আল কুরআনের বাংলা অনুবাদ | সূরা আল ফালাক্ব’এর বাংলা অনুবাদ | সূরা আল ফালাক্ব | Surah Al Falaq | سورة الفلق


সূরা আল ফালাক্ব

সূরা আল ফালাক্ব, মক্কায় অবতীর্ণ আয়াত ৫, রুকু ১

সূরা আল ফালাক্ব এর পরিচয়


সূরা নং : ১১৩
রুকুর সংখ্যা : ১
সূরার নাম : সূরা আল-ফালাক্ব।
সূরার অর্থ : প্রভাত, ঊষা, সকাল, ভোর ইত্যাদি।
আয়াত সংখ্যা : ৫
সিজদার সংখ্যা : ০
অক্ষর সংখ্যা : ৭১
শ্রেণী : মাদানী।
শব্দের সংখ্যা : ২৩
পাড়ার সংখ্যা : ৩০

সূরা আল ফালাক্ব এর নামকরণ


সূরা ফালাক ও সূরা আন-নাস আলাদা আলাদা সূরা হলেও এদের পারস্পরিক সম্পর্ক এত গভীর ও উভয়ের বিষয়বস্তু পরস্পরের সাথে এত বেশি নিকট সম্পর্কিত যে এদেরকে একত্রে “মু’আওবিযাতাইন” (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার দু’টি সূরা) নামে ডাকা হয়; আর এই সূরা দু’টি নাযিলও হয়েছে একই সাথে একই ঘটনার পরি-প্রেক্ষিতে।

সূরা আল ফালাক্ব এর শানে নুযুল


সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস একই প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে বলে মুফাসসিরগণ মত ব্যক্ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ স. জাদুর কারণে অসুস্থ হওয়ার ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সূরাদ্বয় মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। কেননা রাসূলুল্লাহ স.-কে জাদু করার ঘটনা মদীনার ইহুদীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল । আবার অনেক মুফাসসিরগণ সূরাটা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে অভিমত দিয়েছেন। বস্তুত দুটি মতই বিশুদ্ধ। কেননা সূরাদ্বয়ের ভাব বিশ্লেষণ ও বক্তব্যের বিষয় হতে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে, সূরা দুটি প্রথমে মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।

মক্কায় সূরা দুটি নাযিলের প্রেক্ষাপট ছিল এমন যে, রাসূল স.-এর নবুওয়াতের আলোক মশাল উজ্জ্বলিত হলে মক্কার মুশরিকরা তাঁর বিরোধিতা শুরু করে। নানাভাবে তাঁর ক্ষতি করার পাঁয়তারা করে। এমন করুণ মুহূর্তে মহান আল্লাহ তাঁর নবী স.-কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এবং তাঁরই নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করার জন্য সূরা দুটি অবতীর্ণ করেন। এ সূরা দুটির ভাব-বিষয় এক হওয়ার কারণে ‘সূরাতাইন মু’আওয়াযাতাইন’ (দুটি আশ্রয় প্রার্থনার সূরা) বলা হয় ।

সপ্তম হিজরী মুহাররম মাস। খাইবার হতে ইহুদীদের একটি প্রতিনিধিদল মদীনায় উপস্থিত হলো এবং লবীদ ইবনে আ’সম নামের একজন প্রখ্যাত জাদুকরের সাক্ষাৎ করল। তারা তাকে বলল, “মুহাম্মদ আমাদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তা তুমি ভালো করেই জানো; আমরা তাঁর ওপর জাদু করার বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু সফলতা লাভ করতে পারিনি। এই কারণে আমরা তোমার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমরা তোমাকে তিনটি ‘আশরাফি’ (স্বর্ণমুদ্রা) দিচ্ছি; তুমি এটা গ্রহণ করো ও মুহাম্মদের ওপর খুব শক্ত ও তীব্র ক্রিয়াসম্পন্ন জাদুর আঘাত হানো।”

এই সময় রাসূলুল্লাহ স.-এর কাছে একটা ইহুদী ছেলে খাদেম ছিল । এই ছেলেটির সঙ্গে যোগসাজশ করে ওই জাদুকর রাসূল স.-এর চিরুনির একটি টুকরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হলো। এতে রাসূল স.-এর চুল ছিল। এই চুল ও চিরুনির দাঁতের ওপর জাদু করা হয়। এই জাদু একটা পুরুষ খেজুরগাছের ছড়ার আবরণে রেখে লবীদ বনু যাইকের যারওয়ান বা যী-আরওয়ান নামে এক কূপের তলায় পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল।

জাদুর ক্রিয়ায় রাসূলুল্লাহ স. ক্রমে দুর্বল হয়ে আসছিলেন, কিন্তু নবী হিসেবে তাঁর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল, তা যথাযথ পালন করার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারেনি । বস্তুত রাসূল স.-এর ওপর জাদুর ক্রিয়া শুধু তাঁর দেহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তাঁর নবুয়াতের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে জাদুর ক্রিয়া সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত ছিল।

শেষের দিকে তিনি একদিন হযরত আয়েশা রা.-এর গৃহে থাকাবস্থায় আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন, মুহূর্তে তিনি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। এই ঘুমের মধ্যে রাসূলে আরাবী দুজন ফেরেশতার মাধ্যমে স্বপ্নযোগে অবহিত হতে পারেন যে, তাঁকে জাদু করা হয়েছে। কীভাবে জাদু করা হলো? কী পদ্ধতি অবলম্বন করা হলো? এ জাদু থেকে উত্তরণের উপায় কী-সব কিছুই তিনি অবগত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল স. আলী রা. আ’ম্মার ইবন ইয়াসার রা. ও যুবাইর রা.-কে বনু যারওয়ান বা যী-যারওয়ান কূপের কাছে প্রেরণ করেন।

পরে আরো কতিপয় সাহাবাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ স. নিজেও সেখানে উপস্থিত হন। ওই কূপ থেকে পানি তোলা হলো। তখন দেখা গেল যে, খেজুরগাছের ছড়ার সঙ্গে পেঁচানো একগাছি সুতার এগারোটি গিঁট লাগানো রয়েছে। তাঁর সঙ্গে একটি গমের পুঁটলিও ছিল, তাতে কয়েকটি সুঁই বসানো রয়েছে। জিবরাঈল আ. এসে বললেন, আপনি ‘মু’আওয়াযাতাইন’ তথা সূরা ফালাক্ব ও নাস পাঠ করুন। এভাবে রাসূল স. সূরা দুটি পাঠ করার মাধ্যমে জাদুর প্রভাব থেকে আরোগ্য লাভ করেন।

সূরা ফালাক্ব ও নাসের শানে নুযূল সংক্ষিপ্ত ও বিশদ বহু বর্ণনা রয়েছে। অপর এক বর্ণনায় উল্লেখ আছে, একবার রাসূলুল্লাহ স. অসুস্থ হয়ে পড়েন। শারীরিকভাবে প্রচণ্ড অস্থিরতা অনুভব করেন। এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন, দুজন ফেরেশতা তাঁর কাছে আগমন করলেন। একজন মাথার কাছে এসে বসলেন আর অন্যজন পায়ের কাছে। তারা উভয়ে পরস্পর কথপোকথন করতে লাগলেন। তারা নিজেদের মধ্যে এভাবে বাক্য বিনিময় করছিলেন। ‘তাঁর কী হয়েছে? তিনি অসুস্থ। কী অসুখ? তাঁকে জাদু করা হয়েছে। কে জাদু করেছে? এক ইহুদী ব্যক্তি, যার নাম লাবীদ ইবনে আ’সাম। কীভাবে জাদু করেছে? চামড়ার ফিতায় জাদুমন্ত্র করে পাথর চাপা দিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে অমুক কূপে। যাও, সেটিকে বের করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দাও।’

রাসূলুল্লাহ স. এতটুকু স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙে গেল। সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ স. কতিপয় সাহাবাকে নিয়ে স্বপ্নে উল্লিখিত কূপে গেলেন। সেখানে পাথর চাপা দিয়ে রাখা জাদুমন্ত্রের ফিতাটি উদ্ধার করে আনলেন। কিতাটিতে একটি সুতা পেঁচানো রয়েছে এবং তাতে এগারোটি গ্রন্থি দেখা গেল। কিন্তু এ গ্রন্থিগুলো না খোলা গেলে নবীজি স.-এর আরোগ্য লাভ সম্ভব হবে না। এমন করুণ পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহ তা’আলা স্বীয় হাবীবের নিকট ওহী প্রেরণ করলেন। এ প্রেক্ষাপটে সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস নাযিল হলো।

এ সূরাদ্বয়ের আয়াত সংখ্যা হলো এগারোটি। প্রিয় নবী এ সূরার একটি করে আয়াত পাঠ করতে লাগলেন আর সঙ্গে সঙ্গে একটি করে গিঁট বা গ্রন্থি খুলে যেতে লাগল । যখন তিনি সূরা দুটি পড়ে শেষ করলেন ততক্ষণে সবগুলো গিট খুলে গেল। এর ফলশ্রুতিতে নবীজি আলাইহিস সালাম সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন এ সূরা দুটির মহত্ত্বের কারণে উলামাগণ বলেছেন, কেউ যদি সব সময় এ সূরা দুটি পাঠ করে তাহলে কোনো জাদু-মন্ত্র তাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হবে না।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ স. রাত্রিকালে যখন বিছানায় যেতেন তখন তিনি সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে হাতের উভয় তালুতে দিয়ে সারা দেহের যতটুকু অংশ হাতের নাগাল পাওয়া যায় ততটুকু পর্যন্ত হাতের ছোঁয়া দিতেন। প্রথমে মাথায়, তারপর মুখে এবং এরপর দেহের সামনের অংশে তিনবার এভাবে হাত ফিরাতেন। (সহীহ বুখারী-৫০১৭)

সূরা আল ফালাক্ব এর ফজিলত


সূরা ফালাক ও পরবর্তী সূরা নাস একই সাথে একই ঘটনায় অবতীর্ণ হয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রাহেমাহুল্লাহ উভয় সূরার তাফসীর একত্রে লিখেছেন। তাতে বলেছেন যে, এ সূরাদ্বয়ের উপকারিতা ও কল্যাণ অপরিসীম এবং মানুষের জন্যে এ দু'টি সূরার প্রয়োজন অত্যধিক। বদনজর এবং সমস্ত দৈহিক ও আত্মিক অনিষ্ট দূর করায় এ সূরাদ্বয়ের কার্যকারিতা অনেক। বলতে গেলে মানুষের জন্যে শ্বাসপ্রশ্বাস, পানাহার ও পোষাক-পরিচ্ছদ যতটুকু প্রয়োজনীয়, এ সূরাদ্বয় তার চেয়ে বেশী প্রয়োজনীয়। সূরা ফালাক-এ দুনিয়াবী বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সূরা আন-নাসে আখেরাতের আপদ ও মুসীবত থেকে আশ্রয় প্রার্থনার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহে এ সূরা এবং সূরা আন-নাস উভয় সূরার অনেক ফযীলতা ও বরকত বর্ণিত আছে। উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা লক্ষ্য করেছ কি, আদ্য রাত্ৰিতে আল্লাহ তা’আলা আমার প্রতি এমন আয়াত নাযিল করেছেন, যার সমতুল্য আয়াত দেখা যায় না; অর্থাৎ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) ও (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ) আয়াতসমূহ। [মুসলিমঃ ৮১৪] অন্য বর্ণনায় আছে, তাওরাত, ইঞ্জিল, যবূর এবং কুরআনেও অনুরূপ অন্য কোন সূরা নেই। [মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৪৮, ১৫৮–১৫৯] এক সফরে রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করালেন, অতঃপর মাগরিবের সালাতে এ সূরাদ্বয়ই তেলাওয়াত করে বললেনঃ এই সূরাদ্বয় নিদ্ৰা যাওয়ার সময় এবং নিদ্রা থেকে গাত্ৰোত্থানের সময়ও পাঠ করো। [আবু দাউদ: ১৪৬২, মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৪৮]

অন্য হাদীসে তিনি প্রত্যেক সালাতের পর সূরাদ্বয় পাঠ করার আদেশ করেছেন। [আবু দাউদ: ১৫২৩ তিরমিযী: ২৯০৩, নাসায়ী: ১৩৩৬, মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৫৫] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন রোগে আক্রান্ত হলে এই সূরাদ্বয় পাঠ করে হাতে ফুঁক দিয়ে সর্বঙ্গে বুলিয়ে দিতেন। ইন্তেকালের পূর্বে যখন তাঁর রোগযন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়, তখন আমি এই সূরাদ্বয় পাঠ করে তার হাতে ফুঁক দিতাম। অতঃপর তিনি নিজে তা সর্বাঙ্গে বুলিয়ে নিতেন। আমার হাত তাঁর পবিত্ৰ হাতের বিকল্প হতে পারতনা। তাই আমি এরূপ করতাম। [বুখারী: ৫০১৬, মুসলিম: ২১৯২] উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমি কি সূরা ইউসুফ ও সূরা হূদ থেকে পড়ব? তিনি বললেন, ‘বরং তুমি কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক দিয়ে পড়। কেননা, তুমি এর চেয়ে আল্লাহর নিকট প্রিয় ও অধিক অর্থপূর্ণ আর কোন সূরা পড়তে পারবে না। যদি তুমি পার, তবে এ সূরা যেন তোমার থেকে কখনো ছুটে না যায়” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৫৪০] সারকথা এই যে, যাবতীয় বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকার জন্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম এই সূরাদ্বয়ের আমল করতেন।

সূরা আল ফালাক্ব’এর বাংলা অনুবাদ



রহমান রহীম আল্লাহ তা'আলার নামে

১. (হে নবী) তুমি বলো, আমি উজ্জ্বল প্রভাতের মালিকের কাছে আশ্রয় চাই,

২.(আশ্রয় চাই) তাঁর সৃষ্টি করা (প্রতিটি জিনিসের) অনিষ্ট থেকে,

৩. আমি আশ্রয় চাই রাতের (অন্ধকারে সংঘটিত) অনিষ্ট থেকে, (বিশেষ করে) যখন রাত তার অন্ধকার বিছিয়ে দেয়,

৪. (আমি আশ্রয় চাই) গিরায় ফুঁক দিয়ে যাদুটোনাকারিণীদের অনিষ্ট থেকে,

৫. হিংসুক ব্যক্তির (সব ধরনের হিংসার) অনিষ্ট থেকেও (আমি তোমার আশ্রয় চাই) যখন সে হিংসা করে।



💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url