্ত্রী যা কিছু খাবার তৈরি করত দু তিন দিন পরে এসে তা সব একেবারে সে খেয়ে যেত।

সে যখন মাঠে ময়দানে ঘুমিয়ে থাকত তখন অনেক পশু এসে তার শরীরের গরম পেয়ে তার গা ঘেষে শুয়ে থাকত। অনেক সময় এভাবে অনেক শুয়ে থাকা পশু তার পার্শ্বক্রিয়ার কারণে শরীরের চাপে পিষে মারা যেত। অনেক সময় পশুদের তাড়নায় তার শরীরে সুড়সুড়ি লাগলে মশা তাড়ানোর ন্যায় চাপড় দিলে তাতেও অনেক পশু মারা যেত। এভাবে তার সম্বন্ধে অনেক গল্প বর্ণিত আছে।

শেষ জীবনে হযরত মুছা (আঃ) তাকে দ্বীনের দাওয়াত দিবার জন্য তার নিকট যান এবং বলেন তুমি আল্লাহর উপর ঈমান আন এবং আমাকে তাঁর রসুল বলে স্বীকার কর। উত্তরে উজ বলল, আল্লাহ আমাকে নিয়মিত খাবার দিতে পারে না, তার উপর ঈমান আনলে কি হবে। আপনারা গিয়ে ওসব করুন। আমাকে সর্বদা খাবার যোগাড়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তখন হযরত মুছা (আঃ) লাঠিতে ভর করে ষাট গজ উপরে ওঠে তাকে সজোরে লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন। এ আঘাতটি একশত বিশ গজ উপরে লাগে। তাতে উজের হাঁটুর উপর এ আঘাত পতিত হয় ।

হযরত মুছার লাঠির আঘাতে সম্ভবত সে খুব বেদনা অনুভব করে। তখন সে ক্ষিপ্ত হয়ে দূরবর্তী সুউচ্চ পর্বতমালার দিকে দৌড় দেয়। সেখানে গিয়ে একটি বড় ধরনের পর্বত শৃঙ্গে উঠিয়ে মাথায় তুলে নেয়। ওটা দ্বারা সে মুছার কওমকে চাপা দিবে, এটাই ছিল তার উদ্দেশ্য। পথিমধ্যে আকাশ থেকে উড়ে আসা দুটি পাখি উক্ত পর্বত শৃঙ্গের উপর দিয়ে ঠোকরাতে আরম্ভ করে। অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে এক গর্তের সৃষ্টি হয়। পাখি দুটি মরিয়া হয়ে গর্তের মধ্যে ঘন ঘন ঠোকরাতে থাকে। উক্ত গর্ত উজের মাথা পর্যন্ত এলে হঠাৎ পর্বত শৃঙ্গটি তার মাথার মধ্যে গেড়ে গিয়ে ঘারে এসে বাধে তখন তার চোখ মুখ সবই অন্ধকারে ঘিরে যায়, কোন দিক দেখা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় সে পর্বত শৃঙ্গটি মাথা থেকে বের করে ফেলার চেষ্টা করে, কিন্তু ওটা এমনভাবে আটকে পড়ল যে, ওটাকে উঠানো-নামানো কোনটাই আর সম্ভব হলনা। তখন সে ঐ ভাবেই পথ অতিক্রম করতে লাগল। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পরে অদেখা অবস্থায় সে একটি নদীর ভাঙ্গন পাড়ে পা দিতেই উপুর হয়ে নদীর মাঝে পড়ে গেল। তখন তার মাথা পর্বতের ভারে পানির মধ্যে নিমজ্জিত হল এবং পা দুটি উপরে উঠে গেল । এ অবস্থায় সে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে যথেষ্ট চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ঐ অবস্থায় সেখানে তাকে মৃত্যুবরন করতে হল।

নূহ (আঃ)-এর নৌকা নির্মাণে উজবিন উজ


হযরত নূহ (আঃ) তাঁর উম্মতের পরামর্শ অনুসারে একদা এই উজের নিকট গিয়ে তাকে পর্যাপ্ত খাবার দিবার অঙ্গীকার করে নীল নদ থেকে গাছ উত্তোলনের কথা বললেন, উজ খাবার কথা শুনে রাজি হল এবং সঙ্গে সঙ্গে নীল নদের দিকে রওয়ানা করল। কিছুক্ষণের মধ্যে সে নীলনদের তলদেশ খুজে অনেক গাছ তুলে ফেলল। অতঃপর নূহ নবীর কাছে এসে খাবার প্রার্থনা করল, নবী তাকে তিনটি রুটি দিলেন, তখন উজ রাগান্বিত হয়ে বলল, আমাকে পর্যাপ্ত খাবার দিবার অঙ্গীকার করেছ, এখন মাত্র তিনখানা রুটি দিয়ে আমাকে প্রহসন করছ। আমি এখনই গাছ নদীতে ফেলে দিব। হযরত নূহ (আঃ) বললেন, তুমি রুটিগুলো জামার নিচে রাখ এবং এক একটি করে বের করে খেতে থাক, তাতে যদি তোমার তৃপ্তি না হয় তাহলে গাছ নদীতে ফেলে দিও। উজ নবীর কথা অনুসারে জামার নিচে রেখে রুটি খেতে আরম্ভ করল। তখন সে দেখে এক একটি রুটির সাইজ অনেক বড় হয়েছে এবং রুটির কোন শেষ নেই। একাধারে সে বারশ রুটি খেয়ে ফেলল এবং হাসি দিয়ে বলল, হে নূহ! তুমি আমাকে অনেক দিন পরে পেট ভরে খাওয়ালে। এ জন্য তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ। আগামীতে আর যদি কোন কাজে আমাকে প্রয়োজন হয় তবে এভাবে খাবার ব্যবস্থা কর, আমি স্বানন্দে তোমার কাজ করে দেব, এ বলে উজ বিদায় হল। জামা উলটিয়ে সে দেখল তার পূর্বের তিন খানা রুটি সম্পূর্ণ অক্ষত আছে। তখন সে হযরত নূহকে বলল, এ রুটি তিনখানা আমি নিয়ে যাব? হযরত নূহ (আঃ) বললেন, হ্যাঁ ওটা তোমার ওটা নিয়ে যাও তবে মনে রেখ এ রুটিতে তোমার অনেক দিন চলবে। উজ খুশি মনে রুটি নিয়ে বিদায় হল ।

উজের উঠানো কাঠগুলো হযরত নূহ (আঃ) সঙ্গীদের দ্বারা যথাস্থানে নিয়ে এলেন এবং অতি সত্ত্বর তক্তা করে জাহাজের অসমাপ্ত কাজ আরম্ভ করে দিলেন।

সপ্তাহ খানের মধ্যে তিনি জাহাজের সম্পূর্ণ কাজ সমাধা করে ফেললেন। দেশের হাজার হাজার মানুষ জাহাজ নির্মাণের খবর শুনে প্রতিদিন দেখতে আসে এবং বিদ্রুপের হাসি হাসে। কারণ মরুভূমির মধ্যে জাহাজ তৈরির কাজটা একটা হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া আর কি হতে পারে।

নূহ (আঃ)-এর নৌকায় কওমের প্রস্রাব পায়খানা


জাহাজ নির্মানের কাজ সমাপ্ত করে হযরত নূহ (আঃ) আল্লাহ তা'য়ালার পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকেন। এভাবে কয়েক দিন পার হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন দেখা গেল কারা যেন রাতের অন্ধকারে জাহাজের মধ্যে পায়খানা প্রস্রাব করে সর্বনাশ করেছে। হযরত নূহ (আঃ)-এর আর বুঝতে বাকি রইল না, এটা কাদের কাজ, তিনি দুর্বল, ওদের সাথে মোকাবেলায় অগ্রসর হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় । তাই তিনি আল্লাহর তা'য়ালার দরবারে নালিশ করে রাখলেন।

ওদিকে বিধর্মীরা উল্লাস করে জাহাজে পায়খানা করতে লাগল । দিন দিন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। এখন শুধু রাতে নয় দিনের বেলাও দলে দলে মানুষ এসে জাহাজে পায়খানা প্রস্রাব করে যেতে থাকে। একাধারে পনের দিন যাবত এভাবে চলার পরে দেখা গেল পায়খানা ও প্রস্রাবে জাহাজ প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে। হযরত নূহ (আঃ) মাঝে মাঝে এসে দূর থেকে দৃশ্য দেখে যান এবং বুক ভাসিয়ে কাঁদতে থাকেন। তাঁর উম্মতগণের অবস্থাও একই রূপ।

এর মধ্যে একদিন এক অন্ধ ব্যক্তি জাহাজে পায়খানা করার সময় পা ফসকে জাহাজে পড়ে যায় এবং মল মূত্রের মধ্যে একেবারে ডুবে যায়। তারপর সে কোন রকম সাঁতরে উপরে উঠে দেখে, তার চক্ষের অন্ধত্ব দূর হয়ে গেছে। সস্য শ্যামল ধরণী তার রূপ নিয়ে অন্ধের সম্মুখে হাজির হয়েছে। তখন সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজ গোত্রের নিকট ছুটে গিয়ে ঘটনা বলল। গোত্রের মানুষেরা প্রথম তাকে বিশ্বাস করতে পারে নি। পরে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা মহা ভাবনায় পতিত হল। এ খবর ক্রমান্বয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একদল লোক রাত্রি বেলায় একজন অন্ধকে নিয়ে জাহাজের মধ্যে ফেলে দিল। অন্ধ সেখানে চুব খেয়ে উপরে উঠে আসলে সাথে সাথে তার অন্ধত্ব দূর হল। অন্ধ ব্যক্তি পৃথিবীর সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছে। পর পর দুটি অন্ধ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল। এবারে দেশে এক ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হল। এখন আর কেউ সেখানে পায়খানা করার জন্য যায় না। এখন সেখানে অন্ধদের যাতায়াত আরম্ভ হয়। যে জাহাজে ডুব দিয়ে আসে তার অন্ধত্ত আর থাকে না। প্রতি দিন শত শত অন্ধ ব্যক্তিরা আরোগ্য লাভ করার পরে পঙ্গু, অচল, লুলা জাতীয় আক্রান্ত ব্যক্তিরা গিয়ে জাহাজের মল মূত্রের মধ্যে ডুব দিতে আরম্ভ করল, আল্লাহর মহিমায় তারাও আরোগ্য লাভ করল। এরপর আরম্ভ হয় অন্যান্য ব্যাধিগ্রস্থ লোকদের যাতায়াত। তারাও ক্ষণিকের মধ্যে আরোগ্য লাভ করতে লাগল। তখন দেশ-বিদেশ হতে মানুষের ঢল নেমে আসতে আরম্ভ হল। শুধু মল-মূত্র ব্যবহারেই তারা ফিরতো না, বরং পাত্র ভরে ভরে মল-মূত্র নিয়ে যেতে আরম্ভ হল। সপ্তাহখানেকের মধ্যে জাহাজের মল-মুত্র শেষ হয়ে গেল । এরপরে যারা দেশ-বিদেশ থেকে আসল তারা জাহাজ ধুয়ে পানি নিতে আরম্ভ করল, শেষের দিকে ধুয়ে মুছে নিবার ক্ষেত্রে ভীষণ প্রতিযোগিতা ও কাড়াকাড়ি আরম্ভ হল।

নূহ (আঃ)-এর উম্মতদের নৌকায় অবস্থান গ্রহণ


পনের দিন অতিবাহিত হওয়ার পরে যখন জাহাজ সম্পূর্ণ ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেল তখন আল্লাহ তা'য়ালা হযরত নূহ (আঃ)-কে আদেশ দিলেন তোমার খাঁটি উম্মতদেরকে এবং পৃথিবীর সমস্ত পশু-পক্ষী থেকে এক জোড়া করে জাহাজে উঠাও। হযরত নূহ (আঃ) আল্লাহ নির্দেশ শুনে খুবই বিব্রত বোধ করলেন। কারন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রাণীর বাস। অতএব সারা পৃথিবী ঘুরে অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে এগুলো তিনি সংগ্রহ করবেন, বিষয়টি তাঁর নিকট অত্যন্ত কঠিন বলে মনে হতে লাগল। তখন হযরত জিব্রাইল (আঃ) নবীর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, এ ব্যাপারে আপনি আদৌ চিন্তাযুক্ত হবেন না আল্লাহ তা'য়ালা এ বিষয় আপনাকে সাহায্য করবেন, একথা শুনে নবী আস্বস্ত হলেন। নবীকে আরও বলা হল, আপনি বিলম্ব না করে অতি সত্তর এ কাজ সমাধা করুন, কারণ কয়েক দিন পরেই এক মহা প্লাবন আসছে, তাতে পৃথিবী তলিয়ে যাবে। নবী আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশ ক্রমে নানা জায়গায় সফর আরম্ভ করলেন এবং সকল জায়গা থেকে সম্ভাব্য সকল প্রাণী, বৃক্ষ সংগ্রহ করতে আরম্ভ করলেন। আত্মীয়-স্বজনদেরকে মহাবিপদের পূর্বাভাস দিলেন এবং জাহাজে অবস্থান গ্রহণের জন্য বললেন। আত্মীয়-স্বজনেরা তার কথার প্রতি তেমন ভ্রূক্ষেপ করল না। ইতোমধ্যে দেখা গেল বন-জঙ্গল থেকে বিভিন্ন জাতের প্রাণীরা কোন খবর ব্যতিরেকেই জাহাজের নিকট এসে ভীড় জমিয়েছে। হযরত নূহ (আঃ) জাহাজের নিকট এসে প্রাণীদেরকে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে উঠিয়ে নিলেন।

জাহাজটি ছিল বহুতল বিশিষ্ট। উপরে কয়েক তলা ছিল মানুষের স্থান, পরবর্তী কয়েক তলা জীবজন্তু ও পশু-পক্ষীর স্থান। তারপরে কয়েক তলা ছিল উদ্ভিদ ও তরু-লতার স্থান। হযরত নূহ (আঃ) ও তাঁর উম্মতেরা অদম্য চেষ্টা করে সকল প্রাণীদেরকে জাহাজে উঠানোর কাজ সমাপ্ত করেন।

এর মধ্যে হযরত নূহ (আঃ)-এর আত্মীয়-স্বজনদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। এমন কি হযরত নূহ (আঃ)-এর ছেলে কেনান জাহাজে উঠতে রাজি হল না। হযরত নূহ (আঃ) বার বার তাকে বলেছেন, কিন্তু সে কোন কথা গ্রাহ্য করে নি। সর্বশেষে হযরত নূহ ক্রোধান্বিত হয়ে ছেলেকে বললেন, “উঠ শয়তান, জাহাজে উঠ” একথা বলার সাথে সাথে ইবলিশ সকলের অলক্ষ্যে লাফ দিয়ে জাহাজে উঠে বসল, কিন্তু কেনান আর উঠল না। তখন তিনি নিরুপায় হয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বললেন, হে খোদা! তুমি এক সময় আমাকে বলেছিলে যে, আমার পরিবারবর্গকে ধ্বংসের কবলথেকে রক্ষা করবে, সে মর্মে আমার সন্তান কেনানকে রক্ষা কর। আল্লাহ তা'য়ালা তার উত্তরে বললেন- তুমি আল্লাহর নবী আর কেনান কাফের, অতএব সে তোমার পরিবারবর্গের লোক হবার যোগ্য নয়, তার কথা ছেড়ে দাও ।

(এই লেখাটি আলহাজ্ব মাওলানা লুৎফুল আলম রচিত ও ছারছীনা প্রকাশনী হতে প্রকাশিত “কুরআনের শ্রেষ্ট কাহিনী” গ্রন্থ অবলম্বনে তৈরী করা হয়েছে)


💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url