কুরআনের গল্পঃ মহাপ্লাবনের পর নূহ (আঃ) ও ইবলিশ শয়তানের মধ্যে কথোপকথন



নূহ (আঃ) ও ইবলিশ শয়তানের কথোপকথন


ইবলিশ জাহাজ থেকে অবতরণ করে সারা পৃথিবী ঘুরে কোথাও কোন মানুষ বা অন্য প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পেল না। তখন সে হতাশ হয়ে নিষ্ক্রিয় জীবন-যাপন শুরু করল। কয়েকদিন এভাবে থাকার পরে তার ধৈর্য্য আর মানল না। তখন সে সোজা হযরত নূহ (আঃ) নিকট গিয়ে বলে, হে আল্লাহর নবী! আপনি আমার বিরাট উপকার করেছেন, প্লাবনের ভয়াবহতা থেকে আমাকে রক্ষা করেছেন, এ জন্য আমি অশেষ কৃতজ্ঞতার বিনিময়ে আমি আপনাকে কিছু দিতে চাই, আপনি আমার নিকট কি চান? নবী বললেন, তোর নিকট চাইবার আমার কিছুই নেই, তবে একটি বিষয় চাইতে পারি, সেটা হল আমার উম্মতদেরকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করিস না।

শয়তান নিজে থেকে কিছুই করে না


শয়তান নবীর কথার উত্তরে বলল, হুজুর! আমি আল্লাহর কসম করে বলতে পারি জীবনে আমি কোন মানুষকে অন্যায় করার জন্য প্ররোচিত করিনি। বরং এ ব্যাপারে মানুষেরাই চিরদিন আমাকে উত্যাক্ত করছে। আমি শুধুমাত্র অন্যায় কাজের সুচনা করে বিদায় নিতাম। পরে ওটাকে সঠিক রূপদানকারী বা সঞ্জিবীত করার দায়িত্ব চিরদিন বনী আদমেরাই পালন করেছে। দ্বিতীয়ত আমি বিনা দাওয়াতে কোথাও গিয়ে উপস্থিত হই না। ঘন ঘন দাওয়াতের পরে হয়ত একবার গিয়ে দু'একটি উপদেশ দিয়ে এসেছি। এর অতিরিক্ত কোন দিন কিছু করিনি। আগামীতেও করব না। এ ওয়াদা আপনাকে দিতে পারি।

শয়তান কাউকে মূর্তিপূজার দাওয়াত দেয় না


যেমন ধরুন জনৈক নবী ইন্তেকালের পরে আমি একখানা সুসজ্জিত ঘর নির্মাণ করে তার মধ্যে মৃত নবীর হুবহু আকৃতির একটি মূর্তি তৈরি করে রাখি। এরপরে আমি কাউকে তার পূজা করতে দাওয়াত দেই নি। মানুষেরা স্ব-ইচ্ছায় মূর্তির নিকট এসে তার পূজা-অর্চনা আরম্ভ করে। অল্প দিনে মজলিশটি ভালই জমে গেল । বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে মানুষ এসে এ পূজায় অংশ গ্রহন করতে থাকে। এমন কি শেষ দিকে মানুষ খোদার পরিবর্তে নবীর মূর্তির নিকট নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রার্থনা করত। নিঃসন্তান রমনীরা সন্তান লাভের কামনাকরত। অর্থহীনতা দূর করণার্তে মূর্তির নিকট তার দয়া প্রার্থনা করত। কালক্রমে এখানে পুরোহিতের আস্তানা হয় এবং বার্ষিক মেলার নিয়ম প্রবর্তিত হয়।

এক সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা নবীর মূর্তি নিয়ে এভাবে বাড়াবাড়ি ও শেরেক করার প্রতিবাদে দল বেঁদে এসে নবীর মূর্তি রক্ষিত মন্দিরের উপর আক্রমণ করল। তখন পুরোহিত চিৎকার দিয়ে তার ভক্তবৃন্দকে ডাকল। বেশ লোক সেখানে সমবেত হল। তখন উভয় দলের মধ্যে প্রথমে কথাবার্তা পরে ঝগড়া, শেষ পর্যন্ত মারামারি ও যুদ্ধে রূপ নিল। ধর্মপরায়ণেরা মনে করেছিল তাদেরকে আল্লাহ তা'য়ালা সরাসরি সাহায্য করবেন। তাই তারা খালি হাতে সেখানে উপস্থিত হয়। আর ধর্মদ্রোহীরা অস্ত্রে সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেখানে আসে। এ অবস্থায় মারামারি ও যুদ্ধের পরিণাম অত্যন্ত দুঃখজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌছে। ধর্মপরায়ণের দল মার খেয়ে হতাহত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়। আর ধর্মদ্রোহীরা বিজয় পতাকা উড়িয়ে আনন্দ করতে থাকে। এ বিষয়টি নিয়ে বৃদ্ধেরা ও বুদ্ধিজীবীরা আলোচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে, যুদ্ধে যারা বিজয়ী হয়েছে তারাই হকপন্থী। আর যারা হেরে গেছে তারা বাতিলপন্থী। অতএব হকপন্থীদের সাথে থাকাই আমাদের নাজাতের একমাত্র পথ। এই বলে সারা দেশের অধিকাংশ মানুষ মূর্তি পূজায় অংশ গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে মানুষের কৃতকর্মের জন্য আমাকে আদৌ দায়ী করতে পারেন না।

শয়তান কাবিলকে হত্যায় প্ররোচিত করেনি


এভাবে আদম সন্তান কাবিলকে আমি শুধু বলেছিলাম তোমার অপরূপা সুন্দরী বোন একলিমাকে তোমার সাথেই ভাল মানায়। অতএব ওকে ছেড়ে দেয়া তোমার ঠিক হবে না। দরকার বোধে হাবিলকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েও তোমার উদ্দেশ্য সফল করা উচিত। এর অতিরিক্ত কথা আমি তাকে বলিনি। যার পরিণামে সেখানে কি বিরাট দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে এ ব্যাপারে আমাকে দায়ী করতে পারেন না। 

শয়তান বিবি হাওয়াকে গন্ধম খেতে বাধ্য করেনি


অনুরূপ বিবি হাওয়াকে বেহেস্তে বসে শুধু গন্ধম গাছটি দেখিয়ে দিয়েছি এবং ফলের উপকারিতা সম্বন্ধে দু একটি কথা তাকে বলেছি। কিন্তু আমি নিজ হাতে ফল ধরিনি। বিবি হওয়া নিজ হাতে ফল ছিড়েছেন। নিজে খেয়েছেন এবং আদমকে অচৈতন্য করে ফল খাইয়ে দিয়েছেন। পরে ভাগ্য দোষে যা হবার তাই হয়েছে। এ জন্য আমাকে দোষী করতে পারেন না।

শয়তান শুধু বনি আদমকে পরামর্শ দেয়


এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত আমি বনি আদমকে কিছু পরামর্শ দানের কাজ করে যাবার নিয়ত করেছি। আমার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন সহজে আমার আশা পূর্ণ করেন। হুজুর! আমার আর একটি আদর্শ আছে সেটা হল, আমি বাজে মানুষের নিকট বেশি যাতায়াত করি না। আমি নবী-রাসূলগণের সঙ্গলাভ পূণ্যের কাজ মনে করে তাদের সঙ্গেই অধিক সময় কাটানোর ইচ্ছা রাখি। বাকি গউছ, কুতুব ও অলীদেরও কিছু সময় দেবার চিন্তা করেছি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে চলা-ফেরার আমার মান-ইজ্জত রক্ষা পাবে না বলে আমি তাদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলি।

হুজুর! আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। বর্তমানে দীর্ঘদিন যাবত আপনার সঙ্গে আছি। এটা কোন অসৎ নিয়তে নয়। একমাত্র আমার জীবন রক্ষার জন্য । অতএব এখন বলুন, হুজুর! আমি আপনার কি খেদমত করতে পারি।

শয়তান নূহ (আঃ)-এর ফজর নামাজ কাজা করেছিল যেভাবে


হযরত নূহ (আঃ) বললেন, আচ্ছা নবীদের সঙ্গে থেকে যখন কাউকে রেহাই দাওনি তখন আমাকে কবে কি করছ। শয়তান বলল, হুজুর! আপনার কোন ক্ষতি সাধনের চেষ্টা কখনই আমি করিনি। তবে একদা রাত্রি বেলায় উটের গোস্ত দিয়ে উত্তমরূপে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়েছিলেন, ঐ দিন আমি আপনার ঘুমের গভীরতা সৃষ্টির জন্য নানা রঙের স্বপ্নে আপনাকে বিভোর করে রেখেছিলাম । যাতে করে আপনার ফজর নামায কাযা হয়েছিল। হযরত নূহ (আঃ) এ কথা শুনে বললেন, “আস্তাগফিরুল্লাহ, আমি আর জীবনে পেটভরে খানা খাব না।” শয়তান, নবীর কথা শুনে বলল, “আস্তাগফিরুল্লাহ আমিও আর জীবনে উচিত কথা কারো নিকট বলব না।"

হযরত নূহ (আঃ) তখন বললেন, এখন তুই বিদায় হ। তোর আর কোন খেদমত আমার প্রয়োজন নেই। আগামীতেও প্রয়োজন হবে না। শয়তান তখন নিরবে সেখান থেকে কেটে পড়ল। দ্বিতীয়বার আর কোন দিন নবীর সম্মুখে হাজির হয়নি।

হযরত নূহ (আঃ) জুদী পাহাড়ে মসজিদ, বসত বাড়ি স্থাপন করে চতুর্দিকে হেদায়েতের বাণী প্রচার করে বেড়াতেন। নবীর যে সব উম্মতেরা অনেক দূরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে জীবন-যাপন করতে আরম্ভ করে, তাদের সন্তানদেরকে শয়তান পরামর্শ দিয়ে পুনঃ মূর্তি পূজার প্রচলন শুরু করে। হযরত নূহ (আঃ)-এর উম্মতেরা এ পূজা বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু কোন চেষ্টা আদৌ কার্যকরী হল না। ধর্মদ্রোহীদের সংখ্যা সর্বত্র বৃদ্ধি পেতে লাগল ।

নূহ (আঃ)-এর ভাঙা জাহাজের পেরেক দিয়ে শয়তানের যাদুমন্ত্র


কথিত আছে শয়তান হযরত নূহ (আঃ)-এর ভাঙা জাহাজ থেকে কাঠের একটি পেরেক চুরি করে এনে তা দিয়ে কিছু অলৌকিক ঘটনা মানুষকে প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়। যাতে করে এ কাজ দ্বারা মানুষকে সহজে সে পথ ভ্রষ্ট করতে পারে। উক্ত পেরেকটি জনৈক বৃদ্ধ মানুষের হাতে দিয়ে শয়তান বলেছিল এটা দ্বারা তুমি মানুষের পূর্বের ও পরের মঙ্গল-অমঙ্গল বলে দিতে পারবে। ছোট-খাট বিপদাপদ ঠেকাতে পারবে এবং পীড়া থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে সক্ষম হবে। তবে একাজ করার জন্য সকলকে মুর্তি পূজা করতে বাধ্য করতে হবে। বৃদ্ধ শ্রদ্ধাভরে উক্ত পেরেকটি শয়তানের নিকট থেকে গ্রহণ করে মানুষের মাঝে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। যার ফলে পরবর্তীতে দেশের প্রায় সকল মানুষ মূর্তি পূজার প্রতি আসক্ত করে ফেলে। এটা ছিল হযরত নূহ (আঃ)-এর যুগে শয়তানের বিরাট বিজয়।

হযরত নূহ (আঃ)-এর মৃত্যু | হযরত নূহ (আঃ)-এর কবর


হযরত নূহ (আঃ) একাধারে সাড়ে নয় শত বছর জীবিত থেকে দ্বীনের প্রচার করে জুদী পাহাড়ে ইন্তেকাল করেন। সেখানে মসজিদের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। তার ভক্তবৃন্দেরা শুধুমাত্র জুদী পর্বত এলাকায় ছামানীন শহরে নিজেদের আদর্শ সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। বাকি এলাকা আদর্শচ্যুত হয়ে শয়তানের পথ অনুসরণ করে।

(এই লেখাটি আলহাজ্ব মাওলানা লুৎফুল আলম রচিত ও ছারছীনা প্রকাশনী হতে প্রকাশিত “কুরআনের শ্রেষ্ট কাহিনী” গ্রন্থ অবলম্বনে তৈরী করা হয়েছে)



💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url