কেমন ছিল রাসুল (সা:) এর সালাত || রাসুলুল্লাহ (সা:) এর নামাজ || (পর্ব - ১৩)






মহান আল্লাহর বাণী- ‘সফলকাম হবে সেই সব মুমিন যারা সালাতে রত থাকে ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে’। অতএব গভীরভাবে চিন্তা করুন! আপনার প্রভু আল্লাহ কিজন্য আপনাকে সৃষ্টি করেছেন? মনে রাখবেন তিনি আপনাকে বিনা প্রয়োজনে সৃষ্টি করেননি। তাঁর সৃষ্ট এ সুন্দর সৃষ্টি জগতকে সুন্দরভাবে আবাদ করার দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়েই তিনি আপনাকে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। কে এখানে কত বেশী সুন্দর আমল করে এবং তার সৃষ্টিকর্তার হুকুম যথাযথভাবে পালন করে, তা পরীক্ষার জন্য আল্লাহ মউত ও হায়াতকে সৃষ্টি করেছেন। আপনার হাত-পা, চক্ষু-কর্ণ, নাসিকা-জিহবা সর্বোপরি যে মূল্যবান জ্ঞান-সম্পদ এবং ভাষা ও চিন্তাশক্তির নেয়ামত দান করে আপনাকে আপনার প্রভু এ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, তার যথার্থ ব্যবহার আপনি করেছেন কি-না, তার কড়ায়-গন্ডায় হিসাব আপনাকে আপনার সৃষ্টিকর্তার নিকটে দিতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ও জান্নাত লাভের উদ্দেশ্যে ইসলামের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত ও প্রার্থনার অনুষ্ঠান ‘সালাতে’ রত হই ‘তাকবীরে তাহরীমা’-র মাধ্যমে দুনিয়ার সবকিছুকে হারাম করে একনিষ্ঠভাবে বিনম্রচিত্তে বিগলিত হৃদয়ে!! শ্রেষ্ট ইবাদত সালাত বা নামাজে সফলতার জন্য চাই সালাতের সঠিক পদ্ধতির অনুসরণ। আর এই সঠিক পদ্ধতিটি পাওয়া যাবে কেবলমাত্র হযরত মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সা:) এর সালাত বা নামাজের মধ্যেই। তাই আমরা এখানে রাসুল (সা:) এর সালাত বা নামাজ কেমন ছিল এই বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করবো। পুরো আলোচনাটিই নেওয়া হয়েছে ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব রচিত “ ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)” নামক গ্রন্থ থেকে। আল্লাহ আমাদেরকে সালাত বা নামাজের সকল বিষয়ে সঠিকভাবে জানার ও মানার তৌফিক দান করুন। আমিন।।

জানাযা’র নামাজ, মৃতের প্রতি করণীয়সমূহ, কবরে নিষিদ্ধ কর্ম ও প্রচলিত বিদআতসমূহ


মৃত্যু পরবর্তী করণীয় সমূহ

মৃত্যুর পর পাঁচটি কাজ দ্রুত সম্পাদন করতে হয়। যথা গোসল, কাফন, জানাযা, জানাযা বহন ও দাফন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَسْرِعُوا بِالْجِنَازَةِ، فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرٌ تُقَدِّمُوْنَهَا إِلَيْهِ، وَإِنْ يَكُ سِوَى ذَلِكَ فَشَرٌّ تَضَعُوْنَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ ‘তোমরা জানাযা করে দ্রুত লাশ দাফন কর। কেননা যদি মৃত ব্যক্তি পুণ্যবান হয়, তবে তোমরা ‘ভাল’-কে দ্রুত কবরে সমর্পণ কর। আর যদি অন্যরূপ হয়, তাহ’লে ‘মন্দ’-কে দ্রুত তোমাদের কাঁধ থেকে নামিয়ে দাও’। [65]

মাইয়েতের গোসল

(ক) গোসল ও কাফন-দাফনের ছওয়াব : উক্ত কাজ সমূহে অশেষ ছওয়াব রয়েছে দু’টি শর্তে। এক- যদি তিনি স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করেন এবং বিনিময়ে দুনিয়াবী কিছুই গ্রহণ না করেন’ (কাহফ ১৮/১১০)। দুই- যদি তিনি মাইয়েতের কোন অপছন্দীয় বিষয় গোপন রাখেন।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলিম মাইয়েতকে গোসল করালো। অতঃপর তার গোপনীয়তাসমূহ গোপন রাখলো, আল্লাহ তাকে চল্লিশ বার ক্ষমা করবেন। যে ব্যক্তি মাইয়েতের জন্য কবর খনন করল, অতঃপর দাফন শেষে তা ঢেকে দিল, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত পুরস্কার দিবেন জান্নাতের একটি বাড়ীর সমপরিমাণ, যেখানে আল্লাহ তাকে রাখবেন। যে ব্যক্তি মাইয়েতকে কাফন পরাবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের মিহি ও মোটা রেশমের পোষাক পরাবেন’। [66]

(খ) হুকুম: মাইয়েতের দ্রুত গোসল ও কাফন-দাফনের ব্যবস্থা নেওয়া সুন্নাত।[67] গোসলের সময় পর্দার ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং পূর্ণ শালীনতা ও পরহেযগারীর সাথে কুলপাতা দেওয়া পানি বা সুগন্ধি সাবান দিয়ে সুন্দরভাবে গোসল করাবে। সুন্নাতী তরীকা মোতাবেক গোসল করাতে সক্ষম এমন নিকটাত্মীয় বা অন্য কেউ মাইয়েতকে গোসল করাবেন। পুরুষ পুরুষকে ও মহিলা মহিলা মাইয়েতকে গোসল দিবেন। তবে মহিলাগণ শিশুকে গোসল দিতে পারবেন। [68] স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে বিনা দ্বিধায় গোসল করাবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় স্ত্রী আয়েশা (রাঃ)-কে বলেছিলেন, ‘যদি আমার পূর্বে তুমি মারা যাও, তাহ’লে আমি তোমাকে গোসল দেব, কাফন পরাব, জানাযা পড়াব ও দাফন করব’। [69] হযরত আবুবকর (রাঃ)-কে তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস (রাঃ) এবং হযরত ফাতেমা (রাঃ)-কে তাঁর স্বামী হযরত আলী (রাঃ) গোসল দিয়েছিলেন।[70] ধর্মযুদ্ধে নিহত শহীদকে গোসল দিতে হয় না। [71] পানি না পাওয়া গেলে মাইয়েতকে তায়াম্মুম করাবে’।[72]

(গ) গোসলের পদ্ধতি : ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ডান দিক থেকে ওযূর অঙ্গ সমূহ প্রথমে ধৌত করবে। ধোয়ানোর সময় হাতে ভিজা ন্যাকড়া রাখবে। পূর্ণ পর্দার সাথে মাইয়েতের দেহ থেকে পরনের কাপড় খুলে নেবে। গোসলের সময় লজ্জাস্থানের দিকে তাকাবে না বা খালি হাতে স্পর্শ করবে না। তিনবার বা তিনের অধিক বেজোড় সংখ্যায় সমস্ত দেহে পানি ঢালবে। গোসল শেষে কর্পূর বা কোন সুগন্ধি লাগাবে। মাইয়েত মহিলা হ’লে চুল খুলে দেবে। অতঃপর বেণী করে তিনটি ভাগে পিছন দিকে ছড়িয়ে দেবে। [73]

কাফন

সাদা, সুতী ও সাধারণ মানের পরিষ্কার কাপড় দিয়ে কাফন দিবে। মাইয়েতের নিজস্ব সম্পদ থেকে কাফন দেওয়া কর্তব্য। তার ব্যবহৃত কাপড় দিয়েও কাফন দেওয়া যাবে। কেননা জীবিত মানুষ নতুন কাপড়ের অধিক মুখাপেক্ষী। পুরুষ ও মহিলা সকল মাইয়েতের জন্য তিনটি কাপড় দিয়ে কাফন দিবে। একটি মাথা হ’তে পা ঢাকার মত বড় চাদর ও দু’টি ছোট কাপড়। অর্থাৎ একটি লেফাফা বা বড় চাদর। একটি তহবন্দ বা লুঙ্গী ও একটি ক্বামীছ বা জামা। বাধ্যগত অবস্থায় একটি কাপড় দিয়ে কিংবা যতটুকু সম্ভব ততটুকু দিয়েই কাফন দিবে। শহীদকে তার পরিহিত পোষাকে এবং মুহরিমকে তার ইহরামের দু’টি কাপড়েই কাফন দিবে। কাফনের কাপড়ের অভাব ঘটলে এক কাফনে একাধিক মাইয়েতকে কাফন দেওয়া যাবে। কাফনের পরে তিনবার সুগন্ধি ছিটাবে। তবে মুহরিমের কাফনে সুগন্ধি ছিটানো যাবে না।[74] মাইয়েতের নিজস্ব সম্পদ না থাকলে কিংবা তাতে কাফনের ব্যবস্থা না হ’লে কেউ দান করবে অথবা বায়তুল মাল থেকে বা সরকারী তহবিল থেকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।[75] মহিলাদের জন্য প্রচলিত পাঁচটি কাপড়ের হাদীছ ‘যঈফ’। [76]

জানাযা

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর মসজিদের বাইরের নির্দিষ্ট স্থানে অধিকাংশ সময় জানাযা পড়াতেন।[77] তবে প্রয়োজনে মসজিদেও জায়েয আছে। সুহায়েল বিন বায়যা (রাঃ) ও তার ভাইয়ের জানাযা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মসজিদের মধ্যে পড়েছিলেন।[78] হযরত আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর জানাযা মসজিদের মধ্যে হয়েছিল। [79] মেয়েরাও পর্দার মধ্যে জানাযায় শরীক হ’তে পারেন। আয়েশা (রাঃ) ও অন্যান্য উম্মাহাতুল মুমিনীন (রাঃ) মসজিদে নববীর মধ্যে সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)-এর লাশ আনিয়ে নিজেরা জানাযা পড়েছিলেন।[80] মহিলাগণ একাকী বা জামা‘আত সহকারে জানাযা পড়তে পারেন। গোরস্থানের মধ্যে জানাযা না করা উচিৎ।[81] সেখানে কোন মসজিদও নির্মাণ করা যাবে না।[82] তবে কেউ জানাযা না পেলে পরে যেকোন দিন গিয়ে কবরে একাকী বা জামা‘আত সহকারে জানাযা পড়তে পারেন।[83] উল্লেখ্য যে, লাশ পচে গেলে এবং দুর্গন্ধে কাছে দাঁড়ানো সম্ভব না হ’লে দাফন করার পরে কবরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে জানাযা পড়া যাবে।[84] একই ব্যক্তি বিশেষ কারণে একাধিক বার জানাযার ছালাত আদায় করতে পারেন বা ইমামতি করতে পারেন।[85]

জ্ঞাতব্য : (ক) বর্তমান যুগে অনেকে দাফনের পরপরই পুনরায় হাত তুলে দলবদ্ধভাবে দো‘আ করেন। কেউ একই দিনে বা দু’একদিন পরে আত্মীয়-স্বজন ডেকে এনে মৃতের বাড়ীতে দো‘আর অনুষ্ঠান করেন। এগুলি নিঃসন্দেহে বিদ‘আত। জানা আবশ্যক যে, জানাযার ছালাতই হ’ল মৃতের জন্য একমাত্র দো‘আর অনুষ্ঠান। এটা ব্যতীত মুসলিম মাইয়েতের জন্য পৃথক কোন দো‘আর অনুষ্ঠান ইসলামী শরী‘আতে নেই।

(খ) জানাযার পরে বা দাফনের পূর্বে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় সম্মানের নামে করুণ সুরে বিউগল বাজানো সহ যা কিছু করা হয়, সবটাই বিদ‘আত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে মৃতের উপর বিলাপধ্বনি করা হয়, কবরে ও ক্বিয়ামতের দিন এজন্য তাকে আযাব দেওয়া হবে’।[86] আর এটা নিঃসন্দেহে ঐ মাইয়েতের জন্য, যে এসব কাজ সমর্থন করে এবং এসব না করার জন্য মৃত্যুর আগে অছিয়ত না করে যায়।[87]

জানাযা বহন

জানাযা কাঁধে বহন করা সুন্নাত।[88] এ সময় মাথা সম্মুখ দিকে রাখবে। [89] মৃতের পরিবারের লোকেরা ও নিকটাত্মীয়গণ এর প্রথম হকদার। এ দায়িত্ব কেবল পুরুষদের, মেয়েদের নয়। জানাযার পিছে পিছে মেয়েদের যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে এটা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ নয়। এই সময় সরবে কান্নাকাটি করা যাবে না। ধূপ-ধুনা ইত্যাদি অগ্নিযুক্ত সুগন্ধি বহন করা যাবে না। সরবে যিকর, তাকবীর ও তেলাওয়াত বা অনর্থক কথাবার্তা বলা যাবে না। বরং মৃত্যুর চিন্তা করতে করতে চুপচাপ ভাবগম্ভীরভাবে মধ্যম গতিতে মাইয়েতের পিছে পিছে কবরের দিকে এগিয়ে যাবে। চলা অবস্থায় রাস্তায় (বিনা প্রয়োজনে) বসা যাবে না।[90] মাইয়েতের পিছনে কাছাকাছি চলাই উত্তম। তবে প্রয়োজনে সম্মুখে ও ডাইনে-বামে চলা যাবে। কেউ গাড়ীতে গেলে তাকে পিছে পিছেই যেতে হবে।[91] কোন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বা মুরববী আলেম জানাযায় যোগদানে সক্ষম না হ’লে মাইয়েতকে তাঁর সামনে এনে রাখা যাবে। যাতে তিনি একাকী হ’লেও জানাযা পড়তে পারেন। যারা জানাযার পিছনে চলবেন, তাদের ওযূ অবস্থায় থাকা মুস্তাহাব। তবে আবশ্যিক নয়।

বর্তমান যুগে কোন কোন স্থানে জানাযার জন্য গাড়ীতে করে লাশ বহন করতে দেখা যায়। এটি সুন্নাত বিরোধী কাজ। নিতান্ত বাধ্য না হ’লে একাজ থেকে বিরত থাকা উচিৎ। কেননা এটা ইহুদী-নাছারাদের অনুকরণ মাত্র। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, عُوْدُوا الْمَرِيْضَ وَاتَّبِعُوا الْجَنَائِزَ تُذَكِّرْكُمُ الْآخِرَةَ- ‘তোমরা রোগীর সেবা কর এবং জানাযার অনুগমন কর। তা তোমাদের আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেবে’।[92] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জানাযার সাথে ফেরেশতাগণ পায়ে হেঁটে চলেন এবং জানাযা শেষে তারা চলে যান। একারণে আমি বাহনে সওয়ার হইনি। এখন তাঁরা চলে গেছেন বিধায় সওয়ার হ’লাম’। [93]

দাফন

মুসলিম মাইয়েতকে মুসলিম কবরস্থানে দাফন করতে হবে, ইহুদী-নাছারা ও কাফের-মুশরিকদের সাথে নয়। যাতে তারা মুসলিম যিয়ারতকারীদের দো‘আ লাভে উপকৃত হন। শিরক ও বিদ‘আতপন্থী ব্যক্তির পাশে ছহীহ হাদীছপন্থী মুসলমানের কবর দেওয়া উচিৎ নয়। হযরত জাবের (রাঃ) তাঁর পিতার লাশ অন্য মুসলিমের পাশ থেকে যাকে তিনি অপছন্দ করতেন, ৬ মাস পরে উঠিয়ে অন্যত্র দাফন করেছিলেন।[94] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাঁর শয়ন কক্ষে দাফন করা হয়েছিল। এটা ছিল তাঁর জন্য ‘খাছ’। তাছাড়া তাঁর পাশে তাঁর দুই মহান সাথীকে কবর দেওয়া হয়েছিল, যাতে কেউ পৃথকভাবে তাঁর কবরকে সিজদার স্থানে পরিণত করতে না পারে। যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলমানগণ যেখানে শহীদ হবেন, সেখানেই কবরস্থ হবেন।[95] মুসলমান যেখানে মৃত্যুবরণ করেন, সেখানকার মুসলিম কবরস্থানে তাকে দাফন করা উচিৎ। তবে সঙ্গত কারণে অন্যত্র নেওয়া যাবে।[96]

কবর উত্তর-দক্ষিণে লম্বা, গভীর, প্রশস্ত, সুন্দর ও মধ্যস্থলে বিঘত খানেক উঁচু করে দু’দিকে ঢালু হওয়া বাঞ্ছনীয়। অধিক উঁচু করা নাজায়েয। ‘লাহদ’ ও ‘শাক্ব’ দু’ধরনের কবর জায়েয আছে। যাকে এদেশে যথাক্রমে ‘পাশখুলি’ ও ‘বাক্স কবর’ বলা হয়। তবে ‘লাহদ’ উত্তম। মাইয়েতকে কবরে নামানোর দায়িত্ব পুরুষদের। মাইয়েতের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নিকটবর্তীগণ ও সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তিগণ এই দায়িত্ব পালন করবেন, যিনি পূর্বরাতে (বা দাফনের পূর্বে) স্ত্রী সহবাস করেননি। পায়ের দিক দিয়ে মোর্দা কবরে নামাবে (অসুবিধা হ’লে যেভাবে সুবিধা সেভাবে নামাবে)। মোর্দাকে ডান কাতে ক্বিবলামুখী করে শোয়াবে। এই সময় কাফনের কাপড়ের গিরাগুলি খুলে দেবে। [97]

কবরে শোয়ানোর সময় بِسْمِ اللهِ وَعَلَى مِلَّةِ رَسُوْلِ اللهِ ‘বিসমিল্লা-হি ওয়া ‘আলা মিল্লাতে রাসূলিল্লা-হ’ (অর্থ: ‘আল্লাহর নামে ও আল্লাহর রাসূলের দ্বীনের উপরে’) বলবে। ‘মিল্লাতে’-এর স্থলে ‘সুন্নাতে’ বলা যাবে। এই সময় কোন সুগন্ধি বা গোলাপ পানি ছিটানো বিদ‘আত। [98] কবর বন্ধ করার পরে উপস্থিত সকলে (বিসমিল্লাহ বলে) তিন মুঠি করে মাটি কবরের মাথার দিক থেকে পায়ের দিকে ছড়িয়ে দেবে।[99] এ সময় ‘মিনহা খালাক্বনা-কুম ওয়া ফীহা নু‘ঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তা-রাতান উখরা’ (ত্বোয়াহা ২০/৫৫) পড়ার কোন ছহীহ দলীল নেই। [100] অনুরূপভাবে আল্লা-হুম্মা আজিরহা মিনাশ শায়ত্বা-নি ওয়া মিন ‘আযা-বিল ক্বাবরে... পড়ার কোন ছহীহ ভিত্তি নেই।[101]

দাফন চলাকালীন সময়ে কবরের নিকটে বসে কবর আযাব, জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন ও জান্নাতের সুসংবাদের উপরে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে আলোচনা করবে। এই সময় প্রত্যেকে দু’তিনবার করে পড়বে- اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিন ‘আযা-বিল ক্বাবরি’ (হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকটে কবরের আযাব হ’তে পানাহ চাই)।[102]

দাফনের পরে মাইয়েতের ‘তাছবীত’ (التثبيت) অর্থাৎ মুনকার ও নাকীর (দু’জন অপরিচিত ফেরেশতা)-এর সওয়ালের জওয়াব দানের সময় যেন তিনি দৃঢ় থাকতে পারেন, সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে সকলের দো‘আ করা উচিৎ। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِسْتَغْفِرُوْا لِأَخِيْكُمْ وَسَلُوا اللهَ لَهُ التَّثْبِيْتَ فَإِنَّهُ اَلْآنَ يُسْأَلُ ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার দৃঢ় থাকার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ কর। কেননা সত্বর সে জিজ্ঞাসিত হবে’। [103] অতএব এ সময় প্রত্যেকের নিম্নোক্ত ভাবে দো‘আ করা উচিৎ। যেমন,

(১) اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ وَثَبِّتْهُ ‘আল্লা-হুম্মাগফির লাহূ ওয়া ছাবিবতহু’ (অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন ও তাকে দৃঢ় রাখুন’)।[104] অথবা
(২) اَللَّهُمَّ ثَبِّتْهُ بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ ‘আল্লা-হুম্মা ছাব্বিতহু বিল ক্বাউলিছ ছা-বিত’ (হে আল্লাহ! আপনি তাকে কালেমা শাহাদাত দ্বারা সুদৃঢ় রাখুন)। এই সময় ঐ ব্যক্তি দো‘আর ভিখারী। আর জীবিত মুমিনের দো‘আ মৃত মুমিনের জন্য খুবই উপকারী। এই সময় মাইয়েতের তালক্বীনের উদ্দেশ্যে সকলের লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হ পাঠের কোন দলীল নেই। যেটা শাফেঈ মাযহাবে ব্যাপকভাবে চালু আছে।[105]

(৩) পূর্বে বর্ণিত জানাযার ২ নং দো‘আটি এবং ৩ নং দো‘আটির শেষাংশটুকুও اَللَّهُمَّ اغْفِرْلَهُ وَارْحَمْهُ، إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُوْرالرَّحِيْمُ (আল্লা-হুম্মাগফিরলাহূ ওয়ারহামহু, ইন্নাকা আন্তাল গাফূরুর রহীম) পড়া যায়। কিন্তু দাফনের পরে একজনের নেতৃত্বে সকলে সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে দো‘আ করা ও সকলের সমস্বরে ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলার প্রচলিত প্রথার কোন ভিত্তি নেই।

[65]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৪৬ ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-৫।
[66]. ১০৬১. বায়হাক্বী ৩/৩৯৫; ত্বাবারাণী, ছহীহ আত-তারগীব হা/৩৪৯২, সনদ ছহীহ; তালখীছ, পৃঃ ৩১।
[67]. বুখারী ১/১৭৬, হা/১৩১৫, ‘জানায়েয’ অধ্যায়-২৩, অনুচ্ছেদ-৫১।
[68]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৬৮।
[69]. ইবনু মাজাহ হা/১৪৬৫।
[70]. বায়হাক্বী ৩/৩৯৭; দারাকুৎনী হা/১৮৩৩, সনদ হাসান।
[71]. তালখীছ, পৃঃ ২৮-৩৩।
[72]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৬৭; নিসা ৪/৪৩; মায়েদাহ ৫/৬।
[73]. তালখীছ, পৃঃ ২৮-৩০।
[74]. তালখীছ, পৃঃ ৩৪-৩৭; বায়হাক্বী ৪/৭; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মির‘আত ৫/৩৪৩-৪৫।
[75]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৭০।
[76]. আলবানী, আবুদাঊদ, হা/৩১৫৭; সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৮৪৪।
[77]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৮২।
[78]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৬৫৬।
[79]. বায়হাক্বী ৪/৫২।
[80]. মুসলিম হা/৯৭৩; মিশকাত হা/১৬৫৬; বায়হাক্বী ৪/৫১।
[81]. (اَلْأَرْضُ كُلُّهَا مَسْجِدٌ إِلَّا اَلْمَقْبَرَةَ وَالْحَمَّامَ) আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৭৩৭, ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থান সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৮২।
[82]. তালখীছ ৫৩ পৃঃ।
[83]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৫৮-৫৯; মুসলিম, মিশকাত হা/১৬৯৮; বায়হাক্বী ৪/৪৪-৪৯; মির‘আত ৫/৩৯০, ৪৩৩।
[84]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৮১।
[85]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৫৮; ফাৎহুল বারী হা/১৩৩৬-৩৭-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, ‘জানায়েয’ অধ্যায়-২৩, অনুচ্ছেদ-৬৬; মির‘আত হা/১৬৭২-এর আলোচনা দ্র: ৫/৩৯০।
[86]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৭৪০-৪২, ‘মৃতের উপর ক্রদন’ অনুচ্ছেদ-৭।
[87]. বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মির‘আত শরহ মিশকাত হা/১৭৫৪-এর ভাষ্য, ৫/৪৮২-৮৫ পৃঃ।
[88]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, বুখারী, মিশকাত হা/১৬৪৬-৪৭।
[89]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া উছায়মীন ১৭/১৬৬ পৃঃ।
[90]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৪৮।
[91]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৬৭।
[92]. আহমাদ হা/১১২৮৮; বায়হাক্বী, ছহীহুল জামে‘ হা/৪১০৯; তালখীছ, পৃঃ ৩৮-৪৩ ।
[93]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৭২-এর টীকা নং ৪, ছাওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) হ’তে অন্য বর্ণনাও এসেছে; মুসলিম, মিশকাত হা/১৬৬৬।
[94]. বুখারী হা/১৩৫২ ‘জানায়েয’ অধ্যায়-২৩, অনুচ্ছেদ-৭৭; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০০, ৩০২।
[95]. তালখীছ ৫৯-৬০; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০১-০২।
[96]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০৩।
[97]. বুখারী, মিশকাত হা/১৬৯৫; মির‘আত ৫/৪২৮-২৯; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৯০।
[98]. তালখীছ, পৃঃ ১০২।
[99]. তালখীছ, পৃঃ ৫৮-৬৫, ৬৯; মির‘আত ‘মাইয়েতের দাফন’ অনুচ্ছেদ, ৫/৪২৬-৫৭।
[100]. আহমাদ হা/২২২৪১, সনদ যঈফ; তালখীছ পৃঃ ১০২; আলবানী, আহকামুল জানায়েয, টীকা দ্রঃ, মাসআলা নং ১০৬ দ্রঃ।
[101]. ইবনু মাজাহ হা/১৫৫৩, সনদ যঈফ।
[102]. আহমাদ, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৩০ ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫ অনুচ্ছেদ-৩।
[103]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৩৩, ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, ‘কবর আযাবের প্রমাণ’ অনুচ্ছেদ-৪।
[104]. আবুদাঊদ, হাকেম, হিছনুল মুসলিম, দো‘আ নং ১৬৪।
[105]. মিরক্বাত ১/২০৯; মির‘আত ১/২৩০।

কবরে নিষিদ্ধ কর্ম সমূহ

(১) কবর এক বিঘতের বেশী উঁচু করা, পাকা ও চুনকাম করা, সমাধি সৌধ নির্মাণ করা, গায়ে নাম লেখা, কবরের উপরে বসা, কবরের দিকে ফিরে ছালাত আদায় করা। [106]

(২) ধুয়ে-মুছে সুন্দর করা, কবরে মসজিদ নির্মাণ করা, সেখানে মেলা বসানো, ওরস করা ও কবরকে তীর্থস্থানে পরিণত করা।[107]

(৩) কবরের নিকটে গরু-ছাগল-মোরগ ইত্যাদি যবেহ করা। জাহেলী যুগে দানশীল ও নেককার ব্যক্তিদের কবরের পাশে এগুলি করা হ’ত।[108]

(৪) কবরে ফুল দেওয়া, গেলাফ চড়ানো, শামিয়ানা টাঙ্গানো ইত্যাদি।[109] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ আমাদেরকে ইট, পাথর ও মাটি ইত্যাদিকে কাপড় পরিধান করাতে নির্দেশ দেননি’।[110] এগুলি স্পষ্টভাবে কবরপূজার শামিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন,

عَنْ أَبِى الْهَيَّاجِ الأَسَدِىِّ قَالَ قَالَ لِى عَلِىُّ بْنُ أَبِى طَالِبٍ: أَلاَّ أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِى عَلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: أَنْ لاَ تَدَعَ تِمْثَالاً إِلاَّ طَمَسْتَهُ وَلاَ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ

‘তুমি কোন মূর্তিকে ছেড় না নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত এবং কোন উঁচু কবরকে ছেড় না মাটি সমান না করা পর্যন্ত’। [111]

(ক) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রার্থনা করেছেন, اَللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَناً يُّعْبَدُ اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে ইবাদতের স্থানে পরিণত করো না। আল্লাহর গযব কঠোরতর হয় ঐ

জাতির উপরে, যারা তাদের নবীর কবরকে সিজদার স্থানে পরিণত করে।[112]

(খ) আজকাল কবরকে ‘মাযার’ বলা হচ্ছে। যার অর্থ: পবিত্র সফরের স্থান। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে গেছেন, ‘(নেকী হাছিলের উদ্দেশ্যে) তিনটি স্থান ব্যতীত সফর করা যাবে না, মাসজিদুল হারাম, মাসজিদুল আক্বছা ও আমার এই মসজিদ’।[113] তিনি তাঁর উম্মতের উদ্দেশ্যে বলেন,لاَ تَجْعَلُوْا قَبْرِىْ عِيْدًا ‘তোমরা আমার কবরকে তীর্থস্থানে পরিণত করো না’।[114]

(গ) মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে তিনি উম্মতকে সাবধান করে বলেন,لاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُوْرَ مَسَاجِدَ، إِنِّيْ أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ- ‘সাবধান! তোমরা কবর সমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করো না। আমি তোমাদেরকে এ ব্যাপারে নিষেধ করে যাচ্ছি’।[115]

(ঘ) কবরে মসজিদ নির্মাণকারী ও সেখানে মৃতব্যক্তির ছবি, মূর্তি ও প্রতিকৃতি স্থাপনকারীদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أُولَئِكَ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘এরা ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকটে নিকৃষ্টতম সৃষ্টি হিসাবে গণ্য হবে’। [116]

(ঙ) কবরের বদলে কোন গৃহে বা রাস্তার ধারে বা কোন বিশেষ স্থানে মৃতের পূর্ণদেহী বা আবক্ষ প্রতিকৃতি নির্মাণ করে বা স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা ও নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা পরিষ্কারভাবে মূর্তিপূজার শামিল। যা স্পষ্ট শিরক এবং যা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।

উল্লেখ্য যে, মাথাসহ আবক্ষ ছবি ও মূর্তি পুরা মূর্তির শামিল, যা সর্বদা নিষিদ্ধ।[117]
[106]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৬৯৬-৯৯; তিরমিযী, মিশকাত হা/১৭০৯।
[107]. মুসলিম, মিশকাত হা/৭১৩; মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/৭৫০; নাসাঈ, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৯২৬; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৯৫।
[108]. (لا عقر فى الاسلام) আবুদাঊদ হা/৩২২২; আহমাদ হা/১৩০৫৫, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪৩৬।
[109]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৯৫।
[110]. (إن الله لم يأمرنا أن نكسو الحجارة والطين واللبن) মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৪৯৪ ‘পোষাক’ অধ্যায়-২২, ‘ছবি সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৪; আবুদাঊদ হা/৪১৫৩।
[111]. মুসলিম হা/৯৬৯; ঐ, মিশকাত হা/১৬৯৬ ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, ‘মৃতের দাফন’ অনুচ্ছেদ-৬; রাবী আবু হাইয়াজ আল-আসাদী খলীফা আলী (রাঃ)-এর পুলিশ প্রধান ছিলেন। তাঁর পূর্বের খলীফা ওছমান (রাঃ)-এর আমলেও এ নির্দেশ জারি ছিল (আলবানী, তাহযীরুস সাজেদ ৯২ পৃঃ)।
[112]. মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/৭৫০, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থান সমূহ’
অনুচ্ছেদ-৭ ।
[113]. (لا تشد الرحال إلا إلى ثلاث مساجد المسجد الحرام ومسجدي هذا والمسجد الأقصى) মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৯৩, ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থান সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭।
[114]. নাসাঈ, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৯২৬, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ’ অনুচ্ছেদ-১৬।
[115]. মুসলিম হা/১২১৬, মিশকাত হা/৭১৩; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, আলবানী, তাহযীরুস সাজেদ পৃঃ ১৫।
[116]. বুখারী হা/১৩৪১; মুসলিম হা/১২০৯।
[117]. আবুদাঊদ হা/৪১৫৮; দ্রঃ লেখক প্রণীত ‘ছবি ও মূর্তি’ বই পৃঃ ২৫-২৬।

কবরে প্রচলিত শিরক সমূহ

(১) কবরে সিজদা করা
(২) সেদিকে ফিরে ছালাত আদায় করা
(৩) সেখানে বসা ও আল্লাহর কাছে সুফারিশের জন্য তার নিকট প্রার্থনা করা
(৪) সেখানে মসজিদ নির্মাণ করা
(৫) কবরবাসীর নিকটে কিছু কামনা করা
(৬) তার অসীলায় মুক্তি প্রার্থনা করা
(৭) তাকে খুশী করার জন্য কবরে নযর-নেয়ায ও টাকা-পয়সা দেওয়া
(৮) সেখানে মানত করা
(৯) ছাগল-মোরগ ইত্যাদি হাজত দেওয়া
(১০) সেখানে বার্ষিক ওরস ইত্যাদি করা
(১১) মাযারে নযর-নেয়ায না দিলে মৃত পীরের বদ দো‘আয় ধ্বংস হয়ে যাবে, এই ধারণা পোষণ করা (১২) সেখানে নযর-মানত করলে পরীক্ষায় বা মামলায় বা কোন বিপদে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করা
(১৩) খুশীর কোন কাজে মৃত পীরের মাযারে শুকরিয়া স্বরূপ টাকা-পয়সা না দিলে পীরের বদ দো‘আ লাগবে, এমন ধারণা করা
(১৪) নদী ও সাগরের মালিকানা খিযির (আঃ)-এর মনে করে তাকে খুশী করার জন্য সাগরে বা নদীতে হাদিয়া স্বরূপ টাকা-পয়সা নিক্ষেপ করা
(১৫) মৃত পীরের পোষা কুমীর, কচ্ছপ, গজাল মাছ, কবুতর ইত্যাদিকে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ও ক্ষমতাশালী মনে করা
(১৬) এই বিশ্বাস রাখা যে, মৃত পীর কবরে জীবিত আছেন ও ভক্তদের ভাল-মন্দ করার ক্ষমতা রাখেন (১৭) তিনি ভক্তের ডাক শোনেন এবং তার জন্য আল্লাহর নিকট সুফারিশ করেন
(১৮) বিপদে কবরস্থ পীরকে ডাকা ও তার কবরে গিয়ে কান্নাকাটি করা
(১৯) খুশীতে ও নাখুশীতে পীরের কবরে পয়সা দেওয়া
(২০) কবরস্থ ব্যক্তি খুশী হবেন ভেবে তার কবরে সৌধ নির্মাণ করা, তার সৌন্দর্য বর্ধন করা ও সেখানে সর্বদা আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা
(২১) কবর আযাব মাফ হবে মনে করে পীরের কবরের কাছাকাছি কবরস্থ হওয়া
(২২) কবরস্থানের পাশ দিয়ে কোন মুত্তাক্বী আলেম হেঁটে গেলে ঐ কবরবাসীদের চল্লিশ দিনের গোর আযাব মাফ হয় বলে বিশ্বাস রাখা
(২৩) কবরে বা ছবি ও প্রতিকৃতিতে বা স্মৃতিসৌধে বা বিশেষ কোন স্থানে ফুলের মালা দিয়ে বা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনের মাধ্যমে বা স্যালুট জানিয়ে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা অথবা একই উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়ে মীলাদ ও কুরআনখানী করা ইত্যাদি।

জানা আবশ্যক যে, মানুষকে জাহান্নামে নেওয়ার জন্য শয়তান সর্বদা পিছনে লেগে থাকে। এজন্য সে অনেক সময় নিজেই মানুষের রূপ ধারণ করে অথবা অন্য মানুষের মাধ্যমে তার উদ্দেশ্য হাছিল করে। যেমন হঠাৎ করে শুনা যায় অমুক স্থানে স্বপ্নে পাওয়া শিকড়ে বা তাবীযে মানুষের সব রোগ ভাল হয়ে যাচ্ছে। অমুক দুধের বাচ্চা কিংবা পুরুষ বা মহিলার ফুঁক দানের মাধ্যমে দুরারোগ্য ব্যাধি ভাল হয়ে যাচ্ছে। এমনকি পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে চোখের সামনে চিকিৎসা শেষে তখনই সুস্থ হয়ে রোগী বাড়ী ফিরছে। অতঃপর দু’পাঁচ মাস দৈনিক লাখো মানুষের ভিড় জমিয়ে মানুষের ঈমান হরণ করে কথিত ঐ অলৌকিক চিকিৎসক হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। এগুলি সবই শয়তানী কারসাজি। সাময়িকভাবে এরূপ করার ক্ষমতা আল্লাহ ইবলীসকে দিয়েছেন।[118] তবে জীবিত শয়তানের ধোঁকার জাল ছিন্ন হ’লেও মৃত পীর পূজার শয়তানী ধোঁকার জাল বিস্তৃত থাকে যুগের পর যুগ ধরে। যেখান থেকে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই কেবল কদাচিৎ বেরিয়ে আসতে পারেন।

আল্লাহ বলেন, يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيهِمْ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلاَّ غُرُوْرًا ‘শয়তান তাদের মিথ্যা ওয়াদা দেয় ও আশার বাণী শুনায়। অথচ শয়তান তাদেরকে প্রতারণা ব্যতীত কোনই প্রতিশ্রুতি দেয় না’ (নিসা ৪/১২০)। কিন্তু শত প্রতারণার জাল বিছিয়েও শয়তান আল্লাহর কোন মুখলেছ বান্দাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না (হিজর ১৫/৪০)।

পৃথিবীর প্রাচীনতম শিরক হ’ল মৃত মানুষের পূজা। যা নূহ (আঃ)-এর যুগে শুরু হয়। অথচ তাওহীদের মূল শিক্ষা ছিল মানুষকে মানুষের পূজা হতে মুক্ত করে সরাসরি আল্লাহর দাসত্বের অধীনে স্বাধীন মানুষে পরিণত করা। কিন্তু মৃত সৎ লোকের অসীলায় আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করা ও পরকালে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচার ভিত্তিহীন ধারণার উপর ভর করে শয়তানের কুমন্ত্রণায় নূহ (আঃ)-এর সমাজে প্রথম শিরকের সূচনা হয়। যা মুর্তিপূজা, কবরপূজা, স্থানপূজা, ছবি ও প্রতিকৃতি পূজা ইত্যাদি আকারে যুগে যুগে মানব সমাজে চালু রয়েছে।

আল্লাহ বলেন, إِنْ يَدْعُوْنَ مِنْ دُونِهِ إِلاَّ إِنَاثًا وَإِنْ يَدْعُوْنَ إِلاَّ شَيْطَانًا مَرِيْدًا ‘আল্লাহকে ছেড়ে এরা নারীদের আহবান করে। বরং এরা বিদ্রোহী শয়তানকে আহবান করে’ (নিসা ৪/১১৭)। উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন, مَعَ كُلِّ صَنَمٍ جِنِّيَّةٌ ‘প্রত্যেক মূর্তির সাথে একজন করে নারী জিন থাকে’।[119] মক্কা বিজয়ের পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশে খালেদ ইবনু ওয়ালীদ বিখ্যাত ‘উয্যা’ মূর্তি ধ্বংস করার সময় সেখান থেকে বেরিয়ে আসা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বিক্ষিপ্ত চুল বিশিষ্ট একটা নগ্ন নারী জিনকে দ্বিখন্ডিত করেন। [120] এরা অলক্ষ্যে থেকে মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে এবং তাদেরকে মূর্তিপূজা, কবরপূজা, স্থানপূজা ও সৃষ্টি পূজার প্রতি প্রলুব্ধ করে। অথচ এই শিরক থেকে তওবা না করার কারণেই নূহ (আঃ)-এর কওমকে আল্লাহ সমূলে ধ্বংস করেছিলেন। এ যুগেও যদি আমরা এই মহাপাপ থেকে তওবা না করি, তাহ’লে আমরাও আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যাব। আল্লাহ বলেন,

أَلَمْ يَرَوْا كَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُمْ مِنَ الْقُرُوْنِ أَنَّهُمْ إِلَيْهِمْ لاَ يَرْجِعُوْنَ- وَإِنْ كُلٌّ لَّمَّا جَمِيْعٌ لَّدَيْنَا مُحْضَرُوْنَ- (يـس 31-32)-

‘তারা কি দেখে না যে, তাদের পূর্বের কত সম্প্রদায়কে আমরা ধ্বংস করেছি, যারা তাদের নিকটে আর ফিরে আসবে না’। ‘আর অবশ্যই তাদের সকলকে আমাদের নিকট উপস্থিত করা হবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৩১-৩২)। অন্যত্র তিনি বলেন,

إِنَّهُ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ- (المائدة 72)-

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করল, আল্লাহ তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর সেখানে মুশরিকদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না’ (মায়েদাহ ৫/৭২)। তিনি আরও বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُّشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَّشَآءُ- (النساء 48، 
116) ‘আল্লাহ কখনোই শিরকের গোনাহ মাফ করেন না। এতদ্ব্যতীত বান্দার যেকোন গোনাহ তিনি মাফ করে থাকেন, যাকে তিনি ইচ্ছা করেন’ (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)।
[118]. হিজর ১৫/৩৯; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮, ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, ‘কুমন্ত্রণা’ অনুচ্ছেদ-২।
[119]. আহমাদ হা/২১২৬৯, সনদ হাসান; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নিসা ৪/১১৭।
[120]. নাসাঈ কুবরা হা/১১৫৪৭; তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ ২/১৪৫-৪৬।




***********************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url