অহংকারের মারাত্মক পরিণাম || অহংকারই হচ্ছে জঘন্যতম অপরাধের উৎস
ইমাম আবু হামেদ মুহাম্মদ আল-গাযযালী (রহঃ) ছিলেন একজন যুগস্রেষ্ট সাধক ও আলেম। ইসলামের খেদমতে তাঁর বয়ান এবং তাঁর লেখা কিতাবগুলোর মাঝে এমন একটি যাদুকরী প্রভাব লক্ষ্য করা যায় যা অন্য কারো লেখায় বা বয়ানে এতটা প্রভাব সৃষ্টি করে না। তাঁর লেখা কিতাবগুলো পড়ে অতি সহজেই প্রতিটি পাঠকের হৃদয় বিগলিত হয়ে উঠে। “দোযখ ও দোযখের ভয়াবহ শাস্তির বয়ান” শীর্ষক এই প্রবন্ধখানা ইমাম গাযযালীর লেখা “মুকাশাফাতুল কুলূব” বা “আত্মার আলোকমণি” কিতাবের অনুস্মরণে লেখা হয়েছে।
অহংকারের মারাত্মক পরিণাম
অহংকার ও আত্মম্ভরিতার এ দুর্বৃত্তটি মানুষের দুশ্চরিত্রাবলীর মধ্যে অন্যতম এবং এর পরিণতি খুবই জঘন্য ও মারাত্মক। অভিশপ্ত ইবলীস থেকে সর্বপ্রথম যে গুনাহ্টি নিঃসৃত হয়েছিল তা এই অহংকার ও আত্মম্ভরিতার গুনাহ্। যার ফলশ্রুতিতে সে আল্লাহর অভিশপ্ত হয়ে যমীন ও আসমানের প্রশস্ততাসম বেহেশত থেকে বহিষ্কৃত হয়ে দোযখে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
হাদীসে কুদসীতে আছে, বড়ত্ব আমার চাদর, মহত্ত্ব আমার ইযার (পোষাক বিশেষ)। অতএব, এতদুভয়ের যে কোন একটি নিয়ে যে ব্যক্তি আমার সাথে টানাটানিতে লিপ্ত হবে, আমি লা-পরওয়া তাকে টুকরা-টুকরা করে দিবো।
বর্ণিত আছে, অহংকারী-দাম্ভিকদেরকে মানবাকৃতি বজায় রেখে ক্ষুদ্র- ক্ষুদ্র পিপিলিকার আকারে হাশরের ময়দানে উত্থিত করা হবে। সর্বদিক থেকে তাদের উপর লাঞ্ছনার বান নিক্ষিপ্ত হতে থাকবে, তাদেরকে দোযখীদের যখম ও ফোড়ার পূঁজ ও দূর্গন্ধময় রক্ত পান করানো হবে।
হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন:
ثَلاثَةٌ لا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَومَ الْقِيَامَةِ وَ لَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْوَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ شَيْخُ زَانٍ وَمَلِكُ جَائِرٌ وَ عَائِلٌ مُسْتَكْبِرُ
কেয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা'আলা তিন শ্রেণীর লোকদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদের প্রতি কোনরূপ (রহমতের) দৃষ্টিও করবেন না। অধিকন্তু তাদের জন্য থাকবে দোযখের মর্মন্তুদ শাস্তি।
এক, বৃদ্ধ ব্যভিচারী,
দুই, জালেম বাদশাহ্,
তিন, দরিদ্র অহংকারী।
অহংকারই হচ্ছে জঘন্যতম অপরাধের উৎস
বর্ণিত আছে, একদা হযরত উমর (রাযিঃ) নিম্নের এই আয়াতখানি তেলাওয়াত করলেন:
وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللَّهَ اخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ
অতঃপর বললেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন- এক ব্যক্তি সৎকাজের নির্দেশ প্রদানের জন্য উদ্যত হলো, আর তাকে কতল করে দেওয়া হলো, আরেকজন উঠে বললো, কিহে, তোমরা সৎকাজের প্রতি আদেশদাতাকে কতল করে ফেললে? এবার একেও কতল করে দেওয়া হলো। বস্তুতঃ অহংকারই হচ্ছে এ ধরণের জঘন্যতম অপরাধের উৎস।
হযরত ইবনে মাসঊদ (রাযিঃ) বলেন যে, মানুষের পাপ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, তাকে বলা হলো, আল্লাহকে ভয় কর, আর সে উত্তরে বললো, যাও, তুমি তোমার কাজ কর।
হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে বলেছিলেন, ডান হাতে খাও। উত্তরে সে বলেছে, এটা আমার দ্বারা হবে না। হুযূর বললেন, আচ্ছা, আর না হোক। বস্তুতঃ সে অহংকার ভরে ডান হাতে খেতে অস্বীকার করেছিল। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর সে তার ডান হাত আর কখনও উঠাতে পারে নাই, অর্থাৎ তা অকেজো ও অবশ হয়ে যায়।
সাজ-সজ্জা করা অহঙ্কার নয়
বর্ণিত আছে, হযরত সাবেত ইবনে কায়স ইবনে শাম্মাস (রাযিঃ) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, আমি স্বভাবগতভাবে রূপ-সৌন্দর্য পছন্দ করি এবং নিজে সাজ-সজ্জা গ্রহণ করে থাকি, এটা কি অহংকার? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না এটা অহংকার নয়। বরং অহংকার হচ্ছে, হক ও সত্যকে অপছন্দ করা; অস্বীকার করা এবং লোকদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, অথচ তারা তোমারই মত আল্লাহ্ তা'আলার বান্দা অথবা তারা তোমার তুলনায় শ্রেষ্ঠও হতে পারে।
অহঙ্কারের বশে ফেরাউন ঈমান আনা থেকে বিমুখ হয়ে রইল
হযরত ওয়াহ্ ইবনে মুনাব্বেহ্ (রহঃ) বলেন, হযরত মুসা (আঃ) যখন ফেরাউনকে বললেন, ঈমান আন তোমার রাজত্ব তোমার হাতেই থাকবে, তখন সে হামানের সাথে পরামর্শের কথা বলেছে। হামান তাকে পরামর্শ দিয়েছে- এতদিন তুমি প্রভু হিসাবে রয়েছ; লোকেরা তোমার উপাসনা করেছে, এখন তুমি ঈমান আনবে; ফলে তুমি হবে বান্দা এবং আরেক প্রভুর উপাসনা করতে হবে তোমাকে এটা ঠিক নয়। এতে ফেরাউন ঈমান আনা থেকে বিমুখ হয়ে গেল এবং তার অন্তরে হযরত মূসা (আঃ)- এর অনুসারীদের প্রতি ঘৃণা জন্মালো। অতঃপর আল্লাহ্ তা'আলা তাকে সমুদ্রে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দিলেন।
কুরআন পাকে ইরশাদ হয়েছে:
وَقَالُوا لَوْلَا نَزِلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِنَ الْقَرتَينِ عَظِيمٍ
"তারা বললো, এ কুরআন উভয় জনপদের (মক্কা ও তায়েফের) মধ্য হতে কোন প্রধান ব্যক্তির উপর কেন নাযিল করা হয় নাই?” (যুখরুফ : ৩১ )
হযরত কাতাদাহ্ (রাযিঃ) বলেন, উক্ত আয়াতে তারা ‘দুই জনপদের বড় মানুষদের' দ্বারা ওলীদ ইবনে মুগীরা ও আবূ মাসউদ সাকাফীকে বুঝিয়েছে। তারা দাবী করেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তুলনায় তারা দুজন অধিকতর প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী। তারা বলতো, এই এতীম বালককে কি করে আমাদের মধ্যে নবী হিসাবে প্রেরণ করা হলো? আল্লাহ্ পাক তাদের বক্তব্যের জওয়াব দিয়েছেন:
اهم يقسمون رحمةً رَبِّكَ
“এরা কি আপনার রব্বের রহমতকে (স্বীয় মতানুযায়ী) বন্টন করতে চাচ্ছে?” (যুখরুক : ৩২) উপরন্তু তারা আরও আশ্চর্যান্তিত হবে- তারা দোযখে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর সেখানে যখন মসজিদে নববীর সুফ্ফা (আঙ্গিনায়) অবস্থানকারী দরিদ্রদেরকে দেখবে না, তখন তারা বলবে:
مَا لَنَا لَا نَرَى رِجَالاً كُنَّا نَعُدُّهُمْ مِنَ الْأَشْرَارِة
"ব্যাপার কি? আমরা তাদেরকে দেখছি না যাদেরকে নিকৃষ্ট লোকদের মধ্যে গণ্য করতাম।” (ছোয়াদ : ৬২)
এক উক্তি অনুযায়ী তারা হযরত আম্মার, হযরত বেলাল, হযরত সুহাইব ও হযরত মিক্বদাদ (রাযিঃ)-কে উদ্দেশ্য করেছে।
অহংকারী আলেম হবে দোযখের ইন্ধন
হযরত ওয়াহ্ব (রাযিঃ) বলেছেন বস্তুতঃ ইলমের তুলনায় হয় মেঘের সাথে, যা আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে। সুমিষ্ট ও স্বচ্ছ পানির বর্ষণ পেয়ে বৃক্ষরাজি প্রতিটি রগে রগে খুবই তৃপ্ত হয়ে পান করে। অতঃপর নিজ নিজ স্বভাব-প্রকৃতি অনুযায়ী সেই স্বচ্ছ ও মিষ্ট পানির ক্রিয়া গ্রহণ করে- তিক্ত বৃক্ষ তিক্ত ক্রিয়া গ্রহণ করে এবং তার তিক্ততা আরও বৃদ্ধি পায়, অনুরূপভাবে মিষ্ট বৃক্ষের মিষ্টতা বৃদ্ধি পায়। মূলতঃ ইলমের ব্যাপারটিও ঠিক অনুরূপ। ইলম অন্বেষাকারী স্বীয় পরিশ্রম ও সাধনা অনুপাতে তা অর্জন করে। কিন্তু অহংকারী ব্যক্তির অহংকার এতে আরও বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে, বিনয়ী ব্যক্তি ইল্ম অধ্যয়ন করে আরও বিনয়ী হয় এবং তার সৎগুণাবলী উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর কারণ হচ্ছে, যার উদ্দেশ্যই অহংকার ও নিজের বড়ত্ব প্রকাশ করা অথচ সে মূর্খ জাহেল, এমতাবস্থায় ইলমের নাগাল পেলে সে মূলতঃ অহংকার ও বড়াই করার আরও উপকরণ হাতে পেয়ে গেল। পক্ষান্তরে, আল্লাহর প্রতি যার অন্তরে ভয় আছে, সে মূর্খ হলেও ইলম হাসিল করার পর বুঝে নিবে যে, আমার উপর আল্লাহ্ তা'আলার দলীল কায়েম হয়ে গেছে; সুতরাং আর অন্যথা করা যাবে না। অতএব, সে পূর্বাপেক্ষা আল্লাহকে অধিক ভয় করবে এবং অধিক মাত্রায় নম্রতা ও বিনয় এতিয়ার করবে।
হযরত আব্বাস (রাযিঃ)-সূত্রে বর্ণিত এক রেওয়ায়াতে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ ভবিষ্যতে এমন এক শ্রেণীর লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু হুকুমের (গলা) নীচে তা পৌঁছবে না। তারা বলবে, আমরা কুরআন পড়েছি, অধ্যয়ন করেছি, আমাদের চেয়ে বড় বিজ্ঞ ও আলেম কারা? অতঃপর সাথীদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, এসব লোক এ উম্মতের মধ্য থেকেই হবে। বস্তুতঃ এরাই হবে দোযখের ইন্ধন ।
হযরত উমর (রাযিঃ) বলেন, অত্যাচারী ও অহংকারী আলেম হয়ো না। এতে তোমার মূর্খতা দূর হবে না; এরূপ ইলম তোমার কোন উপকারে আসবে না।
বর্ণিত আছে, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে এক ব্যক্তির প্রশংসা করা হয়েছিল। কিছুদিন পর লোকটি হুযুরের দরবারে উপস্থিত হলে সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্, আমরা সেদিন যে লোকটির প্রশংসা করেছিলাম, তিনি উপস্থিত হয়েছেন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তার চেহারায় শয়তানের প্রভাব লক্ষ্য করছি। লোকটি সালাম করে হুযুরের সম্মুখে এসে দাড়ালো। হুযুর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি সত্যি করে বল, তোমার মনে কি এ কথা এসেছে যে, এসব লোকের মধ্যে তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ নাই? লোকটি বললো, হাঁ।
লক্ষ্য করার বিষয় হলো, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়্যাতের নূর-দৃষ্টিতে তার অন্তরের গোপন বিষয়টি দিব্যি উপলব্ধি করে নিয়েছেন, যা তার চেহারায় তিনি প্রত্যক্ষ করছিলেন।
হারস ইবনে জায' যুবাইদী (রাযিঃ) বলেছেন, জ্ঞানী-গুণী ও আলেমদের মধ্যে যারা হাসিমুখে পাশে আসেন, আমি তাদেরকে বড় পছন্দ করি। আর যারা এমন যে, তুমি তাদের সাথে হাসিমুখে খোলা মনে পাশে আছো; কিন্তু তারা ভ্রূকুঞ্চিত করে সংকীর্ণ মন নিয়ে সাক্ষাৎ করে। বস্তুতঃ তারা নিজেদের জ্ঞান-গরিমার উপর গর্ব-অহংকারে নিমজ্জিত। আল্লাহ্ তা'আলা মুসলমানদেরকে এসব লোকের আধিক্য থেকে হেফাজত করুন।
বর্ণিত আছে, হযরত আবূ যর গেফারী (রাযিঃ) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতিতে এক ব্যক্তির উপর কটু বাক্য প্রয়োগ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, ওহে কৃষ্ণাঙ্গিনীর পুত্র। এ কথা শুনে তিনি বললেন, হে আবূ যর! অনেক বেশী বলা হয়ে গেছে ; কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের (শুধু বর্ণ-তারতম্যের কারণে) কোনই প্রাধান্য নাই। হযরত আবু যর গেফারী বলেন, আমি মাটিতে শুয়ে পড়লাম এবং লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এসব লোক এ উম্মতের মধ্য থেকেই হবে। বস্তুতঃ এরাই হবে দোযখের ইন্ধন ।
হযরত উমর (রাযিঃ) বলেন, অত্যাচারী ও অহংকারী আলেম হয়ো না। এতে তোমার মূর্খতা দূর হবে না; এরূপ ইলম তোমার কোন উপকারে আসবে না।
*************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.