সাহাবাগণের জীবনকথা-১৭ || হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর জীবনী (১ম পর্ব)






হযরত আয়িশা (রা)-এর পরিচয়, জন্ম, বাল্যকাল ও বিয়ে


হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর জীবনীর এই পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

আয়িশা (রা) এর নাম

উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশা সিদ্দীকা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রিয়তমা স্ত্রী। তাঁর ডাকনাম বা কুনিয়াত উম্মু ‘আবদিল্লাহ এবং উপাধি সিদ্দীকা। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, তাঁর অন্য একটি উপাধি আল-হুমায়রা। তিনি ফরসা সুন্দরী ছিলেন। এ কারণে আল-হুমায়রা বলা হতো।

উরওয়া বলেনঃ একবার হিজাবের হুকুম নাযিলের পূর্বে উয়ায়না ইবন হিসন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তখন আয়িশা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উয়ায়না আয়িশার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেনঃ “ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ ‘আল-হুমায়রা’ (সুন্দরীটি) কে?” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দেনঃ “এ হচ্ছে আবু বকরের মেয়ে ‘আয়িশা।” অনেকে এই বর্ণনাটিকে ভিত্তিহীন মনে করেছেন।
 

আয়িশা (রা) এর কুনিয়াত

আবদুল্লাহ ছিলেন ‘আয়িশার (রা) বোন আসমার (রা) ছেলে। ইতিহাসে তিনি আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর নামে প্রসিদ্ধ। কুনিয়াত হয় কোন সন্তানের নামের সাথে। আয়িশা (রা) ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তাঁর কোন কুনিয়াত ও ছিল না। সেকালের আরবে কুনিয়াত ছিল শরাফত ও আভিজাত্যের প্রতীক। অভিজাত শ্রেণীর লোকদের নাম ধরে ডাকার নিয়ম ছিল না। কুনিয়াত বা উপনামেই তাদেরকে সম্বোধন করা হতো। একদিন আয়িশা (রা) স্বামী রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আপনার অন্য স্ত্রীগণ তাঁদের পূর্বের স্বামীদের সন্তানদের নামে নিজেদের কুনিয়াত ধারণ করেছেন, আমি কার নামে কুনিয়াত ধারণ করি? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তোমার বোনের ছেলে আবদুল্লাহর নামে। সেই দিন থেকে তাঁর কুনিয়াত বা ডাকনাম হয় ‘উম্মু ‘আবদিল্লাহ’-‘আবদুল্লাহর মা।
 
একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আয়িশা (রা) একটি পুত্র সন্তানের মা হন এবং শিশুকালেই তাঁর মৃত্যু হয়। তার নাম রাখা হয় ‘আবদুল্লাহ। সেই সন্তানের নামেই তাঁর কুনিয়াত হয়। ইবন হাজার ‘আসিকিলানী-বলেন, এ বর্ণনা সঠিক নয়। তাছাড়া বিভিন্ন সহীহ হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।

আয়িশা (রা) এর বংশ পরিচয়

আয়িশার (রা) পিতা খলীফাতু রাসূলিল্লাহ, আস্-সিদ্দীকুল আকবর আবু বকর (রা) এবং মাতা উম্মু রূমান যয়নাব বিনত ‘আমের, মতান্তরে ‘উমাইর আলী-কিনানী। পিতার দিক দিয়ে তিনি কুরাইশ গোত্রের বনু তাইম শাখার এবং মাতার দিক দিয়ে বনু কিনানার সন্তান। মা গানাম ইবন মালিক কিনানার মেয়ে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আয়িশার (রা) বংশধারা পিতৃকূলের দিক দিয়ে উপরের দিকে সপ্তম/অষ্টম পুরুষে এবং মাতৃকূলের দিক দিয়ে একাদশ/দ্বাদশ পুরুষে মিলিত হয়েছে।
 
‘আয়িশা (রা) পিতা আবু বকর (রা) হিজরী ১৩ সনে ইনতিকাল করেন। মা উম্মু রুমান সম্পর্কে অধিকাংশ ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, তিনি পাঁচ অথবা ছয় হিজরীতে ইনতিকাল করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কবরে নেমে তাঁকে দাফন করেন এবং জানাযার নামায পড়েন। কিন্তু এ তথ্য সঠিন নয়। কারণ, নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত যে, তিনি উসমানের (রা) খিলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। হিজরী ৬ষ্ঠ সনের ইফক (‘আয়িশার (রা). চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ)-এর ঘটনা সংক্রান্ত সকল হাদীসে তাঁর নাম এসেছে। হিজরী নবম সনের ‘তাখঈর’ (যে কোন একটি জিনিস বেছে নেওয়ার ইখতিয়ার)-এর ঘটনার সময়ও তিনি জীবিত ছিলেন। এ কথা তাবাকাত, বুখারী, মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদের বর্ণনা সমূহে জানা যায়। ইমাম বুখারী ‘তারীখে, মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদের বর্ণনা সমূহে জানা যায়। ইমাম বুখারী তারীখে সাগীর’ গ্রন্থে তাঁর নামটি ঐ সকল লোকদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন যাঁরা হযরত আবু বকরের (রা) খিলাফতকালে ইনতিকাল করেন। তিনি প্রথম বর্ণনাটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। হাফেজ ইবন হাজার আত-তাহযীব’ গ্রন্থে একটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করে প্রমাণ করেছেন যে, ইমাম মুখারীর বর্ণনা সঠিক।

আয়িশা (রা) এর জন্ম

‘আয়িশার (রা) মা উম্মু রূমানের (রা) প্রথম বিয়ে হয় ‘আবদুল্লাহ ইবন আল-হারিস আল-আযদীর সাথে। আবদুল্লাহ স্ত্রী উম্মু রূমানকে নিয়ে মক্কায় আসেন এবং আবু বকরের সাথে মৈত্রী চুক্তি করে সেখানে বসবাস করতে থাকেন। এটা ইসলাম-পূর্ব কালের কথা। আত-তুফাইল নামে তাঁদের একটি পুত্র সন্তান হয়। আবদুল্লাহ মারা যান এবং আবু বকর (রা) উম্মু রূমানকে বিয়ে করেন। এখানে তাঁর দুইটি সন্তান হয়-আবদুল্লাহ ও আয়িশা। হযরত আয়িশার (রা) জন্মের সঠিক সময়কাল সম্পর্কে তারিখ ও সীরাতের গ্রন্থবলীতে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। এ কারণে তাঁর জন্মসন সম্পর্কে বেশ মতপার্থক্য দেখা যায়। সাইয়্যেদ সুলায়মান নাদবী বলেনঃ ঐতিহাসিক ইবন সা‘দ লিখেছেন এবং কোন কোন সীরাত বিশেষজ্ঞ তাঁকে অনুসরণ করে বলেছেন নুবুওয়াতের চতুর্থ বছরের সূচনায় আয়িশা জন্মগ্রহণ করেন এবং দশম বছরে ছয় বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু এ কথা কোনভাবেই সঠিক হতে পারে না। কারণ নুবুওয়াতের চতুর্থ বছরের সূচনায় তাঁর জন্ম হলে দশম বছরে তাঁর বয়স ছয় বছর নয়, বরং সাত বছর হবে। মূলত আয়িশার (রা) বয়স সম্পর্কে কয়েকটি কথা সর্বসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত। তা হলো, হিজরাতের তিন বছর পূর্বে ছয় বছর বয়সে বিয়ে হয়। প্রথম হিজরীর শাওয়াল মাসে নয় বছর বয়সে স্বামী গৃহে যান এবং এগারো হিজরীর রাবীউল আওয়াল মাসে আঠারো বছর বয়সে বিধবা হন। এই হিসাবে তাঁর জন্মের সঠিক সময়কাল হবে নুবুওয়াতের পঞ্চম বছরের শেষের দিক। অর্থাৎ হিজরাত পূর্ব নবম সনের শাওয়াল মাসে, মুতাবিক জুলাই, ৬১৪ খ্রিস্টাব্দ।
 
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেইশ বছরের নুবুওয়াতী জীবনের প্রায় তেরো বছর মক্কায় এবং দশ বছর মদীনায় অতিবাহিত হয়। নাদবী সাহেবের বর্ণনা, মতে আয়িশার (রা) যখন জন্ম হয় তখন নুবুওয়াতের চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে পঞ্চম বছর চলছে। ইমাম জাহাবী বলেনঃ আয়িশা (রা), ফাতিমার চেয়ে আট বছরের ছোট। আয়িশা বলেছেন, তিনি মক্কায় একজন বৃদ্ধ অন্ধ হাতী চালকের সাক্ষাৎ পেয়েছেন।

আয়িশা (রা) এর ইসলাম গ্রহণ

‘আয়িশা (রা) কখন কিভাবে মুসলমান হয় সে সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে হযরত সিদ্দীকে আকবরের (রা) বড় সৌভাগ্য যে, তাঁরই গৃহে সর্বপ্রথম ইসলামের আলো প্রবেশ করে। এই কারণে হযরত আয়িশা ঐ সকল ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতী নর-নারীদের একজন যাঁদের কর্ণকুহরে মুহূর্তের জন্যও কুফর ও শিরকের আওয়ায পৌঁছেনি। আয়িশা (রা) বলেনঃ যখন থেকে আমি আমার বাবা-মাকে চিনেছি তখন থেকেই তাঁদেরকে মুসলমান পেয়েছি। ইমাম জাহাবী শুধু বলেছেনঃ আয়িশা ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু কখন কিভাবে, তা বলেননি। ইবন হিশাম যাঁরা আবু বকরের (রা) হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন, তাঁদেরকে একটা স্বতন্ত্র শিরোনামে উল্লেখ করেছেন। সেখানে আয়িশার (রা) নামটিও এসেছে।

আয়িশা (রা) এর শিশু ও বাল্যকাল

আয়িশাকে (রা) ওয়ায়িল-এর স্ত্রী দুধপান করান। এই ওয়ায়িল-এর ডাকনাম ছিল আবুল ফুকায়‘য়াস। তাঁর ভাই আফলাহ-যিনি আয়িশার দুধচাচা-পরবর্তীকালে মাঝে মাঝে ‘আয়িশার (রা) সাথে দেখা করতে আসতেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুমতি নিয়ে ‘আয়িশা (রা) তাঁর সামনে যেতেন। তাঁর দুধ-ভাইও মাঝে মাঝে দেখা করতে আসতেন।
 
আয়িশার (রা) বাল্যজীবন অন্যসব শিশুদের মতই কেটেছে। তবে একটু ভিন্নতর ছিল। বাল্যকালেই তার তীক্ষ্ণ মেধা ও বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যসব শিশুদের মত খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। সমবয়সী প্রতিবেশী মেয়েরা তাঁর কাছে আসতো এবং তিনি অধিকাংশ সময় তাদের সাথে খেলতেন। কিন্তু সেই বয়সে খেলার মধ্যেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্মান ও মর্যাদার প্রতি সজাগ থাকতেন। অনেক সময় এমন হতো যে, তিনি অন্যদের সাথে পুতুল নিয়ে খেলছেন, এমন সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের গৃহে এসেছেন এবং হঠাৎ তাঁদের মধ্যে হাজির হয়েছেন। ‘আয়িশা (রা) পুতুলগুলি তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলতেন এবং অন্য সাথীরা রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখা মাত্র ছুটে পালাতো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিশুদের ভালোবাসতেন। তাঁদের খেলাধুলাকেও খারাপ মনে করতেন না। তিনি পালিয়ে যাওয়া শিশুদের ডেকে ডেকে ‘আয়িশার সাথে খেলতে বলতেন। শিশুদের খেলাগুলির মধ্যে দুইটি খেলা ছিল তাঁর সর্বাধিক প্রিয়। পুতুল খেলা ও দোল খাওয়া। একদিন ‘আয়িশা (রা) পুতুল নিয়ে খেলছেন, এমন সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসে পড়লেন। পুতুলুগুলির মধ্যে একটি দুই ডানাওয়ালা ঘোড়াও ছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ঘোড়ার তো কোন ডানা হয় না। ‘আয়িশা সাথে সাথে বলে উঠলেনঃ কেন? সুলায়মান আলাইহিস সালামের ঘোড়াগুলির তো ডানা ছিল-একথা কি আপনি শোনেননি? ‘আয়িশার (রা) এমন উপস্থিত জবাব শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমনভাবে একটু হেসে দেন যে, তাঁর দাঁত দেখা যায়।

এই ঘটান দ্বারা ‘আয়িশার (রা) স্বাভাবগত উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের জ্ঞান, এবং তীক্ষ্ণ মেধার অনুমান করা যায়।
 
সাধারণত শৈশবকালের কথা মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়। কিন্তু ‘আয়িশার (রা) ছোটবেলার সব কথাই স্মৃতিতে ছিল। হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেন তখন ‘আয়িশার (রা) বয়স আট/নয় বছরের বেশি হবে না। কিন্তু হিজরাতের ঘটনার যত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা আর কোন সাহাবী দিতে পারেননি।
 
ইমাম বুখারী সূরা আল-কামার-এর তাফসীরে বর্ণনা করেছেন। ‘আয়িশার (রা) বলেন, যখন এই আয়াতঃ মক্কায় নাযিল হয় তখন আমি ছোট্ট মেয়ে, খেলছিলাম। ছোটবেলায় হযরত ‘আয়িশার (রা) মাকে মাঝে মাঝে ক্ষেপিয়ে তুলতেন। তিনিও মেয়েকে শাস্তি দিতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতে কষ্ট অনুভব করতেন। একবার তিনি উম্মু রূমানকে বলেন, আমার খাতিরে তাকে আর শাস্তি দিবেন না। একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার পিতৃগৃহে এসে দেখেন, দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে ‘আয়িশা কাঁদছেন। তিনি উম্মু রূমানকে বলেন, আপনি আমার কথায় গুরুত্ব দেননি। উম্ম রূমান বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ‘‘ এ মেয়ে আমার বিরুদ্ধে তার বাপের কাছে লাগায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যা কিছুই করুক না কেন, তাকে কষ্ট দিবেন না। আল্লামাহ সাইয়্যেদ সুলায়মান নাদবী ‘মুসতাদরিকে হাকেম’-এর বরাত দিয়ে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
 

আয়িশা (রা) এর বিয়ে

রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথমা স্ত্রী হযরত খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ। তাঁকে বিয়ে করার সময় রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স ছিল পঁচিশ এবং খাদীজার (রা) চল্লিশ। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে পঁচিশ বছর ঘর করার পর নুবুওয়াতের দশম বছর রমযান মাসে হিজরাতের তিনি বছর পূর্বে খাদীজা (রা) ইনতিকাল করেন। তখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স পঞ্চাশ এবং খাদীজার পঁয়ষট্টি।
 
সাওদার (রা) জীবনীতে আমরা উল্লেখ করেছি যে, খাদীজার (রা) ইনতিকারের পর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিমর্ষ দেখে ‘উসমান ইবন মাজে’উনের স্ত্রী খাওলা বিনত হাকীম বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি আবার বিয়ে করুন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতে চাইলেন-কাকে? খাওলা বললেনঃ বিধবা ও কুমারী দুই রকম পাত্রীই আছে। যাকে আপনার পছন্দ হয় তাঁর বিষয়ে কথা বলা যেতে পারে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার জানতে চাইলেনঃ তারা কারা? খাওলা বললেনঃ বিধবা পাত্রীটি সাওদা বিনত যাম‘আ, আর কুমারী পাত্রীটি আবু বকরের মেয়ে ‘আয়িশা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ভালো। তুমি তার সম্পর্কে কথা বলো।
 
হযরত খাওলা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্মতি পেয়ে প্রথমে আবু বকরের (রা) বাড়ী এসে প্রস্তাব দেন। জাহিলী আরবের রীতি ছিল, তারা আপন ভাইয়ের সন্তানদের যেমন বিয়ে করতো না, তেমনি সৎ ভাই, জ্ঞাতি ভাই বা পাতানো ভাইয়ের সন্তানদেরকেও বিয়ে করা বৈধ মনে করতো না। এ কারণে প্রস্তাবটি শুনে আবু বকর বললেনঃ খাওলা! আয়িশা তো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাতিজী। তার সাথে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিয়ে হয় কেমন করে? খাওলা (রা) ফিরে আসলেন এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আবু বকর আমার দীনী ভাই। আর এ ধরনের ভাইদের সন্তানদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। আবু বকর (রা) প্রস্তাব মেনে নেন এবং খাওলাকে  বললেন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে আসতে।
 
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে ‘আয়িশার (রা) বিয়ের প্রস্তাব আসার আগে জুবাইর ইবন মুত‘ইম ইবন আদীর সাথে তাঁর বিয়ের কথা হয়েছিল। এ কারণে তার কাছেও জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন ছিল। হযরত আবু বকর (রা) মুত‘ইম ইবন আদীর আছে গিয়ে বললেনঃ তুমি তোমার ছেলের সাথে ‘আয়িশার বিয়ের প্রস্তাব করেছিল। এখন তোমাদের সিদ্ধান্ত কী, বল? মুত‘ইম তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন। মুত‘ইমের পরিবার তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। এ কারণে তাঁর স্ত্রীর এ প্রস্তাবে মত নেই। তখন আবু বকর (রা)  মুত‘ইমের দিকে ফিরে বললেনঃ তোমার স্ত্রী কী বলে? মুত‘ইম বললেনঃ সে যা বলেছে, আমারও মত তাই। তারপর ফিরে এসে সে খাওলাকে বললেনঃ আপনি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে আসুন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এলেন এবং আবু বকর বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। বালাজুরী অবশ্য অন্য কারো সাথে ‘আয়িশার প্রস্তাবের কথা সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেছেন।
 
‘আয়িশা (রা) ও সাওদার (রা) বিয়ে একই সময় হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাওদাকে বিয়ের পরই ঘরে তুলে নেন এবং শুধু তাঁকে নিয়ে তিন বছর ঘর করার পর ‘আয়িশাকে (রা) ঘরে নিয়ে আসেন।
 
এই বিয়ে অতি সাদামাটা ও অড়ম্বরহীনভাবে সম্পন্ন হয়। ‘আতিয়্যা (রা) এই বিয়ের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-‘আয়িশা অন্য মেয়েদের সাথে খেলছিলেন। তাঁর সেবিকা এসে তাঁকে নিয়ে যায় এবং আবু বকর (রা) এসে বিয়ে পড়িয়ে দেন।’
 
এই বিয়ে যে কত অনাড়ম্বর ও অনুষ্ঠানহীন অবস্থায় শেষ হয়েছিল তা অনুমান করা যায় খোদ ‘আয়িশার (রা) একটি বর্ণনা দ্বারা। তিনি বলছেনঃ যখন আমার বিয়ে হয়, আমি কিছুই জানতাম না। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর মা আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেন।
 
‘আয়িশা (রা) বলেনঃ বিয়ের সময় আমি এক ছোট্ট মেয়ে। ‘হাওফা’ নামক এক প্রকার পোশাক পরি। বিয়ের পর ছোট্ট হওয়া সত্ত্বেও আমার মধ্যে লজ্জা এসে যায়। উল্লেখ্য যে, ‘হাওফা’ হলো চামড়ার তৈরি পায়জামার মত এক ধরণের পোশাক, যা শিশুদের মাঝদেহ বরাবর পরা থাকে। ‘আয়িশারকে (রা) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কত দেন মাহর দান করেছিলেন, সে বিষয়ে মত পার্থক্য আছে। ইবন সা‘দের বর্ণনাসমূহের মাধ্যমে জানা যায়, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মোহর হিসেবে ‘আয়িশাকে (রা) একটি ঘর দান করেন যার মূল্য ছিল পঞ্চাশ দিরহাম। ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন চারশো’ দিরহামের কথা। ইবন সা‘দের অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, যা খোদ ‘আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ মাহর ছিল বারো উকিয়া ও এক নশ-যা পাঁচশো দিরহামের সমান। সহীহ মুসলিমে আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীগণের মোহর  সাধারণত পাঁচশো দিরহাম হতো। মুসনাদে আহমাদে ‘আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর মাহর ছিল পাঁচশো।
 

আয়িশা (রা)-কে বিয়ে করার পূর্বেই রাসূল (সাঃ) সুসংবাদ প্রাপ্ত হন

‘আয়িশাকে (রা) বিয়ে করার পূর্বেই রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুসংবাদ লাভ করেছিলেন। একদিন স্বপ্নে দেখেন যে, এক ব্যক্তি কোন একটি জিনিস এক টুকরো রেশমে জড়িয়ে তাঁকে দেখিয়ে বললেন, এটি আপনার। তিনি খুলে দেখেন তার মধ্যে ‘আয়িশা (রা)।
 
‘আয়িশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তিন রাত আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম। একজন ফিরিশতা রেশমের একটি খন্ডে কিছু একটা মুড়ে এনে বললো, এ আপনার স্ত্রী। মাথার দিক থেকে আমি খুলে দেখলাম, তার মধ্যে তুমি। আমি বললাম, এ যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে তাহলে হোক।
 
ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ জিবরীল (আ) তাঁর একটি প্রতিকৃতি সবুজ রেশমের একটি টুকরোয় জড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট নিয়ে এসে বলেনঃ ইনি হবেন দুনিয়া ও আখিরাতে আপনার স্ত্রী।

আয়িশা (রা) এর বিয়ের সময়কাল

‘আয়িশার (রা) বিয়ের সঠিক সময়কাল নিয়ে একটু মতভেদ আছে। আল্লামা বদরুদ্দীন ‘আয়নী সহীহ আল-বুখারীর ভাষ্যে লিখেছেনঃ ‘আয়িশার (রা) বিয়ে হিজরাতের দুই বছর পূর্বে, আবার বলা হয়ে থাকে তিন বছর পূর্বে এবং একথাও বলা হয়েছে যে, দেড় বছর পূর্বে হয়েছিল’ কিছু কিছু বর্ণনায় জানা যায়, খাদীজার (রা) ইনতিকালের তিন বছর পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশাকে (রা) বিয়ে করেন। কোন কোন সীরাত বিশেষজ্ঞ বলেন, যে বছর খাদীজার (রা) মৃত্যু হয় সেই বছর ‘আয়িশার (রা) বিয়ে হয়।
 
সুলায়মান নাদবী বলেনঃ খাদীজার (রা) ওফাতের তারিখ দ্বারা ‘আয়িশার (রা) বিয়ের সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু খাদীজার (রা) ওফাতের তারিখও সর্বসম্মত নয়। সেখানেও মতভেদ আছে। এ ক্ষেত্রে খোদ ‘আয়িশার (রা) বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। কিন্তু বুখারী ও মুসনাদে তাঁর থেকেও ভিন্ন দুইটি বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি বর্ণনায় এসেছে খাদীজার (রা) ওফাতের তিন বছর পর তাঁর বিয়ে হয়। অপর বর্ণনাটিতে খাদীজার (রা) ওফাতের বছরে বিয়ের কথা এসেছে।
 
অধিকাংশ গবেষকের সিদ্ধান্ত এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসমূহের গরিষ্ঠ অংশ যা সমর্থন করে তা হলো, খাদীজা (রা) নুবুওয়াতের দশম বছরে হিজরাতের তিন বছর পূর্বে রমযান মাসে ইনতিকাল করেন এবং তার এক মাস পরে শাওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশাকে (রা) বিয়ে করেন। তখন ‘আয়িশার (রা) বয়স ছয় বছর। এই হিসাবে হিজরাত পূর্ব তিন সনের শাওয়াল, মুতাবিক ৬২০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ‘আয়িশার (রা) বিয়ে হয়। আল-ইসতী‘য়ার গ্রন্থাগার ইবন ‘আবিদল বার এই মত সমর্থন করেছেন। মূলত বিয়ে হয়েছিল খাদীজার (রা) ওফাতের বছরেই এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় তিন বছর পরে যখন নয় বছর বয়সে তাঁকে ঘরে তুলে নেন। ‘আয়িশার (রা) একটি বর্ণনা যা ইবন সা’দ নকল করেছেন, তাতে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
 
বিয়ের পর ‘আয়িশা (রা) প্রায় তিন বছর পিতৃগৃহে অবস্থান করেন। দুই বছর তিন মাস মক্কায় এবং সাত/আট মাস হিজরাতের পর মদীনায়।
 

আয়িশা (রা) এর মদিনায় হিজরত

মক্কায় পৌত্তলিকদের যুলুম-নির্যাতনের মাত্রা যখন সহ্যের সীমা ছেড়ে গেল, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন মদীনায় হিজরাতের সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘আয়িশা (রা) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় আবু বকরের গৃহে আসতেন। একদিন অভ্যাসের বিপরীতে চাদর দিয়ে মাথা-মুখ ঢেকে দুপুরের সময় উপস্থিত হন। আবু বকরের (রা) কাছে তখন তাঁর দুই মেয়ে ‘আয়িশা ও আসমা বসা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আবু বকর! আপনার কাছে বসা লোকগুলিকে একটু সরিয়ে দিন, আমি কথা বলতে চাই। আবু বকর বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখানে অন্য কেউ নেই। আপনারই ঘরের লোক। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসলেন এবং হিজরাতের সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করেন। ‘আয়িশা ও আসমা দুই বোন মিলে সফরের জিনিসপত্র গোছগাছ করেন। তারপর দুইজন মদীনার পথ ধরেন। তাঁরা তাঁদের পরিবার-পরিজনকে মক্কায় শক্রদের মধ্যে ছেড়ে যান।
 
মদীনায় একটু স্থির হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা থেকে পরিবার-পরিজনকে মদীনায় নেওয়ার জন্য যায়িদ ইবন হারিসা (রা) ও আবু রাফেহকে (রা) মক্কায় পাঠান। তাঁদেরকে দুইটি উট ও পাঁচশো দিরহাম দেন-যা আবু বকর (রা) রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রয়োজন পূরনের জন্য দিয়েছিলেন। আবু বকরও (রা) তাঁদের সাথে আবদুল্লাহকে বলে পাঠান যে, সে যেন ‘আয়িশা, আসমা এবং তাঁদের মা উম্মু রূমানকে নিয়ে মদীনায় চলে আসে।
 
এই সকল লোক যখন মক্কা থেকে যাত্রা করেন তখন তালহা ইবন ‘আবদিল্লাহ হিজরাতের উদ্দেশ্যে তাঁদের সহযাত্রী হন। আবু রাফে’ ও যায়িদ ইবন হারিসার সঙ্গে ফাতিমা, উম্ম কুলসুম, সাওদা বিনত যাম‘আ উম্ম আয়মান ও উসামা ইবন যায়িদ এবং ‘আবদুল্লাহ ইবন আবী বকরের (রা) সঙ্গে উম্ম রূমান, ‘আবদুল্লাহর দুই বোন-‘আয়িশা ও আসমা ছিলেন।
 
এই কাফেলা মক্কা থেকে যাত্রা করেন যখন হিজাযের বনু কিনানার আবাসস্থল আল-বায়দ’ পৌঁছে তখন ‘আয়িশা (রা) ও তাঁর মা উম্মু রূমান (রা) যে উটের আরোহী ছিলেন সেই উটটি তাঁদের নিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে পালালো। প্রতি মুহূর্তে তাঁরা আশংকা করতে থাকেন, এই বুঝি হাওদাসহ ছিটকে পড়ছেন। মেয়েদের যেমন স্বভাব, মার নিজের জানের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, কলিজার টুকরা ‘আয়িশার (রা) জন্য অস্থির হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। অনেক দূর যাওয়ার পর উটটি ধরে বশে আনা হয়। সবাই নিরাপদে ছিলেন এবং নিরাপদেই মদীনায় পৌঁছেন। হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন মসজিদে নববী ও তার আশে-পাশে ঘর-বাড়ী নির্মাণ করছিলেন। তারই একটি ঘরে সাওদা (রা) এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যাদের থাকার ব্যবস্থা হয়।
 
‘আয়িশা (রা) আপনজনদের সাথে মদীনার বনু হারেস ইবন খাযরাজের মহল্লায় অবতরণ করেন এবং সাত-আট মাস সেখানে মায়ের সাথে বসবাস করেন। মক্কা থেকে মদীনায় আগত অধিকাংশ মুহাজিরের নিকট মদীনার আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না। বহু নারী-পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবু বকর (রা) ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হন। অল্প বয়সী মেয়ে ‘আয়িশা (রা) পিতার সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি একদিন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট এসে পিতার অবস্থা জানালে তিনি আবু বকরের (রা) জন্য দু‘আ করেন। আবু বকর (রা) সুস্থ হয়ে ওঠেন।
 
পিতাকে সুস্থ করে তোলার পর ‘আয়িশা (রা) নিজেই শয্যা নিলেন। এবার পিতা মেয়ের সেবায় মনোযোগী হলেন। আবু বকর (রা) অসুস্থ মেয়ের শয্যার কাছে যেতেন এবং অত্যন্ত দরদের সাথে তাঁর মুখে মুখ ঘঁষতেন। অসুস্থতা এত মারাত্মক ছিল যে, ‘আয়িশার (রা) মাথার প্রায় সব চুল পড়ে যায়।
 

আয়িশা (রা) এর স্বামী গৃহে গমন

বিপদ-আপন থেকে মুক্ত হওয়ার পর আবু বকর (রা), মতান্তরে উম্মু রূমান (রা) একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার স্ত্রীকে ঘরে তুলে নিচ্ছেন না কেন? রাসূলুল্লাহ বললেনঃ এখন আমার হাতে মোহর আদায় করার মত অর্থ নেই। আবু বকর (রা) বললেনঃ আমার অর্থ গ্রহণ করুন। আমি ধার দিচ্ছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বারো উকিয়া ও এক নশ (= পাঁচশো দিরহাম) আবু বকরের (রা) নিকট থেকে ধার নিয়ে ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠিয়ে দেন।
 
মদীনা ছিল যেন ‘আয়িশার শ্বশুর বাড়ী। আনসারী মহিলারা নববধূকে বরণ করে নেওয়ার জন্য আবু বকরের (রা) গৃহে আসলেন। ‘আয়িশা (রা) তখন বাড়ীর আঙ্গিনায় খেজুর গাছের তলায় অন্য মেয়েদের সাথে খেলছেন। মা উম্মু রমান (রা) তাকে ডাকলেন। মায়ের ডাক কানে যেতেই হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসেন। তারপর সেই কক্ষে নিয়ে যান যেখানে অতিথি মহিলারা তাঁর অপেক্ষায় বসে ছিলেন। নব বধূ কক্ষে প্রবেশ করতেই মহিলারা বলে উঠলেনঃ তোমার আগমন শুভ ও কল্যাণময় হোক। তাঁরা নববধুকে সাজালেন। কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপস্থিত হলেন।
 
এক পেয়ালা দুধ ছাড়া সেই সময় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে আর কিছুই উপস্থাপন করা হয়নি। আসমা বিনত ইয়াযীদ ছিলেন ‘আয়িশার (রা) একজন খেলার সাথী। তিনি বলেছেন, আমি ছিলাম ‘আয়িশার বান্ধবী। আমি তাকে সাজিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট উপস্থাপন করেছিলাম। আমার সাথে অন্যরাও ছিল। আমরা এক পেয়ালা দুধ ছাড়া সেই সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে দেওয়ার মত আর কিছুই পাইনি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেয়ালা থেকে সামান্য একটু দুধ মুখে দিয়ে ‘আয়িশার দিকে এগিয়ে দেন। ‘আয়িশা নিতে লজ্জা পাচ্ছে দেখে আমি তাকে বললামঃ ‘রাসূলুল্লাহর দান ফিরিয়ে দিওনা।’ তখন সে অত্যন্ত লাজুক অবস্থায় গ্রহণ করে এবং সামান্য পান করে রেখে দিতে যায়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেনঃ তোমার সাথীদের দাও। আমরা বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ সময় আমাদের পান করার ইচ্ছা নেই। তিনি বললেনঃ মিথ্যা বলবে না। মানুষের প্রতিটি মিথ্যা লেখা হয়। অপর একটি বর্ণনায় এসেছেঃ ক্ষুধা ও মিথ্যা একত্র করো না। মিথ্যা লেখা হয়। এমন কি ছোট ছোট মিথ্যাও।
 

আয়িশা (রা) এর স্বামী গৃহে গমনের সময়কাল

সহীহ বর্ণনাসমূহের ভিত্তিতে একথা জানা যায় যে, ‘আয়িশার (রা) স্বামীগৃহে গমন হয় প্রথম হিজরীর শাওয়ার মাসে। ‘আল্লামা ‘আয়নী লিখেছেন, হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পর তিনি স্বামীগৃহে যান। এ ধরনের একটি কথা ‘আয়িশা (রা) থেকেও বর্ণিত আমাকে হিজরাতের তিন বছর পূর্বে বিয়ে করেন এবং হিজরতের আঠারো মসের মাথায় শাওয়াল মাসে আমার সাথে বাসর করেন। বিয়ের সময় আমি ছয় বছরের এবং বাসরের সময় নয় বছরের এক মেয়ে। কিন্তু এ বর্ণনা সঠিক হতে পারে না। কারণ, এই বর্ণনার ভিত্তিতে ‘আয়িশার (রা) তখন বয়স হবে দশ বছর। অথচ হাদীস ও ইতিহাসের সকল গ্রন্থ এ ব্যাপারে একমত যে, সেই সময় তাঁর বয়স ছিল নয় বছর।
 
‘আয়িশার (রা) বিয়ে ও স্বামীগৃহে গমন উভয় কাজই সম্পন্ন হয় শাওয়াল মাসে। এ কারনে তিনি আজীবন এ ধরনের অনুষ্ঠান শাওয়াল মাসে করতে পছন্দ করতেন। তিনি বলতেনঃ আমার বিয়ে ও স্বামীগৃহে গমন-দুটোই হয় শাওয়ালে। আর এ কারণে স্বামীর নিকট আমর চেয়ে অধিক ভাগ্যবতী আর কে ছিল।
 
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে নববীর পাশে নির্মিত ছোট্ট একটি ঘরে ‘আয়িশাকে (রা) এনে উঠান। আজ যেখানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুয়ে আছেন সেটাই ‘আয়িশার (রা) ঘর। পরবর্তীকালে ‘আয়িশা (রা) বলতেনঃ এখন আমি যে ঘরে আছি, আমার এই ঘরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে প্রথম এনে উঠান। তিনি এখানেই ওফাত পেয়েছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের দরজা সোজাসুজি মসজিদের একটি দরজা বানিয়ে নেন। পূর্বের বর্ণনাসমূহ থেকে প্রত্যেকেই বুঝতে পারে, ‘আয়িশার (রা) বিয়ে, স্বামীগৃহে গমন, তথা প্রতিটি অনুষ্ঠান কত আড়ম্বরহীন ও সাদামাটা ছিল। তাতে অতিরঞ্জিত প্রদর্শনী বা বাহুল্য ভাবের কিছু ছিল না।
 

আয়িশা (রা) এর বিয়ের মাধ্যমে বহু কূসংস্কার ও কু-প্রথার বিলোপ

‘আয়িশার (রা) বিয়ের মাধ্যমে তৎকালীন আরবের বহু কূসংস্কার ও কু-প্রথার বিলোপ ঘটে। তারা সকল প্রকার ভাই, এমনকি মুখে বলা ভাইয়ের মেয়েকেও বিয়ে করা বৈধ মনে করতো না। এ কারণে খাওলার (রা) প্রস্তাব শুনে আবু বকর (রা) বলে ওঠেনঃ এটা কি বৈধ? ‘আয়িশা তো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাতিজী। একথা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কানে গেলে তিনি বললেনঃ আবু বকর আমার ইসলামী ভাই। তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে বৈধ।
 
আর একটি কু-প্রথা হলো, শাওয়াল মাসে তারা বিয়ে-শাদী করতোনা। অতীতে কোন এক শাওয়াল মাসে আরবে প্লেগ দেখা দেয়। এ কারণে তারা এ মাসটিকে অশুভ বলে বিশ্বাস করতো এবং এ মাসে তারা কোন বিয়ের অনুষ্ঠান করতো না।
 
তৎকালীন আরবের কিছু লোকের এ বিশ্বাসও ছিল যে, এ মাসে নববধূকে ঘরে আনলে তাদের সম্পর্ক টেকে না। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এমন বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে ‘আয়িশার (রা) এ বিয়ে কুঠারাঘাত করে। নববধূকে ঘরে আনার অনুষ্ঠানটি হয় দিনের বেলায়। এটাও ছিল প্রচলিত প্রথার বিপরীত।
 
আরেকটি প্রথা ছিল দুলহানের আগে আগে তারা আগুন জ্বালাতো। নব দস্পতির প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হতো কোন মঞ্চে অথবা অভ্যন্তরে। এই সকল কুপ্রথার মূলোৎপাটন ঘটে এই বিয়ের মাধ্যমে।


হযরত আয়িশা (রাঃ) এর ১২ পর্বের পুরো জীবনী পড়ুন-




****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url