কুরআনের গল্পঃ নূহ (আঃ)-এর মহাপ্লাবন এবং মহাপ্লাবনের সময় সংগঠিত ঘটনাসমূহ
নূহ (আঃ)-এর মহাপ্লাবন
সে দিন ছিল চন্দ্র মাসের ২রা রজব। ভোর রাত্র থেকে আকাশ থেকে গরম পানির বর্ষণ আরম্ভ হল। আর মাটি ফেটে উঠতে আরম্ভ করল ভীষণ ঠাণ্ডা পানি । উভয় পানির মিশ্রণ যখন ঘটল, তখন আরম্ভ হল বাতাসের রুদ্র রোষ। সময় যত অতিবাহিত হতে লাগল বাতাস ও পানির প্রচণ্ডতাও তত বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করল । দেখতে দেখতে মাটির উপর অনেক পানি জমে গেল। দুপুরের মধ্যে শুষ্ক মরু ভূমির উপর দিয়ে বয়ে যেতে আরম্ভ করল প্রচণ্ড স্রোত। হযরত নূহ (আঃ)-এর জাহাজ পানির উপর ভেসে উঠল। তখন কিছু লোক পানির উপর দিয়ে সাঁতরে জাহাজের নিকট আসতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু স্রোতের আক্রমণে তাদেরকে অন্য দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
এ সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনা হলো-
২৩:২৭ فَاَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡهِ اَنِ اصۡنَعِ الۡفُلۡکَ بِاَعۡیُنِنَا وَ وَحۡیِنَا فَاِذَا جَآءَ اَمۡرُنَا وَ فَارَ التَّنُّوۡرُ ۙ فَاسۡلُکۡ فِیۡهَا مِنۡ کُلٍّ زَوۡجَیۡنِ اثۡنَیۡنِ وَ اَهۡلَکَ اِلَّا مَنۡ سَبَقَ عَلَیۡهِ الۡقَوۡلُ مِنۡهُمۡ ۚ وَ لَا تُخَاطِبۡنِیۡ فِی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ۚ اِنَّهُمۡ مُّغۡرَقُوۡنَ
অর্থঃ তারপর আমি তার কাছে ওহী প্রেরণ করলাম যে, তুমি আমার চোখের সামনে ও আমার ওহী অনুযায়ী নৌকা তৈরী কর। তারপর যখন আমার আদেশ আসবে এবং চুলা (পানিতে) উথলে উঠবে তখন প্রত্যেক জীবের এক জোড়া ও তোমার পরিবারবর্গকে নৌযানে তুলে নিও; তবে তাদের মধ্যে যাদের ব্যাপারে পূর্বে সিদ্ধান্ত হয়ে আছে তারা ছাড়া। আর যারা যুলম করেছে তাদের ব্যাপারে তুমি আমাকে সম্বোধন করো না। নিশ্চয় তারা নিমজ্জিত হবে। (সূরা আল মু'মিনুন : ২৭)
উল্লেখিত আয়াতে 'তার' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অনেকে এই শব্দের অর্থ বলতে ভূমি বুঝিয়েছেন এবং কেউ এর অর্থ করেছেন ভূমির ওপরের অংশ। কেউ বলেছেন, এর অর্থ হলো, প্রভাতের উদয়। কিন্তু এর বাহ্যিক অর্থ হলো চুলা । উল্লেখিত আয়াতের বর্ণনাদৃষ্টে মনে হয়, এমন কোন বিশেষ চুলা বা উনুন পূর্ব থেকেই নির্দিষ্ট করা ছিলো, যে উনুনের তলদেশ ফেটে যখন পানি উঠতে থাকবে, তখনই বুঝতে হবে যে, মহাপ্লাবনের সূচনা হলো। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে-
১১:৪০ حَتّٰۤی اِذَا جَآءَ اَمۡرُنَا وَ فَارَ التَّنُّوۡرُ ۙ قُلۡنَا احۡمِلۡ فِیۡهَا مِنۡ کُلٍّ زَوۡجَیۡنِ اثۡنَیۡنِ وَ اَهۡلَکَ اِلَّا مَنۡ سَبَقَ عَلَیۡهِ الۡقَوۡلُ وَ مَنۡ اٰمَنَ ؕ وَ مَاۤ اٰمَنَ مَعَهٗۤ اِلَّا قَلِیۡلٌ
অর্থাঃ এইভাবে যখন আমার আদেশ এলো আর সেই চুলাটি উথলে উঠলো। তখন আমি বললাম, প্রত্যেক ধরনের জন্তু-জানোয়ার এক এক জোড়া নৌকায় উঠিয়ে নাও। তোমার পরিবারের লোকদেরকেও অবশ্য তাদের ব্যতীত যাদেরকে পূর্বেই চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে- এতে তুলে নাও। আর সেই লোকদেরকেও এতে বসাও যারা ঈমান এনেছে। তবে নূহের সাথে ঈমান এনেছে তাদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। (সূরা হুদ : ৪০ )
মহান আল্লাহ তা'য়ালা হযরত নূহকে আদেশ দিলেন-
২৩:২৮ فَاِذَا اسۡتَوَیۡتَ اَنۡتَ وَ مَنۡ مَّعَکَ عَلَی الۡفُلۡکِ فَقُلِ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ الَّذِیۡ نَجّٰنَا مِنَ الۡقَوۡمِ الظّٰلِمِیۡنَ
২৩:২৯ وَ قُلۡ رَّبِّ اَنۡزِلۡنِیۡ مُنۡزَلًا مُّبٰرَکًا وَّ اَنۡتَ خَیۡرُ الۡمُنۡزِلِیۡنَ
অর্থাঃ তারপর যখন নিজের সাথীদের নিয়ে নৌকায় আরোহণ করবে তখন বলবে, আল্লাহর শোকর-যিনি আমাদের উদ্ধার করেছেন জালিমদের হাত থেকে। আর বলো, হে রব! আমাকে নামিয়ে দাও বরকতপূর্ণ স্থানে এবং তুমি সর্বোত্তম স্থানদানকারী । (সূরা আল মুমিনুন : ২৮-২৯)
এবার হযরত নূহ আলায়হিস সালাম তাঁর অনুসারীদেরকে আদেশ করেছিলেন নৌকার উঠার জন্য। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
১১:৪১ وَ قَالَ ارۡکَبُوۡا فِیۡهَا بِسۡمِ اللّٰهِ مَجۡؔرٖىهَا وَ مُرۡسٰىهَا ؕ اِنَّ رَبِّیۡ لَغَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
অর্থাঃ নূহ বললো, তোমরা এতে উঠে বসো। আল্লাহর নামেই এটা চলতে থাকবে এবং স্থিতি লাভ করবে। আমার রব বড়ই ক্ষমাশীল করুণাময়। (সূরা হূদ-৪১)
আযাবের ধরণটা কেমন ছিল, মহান আল্লাহর ভাষায় -
৫৪:১১ فَفَتَحۡنَاۤ اَبۡوَابَ السَّمَآءِ بِمَآءٍ مُّنۡهَمِرٍ
৫৪:১২ وَّ فَجَّرۡنَا الۡاَرۡضَ عُیُوۡنًا فَالۡتَقَی الۡمَآءُ عَلٰۤی اَمۡرٍ قَدۡ قُدِرَ
অর্থাঃ তখন আমি আকাশের দুয়ারসমুহ উন্মুক্ত করে মুষল ধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করিয়েছি। এবং যমীন বিদীর্ণ করে প্রস্রবনে পরিণত করেছি। আর এই সমস্ত পানি সেই কাজটি পূর্ণ করার কাজে লাগলো, যা পূর্বেই নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। (সূরা ক্বামার -১১-১২)
বালুময় শুষ্ক মরুভূমিতে তেজস্বিনী স্রোতের ধারা বয়ে যাওয়ার ঘটনা কোন দিন রূপকথায়ও শোনে নাই। তাই নূহ (আঃ)-এর জাহাজ নিয়ে দেশের নেতৃবৃন্দ থেকে আরম্ভ করে সাধারণ মানুষ সকলেই উপহাসের ভাষায় আলোচনা করে বেড়াত। কিন্তু যখন বাস্তব অবস্থা দেখল তখন তাদের জ্ঞান ফিরে এল । আল্লাহর নবীর প্রতি ও তাঁর কথার প্রতি আস্থা আসল। তখন বীর অনুসন্ধানে অনেকে বাড়ি থেকে বের হল। কিন্তু প্লাবনের গতি তখন এমন কঠিন রূপ ধারণ করেছিল। যাতে করে ঘর থেকে বের হয়ে আর কেউ রেহাই পেল না। স্রোতের কঠিন আঘাতে ছিটকে কে কোথায় চলে গেল তার কোন পাত্তা থাকল না। বাতাসের প্রচন্ড আঘাতে সমস্ত গাছ-পালা উপড়ে স্রোতের টানে তড়িৎ গতিতে অজানা গন্তব্যে চলে যেতে আরম্ভ করল। ঘর, দালান, ইমারত কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। এক এক করে সব কিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
নূহ (আঃ)-এর ছেলে কেনানের মৃত্যু
হযরত নূহ (আঃ)-এর ছেলে কেনান অতি উচ্চ এক পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিল। যখন সে পাহাড় ডুবে পানি আরো উপরে উঠে গেল, তখন কেনান আল্লাহর নামে তছবীহ আরম্ভ করল। কিন্তু নিষ্ঠুর ঝড় তাকে রেহাই দিল না। বাতাসের একটা প্রচণ্ড ঝাপটা এসে তাকে পাহাড়ের উপর ভীষণ জোরে আছাড় দিল। তাতে কেনানের মাথা ও শরীরের সমস্ত হাড় গুঁড়া হয়ে গেল। তার লাশ পানিতে অজানা দেশে ভাসিয়ে নিল। বড় বড় পর্বতগুলোর চূড়া ভেঙ্গে ভেঙ্গে পানিতে পড়তে আরম্ভ করল। কোন জীব-জানোয়ারের অস্তিত্ব দূরের কথা মাটিও স্থির থাকলনা। সমুদয় মাটির সমতলে পরিণত হল। পৃথিবীর কোন জীব-জানোয়ার যে গুলো হযরত নূহ (আঃ)-এর জাহাজের বাইরে ছিল কেউ রেহাই পেল না। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালার উপরে চল্লিশ গজ পর্যন্ত পানি উঠেছিল। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছিল সমস্ত পৃথিবীটা অতল সমুদ্রের মাঝে তলিয়ে গেছে ।
হযরত নূহ (আঃ) তাঁর সঙ্গী-সাথী ও জীব-জনোয়ার নিয়ে জাহাজে নিরাপদে ছিলেন। জাহাজ নিজ গতিতে কোথায় যাচ্ছিল যাত্রীরা তার কোন খবর রাখত না। জাহাজ অধিকাংশ সময় বায়তুল্লাহর চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে তওয়াফ করে চলছিল। আল্লাহ তা'য়ালা এ বিভিষিকাময়ী তুফান ও প্লাবনের মাঝে জাহাজখানি নিরাপদ রেখেছেন। যাত্রীরাও ভীষণ প্রলয় সম্বন্ধে কিছুই অবগত হতে পারে নি। এক সময় জাহাজের ময়লা আবর্জনা জমে ভীষণ নোংরা হয়ে যায়। তখন হযরত নূহ (আঃ) হাতিকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে জাহাজ পরিষ্কার করার আদেশ দেন। হাতি তার সুড় দ্বারা বাইরের পানি এনে জাহাজ ধুয়ে ময়লা বাইরে ফেলে দিতে আরম্ভ করে । এভাবে সে সম্পূর্ণ জাহাজ ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়।
নূহের (আঃ) জাহাজে ইবলিসের কুমন্ত্রনা
ইবলিস জাহাজের মধ্যে কয়েক মাস আত্মগোপন করে ছিল। একদা তার মাথায় কুবুদ্ধি আসল, সে শূকরের কাছে গিয়ে তার নাকে হাত বুলিয়ে সুড়সুড়ি দিল। শূকর তখন সজোরে হাঁচি দিল। অমনি তার নাকের মধ্যে থেকে ইঁদুর বেড়িয়ে আসল। ইঁদুরগুলি ছুটাছুটি করে জাহাজের নিচ তলায় গিয়ে কাঠ কাটতে আরম্ভ করল। ইবলিসের ইচ্ছা ছিল ইঁদুর দ্বারা জাহাজ ছিদ্র করে দিলে জাহাজে পানি উঠে সেটি তলিয়ে যাবে। এ খবরটি কবুতর গিয়ে হযরত নূহ (আঃ)-এর কাছে পৌঁছে দেয়। তখন হযরত নূহ (আঃ) পশুদের এলাকায় এসে জিজ্ঞেস করলেন, ইঁদুর আসল কোথা থেকে? শূকর উত্তর দিল, হুজুর! ইবলিস এসে আমার নাকে সুড়সুড়ি দিলে আমি সজোরে হাঁচি দিই। সেই সাথে আমার নাক থেকে কয়েকটি ইঁদুর ছানা বেড়িয়ে আসে। ইবলিস পৃথিবীতে বসে কয়েক দিন পূর্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি ইঁদুর ছানা আমার কানের মধ্যে গুঁজে রেখে দিয়েছিল। সেই ইঁদুরগুলি সম্ভবত আমার নাক দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। হযরত নূহ (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন ইবলিস আমার অনুমতি ব্যতিরেকে কিবাবে জাহাজে উঠল? তখন হযরত নূহ (আঃ) ইবলিসকে ডেকে অবৈধভাবে জাহাজে উঠার বিষয় জিজ্ঞেস করলেন। তখন ইবলিস বলল, হে আল্লাহর নবী! আমি আপনার আদেশ ছাড়া জাহাজে উঠিনি। আপনি যখন আপনার সন্তান কেনানকে জাহাজে উঠার জন্য শেষ বারের মত বলছিলেন, তখন তাকে গালির ছলে বলেছিলেন “উঠ শয়তান, জাহাজে উঠ” তখন আমি আপনার ঐ কথাটি আমার জন্য আদেশ মনে করে জাহাজে উঠে পরি। অতএব আমাকে অবৈধ প্রবেশকারী বলতে পারবেন না । হযরত নূহ (আঃ) ইবলিসের কথার জবাব দিলেন না ।
অতএব তিনি জাহাজের নিরাপত্তার জন্য অন্য তলায় বসবাস রত বিড়ালকে ডেকে জাহাজের তলদেশে পাঠিয়ে দিলেন। বিড়াল দেখে ইঁদুর আত্মসমর্পণ করল। বিড়াল তখন ইঁদুরকে এনে হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্মুখে হাজির করে দিল। ইঁদুর কাকুতির সাথে হযরত নূহ (আঃ)-এর নিকট আরজ করে বলল, ইবলিস জাহাজের একজন দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি অতএব তার আদেশকে আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে জাহাজ কাটার কাজ আরম্ভ করি। এখন আমরা আমাদের ভুল ধরতে পেরেছি। অতএব আমাদের ভুলের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থী ।
উজবিন উজ কিভাবে বেঁচেছিল
এতবড় সর্বনাশা প্লাবনের মাঝে উজবিন উজ কিন্তু আদৌ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে পাহাড়ে গিয়ে উঠে। যখন পানি বৃদ্ধি পেতে পেতে উজের মাথা পর্যন্ত পানি হল তখন সে চিৎকার দিয়ে বলল, হে নূহ (আঃ)-এর খোদা! আমি তোমার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। আমি নূহ (আঃ)-এর সাথে কোন দিন অসৌজন্যমূলক আচরণ করিনি। আমি নূহ (আঃ)-এর আদেশক্রমে তার জাহাজের জন্য নীল নদ থেকে কাঠ সংগ্রহ করে দিয়েছি। এ কাজটির কল্যাণে তুমি আমার জীবন রক্ষা কর। উজের এ আবেদন আল্লাহর দরবারে মঞ্জুর হয়। যার জন্য প্লাবনের মাঝে এক পর্বত শৃঙ্গকে অনেক উঁচু করে দেয়া হয়। যাকে জড়িয়ে ধরে উজের জীবন রক্ষা পায়। প্লাবনের সময় উজের খাদ্য খাদকে কোন অসুবিধা হয় নি। প্রচুর মাছ সে তার অতি নিকটে পায়। যা খেয়ে জীবন ধারণ করে।
নূহ (আঃ) এর মহাপ্লাবন কত দিন ছিল
দীর্ঘ চল্লিশ দিন যাবত আকাশ থেকে অবিরাম বৃষ্টি এবং মাটি ফেরে পানি উঠায় যখন সারা পৃথিবী পানির অতল তলে তলিয়ে গেল তখন শুধু মাত্র হযরত নূহ (আঃ)-এর জাহাজখানি ছোট একটি কচুরী পানার ন্যায় ভাসমান ছিল। দিগন্তহীন জলাশির মাঝে আর কোন কিছুর অস্তিত্বের চিহ্ন ছিল না।
নূহ (আঃ)-এর জাহাজ কতদিন পানিতে ভেসেছিল
হযরত নূহ (আঃ)-এর জাহাজখানি একাধারে ছয় মাস আট দিন যাবত পানির উপর ভেসে ছিল। তারপরে আল্লাহ তা'য়ালা আসমানকে বর্ষণ বন্ধ করতে এবং জমিনকে পানি উদগীরণ করতে নিষেধ করলেন। তখন থেকে ধীরে ধীরে পানি কমতে আরম্ভ হল।
নূহ (আঃ)-এর জাহাজের মাটিতে অবতরণ
এক সময় বাতাস বন্দ হল এবং স্রোতের বেগ স্তিমিত হল। এ সময় জাহাজখানি জুদী পাহাড়ে এসে ঠেকল, আস্তে আস্তে অন্যান্য পর্বত চূড়া দৃশ্যমান হতে লাগল ।
আল্লাহর আযাবে নিমজ্জিত হয়ে যখন ইসলামের শত্রুগণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, তখন আযাবের এলাকাসমূহ পূর্বের ন্যায় হয়ে গেল। মহান আল্লাহ আদেশ দিলেন-
১১:৪০ حَتّٰۤی اِذَا جَآءَ اَمۡرُنَا وَ فَارَ التَّنُّوۡرُ ۙ قُلۡنَا احۡمِلۡ فِیۡهَا مِنۡ کُلٍّ زَوۡجَیۡنِ اثۡنَیۡنِ وَ اَهۡلَکَ اِلَّا مَنۡ سَبَقَ عَلَیۡهِ الۡقَوۡلُ وَ مَنۡ اٰمَنَ ؕ وَ مَاۤ اٰمَنَ مَعَهٗۤ اِلَّا قَلِیۡلٌ
অর্থাঃ নির্দেশ হলো, হে যমীন! তোমার সব পানি গিলে ফেল আর আকাশ থেমে যাও। তারপর পানি যমীনে বসে গেল এবং ফায়সালা চূড়ান্ত হয়ে গেল । নৌকা জুদী পর্বতের গায়ে এসে ভিড়লো। তারপর বলে দেয়া হলো, জালিম লোকজন দূর হয়ে গেল। (সূরা হূদ : ৪৪)
হযরত নূহ (আঃ)-এর জাহাজ পর্বতের উপর এমনভাবে আটকে গেল যাতে সকল প্রাণীর উঠা-নামা সহজ হয়। হযরত নূহ (আঃ)-প্রথমে জুদী পাহাড়ের উপর অবতরণ করেন। অতঃপর তার উম্মতেরা অবতরণ করেন। তারা চতুর্দিকে চেয়ে দেখল পানিতে পৃথিবী ছেয়ে আছে। উম্মতেরা পাহাড়ের উপর অবতরণ করে সেখানে থাকার মত ঘর তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করল। কাঠের অভাবে পাথরের উপর পাথর রেখে দেয়াল তৈরি করল। অতঃপর ফোম দিয়ে ছাদের ব্যবস্থা করল। এভাবে খুব ছোট ছোট ঘর তৈরির কাজে সকলে ব্যস্ত হল। এ সময়ের মধ্যে জমিনের পানি সবটুকু নিঃশেষ হল। তখন হযরত নূহ (আঃ) পক্ষীকুলকে জমিনের পানি মাপার জন্য প্রেরণ করলেন। এগুলোর মধ্যে শুধু কবুতর এসে জানায় অতি সামান্য পানি বাকি আছে। তখন তিনি উম্মতদেরকে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ নিয়ে জমিনে প্রেরণ করলেন। তারা যেন উদ্ভিদের উপযোগী স্যাতস্যাতে মাটিতে এগুলি পুতে আসেন। উম্মতেরা নবীর আদেশ অনুসারে বিভিন্ন উদ্ভিদ চারা নিয়ে জমিনে গেলেন এবং সেখানে স্বযত্নে পুতে রাখলেন। অতঃপর নবী সমস্ত জীব জানোয়ারকে জমিনে পৌঁছে দিতে আদেশ দিলেন। উম্মতেরা তখন জীব-জানোয়ারগুলোকে ধরে ধরে পাহাড়ের উপর থেকে নামিয়ে দিলেন। কোন কোন জানোয়ার নিজেরাই নামতে সক্ষম হল।
উম্মতেরা জমিনের চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। সর্বত্র পরিষ্কার দেখা যায়। তবে উত্তর দিকে কিছু দূরে একটি বাগানের মত কি যেন মনে হয় । উম্মতেরা এ ব্যাপারটি দেখে অবাক হলেন এবং রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য সেদিকে রওয়ানা করলেন। ধীরে ধীরে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে দেখলেন বাস্তবিকই একটি বিরাট বাগানের অস্তিত্ব সেখানে বিরাজমান। এমন প্লাবনের পরে কোন বাগানের অস্তিত্ব পৃথিবীতে বাকি থাকতে পারে এটা তাদের নিকট অতি বিস্ময়কর বলে মনে হল। তারা আরো সম্মুখে অগ্রসর হয়ে দেখল এক সুবিশাল বাগিচা, উম্মতেরা কৌতূহল বশে বাগানের মধ্যে প্রবেশ করে দেখলেন সেখানে এক গোয়াল ঘরে অনেক গাভী, আস্তাবলে অনেক ঘোড়া এবং কতিপয় মানুষও সেখানে ঘুরাফিরা করছে। তখন তারা লোকগুলোর নিকটে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভাই আপনারা কারা? তারা বলল, আমরা গরীব কৃষক। উম্মতেরা জিজ্ঞেস করল, আপনারা এখানে কিভাবে বেঁচে রইলেন। সারা পৃথিবী ব্যাপী এত বড় ভয়াবহ প্লাবন হল, তার মাঝে আপনাদের বস্তি ও আপনারা কিভাবে রক্ষা পেলেন।
কৃষকেরা বলল, ভাই আমরা এখানে সামান্য বৃষ্টি ব্যতীত আর কিছুর খবর জানি না। আমরা হযরত নূহ (আঃ)-এর উম্মত বলে দাবি করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁকে আমরা আজ পর্যন্ত চোখে দেখিনি। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়ে আমার আম্মা আজ কয়েক বছর যাবত কান্নাকাটি করে দিন গুজরান করছেন। তিনি ঐ ঝুপড়িতে থাকেন এবং নবীর সাক্ষাতের জন্য ব্যকুল হয়ে কাঁদছেন। আমরা তার আঠারো জন সন্তান-সন্ততি সদা সর্বদা তার খেদমত করে থাকি। তার উপদেশ অনুসারে চলি এবং যুগের নবী হযরত নূহ (আঃ)-এর অনুসন্ধানে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াই। বর্তমানে আমাদের আম্মার অসুস্থতার জন্য কেউ নবীর সন্ধানে বাইরে যেতে পারি নি। সকলেই আম্মার নিকটে আছি। আমরা চাষাবাদ করি এবং বাগানে ফলমূল উৎপাদন করে জীবন ধারণ করে থাকি। উম্মতেরা এ সব লোকের কথা শুনে বলল, ভাই তোমার আম্মার নিকট আমাদেরকে একটু নিয়ে যাবে? তারা বলল চলুন, তিনি এখন কিছুটা সুস্থ। উম্মতেরা তাদের সাথে রওনা হল, বিশাল সে বাগান মনে হয় যেন কয়েকটি গ্রাম জুড়ে বাগানের পর বাগান রয়েছে।
অনেকক্ষণ হাঁটার পরে তারা গিয়ে একটি গাছের পাতার তৈরি ঘরের নিকটে পৌঁছল। অতঃপর তাদের একজনে ঘরে ঢুকে তার আম্মাকে মেহমান আগমনের খবর দিল। বৃদ্ধা তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, এবার হয়ত আল্লাহ তা'য়ালা হযরত নূহ (আঃ)-এর খাস উম্মতদের সাথে সাক্ষাতের নছিব দান করবেন। এই বলে বৃদ্ধা তাদেরকে ঘরে নিয়ে আসার জন্য ছেলেদেরকে বললেন। তখন উম্মতেরা বৃদ্ধার নিকট গমন করল। বৃদ্ধা তাদেরকে দেখে বললেন, বাবা! আজ আমি ধন্য, তোমাদের ন্যায় নবীর প্রিয় ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য আল্লাহ আমাকে এত সহজে দান করবেন তা কোন দিন কল্পনা করি নি ।
আমি হযরত নূহ (আঃ)-এর সাথে স্বপ্নে কিছুটা সম্পর্ক রাখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। কিন্তু বাস্তবে তাকে দর্শন করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাই দিবারাত্র আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বলি, হে খোদা! আমার জীবনে অন্তত একবার নবীর দর্শন লাভের সৌভাগ্য দান কর। আপনারা যে নবীর একান্ত ঘনিষ্ট সহচর সে খবর আমি পেয়েছি। আপনাদের দর্শন লাভে আমি অন্তরের যে কত তৃপ্তি লাভ করেছি তা আপনাদিগকে বলে বুঝাতে পারব না। আমি আজ আপনাদের মারফত নবীর দরবারে ছালামটুকু প্রেরনের সৌভাগ্য লাভ করেছি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। আপনারা আমার ও আমার সন্তানদের জন্য একটু দোয়া করুন যেন নবীর প্রদর্শিত পথের সন্ধান লাভ করতে পারি। কিয়ামতের দিন যেন নবীর কদমের নিকট আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের একটু স্থান করে দেন ।
উম্মতেরা বৃদ্ধার অবস্থা দেখে অবাক হলেন এবং বললেন, আম্মা! আপনি আল্লাহ তা'য়ালার একজন অতি প্রিয় ব্যক্তি। আপনার পদমর্যাদার কথা আমরা এখানে বর্ণনা করব না। আমরা আপনার খবর ও আপনার কথা নবীর খেদমতে পৌঁছে দেব। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন। এই বলে উম্মতেরা বিদায় হলেন।
ওদিকে আল্লাহ তা'য়ালা নবীকে হুকুম দিলেন তিনি যেন জাহাজ বেঙ্গে জুদী পাহাড়ের উপর একখানা মসজিদ নির্মাণ করেন এবং উম্মতের জন্য আবাসিক ঘর তৈরি করেন। জাহাজে নবীর উম্মতের সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই শত। তাদের মধ্য থেকে স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে জুদী পাহাড়ের উপর নির্মিত নতুন শহরের নামকরণ করেছেন 'ছামানীন অর্থ আসা। বাকি উম্মতদেরকে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাসের আদেশ প্রদান করেন ।
(এই লেখাটি আলহাজ্ব মাওলানা লুৎফুল আলম রচিত ও ছারছীনা প্রকাশনী হতে প্রকাশিত “কুরআনের শ্রেষ্ট কাহিনী” গ্রন্থ অবলম্বনে তৈরী করা হয়েছে)
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url