কুরআনের গল্পঃ হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ) এর দুনিয়ার পার্থিব জীবন যাপন



আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়ার দুনিয়ার জীবন শুরু


হযরত আদম (আঃ) আল্লাহ তা'য়ালার তরফ থেকে ক্ষমা লাভের পর কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন বটে কিন্তু জীবন যাপনের ক্ষেত্রে জটিলতার মধ্যে দিন যাপন করতে লাগলেন। তিনি ও বিবি হাওয়া এ দীর্ঘদিন গাছের ফলমূল ও পানি পান করে জীবন ধারণ করেছেন। যা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর ও পীড়াদায়ক । 

তাঁদের এমন কষ্টকর অবস্থায় হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বেহেস্ত থেকে এক জোড়া বলদ এক জোড়া গাভী এনে দিলেন। তৎসঙ্গে কিছু গমের বীজও নিয়ে আসলেন। অতঃপর বলদ দ্বারা চাষাবাদ করে ফসল উৎপাদন করার পদ্ধতি তিনি শিখিয়ে দিলেন। গম মাটিতে ফেলার সাথে সাথে হযরত আদম (আঃ) সাত ঘন্টার মধ্যে পাকা গম লাভ করতে সক্ষম হলেন। এর খোসা ছাড়ান ও গুঁড়া করে রুটি তৈরির পদ্ধতি বিবি হাওয়াকে শিখিয়ে দেয়া হল। কিন্তু রুটি ভাজার জন্য আগুনের অভাব দেখা দিল। তখন হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আল্লাহ তা'য়ালার আদেশক্রমে দোযখ থেকে সামান্য ধুয়া নিয়ে আসলেন। যখন ঐ ধুয়া মাটির উপর রাখা হল তখন মাটি নিমিষের মধ্যে জ্বলে এক গর্তের সৃষ্টি হল, উক্ত গর্ত দ্বারা দোজখের ধুয়া দোজখে গিয়ে পতিত হল । এভাবে কয়েক বার চেষ্টা করে দোজখের ধুয়া পৃথিবীতে রাখা সম্ভব হল না। তখন আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশক্রমে উক্ত ধুয়া রহমতী দরিয়ায় সাতবার ধুয়ে পৃথিবীতে আনা হল। তখন উহা স্বাভাবিক আগুন হিসেবে প্রয়োজনীয় জ্বালানি কার্য সমাধা করে।

জনৈক মুফাস্সের লিখেন দোজখের দৃয়া দোজখে চলে যাবার পরে আল্লাহ তা'য়ালা হযরত আদম (আঃ)-কে চকমকি পাথর ঘসে আগুন জ্বালানের নির্দেশ দেন। সেভাবে আদম (আঃ) আগুনের সন্ধান লাভ করেন। আগুনের ব্যবস্থা হবার পরে রুটি তৈরি, মাংস পাক করা ও অন্যান্য জরুরি প্রয়োজন সমাদা করা আদম ও বিবি হাওয়ার পক্ষে সহজ হয়। এরপরে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) লোহার ব্যবহার, স্বর্ণের ব্যবহার, শিক্ষা-দীক্ষার পদ্দতি, ঘর তৈরির জ্ঞান ইত্যাদি এক এক করে হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়াকে শিখিয়ে দেন। যাতে করে শেষ জীবনে হযরত আদম (আঃ) বিনা পরিশ্রমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনেক কঠিন ও দুরুহ কাজ সহজে সমাধান করতে সক্ষম হন।

সরল মতি আদম (আঃ) ও হাওয়া বেহেস্তে থাকাকালীন সময় যতটা সহজ সরল ছিলেন, পৃথিবীতে আগমনের পরে তার চেয়ে বহুগুণ সতর্ক ও সাবধান হন। শয়তানের পক্ষে পৃথিবীতে এসে আদম (আঃ)-কে দ্বিতীয়বার আর কোন বিপদে ফেলা সম্ভব হয়নি। বরং হযরত আদম (আঃ)-কে ধোকা দিতে গিয়ে শয়তানকে অনেক ক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে শয়তান আদম (আঃ)-এর সন্তানদের মধ্যে নিজ প্রভাব ও প্রসারতা বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।

হযরত আদম (আ:) ও বিবি হাওয়ার সন্তান-সন্তুতি


হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়াকে আল্লাহ তা'য়ালা স্থায়ীভাবে সিংহলে বসবাসের আদেশ দেন। তারা আল্লাহ তা'য়ালার হুকুম অনুসারে সেখানে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। সেখানে তাদের সন্তান-সন্ততি জন্ম নেয়। আল্লাহ তায়ালার বিধান হিসেবে বিবি হাওয়া একত্রে দুটি সন্তান প্রসব করতেন। একটি ছেলে অপরটি মেয়ে। এ পদ্ধতির রহস্য ছিল, এক জোড়ের ছেলে অপর জোড়ের মেয়ের সাথে এবং অপর জোড়ের মেয়ে প্রথম জোড়ের ছেলের সাথে বিবাহ সম্পাদন করা হত।

হযরত আদম (আঃ)-এর প্রথম যে জোড়া সন্তান জন্ম হয় তার ছেলের নাম কাবিল ও মেয়ের নাম রাখা হয় একলিমা। একলিমা ছিল খুব সুন্দরী ও রূপসী। দ্বিতীয় বার হযরত আদম (আঃ)-এর যে সন্তান জন্ম নেয় তার ছেলের নাম রাখা হয় হাবিল ও মেয়ের নাম রাখা হয় সাজা। দ্বিতীয় বারের কন্যটি তেমন সুন্দরী ছিল না। এভাবে প্রতি বছর বিবি হাওয়া এক জোড়া করে সন্তান জন্ম দিতে আরম্ভ করেন। ইতিহাস সূত্রে যতদূর জানা যায় তাতে বিবি হাওয়া সর্বমোট ১৮০ জোড়া সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। 

হযরত আদম (আঃ) প্রায় বারশত বছর জীবিত ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর সাড়ে তিনশত সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সন্তানদের অধিকাংশকে তিনি নিজের পার্থিব ও পারলৌকি তালিম দান করেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে কাবিল ছাড়া সকলেই ঈমানদার ছিলেন। হযরত আদম (আঃ) জীবনের শেষ দিকে মোটামুটি আরাম আয়েসে কাটিয়েছেন।

হাবিল ও কাবিলের বিবাহ বিষয়ক কাহিনী


প্রথম ও দ্বিতীয় জোড়ের সন্তানেরা যখন বড় হয় তখন আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর বিধান অনুসারে তাদের বিবাহ সম্পাদন করার জন্য তাকিদ দেন। তখন হযরত আদম (আঃ) প্রথম দুই জোড়ের সন্তানদেরকে ডেকে আল্লাহ তা'য়ালার বিধান অনুসারে বিবাহের প্রস্তাব করেন। এক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান কাবিল আপত্তি করে বলল, আমার বোন একলিমাকে আমি বিবাহ করব। তখন হযরত আদম (আঃ) বললেন, এটি আল্লাহ তা'য়ালার বিদান নয়। কাবিল বলল, এটি আল্লাহর বিধান নয় তার প্রমাণ কি? তখন হযরত আদম (আঃ) বললেন, তুমি এবং হাবিল দুজনে দুটি কুরবানী করে মিনার পাহাড়ের উপর রেখে আস। যার কুরবানী আল্লাহ কবুল করবেন সে একলিমাকে বিবাহ করবে।

হযরত আদম (আঃ)-এর যুগে সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ অবগতির জন্য আল্লাহ তা'য়ালা এ ধরনের একটি মোজেজা হযরত আদম (আঃ)-কে দান করেছিলেন। অন্যান্য নবীগণের যুগেও এ জাতীয় অনেক ব্যবস্থা চালু ছিল। যা দ্বারা সরাসরি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অজানা বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া সম্ভব ছিল এবং উচিত বিচারের রায় পাওয়া যেত। যেমন- হযরত নূহ (আঃ)-এর যুগে ছিল 'জাহাজ'। জাহাজের উপর হাত রাখলে যদি জাহাজ স্থির থাকত তবে বুঝা যেত বাদী সত্যবাদী, আর যদি নড়ে উঠত তবে বুঝা যেত বাদী মিথ্যাবাদী।

 হযরত দাউদ (আঃ)-এর যুগে ছিল 'লোহার শিকল” এর ব্যবস্থা। এটা আসমানে ঝুলন্ত থাকত। বিবাদমান ব্যক্তিদের মধ্যে যে শিকল ধরত সে যদি সত্যবাদী হত তা হলে শিকল তার হাত জড়িয়ে ধরত। আর যদি মিথ্যাবাদী হত তবে শিকল তাকে ধরতনা। হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর যুগে ছিল 'গর্তের বিচার।' বিবাদ মান ব্যক্তিদের মধ্যে যার পা গর্তে আটকে যেত সে ছিল অন্যায়কারী আর যার পা গর্তে আটকাত না সে ছিল সত্যবাদী।

হযরত জাকারিয়া (আঃ)-এর যুগে ছিল কলমের বিচার। এভাবে অধিকাংশ নবীর যুগে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের এক একটি খোদায়ী ব্যবস্থা থাকত। কিন্তু শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে আল্লাহ তা'য়ালা এসব ব্যবস্থা বাতিল করে দুজন সাক্ষীর জবান বন্দির উপর সত্য-মিথ্যার প্রমাণ নির্ভর করে দিলেন। এটা ছিল শেষ নবীর উম্মতকে সম্মানীত করে দেখাবার একটি পদ্ধতি মাত্র।

হযরত আদম (আঃ) এর নির্দেশ অনুসারে তার দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল দুটি মেষ জবাই করে মিনার এক পাহাড়ের উপর রেখে আসল। কিছুক্ষণের মধ্যে একখণ্ড অগ্নি এসে হাবিলের জবেহকৃত মেষটি উধাও করে দিল। এ দৃশ্য অবলোকন করে হযরত আদম (আঃ) বললেন, হাবিলের কুরবানী কবুল হয়েছে। অতএব সেই একলিমাকে বিবাহ করবে। আল্লাহ তা'য়ালার এ ইঙ্গিত অনুসারে হযরত আদম (আঃ) হাবিলের সঙ্গে একলিমাকে এবং কাবিলের সঙ্গে সাজকে বিবাহ দিয়ে দিলেন ।

কাবিল ঈমানদারীর ক্ষেত্রে খুব অগ্রগামী ছিল না। সে পিতার সিদ্ধান্ত মনে প্রাণে মেনে নিতে পারল না। সে হাবিলকে হুমকি দিয়ে বলল, তুমি একলিমাকে পরিত্যাগ কর, না হয় আমি তোমাকে হত্যা করব। হাবিল সে কথায় বলল, আমি আল্লাহ ও রাসূলের সিদ্ধান্তের উপর বহাল থাকব। তাতে তুমি আমাকে ভয় প্রদর্শন করে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। কাবিল এ কথায় ভীষণ ক্রোধান্বিত হল। এবং হাবিলকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করল। একদা হযরত আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) কাবাঘর জিয়াতের জন্য মক্কা শরীফ চলে গেলেন। এদিকে কাবিল এ সময়টাকে তার দুরভিসন্ধি চরিতার্থের উপযোগী সময় হিসেবে বেছে নিল এবং হাবিলের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াতে লাগল ।

মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যার কাহিনী


কাবিলের চিন্তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে একটা প্রতিবন্ধকা দেখা দিল। সেটা হল কি উপায়ে তাকে হত্যা করবে তা সে স্থির করতে পাল না। এ সময় শয়তান দীর্ঘদিন পরে আদম (আঃ)-এর সস্তানদের ক্ষেত্রে একটু কাজ করার সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হল। সে কাবিলের সম্মুখে একজন পথচারী হিসেবে উপস্থিত হল। কাবিল দেখল পথচারীর সম্মুখ দিয়ে একটি সাপ অতিক্রম করছিল। এমন সময় পথচারী একখণ্ড ভারী পাথর এনে সাপের মাথায় আঘাত করল। তাতে সাপের মাথা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল এবং অল্প সময়ের মধ্যে সাপটি মারা গেল। একাজ সমাদা করে পথচারী চলে গেল। কাবিল এ দৃশ্য দেখে হত্যার উপযুক্ত কৌশল গ্রহণ করল।

অতঃপর সে হাবিলের খোঁজ খবরে বের হল। বাড়ির বাইরে গিয়ে সে দেখতে পেল, হাবিল ছাগল বসবাসকারী একটি নির্জন গৃহের এক কোণে ঘুমিয়ে আছে। তখন কাবিল দুর থেকে একটি ভারী পাথর বহন করে নিয়ে আসল এবং ধীরে ধীরে হাবিলের কাছে গিয়ে সজোরে পাথর দ্বারা তার মাথায় আঘাত করল। অমনি হাবিল ছটফট করে উঠল। তখন কাবিল পাথরটি উঠিয়ে পুনরায় তার মাতায় আঘাত করল। এবার সে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হাবিল মৃত্যুবরণ করল।

প্রাথমিক কাজ সমাদা করে সে দ্বিতীয় আর একটি সমস্যার সম্মুখীন হল। হাবিলকে হত্যা করা হয়েছে, এখন তার লাশটি কি করা যাবে, যদি এভাবে রাস্তার পাশে লাশটি পড়ে থাকে তাহলে তার অন্যান্য ভাইয়েরা এ হত্যার রহস্য অবশ্যই উদ্ঘাটন করে ফেলবে। কাবিল এ বিষয় নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হল । এমন কি সে দুচক্ষের পানি ছেড়ে দিয়ে অঝোর নয়নে কাঁদতে লাগল । এমন সময় সে একটু দূরে দেখতে পেল, দুটি কাক ভীষণ যুদ্ধে ও মারামারিতে লিপ্ত। কিছুক্ষণ মরণপণ যুদ্ধ করার ফলে একটি কাক মৃত্যুবরণ করল, হত্যাকারী কাকটি নিজ ঠোঁট ও পা দ্বারা মাটিতে একটা বড় গর্ত করে নিল এবং মৃত কাকটিকে টেনে এনে সে গর্তের মধ্যে ফেলে উপরে মাটি দিয়ে ঢেকে দিল। এ কাজ সমাধান করে কাকটি উড়ে চলে গেল। কাবিল এ দৃশ্য দেখে নিজের জন্য পথ পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি সে নিকটবর্তী স্থানে একটি কবর খনন করল এবং তার মধ্যে হাবিলকে রেখে মাটি চাপা দিল।

এ সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে এরশাদ হয়েছে-

৫:২৭ وَ اتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَاَ ابۡنَیۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ ۘ اِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنۡ اَحَدِهِمَا وَ لَمۡ یُتَقَبَّلۡ مِنَ الۡاٰخَرِ ؕ قَالَ لَاَقۡتُلَنَّکَ ؕ قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰهُ مِنَ الۡمُتَّقِیۡنَ  ৫:২৮ لَئِنۡۢ بَسَطۡتَّ اِلَیَّ یَدَکَ لِتَقۡتُلَنِیۡ مَاۤ اَنَا بِبَاسِطٍ یَّدِیَ اِلَیۡکَ لِاَقۡتُلَکَ ۚ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اللّٰهَ رَبَّ الۡعٰلَمِیۡنَ  ৫:২৯ اِنِّیۡۤ اُرِیۡدُ اَنۡ تَبُوۡٓاَ بِاِثۡمِیۡ وَ اِثۡمِکَ فَتَکُوۡنَ مِنۡ اَصۡحٰبِ النَّارِ ۚ وَ ذٰلِکَ جَزٰٓؤُا الظّٰلِمِیۡنَ   ৫:৩০ فَطَوَّعَتۡ لَهٗ نَفۡسُهٗ قَتۡلَ اَخِیۡهِ فَقَتَلَهٗ فَاَصۡبَحَ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ  ৫:৩১ فَبَعَثَ اللّٰهُ غُرَابًا یَّبۡحَثُ فِی الۡاَرۡضِ لِیُرِیَهٗ کَیۡفَ یُوَارِیۡ سَوۡءَۃَ اَخِیۡهِ ؕ قَالَ یٰوَیۡلَتٰۤی اَعَجَزۡتُ اَنۡ اَکُوۡنَ مِثۡلَ هٰذَا الۡغُرَابِ فَاُوَارِیَ سَوۡءَۃَ اَخِیۡ ۚ فَاَصۡبَحَ مِنَ النّٰدِمِیۡنَ  ৫:৩২ مِنۡ اَجۡلِ ذٰلِکَ ۚۛؔ کَتَبۡنَا عَلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ اَنَّهٗ مَنۡ قَتَلَ نَفۡسًۢا بِغَیۡرِ نَفۡسٍ اَوۡ فَسَادٍ فِی الۡاَرۡضِ فَکَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیۡعًا ؕ وَ مَنۡ اَحۡیَاهَا فَکَاَنَّمَاۤ اَحۡیَا النَّاسَ جَمِیۡعًا ؕ وَ لَقَدۡ جَآءَتۡهُمۡ رُسُلُنَا بِالۡبَیِّنٰتِ ۫ ثُمَّ اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنۡهُمۡ بَعۡدَ ذٰلِکَ فِی الۡاَرۡضِ لَمُسۡرِفُوۡنَ

অর্থঃ আর তাদেরকে আদমের দু পুত্রের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে শুনিয়ে দিন যখন তারা উভয়ে কিছু কোরবানী (আল্লাহ পাকের দরবারে পেশ করল। তখন তাদের একজনের কোরবানী কবূল হল এবং অপর জনের কবূল হল না, (যার কোরবানী কবূল হল না) সে বলল, আমি তোমাকে খুন করবই। অপর জন বলল, আল্লাহ্ পাক মুত্তাকীদের কোরবানী কবূল করে থাকেন। তুমি আমাকে খুন করার জন্য তোমার হাত বাড়ালেও, আমি তোমাকে খুন করার জন্য আমার হাত তুলব না। আমি বিশ্ব রব আল্লাহ্ তা'আলাকে ভয় করি, আমি চাই যে, (এই বাড়াবাড়ির দরুন) তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বহন কর; ফলে তুমি দোযখীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এটাই যালিমদের শাস্তি। অতঃপর তার নফস্ তাকে উত্তেজিত করল নিজের ভাইকে হত্যা করতে। অতঃপর সে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত হল। অনন্তর আল্লাহ্ একটি কাক পাঠালেন, সে এসে মাটি খুঁড়তে লাগল, যেন কাবীলকে দেখিয়ে দেয়, কিরূপে, ঢাকবে নিজের ভাইয়ের লাশকে । (তা দেখে) কাবীল (মনে মনে) বলল, হায় আফসুস! আমি এ কাকটির মতও হতে পারলাম না যাতে নিজের ভাইয়ের লাশকে গোপন করতে পারি। অতঃপর সে অনুতপ্ত হতে লাগল। এ কারণে আমি বনি ইসরাঈলদের প্রতি বিধান দিলাম যে, কেউ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করলে কোন প্রাণের বিনিময় ব্যতীত অথবা কোন ফাসাদ ব্যতীত যা ভূ-পৃষ্ঠে তার দ্বারা বিস্তার হয়, তবে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি একটি প্রাণকে রক্ষা করল, তবে সে দুনিয়ার সব লোকের প্রাণরক্ষা করল। (সূরা মায়েদা : ২৭-৩২)

ইমাম আহমদ (রহঃ) স্বীয় মুসনাদ কিতাবে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন-

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا تَقْتُلُ نَفْسٍظُلْمًا إِلا كَانَ عَلَى ابْنِ آدَمَ الْأَوَّلَ كَفَّلَ مِنْ دَمِهَا لِأَنَّهُ كَانَ أَوَّلَ مِنْ سُن القتل -

অর্থঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ভূ-পৃষ্ঠে যখনই কোন ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয় তখনই তার গুনাহ অবশ্যই হযরত আদম (আঃ)-এর পুত্রের (অর্থাৎ কাবীলের) ঘাড়ে বর্তায়। কেননা, সে-ই প্রথম ব্যক্তি যে অন্যায়ভাবে হত্যা আরম্ভ করে এ অপবিত্র প্রথার প্রবর্তন করেছে। (মুসনাদে আহমদ)

কাকের ঘটনাটি তাফসিরকারগণ লিখেছেন যে, কাক দুটি ছিল আল্লাহর ফেরেশতা। এ ফেরেশতা পাঠিয়ে আল্লাহ তা'য়ালা মৃত দেহকে কিভাবে দাফন করতে হবে তা পৃথিবীর মানুষকে শিক্ষা দানের জন্য এ ঘটনার অবতারণা করেন। যেহেতু ইতোপূর্বে এ পৃথিবীতে আর কোন মানুষ মারা যায়নি। এটাই মৃত্যুর প্রথম ঘটনা। অতএব মৃত্যুর পরের বিধান ও নিয়ম সম্বন্ধে কারো কোন জ্ঞান ছিল না। তাই ঐ ভাবে আল্লাহ তা'য়ালা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া হত্যা করা ও সহিংসতার ঘটনাও পৃথিবীতে এটাই সর্বপ্রথম।

কাবিল সব ঝামেলা শেষ করে নিশ্চিন্ত হল, এবার সে মহা আনন্দে একলিমাকে বিয়ে করবে। পৃথিবীতে তার আর কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। তাই মনের আনন্দে সে পথ চলতে আরম্ভ করল। হঠাৎ আল্লাহ তা'য়ালার ইঙ্গিতে তার হাঁটু পর্যন্ত মাটির মধ্যে গেড়ে গেল। কাবিল তা উঠানোর জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করল। বার বার আল্লাহ তা'য়ালার নাম স্মরণ করল এবং তার করুণা ভিক্ষা চাইল। আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ থেকে বাণী এল, হে পাপিষ্ঠ! রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে যে ব্যক্তি ভাইকে হত্যা করেছে, তার শাস্তি হল জীবন্ত অবস্থায় তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলা । তাই তোমার অন্তিম সময় এসে গেছে কোন ক্রমে তোমার রেহাই নেই ।

তখন কাবিল অনুনয়ের স্বরে বলল, হে পরোয়ারদেগার! বেহেস্তে শয়তান আপনার নিষেধ অমান্য করে হযরত আদম (আঃ)-কে নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করিয়েছিল। তার উপর তো এতবড় শান্তি অবতীর্ণ হয়নি। এছাড়া হযরত আদম ও বিবি হাওয়া (আঃ) সরাসরি আপনার আদেশ লঙ্ঘন করল, তাদেরকেও এত বড় শাস্তি প্রদান করেননি। সেখানে আমার উপর এত বড় শাস্তি চাপানো কি অন্যায় নয়? তখন তাকে জবাব দেয়া হল, তারা কেউ রক্তের বন্ধনের ভাইকে হত্যা করেনি । তোর অপরাদের তুলনায় তাদের অপরাধ শত ভাগের এক ভাগ ।

এরপরে কাবিলের কোমর পর্যন্ত মাটি গ্রাস করে নিল। সে বলল, আমার পাপ কার্যের ধরন সর্বনিকৃষ্ট। অতএব আমাকে আল্লাহ তা'য়ালা চরম শাস্তি দিবেন তাই সে চিৎকার দিয়ে আল্লাহ তা'য়ালার দরবারে ফরিয়াদ করল, হে মহান প্রভু! আপনি আমার পিতা হযরত আদম (আঃ) কে যে কলেমার উছিলায় ক্ষমা করেছিলেন আমি সে কলেমা পাঠ করছি “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূল্লাহ”। এখন এ কলেমার বরকতে আমাকে ক্ষমা করুন। এরপরে কাবিলকে ছেড়ে দেয়ার জন্য আল্লাহ তা'য়ালা মাটিকে হুকুম দিলেন। অমনি মাটি তাকে ছেড়ে দিল। এবার কাবিল নিজকে পাপমুক্ত মনে করল। তাই সে একলিমাকে ধর্ষণ করতে অগ্রসর হল, তখন আল্লাহ তা'য়ালা কাবিলকে ফেরেশতা দ্বারা এক নির্জন এলাকায় নির্বাসন দিলেন। সেখানে তাকে এক মহাশাস্তির মধ্যে রেখে দিলেন। জনৈক ফেরেশতাকে নিয়োগ করে দিলেন যে এক কঠিন পাথর দ্বারা তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবে। ক্ষণকাল পরে মাথা ঠিক হবে, আবার পাথর দ্বারা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবে। আল্লাহ তা'য়ালা এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে শাস্তি প্রদানের হুকুম দিয়েছেন। কাবিল পাথরের প্রতি আঘাতের যন্ত্রণায় আকাশ বিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পুনরায় যখন তার হুঁশ আসে তখন তাকে দ্বিতীয় বার আঘাত করা হয় ।

হযরত আদম (আঃ) হজ্জ সমাধা করে দেশে এসে হাবিলকে দেখতে পেলেন না । তখন আদম ও হাওয়া উভয়ের মন খুব অস্তির হয়ে উঠল। কারণ হাবিল ছিল পিতামাতার অত্যন্ত প্রিয়। হাবিল যেমন ছিল ন্যায়পরায়ণ, সৎ, সাহসী তেমনি ধর্মানুরাগী ও পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই পিতামাতা তাকে না পেয়ে খুবই অস্থির হয়ে গেলেন। এক্ষেত্রে কাবিলের কথা তারা ভুলেও স্মরণ করলেন না। কারণ তার চরিত্র ছিল খারাপ। ধর্ম কর্মের বালাই তার মধ্যে অদৌ ছিল না। এ জন্য পিতামাতা কখনই তাকে সহ্য করত না। সর্বদা তার থেকে দূরে থাকা নিরাপদ মনে করতেন ।

হযরত আদম (আঃ) ও হাওয়া পুত্র শোকে পাগল প্রায় হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান আরম্ভ করলেন। একদা জিব্রাঈল (আঃ) তাঁদের কান্না দেখে আর সহ্য করতে পারলনা তখন হযরত আদম ও হাওয়ার নিকটবর্তী হয়ে বললেন, আপনার প্রাণপ্রিয় সন্তান হাবিলকে আপনার কুপুত্র কাবিল হত্যা করেছে এবং তাকে বিনা জানাজায় অমুক স্থানে দাফন করেছে। তখন হযরত আদম (আঃ)- হাবিলের কবর দেখার জন্য আবেদন জানাল। জিব্রাঈল (আঃ)- তখন হযরত আদম ও হাওয়াকে নিয়ে হাবিলের কবরের কাছে পৌঁছে বললেন, এটাই হাবিলের কবর। হযরত আদম ও হাওয়া প্রথমে তার জানাজা পড়লেন। তারপরে কবরের পাশে বসে দীর্ঘ সময় কাঁদলেন। সর্বশেষে পূত্র বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কবর খুড়ে হাবিলকে বের করলেন এবং একটি বাক্সে ভরে নিজ বাসস্থানে নিয়ে আসলেন। বাক্সটি নিজেদের ঘরে রেখে দিলেন। দৈনিক আট দশ বার বাক্স খুলে হাবিলের চেহারা দেখতেন।

একদা হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এসে আদম (আঃ)-কে বললেন, মৃত্যু লাশ এভাবে রাখা আল্লাহ তা'য়ালার বিধান নয়। অতএব, আল্লাহ তা'য়ালার সন্তুষ্টির জন্য এ লাশকে কবরে দাফন করুন। হযরত আদম ও হাওয়া অন্যান্য সন্তানদেরকে নিয়ে আর একবার জানাজা পড়ে নিজ ঘরের মধ্যে এক পাশে হাবিলের লাশ দাফন করলেন।

আদম (আঃ)-এর তৃতীয় পুত্র হযরত শীশ (আঃ)


হযরত আদম (আঃ)-এর তৃতীয় বারের পুত্র সন্তানের নাম ছিল হযরত শীশ (আঃ)। আদম (আঃ)-এর তৃতীয় পুত্র হযরত শীশ (আঃ) ছিলেন আদম সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে নেক্কার ব্যক্তি। তিনি নবুয়তী লাভ করেছিলেন। হাবিলের পরে হযরত শীশ ছিলেন পিতা-মাতার নিকট অধিক প্রিয়। তিনি আদম (আঃ)-এর বৃদ্ধ বয়সে সর্বদা তাঁর নিকটে খেদমতে মশগুল থাকতেন। একদা বৃদ্ধ বয়সে হযরত আদম (আঃ) সকল সন্তানকে তার জন্য ফলমূল নিয়ে আসতে হুকুম দিলেন। সন্তানেরা পিতার হুকুমের পরিপ্রেক্ষিতে যে যা পারল তা নিয়ে আসল। কিন্তু হযরত শীশ (আঃ) কিছুই আনলেন না । তখন হযরত আদম (আঃ) বললেন, শীশ তুমি তো কোন ফল নিয়ে আসলে না? হযরত শীশ বললেন, আব্বাজান আপনি বেহেস্তের মধ্যে অত্যন্ত সুস্বাদু ফলের স্বাদ গ্রহন করেছেন। এখন এই পৃথিবীর স্বাদ বিহীনফল আপনার সম্মুখে পেশ করতে আমার লজ্জা হচ্ছে, তাই আমি কিছুই আনিনি। এছাড়া আপনি আল্লাহর একজন অদ্বিতীয় নবী। আপনি যদি বেহেস্তী ফল খেতে আশা করেন এবং আল্লাহ তা'য়ালার নিকট আরজ পেশ করেন তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'য়ালা আপনার জন্য বেহেস্তী ফল প্রেরণ করবেন।

হযরত আদম (আঃ) শীশ (আঃ) এর কথা শুনে বললেন, প্রিয় বৎস। আমি আল্লাহ তা'য়ালার নিকট গন্ধম খেয়ে যে অপরাধ করেছি তাতে দ্বিতীয় বার পুনঃ খাবারের জন্য কিছুর আবেদন করতে আমার ভীষণ লজ্জা হয়। তার চেয়ে বরং তুমি নিষ্পাপ ছেলে, আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা কর। তখন হযরত শীশ (আঃ) আল্লাহ তা'য়ালার দরবারে কিছু ফল-ফুলের জন্য প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ তা'য়ালা হযরত শীশ (আঃ) এর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকগুলো ঝুড়ি ফল বোঝাই করে একজন হুরকে দিয়ে হযরত শিশের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। হুর হযরত শীশ (আঃ) এর নিকট এসে বললেন, আল্লাহ তা'য়ালা আমাকেসহ সব ফলমূল আপনার জন্য প্রেরণ করেছেন। তখন হযরত শীশ (আঃ) সবকিছু নিয়ে পিতার সম্মুখে হাজির হলেন। হযরত আদম (আঃ) বেহেস্তী ফল খেলেন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ সকল সন্তানের মধ্যে বিতরণ করলেন। সর্বশেষে হুরের সাথে হযরত শীশ (আঃ)-এর বিবাহ দিয়ে দিলেন। অতঃপর হুরকে বললেন, মা! তুমি এখন বেহেস্তে চলে যাও। যেহেতু পৃথিবীতে তোমার উপযোগী পরিবেশ নেই। তোমার সাথে একদিন বেহেস্তেই শীশের মিলন হবে পৃথিবীতে নয়। তখন হুর সালাম দিয়ে বিদায় গ্রহন করলেন।

হযরত আদম (আঃ) এর সন্তান সংখ্যা, মৃত্যু ও মাজার


হযরত আদম (আঃ) প্রায় বারশত বছর জীবিত ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর সাড়ে তিনশত সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সন্তানদের অধিকাংশকে তিনি নিজের পার্থিব ও পারলৌকি তালিম দান করেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে কাবিল ছাড়া সকলেই ঈমানদার ছিলেন। হযরত আদম (আঃ) জীবনের শেষ দিকে মোটামুটি আরাম আয়েসে কাটিয়েছেন। তিনি নিজে নবী হওয়া সত্ত্বেও হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতের অন্তর্ভুক্তির ভাগ্য লাভ করেন।

তিনি অল্প দিন রোগ ভোগের পরে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁকে সিংহলের এক সুরম্য স্থানে দাফন করা হয়। মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁর মাজার জিয়ারতের লক্ষ্যে সিংহল যাত্রা করে থাকেন। আজ পর্যন্ত তাঁর মাজার জিয়ারতের কার্য অব্যাবহত রয়েছে।

আদম (আঃ) এর কয়েকটি মোজেজা


হযরত আদম (আঃ) সম্বন্ধে কয়েকটি বিরাট বিরাট মোজেজার কথা বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত আছে। নিচে হযরত আদম (আঃ) কয়েকটি মোজেজা উদ্ধৃত করা হল।

হযরত আদম (আঃ) আল্লাহর নির্দেশক্রমে পৃথিবীতে আগমনের প্রাক্কালে মেছওয়াকের জন্য এক খণ্ড গাছ সঙ্গে নিয়ে আসেন। উক্ত গাছটি ছিল অত্যন্ত মোজেজা পূর্ণ। উক্ত গাছ হাতে নিয়ে আল্লাহ তা'য়ালার দরবারে যা কিছু প্রার্থনা করা হত আল্লাহ তা'য়ালা সঙ্গে সঙ্গে তা মঞ্জুর করতেন। উক্ত গাছ পরবর্তী সময় নবীগণের হাতে হাতে হযরত মুছা (আঃ)-এর নিকট 'আস' হিসেবে এসে পৌছে। যা দ্বারা তিনি সর্প তৈরি করে পৃথিবীর সব বিধর্মীদের সাথে মোকাবিলা করেছিলেন। যে কাহিনী সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী অতি প্রসিদ্ধ ।

এক সময় হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তানেরা দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। তখন তারা পিতার নিকট গিয়ে তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে বলেন । হযরত আদম (আঃ) ব্যক্তিগত সুবিধা সুযোগ সম্বন্ধে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে সাহস পেতেন না। তাই তিনি সন্তানদের পিড়াপিড়ি সত্ত্বেও আল্লাহর দরবারে কোন দোয়া করেননি। তখন আদম (আঃ)-এর সন্তানেরা একত্রিত হয়ে তাঁর পিতার উছিলা দিয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন। আদম (আঃ)-এর সন্তানদের এ ফরিয়াদের পরিপ্রেক্ষিত আল্লাহ তা'য়ালা হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-এর মারফত অসংখ্য স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা পাঠিয়ে দেন। আদম (আঃ)-এর সন্তানেরা এ মুদ্রা নিয়ে পিতার নিকট গমন করেন। এ মুদ্রা দ্বারা তখন কোন প্রয়োজনীয় জিনিস খরিদ করা সম্ভব ছিল না। কারণ পৃথিবীতে তখন পর্যন্ত আদম সন্তান ব্যতীত অন্য কোন মানুষ ছিল না, কোন উৎপাদন, কোন ক্রয় ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা ছিল না। এহেন অবস্থায় টাকা ও স্বর্ণ মুদ্রা দ্বারা কি উপকার সাধিত হবে?

এ কথা ভেবে হযরত আদম (আঃ) তাঁর সন্তানদেরকে বললেন, আমি তোমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট স্থানের কথা বলে দিচ্ছি। তোমরা স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে সেখানে যাবে এবং যার যা প্রয়োজন তার নাম বলে প্রয়োজনীয় মুদ্রা সেখানে রেখে আসবে। পরের দিন তোমাদের মুদ্রার বিনিময়ে প্রয়োজনীয় বস্তু তোমরা সেখানে পাবে। আদম সন্তানেরা পিতার নিকট থেকে সমস্যার এক অভিনব সমাধান পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হল। তারা আর বিলম্ব না করে পিতার উপদেশ অনুসারে স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে যথাস্থানে চলে গেল এবং শৃঙ্খলার সাথে লাইন ধরে মুদ্রা জমা করে আসল, পরের দিন যথা সময়ে তারা গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেখল পিতার কথা অনুসারে তারা সকলে নিজ নিজ মালপত্র পেয়ে গেল। তখন আওলাদে আদম (আঃ) আল্লাহ তা'য়ালার দরবারে ছেজদায় পড়ে শুকরিয়া আদায় করেন।

কথিত আছে হযরত আদম (আঃ) যখন পৃথিবীতে অবতরণ করেন, তখন যে স্থানে তিনি প্রথম পা রাখেন সেখানের মাটিগুলো টগবগ করে ফুটে উঠে এবং ঘুরতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে শয়তান ভাবল এ মাটি দ্বারা বিরাট উদ্দেশ্য সাধন হয়ে যাবে। তখন সে সেখান থেকে এক মুষ্টি মাটি নিয়ে গভীর সমুদ্রের মাঝে এক পর্বতমালার উপর রেখে দেয়। বাকি ঘূর্ণায়মান মাটি একটি গর্তের আকার ধারণ করে ভূগর্ভে চলে যায়। ভূগর্ভে চলে যাওয়া এ মাটি হতে নাকি পৃথিবীর খনিজ দ্রব্যের সৃষ্টি হয়। এযাবৎ শতাধিক রকমের খনিজ দ্রব্য মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো সবই হযরত আদম (আঃ)-এর কদম মোবারকের বরকতে সৃষ্টি বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। দ্বিতীয়ত যে মাটি শয়তান পর্বত চূড়ায় রেখে দিয়েছিল তা দ্বারা পৃথিবীতে যাদু বিদ্যার প্রচলন হয়। যা আজ পর্যন্ত মানুষের অকল্যাণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

হযরত আদম (আঃ)-এর জমানায় আইয়ামে বিয়াজের রোজা ফরজ ছিল। (প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখকে আইয়ামে বিয়াজ বলা হয়) হযরত শীশ (আঃ) নবুয়তী লাভ করার পরে আইয়ামে বিয়াজের রোজার ইফতারী আল্লাহ তা'য়ালা হযরত আদম ও তাঁর সন্তানদের জন্য ফেরেশতা মারফত বেহেস্ত থেকে প্রেরণ করতেন । এটা ছিল নূরে মোহাম্মদীর বরকত।

একদা হযরত শীশ (আঃ) যখন দেখলেন তাঁর পিতা আদম (আঃ) অতি সাধারণ ভাবে সন্তানদেরকে নিয়ে ইফতার করেন। যা সংগ্রহ করাও ছিল খুব কষ্টকর, তখন তিনি আল্লাহ তা'য়ালার নিকট ফরিয়াদ করে বলেন, হে পরম করুণাময়! তোমার নিকট খাদ্য, সম্পদ, অর্থ কোন কিছুর অভাব নেই। এমতাবস্থা নূরে মোহাম্মদীর বহনকারী ব্যক্তিত্ব, হযরত আদম (আঃ) খাদ্যের অভাবে যথেষ্ট দূরবস্থায় কাটাচ্ছে। এ ব্যাপার তোমার রহমত কামনা করি। হযরত শীশ (আঃ)-এর দোয়ার পর হতে রোজার তিন দিন ইফতারীর নামে বহু রকম খাদ্য সামগ্রী বেহেস্ত হতে আসতে থাকে। সে খাদ্য ছিল এত পর্যাপ্ত যা দশদিন যাবত সকলে খাবার পরেও উদ্বৃত্ত থাকত। হযরত আদম (আঃ) শেষ বয়সে আল্লাহ তা'য়ালার আরো অনেক দান অনুদান লাভ করেছেন, যার সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন।


(এই লেখাটি আলহাজ্ব মাওলানা লুৎফুল আলম রচিত ও ছারছীনা প্রকাশনী হতে প্রকাশিত “কুরআনের শ্রেষ্ট কাহিনী” গ্রন্থ অবলম্বনে তৈরী করা হয়েছে)


💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url