কুরআন শরীফ লিপিবদ্ধ করণ ও মুদ্রণের ইতিহাস এবং ক্রমবিকাশ


কুরআন শরীফের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ


'পড়ো তোমার মালিকের নামে যিনি সব কিছু পয়দা করেছেন। (সূরা আমালাক্ব ১-৫) সর্বশেষ ওহী' সে দিনকে ভয় করো যেদিন তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে নেয়া হবে।' (সূরা আল বাক্বারা ২৮১), আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাংগ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের জন্যে জীবন বিধান হিসেবে আমি ইসলামের ওপর সন্তুষ্ট হলাম।' (সূরা আল মায়েদা ৩) কুরআন নাযিলের মোট সময় প্রায় ২২ বছর ৫ মাস।

সর্বপ্রথম ওহী বা আয়াত

কুরআন নাযিলের ছয় মাস আগে থেকেই আল্লাহ তা'আলা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম--কে স্বপ্নের মাধ্যমে এ মহান কাজের জন্যে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলেন। ইতিহাসের প্রমাণ অনুযায়ী প্রথম ওহী এসেছিলো রমযান মাসের ২১ তারিখ সোমবার রাতে। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বয়স ছিলো তখন ৪০ বছর ৬ মাস ১২ দিন। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে নাজিলকৃত সর্বপ্রথম ওহী ছিল-

৯৬:৫ عَلَّمَ الۡاِنۡسَانَ مَا لَمۡ یَعۡلَمۡ ؕ    ৯৬:৪ الَّذِیۡ عَلَّمَ بِالۡقَلَمِ   ৯৬:৩ اِقۡرَاۡ وَ رَبُّکَ الۡاَکۡرَمُ ۙ  ৯৬:২ خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ عَلَقٍ ۚ   ৯৬:১ اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ

অর্থঃ পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে 'আলাক' থেকে। পড়, আর তোমার রব মহামহিম। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না। (সূরাঃ আল-আলাক, আয়াতঃ১-৫)

নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে প্রমাণিত রয়েছে যে, সূরা আলাক থেকেই ওহীর সূচনা হয় এবং এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত (مَا لَمْ يَعْلَمْ) পর্যন্ত সর্ব প্রথম নাযিল হয়। [দেখুন, বুখারী: ৬৯৮২, মুসলিম: ১৬০] অধিকাংশ আলেম এ বিষয়ে একমত। কেউ কেউ সূরা আল-মুদ্দাসসিরকে প্রথম সূরা এবং কেউ সূরা ফাতেহাকে সর্বপ্রথম সূরা বলে অভিহিত করেছেন। তবে প্রথমোক্ত মতটিই বিশুদ্ধ। [আল-ইতকান কী উলূমিল কুরআনঃ ১/৯৩]

হযরত আয়শা রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহা থেকে বর্ণিত আছে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ওপর ওহী নাযিলের সূচনা হয়েছিলো স্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন তা দিনের আলোর মত তাঁর জীবনে প্রতিভাত হতো। এক টুকরো দৃশ্যমান ছবি তাঁর অন্তরে সদা ভাস্বর হয়ে থাকতো। জিবরাঈল - 'আলাইহিস সালাম- এর মাধ্যমে ওহী প্রাপ্তির আগে আস্তে আস্তে তিনি নির্জনতাপ্রিয় হয়ে ওঠেন, হেরা গুহায় নিভৃতে আল্লাহ তা'আলার ধ্যানে তিনি মশগুল হয়ে পড়েন এবং বিশাল সৃষ্টি ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীর চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন। এভাবেই হেরা গুহায় তাঁর রাত আর দিন কাটে। খাবার ও পানি শেষ হয়ে গেলে সেসব নেয়ার জন্যেই তিনি শুধু বাড়ি ফিরেন। মাঝে মাঝে প্রিয় স্ত্রী খাদিজাও হেরা গুহায় তাঁকে খাবার দিয়ে আসেন। এমনি করে একদিন তাঁর কাছে আল্লাহর ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম- এসে গম্ভীর কণ্ঠে তাঁকে বললেন, 'ইক্রা' -পড়ুন। মোহাম্মদ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। উদ্বেলিত কণ্ঠে বললেন আমি তো পড়তে জানি না'। ফেরেশতা তাঁকে বুকে চেপে ধরে আবার বললেন, পড়ুন।

তিনি পুনরায় বললেন, আমি তো পড়তে জানি না। ফেরেশতা আবার তাঁকে বুকে জড়িয়ে চেপে ধরলেন এবং বললেন, পড়ুন। তৃতীয় বার যখন ফেরেশতা তাঁকে বুকে আলিংগন করে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুন, এবার মোহাম্মদ -সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ওহীর প্রথম পাঁচটি আয়াত পড়লেন। অতঃপর তিনি ঘরে ফিরলেন। প্রিয়তমা সংগীকে বললেন, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও'। হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহা  প্রিয় নবীকে চাদর দিয়ে জড়িয়ে দিলেন। এরপর তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে আপনার? আপনি এমন কাঁপছেন কেন?

রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, একজন অভিনব ব্যক্তি আমার কাছে এসে আমাকে বললেন, পড়ুন। আমি বললাম, আমি তো পড়তে জানি না। তারপর তিনি তিন তিন বার আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন, অতঃপর তার সাথে আমি পড়তে শুরু করলাম। তার কথা শুনে খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহা- বললেন, আপনার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা আপনি মানুষের উপকার করেন, মানবতার সেবা করেন, এতীমদের আশ্রয় দেন, মহান আল্লাহ আপনার কি কোন ক্ষতি করতে পারেন!

খাদিজা -রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহা - প্রিয় নবীকে তাঁর চাচাত ভাই ওরাকা ইবনে নওফেলের কাছে নিয়ে গেলেন। ওরাকা ইবনে নওফেল ছিলেন ঈসায়ী ধর্মের আলেম এবং হিব্রু ভাষার পন্ডিত ব্যক্তি। সে সময় তিনি বয়সের ভারে আক্রান্ত এবং দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েছিলেন। হযরত খাদিজা -রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহা- বললেন, ভাইজান, আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম- তাকে হেরা গুহার সব ঘটনার কথা বর্ণনা করলেন। শুনে ওরাকা বললেন, তিনি সে-ই দূত জিবরাঈল, যিনি হযরত মুসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে ওহীর বাণী নিয়ে আসতেন। হায়, আমি যদি সে সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারতাম যখন তোমার কওমের লোকেরা তোমাকে জন্মভূমি থেকে বের করে দেবে। রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম- অবাক হয়ে বললেন, কেন আমাকে তারা মাতৃভূমি থেকে বের করে দেবে? ওরাকা বললেন, তুমি যে ওহী লাভ করেছো, এ ধরনের ওহী যখনই কোন নবী পেয়েছেন তাঁর সাথে এভাবেই স্বজাতির পক্ষ থেকে শত্রুতা করা হয়েছে। যদি আমি সে দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই আমি তোমার সাহায্যে এগিয়ে আসবো।

সর্বশেষ ওহী বা আয়াত


সর্বশেষ অবতীর্ণ ওহী বা আয়াত সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হ’ল- সূরা বাক্বারাহর সর্বশেষ ২৮১ নং আয়াত- 

২:২৮১ وَ اتَّقُوۡا یَوۡمًا تُرۡجَعُوۡنَ فِیۡهِ اِلَی اللّٰهِ ٭۟ ثُمَّ تُوَفّٰی کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَ هُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ

অর্থঃ আর তোমরা সে দিনের ভয় কর, যে দিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে সে যা উপার্জন করেছে, তা পুরোপুরি দেয়া হবে। আর তাদের যুলম করা হবে না। 

(সৈয়ূত্বী, আল-ইৎক্বান ১/৩৫ পৃঃ)। শেষোক্ত আয়াত সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী বিভিন্ন বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেন, এটিই হ’ল সর্বাধিক পরিচিত, বহু সূত্রে বর্ণিত, সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। যা রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ৭ বা ২১ দিন পূর্বে নাযিল হয় (তাফসীর বাক্বারাহ ২৮১ আয়াত)। ইবনু হাজার (রহঃ)ও এটাকে সর্বাধিক বিশুদ্ধ বলে মত পোষণ করেছেন (ফাৎহুল বারী হা/৪৩৭৮-এর পূর্বে, ৮/৩১৭)।

কুরআন লিপিবদ্ধ করার ইতিহাস


যখন থেকে কুরআন নাযিল শুরু হয়, সেদিন থেকেই আল্লাহর রসূল তা লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য পারদর্শী সাহাবীদের নিযুক্ত করতে আরম্ভ করেন। হযরত যায়দ বিন সাবেত রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ ছাড়া আরো ৪২ জন সাহাবী এ কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এ সম্পর্কে রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা কুরআন ছাড়া আমার কাছ থেকে অন্য কিছু লেখো না।

কুরআনের বিভিন্ন পরিসংখ্যান


কোরআনে মোট একশ চৌদ্দটি সূরা রয়েছে। প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর যুগে হযরত যায়দ ইবনে সাবেত রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ- এ সংখ্যা নির্ণয় করেন। কোনো কোনো সূরার আয়াত সম্বলিত তথ্য স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেই পাওয়া যায়। যেমন 'সূরা ফাতেহার ৭ আয়াত-এর যে কথা রয়েছে তা রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম- নিজেই বলেছেন। সূরা মূলক-এ ত্রিশ আয়াতের কথাও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

কুরআনের ধারাবাহিকতা প্রসংগে একটি বর্ণনা এমন রয়েছে যে, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম- রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলেছেন, অমুক আয়াতটি সূরা বাক্বারার ২৮০ নং আয়াতের পর লিপিবদ্ধ করুন। অন্য এক রেওয়ায়াতে তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সূরা কাহফের প্রথম দশটি আয়াত তেলাওয়াত করার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। এ ধরনের আরো কিছু কিছু রেওয়ায়াত পাওয়া যায়, কিন্তু সামগ্রিকভাবে রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে কুরানের সূরা ও আয়াতের সংখ্যা সম্পর্কে আর তেমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।

হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-এর যুগেও কুরআনের আয়াতের গণনা হয়েছে এমন কোন রেওয়ায়াত পাওয়া যায় না। সম্ভবত সর্বপ্রথম হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহু -এর যুগেই আয়াত গণনার কাজটি শুরু হয়েছে। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহু- তারাবীর নামাযের প্রতি রাকা'তে তিরিশ আয়াত করে তেলাওয়াত করার একটা নিয়ম জারি করেছিলেন। অন্যান্য সাহাবাদের মধ্যে হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহু- হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহু, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহু, হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু “আনহু- হযরত আবুদ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহু, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহু- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহু - ও হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহা প্রমুখ সাহাবী কুরআনের আয়াত সংখ্যা নির্ণয় করেছেন।

আয়াতের সংখ্যার মধ্যে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। এর কারণ, কিছু কিছু আয়াতের শেষে রসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম- মাঝে মাঝে ওয়াকফ করেছেন, আবার কখনও ওয়াকফ না করে পরবর্তী আয়াতের সাথে মিলিয়ে তা তেলাওয়াত করেছেন। এমতাবস্থায় কেউ কেউ প্রথম অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে এক ধরনের গণনা করেছেন। আবার কেউ কেউ পরবর্তী অবস্থার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে আয়াতের সংখ্যা নির্ণয় করেছেন। এতে করে কুরআনের আয়াতের সংখ্যা নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। তবে সাধারণত হযরত আয়েশার গণনাকে এ ব্যাপারে বেশী নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়।

'বিসমিল্লাহ' নেই
কুরআনে 'বিসমিল্লাহ' নেই- এমন সূরা হচ্ছে সূরা আত তাওবা'।

দুই বার 'বিসমিল্লাহ'
দুই বার 'বিসমিল্লাহ' আছে এমন সূরা হচ্ছে সূরা 'আন নামল'। 

নয়টি মীম অক্ষরের সূরা
নয়টি মীম অক্ষর সম্বলিত সূরা হচ্ছে সূরা আল কাফিরুন।

কোনো মীম অক্ষর নেই
কোনো মীম নেই যে সূরায় তা হচ্ছে সূরা  'আল কাওসার'।

কুরআনের প্রথম মোফাসসির
কুরআনের প্রথম মোফাসসির হচ্ছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহু। 

কুরআনের প্রথম সংকলক
কুরআনের প্রথম সংকলক হচ্ছেন হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ । 

কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক
কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক হচ্ছেন মাওলানা আমীর উদ্দীন বসুনিয়া।

কুরআনের নাম
কুরআনে উল্লিখিত কুরআনের নাম ৫৫টি।

কুরআন প্রথম যাঁর মাধ্যমে এসেছে
কুরআন প্রথম যাঁর মাধ্যমে এসেছে তিনি হচ্ছেন হযরত জিবরাঈল 'আলাইহিস সালাম।

কুরআনে যে সাহাবীর নাম আছে
কুরআনে যে ভাগ্যবান সাহাবীর নাম আছে তিনি হচ্ছেন হযরত যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-।

তেলাওয়াতের সাজদা
কুরআনে তেলাওয়াতে সাজদার সংখ্যা সর্বসম্মত ১৪ (মতপার্থক্যে ১৫)

কয়েকজন বিশিষ্ট ওহী লেখকের নাম
১. হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
২. হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
৩. হযরত ওসমান বিন আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
৪. হযরত আলী বিন আবি তালেব রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ- 
৫. হযরত যায়দ বিন সাবেত রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ- 
৬. হযরত আবদুল্লাহ বিন সা'দ রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ- 
৭. হযরত যোবায়ের বিন আওয়াম রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ- 
৮. হযরত খালেদ বিন সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ- 
৯. হযরত হানযালা বিন রাবী রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ- 
১০. হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
১১. হযরত আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ- 
১২. হযরত মোহাম্মদ বিন মাসলামা রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ- 
১৩. হযরত আবদুল্লাহ বিন সালুল রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ- 
১৪. হযরত মুগীরা বিন শোবা রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
১৫. হযরত মোয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
১৬. হযরত আমর ইবনুল আস রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
১৭. হযরত জাহম ইবনুস সালত রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
১৮. হযরত শোরাহবিল বিন হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
১৯. হযরত আবদুল্লাহ বিন আরকাম আয যুহরী রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
২০. হযরত সাবেত বিন কায়স রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
২১. হযরত হোযায়ফা বিন আল ইয়ামান রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
২২. হযরত আমের বিন ফুহায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
২৩. হযরত আবদুল্লাহ বিন যোবয়র রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-
২৪. হযরত আবান বিন সায়ীদ রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ-

কুরআন মুদ্রণের ইতিহাস


মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত কুরআন শরীফ হাতেই লেখা হতো। প্রত্যেক যুগেই এমন কিছু নিবেদিতপ্রাণ কুরআনের 'কাতেব' মজুদ ছিলেন যাঁদের একমাত্র কাজ ছিলো কুরআন শরীফ লিপিবদ্ধ করা। কুরআনের প্রতিটি অক্ষরকে সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করার লক্ষে এটি নিঃসন্দেহে এক নযীরবিহীন ঘটনা।

প্রথম মুদ্রিত কুরআন


মুদ্রণ যন্ত্র আবিস্কারের পর ইউরোপের হামবুর্গ নামক স্থানে হিজরী ১১১৩ সনে সর্বপ্রথম কুরআন শরীফ মুদ্রিত হয়। এরপর বিশ্বের এখানে সেখানে অনেকেই ছাপাখানার মাধ্যমে কুরআন শরীফ মুদ্রণ শুরু করেন, কিন্তু মুসলিম জাহানে নানা কারণে প্রথম দিকে মুদ্রিত কুরআন শরীফ তেমন একটা গ্রহণযোগ্য হয়নি।

মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম মাওলানা ওসমান রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে ১৭৮৭ খৃষ্টাব্দে কুরআন মুদ্রণের কাজ করেন। প্রায় একই সময় কাযান শহর থেকেও কুরআনের একটি নোসখা মুদ্রিত হয়।

১৭৮৭ খৃস্টাব্দে ইরানের তেহরানে লিখো মুদ্রণ যন্ত্রে প্রথম কুরআন শরীফের একটি কপি মুদ্রিত হয়। এরপর থেকে আস্তে আস্তে দুনিয়ার অন্যান্য এলাকাতেও ব্যাপকভাবে ছাপাখানার মাধ্যমে কুরআন মুদ্রণের রেওয়াজ চালু হতে থাকে। মূদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কারের আগে কুরআনের আয়াতসমূহ সাধারণত পাথর, শিলা, শুকনা চামড়া, খেজুর গাছের শাখা, , বাঁশের টুকরা, গাছের পাতা এবং পশুর চামড়ার ওপর লেখা হতো।

কুরআনের নোকতা


আরবদের মধ্যে আগে আরবী বর্ণমালায় নোকতা সংযোজন করার কোনো রীতি প্রচলিত ছিলো না। তারা নোকতাবিহীন অক্ষর লেখতো। এতে কুরআন শরীফ তেলাওয়াতের ব্যাপারে কোনো অসুবিধা হতো না। কেননা কুরআনের তেলাওয়াত কোনদিনই অনুলিপিনির্ভর ছিলো না। হাফেযদের তেলাওয়াত থেকেই লোকেরা তেলাওয়াত 
শিক্ষা করতো। হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ - যখন মুসলিম জাহানের বিভিন্ন এলাকায় কুরআনের 'মাসহাফ' প্রেরণ করতেন, তখন তার সাথে তিনি বিশিষ্ট তেলাওয়াতকারী হাফেযদেরও পাঠাতেন। সে যুগে আরবী বর্ণমালায় নোকতা সংযোজন করা দূষণীয় কাজ মনে করা হতো। এ কারণেই ওসমানী মাসহাফেও প্রথম দিকে কোনো নোকতা ছিলো না। এতে করে প্রচলিত সব কয়টি কেরাতেই কুরআন তেলাওয়াত করা সহজ হতো, কিন্তু পরে অনারব লোকদের প্রয়োজনে আরবী বর্ণমালায় নোকতা সংযোজন একান্ত জরুরী হয়ে পড়ে।

কুরআনুল কারীমের হরফসমূহে কে সর্বপ্রথম নোকতার প্রচলন করেছিলেন এ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো মতে বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ তাবেয়ী হযরত আবুল আসাদ দুয়েলী রহিমাহুল্লাহ- এ কাজটি সর্বপ্রথম আনজাম দেন। অনেকে মনে করেন, আবুল আসাদ দুয়েলী এ কাজটি হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহা -এর নির্দেশেই সম্পাদন করেছেন।

কারো মতে কুফার শাসনকর্তা যিয়াদ বিন আবু সুফিয়ান আবুল আসাদের দ্বারা এ কাজটি সম্পন্ন করিয়েছেন। আবার অন্যদের মতে তিনি এ কাজ আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের নির্দেশে সম্পাদন করেছেন। অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এ কাজটি হযরত হাসান বসরী -রহিমাহুল্লাহ, হযরত ইয়াসের ইবনে ইয়ামার এবং নসর বিন আছেম লাইসীর দ্বারা সম্পন্ন করিয়েছিলেন।

অনেকে আবার এ অভিমতও প্রকাশ করেছেন যে, যিনি কুরআনের হরফসূহে নোকতা সংযোজন করেছেন তিনি সর্বপ্রথম আরবী বর্ণমালায়ও নোকতার প্রচলন করেন। প্রখ্যাত বর্ণমালা বিশেষজ্ঞ ও সাহিত্যিক আল্লামা কলশন্দী এ অভিমতের প্রতিবাদ করে বলেছেন, মূলত এর বহু আগেই আরবদের মাঝে নোকতার আবিষ্কার হয়েছে। তাঁর মতে আরবী লিখন পদ্ধতির আবিষ্কারক ছিলেন মোয়ামের ইবনে মুরার, আসলাম ইবনে সোদরাহ এবং আমর ইবনে জাদারা নামক এ তিন ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে মোয়ামের হরফের আকৃতি আবিষ্কার করেন। পড়ার মাঝে থামা, শ্বাস নেয়া এবং একত্রে মিলিয়ে পড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহও তিনি আবিষ্কার করেন। আরেক বর্ণনায় হযরত আবু সুফিয়ানকে নোকতার আবিষ্কারক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁদের মতে তিনি নোকতার এ পদ্ধতি হীরাবাসীদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন, আর এ হীরাবাসীরা তা গ্রহণ করেছিলেন আম্বারবাসীদের কাছ থেকে। এতে বুঝা যায় পরবতীকালে যে ব্যক্তির মাধ্যমে কুরআনের নোকতার প্রচলন শুরু হয়, প্রকৃতপক্ষে তিনিই এই নোকতার মূল আবিষ্কারক নন; বরং তিনি ছিলেন কুরআনে সর্বপ্রথম নোকতার প্রচলনকারী মাত্র।

কুরআনের  হারাকাত


নোকতার মতো প্রথম অবস্থায় কুরআনে কারীমে হরকত বা যের যবর পেশ ইত্যাদিও ছিলো না। সর্বপ্রথম কে হরকতের প্রবর্তন করলেন এ ব্যাপারেও মতপার্থক্য রয়েছে। কারো কারো মতে সর্বপ্রথম হযরত আবুল আসাদ দুয়েলী কুরআনে হরকত প্রবর্তন করেন। আবার অনেকেরই অভিমত হচ্ছে যে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এ কাজটি ইয়াহইয়া বিন ইয়াসার এবং নসর বিন আসেম লাইসীর দ্বারা সম্পন্ন করিয়েছিলেন। বিশ্বস্ত অভিমত হচ্ছে হযরত আবুল আসাদ দুয়েলীই সর্বপ্রথম কুরআন শরীফের জন্যে হারাকাত আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু তার আবি হরকতসমূহ আজকাল প্রচলিত হারাকাতের মতো ছিলো না। তাঁর আবিষ্কৃত হারাকাতে যবরএর জন্যে হরফের উপরিভাগে একটা নোকতা এবং যেরএর জন্যে নীচে একটা নোকতা বসিয়ে দেয়া হতো। পেশের উচ্চারণ করার জন্য হরফের সামনে এক নোকতা এবং তানওয়ীনের জন্যে দুই নোকতা ব্যবহার করা হতো। পরে খলীল বিন আহমদ হামযা-এর সাথে তাশদীদের চিহ্ন তৈরি করেন।

এরপর বাগদাদের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ হযরত হাসান বসরী রহিমাহুল্লাহ- ইয়াহইয়া বিন ইয়াসার ও নসর বিন আছেম লাইসী প্রমুখকে কুরআন শরীফে নোকতা ও হারাকাত প্রদানের কাজে নিয়োজিত করেন। একে আরো সহজবোধ্য করার জন্যে উপরে, নীচে বা পাশে অতিরিক্ত বিন্দু ব্যবহার করার ব্যাপারে হযরত আবুল আসাদ দুয়েলী প্রবর্তিত পদ্ধতির জায়গায় বর্তমান আকারের হারাকাত প্রবর্তন করা হয়, যাতে করে হরফের নোকতার সংগে হারাকাত নোকতার মিশ্রণজনিত কোনো জটিলতার সৃষ্টি না হয়।

কুরআনে হারাকাত ও নোকতার সংখ্যা


যবর ৫৩২২৩, যের ৩৯৫৮৩, পেশ ৮৮০৪, মদ ১৭৭১, তাশদীদ ১২৭৪, নোকতা ১০৫৬৮৪।

কুরআনে বিভিন্ন অক্ষরের সংখ্যা


আলিফ ৪৮৮৭২, বা ১১৪২৮, তা ১১৯৯, ছা, ১২৭৬, জীম ৩২৭৩, হা ৯৭৩, খা, ২৪১৬, দাল ৫৬০২, যাল, ৪৬৭৭, রা, ১১৭৯৩, যা ১৫৯০, সীন ৫৯৯১, শীন ২১১৫, ছোয়াদ ২০১২, দোয়াদ, ১৩০৭, তোয়া ১২৭৭, যোয়া ৮৪২, আঈন ৯২২০, গাঈন ২২০৮, ফা, ৮৪৯৯, ক্বাফ ৬৮১৩, কাফ ৯৫০০, লাম ২৪৩২, মীম ৩৬৫৩৫, ন ন ৪০১৯০, ওয়াও ২৫৫৪৬, হা ১৯০৭০, লাম আলিফ ৩৭৭০, ইয়া ৪৫৯১৯৷

সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ ও কুরআনের অক্ষর গণনা করেছেন বলে অনেকে মনে করেন। তাঁর গণনা মতে কুরআনের অক্ষর হচ্ছে ৩,২২,৬৭১। তাবেয়ীদের মাঝে মোজাহেদ -রহিমাহুল্লাহ-এর গণনা অনুযায়ী কুরআনের অক্ষর হচ্ছে ৩,২১,১২১। তবে সাধারণভাবে ৩,২০,২৬৭ সংখ্যাটিই বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

কুরআনের  শব্দ সংখ্যা


সাহাবায়ে কেরামরা তাদের যুগে কুরআনের শব্দ সংখ্যাও নির্ণয় করেছেন। অবশ্য এ স ম্পর্কে সরাসরি তাদের সাথে সম্পৃক্ত কোন রেওয়ায়াত পাওয়া যায় না। যা কিছু আছে সবই পরবর্তীকালের। হুমায়দা আযরাজের গণনা অনুযায়ী ৭৬,৪৩০, আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহর গণনা মোতাবেক ৭০৪৩৯, মোজাহেদের গণনা মোতাবেক ৭৬২50, তবে যে সংখ্যাটি সাধারণভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তা হচ্ছে ৮৬৪৩০।

কুরআনের আয়াত সংখ্যা


হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহা -এর মতে ৬৬৬৬, হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ -এর মতে ৬২৫০, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ -এর মতে ৬২৩৬, হযরত ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহ -এর মতে ৬২১৮, মক্কার গণনা মতে ৬২১২, বসরার গণনা মতে ৬২২৬, ইরাকের গণনা মতে ৬২১৪, ঐতিহাসিকদের মতে হযরত আয়েশার গণনাই বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। যদিও আমাদের এখানে প্রচলিত কুরআনের নোসফাসমূহ থেকে আয়াতের সংখ্যা গুনলে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায় না।


💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url