সাহাবাগণের জীবনকথা-২৫ || হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর জীবনী (৯ম পর্ব)





হযরত আয়িশা (রা) এর জীবনী ৯ম পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

হযরত আয়িশা (রা) এর স্থান ও মর্যাদা

সহীহ মুসলিমের ‘আল-ফাদায়িল অধ্যায়ে এসেছে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘আমি তোমাদের মধ্যে দুইটি বিরাট জিনিস রেখে যাচ্ছিঃ আল্লাহর কিতাব এবং আহলি বায়ত (আমার পরিবার-পরিজন) বিশেষজ্ঞরা বলেছেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ বাণীর তাৎপর্য হলো, যদিও কিতাবুল্লাহ তার সহজ-সরল ভাষা ও বর্ণানার জন্য সহজেই বোধগম্য এবং বাস্তবায়নযোগ্য তবুও সর্বদাই দুনিয়াতে এমন সব মানুষের প্রয়োজন থাকবে যারা তার রহস্যসমূহ উদঘাটন করতে পারেন এবং তার ইলমী ও আললী ব্যাখ্যা দিতে পারেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে এমন ব্যক্তিদের আহলে বায়তের মধ্যে তালাশ করা উচিত।

হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত আয়িশা (রা) সম্পর্কে যে সকল মন্তব্য ও বাণী রেখে গেছেন, ‘আয়িশা (রা)ও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহচার্য ও শিক্ষায় সেভাবে নিজেকে যোগ্য করে তুলেছেন, সর্বোপরি তিনি স্বীয় স্বভাবগত তীক্ষ্ণ মেধা ও যোগ্যতা দ্বারা নিজেকে যেভাবে শানিত করেছেন, তাতে আহলি বায়তের মধ্যে তাঁর যে এক বিশেষ মর্যাদার আসন ছিল, সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। এরই ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং ইসলামী হুকুম্ আহকামের শিক্ষাদান তাঁর চেয়ে ভালো আর কে করতে পারতেন? লোকেরা তো কেবল বাইরের নবীকে প্রত্যক্ষ করতেন, অভ্যন্তরের নবী থাকতেন তাদের দৃষ্টির আড়ালে। পক্ষান্তরে হযরত আয়িশা (রা) বাহির ও গৃহাভ্যন্তর-সর্ব অবস্থার নবীকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করতেন। আর একারণেই আল্লাহর নবী বলেছেন-

“নারী জাতির উপর আয়িশার (রা) মর্যাদা তেমন, যেমন সকল খাদ্য-সামগ্রীর উপর সারীদের মর্যাদা। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে ‘আয়িশাকে (রা) স্ত্রী হিসেবে লাভের সুসংবাদ পান। তাঁর বিছানা ছাড়া আর কোন স্ত্রীর বিছানায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহী লাভ করেননি। মহান ফিরিশতা জিবরীল আমীন তাঁকে সালাম পেশ করেছেন। তিনি দুইবার জিবারীলকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে আয়াত নাযিল করেছেন। আর তিনিই যে আখিরাতে জীবনে রাসূলে পাকের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রী হবেন, সে কথাও রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানিয়ে গেছেন। এ সকল কথা সহীহ বুখারীর ‘আয়িশার সম্মান ও মর্যাদা অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে।

হযরত ‘আয়িশা (রা) বলতেন, আমি গর্বের জন্য নয়, বরং বাস্তব কথাই বলছি। আর তা হলো, আল্লাহ তা’য়ালা আমাকে এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা আর কাউকে দান করেননি। 
(১) ফিরিশতা রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বপ্নের মধ্যে আমার ছবি দেখিয়েছেন, 
(২) আমার সাত বছর বয়সে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বিয়ে করেছেন, 
(৩) নয় বছর বয়সে আমি স্বামী গৃহে গমন করেছি, 
(৪) আমিই ছিলাম রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একমাত্র কুমারী স্ত্রী, 
(৫) যখন তিনি আমার বিছানায় থাকতেন তখনও তাঁর উপর ওহী নাযিল হতো, 
(৬) আমি ছিলাম রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী, 
(৭) আমার নির্দোষিতা ঘোষণা করে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে, 
(৮) জিবরীলকে (আ) আমি স্বচক্ষে দেখেছি, 
(৯) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, 
(১০) আমি তাঁর খলীফা ও তাঁর সিদ্দীকের কন্যা, 
(১১) আমাকে পবিত্র করে সৃষ্টি করা হয়েছে, 
(১২) আমার মাগফিরাত এবং জান্নাতে আমাকে উত্তম জীবিকা দানের অঙ্গিকার করা হয়েছে, 
(১৩) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পার্থিব জীবনের সর্বশেষ মুহূর্তে আমার মুখের লালা তাঁর লালার সাথে মিলেছে, 
(১৪) আমারই ঘরে তাঁর কবর দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের আরো গৌরব ও মর্যাদার কথা তিনি নিজেও যেমন বলেছেন, তেমনি আরো বহু সাহাবী বর্ণনা করেছেন। হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে যা ছড়িয়ে আছে।

হযরত ‘আয়িশার (রা) এত সব মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য দেখে কোন কোন ‘আলিম মনে করেছেন, তিনি তাঁর পিতা আবু বকর (রা) থেকেও উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। ইমাম জাহাবী বলেন, তাঁদের একথা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘য়ালা প্রত্যেকটি জিনিসের বিশেষ বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। আমরা বরং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, দুনিয়া ও আখিরাতে তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রী। এর চেয়ে বড় গর্বের বিষয় তাঁর জন্য আর কিছু কি আছে? তা সত্ত্বেও হয়রত খাদীজার এমন বৈশিষ্ট্য আছে যা কেউ অর্জন করতে পারেনি। হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি, অনেকগুলি করণে তাঁর চেয়ে খাদীজার (রা) মর্যাদা অনেক বেশি।’

হযরত ‘আয়িশা সিদ্দীকার (রা) সারীতে মুবারাকার প্রতি যখন আমরা একটি বিশ্লেষণ ও তুলনামূলক দৃষ্টিপাত করি তখন কেবল সকল মহিলা সাহাবী নয়, বরং অনেক বড় বড় পুরুষ সাহাবীদের তুলনায় তাঁর মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যটি পরিপূর্ণরূপে পাই তা হলো, তিনি জন্ম ও স্বভাবগতভাবে চিন্তা ও অনুধ্যানশীল মেধা ও মস্তিষ্ক লাভ করেছিলেন। দীনের তাৎপর্য বিষয়ে গভীর জ্ঞান, ইজতিহাদের ক্ষমতা ও শক্তি, সমালোচনা ও পর্যালোচনার রীতি-পদ্ধতি, ঘটনাবলীর যথাযথ উপলব্ধি, গভীর অর্ন্তদৃষ্টি এবং শুদ্ধ ও সঠিক সিদ্ধান্ত ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর স্থান ছিল অতি উচ্চে।

তিনি যে সব কথা বলতেন, যেসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিতেন, তা হতো বিলকুল প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির অনুকূলে। তাঁর এমন কোন বর্ণনা খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য হবে যা সমর্থনের জন্য মানুষের বুদ্ধি ও প্রজ্ঞাকে নানা রকম তাবীল বা ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। একথা অবশ্য সত্য যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অতি নিকটের মানুষ হওয়ার সুবাদে তিনি তাঁর যাবতীয় কথা ও কাজ অধ্যয়নের খুব চমৎকার সুযোগ লাভ করেছিলেন। কিন্তু যখন আমরা দেখি যে, তিনি ছাড়া আরও অনেক ব্যক্তি এমন ছিলেন যাঁদের নৈকট্য তাঁর চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না তখন আমাদের সামনে হযরত ‘আয়িশার (রা) মেধা ও মননের শ্রেষ্ঠত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘুরে ফিরে সেই একই কথা আসে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখ নিঃসৃত বাণী ‘আয়িশা (রা) ছাড়া আরো অনেকে শুনতেন, কিন্তু তিনি যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেন এবং তার প্রকৃত প্রাণসত্তা তাঁর মেধা ও মস্তিষ্ক যতটুকু অনুধাবন করতে সক্ষম হতো, অন্যরা তা পারতো না।

উম্মূল মু’মিনীন হযরত ‘আয়িশা (রা) ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দারগাহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেধাবী শিক্ষার্থী। তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা ছির অতুলনীয়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তৎকালীন সকল নারী অথবা সকল উম্মাহাতুল মু’মিনীন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সহধর্মিণীগণ, যাঁরা বিশ্বের সকল বিশ্বাসীদের মাতা, অথবা সাহাবীদের একটি অংশের উপরই ছিল না, বরং কতিপয় বিশিষ্ট সাহাবী ছাড়া সকল সাহাবীর উপরই ছিল। হযরত আবু মূসা আল-আশ’য়ারী (রা) বলেন। আমরা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবীরা কক্ষনো এমন কোন কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হইনি, যে বিষয়ে আমরা ‘আয়িশার (রা) নিকট জানতে চেয়েছি এবং সে সম্পর্কে কোন জ্ঞান আমরা তাঁর কাছে পাইনি।

হযরত আবু মূসা আল-আশ’য়ারী (রা) একজন অতি উঁচু মর্যাদার সাহাবী। তাঁর উপরোক্ত মন্তব্য দ্বারা হযরত ‘আয়িশার (রা) জ্ঞানের পরিধি ও বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। প্রখ্যাত তাবে’ঈ হযরত ‘আতা ইবন আব রাবাহ-যিনি বহু সাহাবীর ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন, বলেন-

হযরত ‘আয়িশা (রা) ছিলেন মানুষর মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ, সবচেয়ে বেশি জানা ব্যক্তি এবং আম জনতার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর মতামতের অধিকারিণী।

তাবে’ঈদের ইমাম বলে খ্যাত হযরত ইমাম যুহরী-যিনি একাধিক অতি মর্যাদাবান সাহাবীর তত্ত্বাবধানের লালিত-পালিত হন, বলেনঃ

-হযরত ‘আয়িশা (রা) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় ‘আলিম ছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেক বড় বড় সাহাবী তাঁর কাছে জানতে চাইতেন।

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত‘ আবদুর রহমান ইবন ‘তাওফের (রা) সুযোগ্য পুত্র আবু সালামা যিনি একজন অতি উঁচু স্তরের তাবে’ঈ ছিলেন, বলেন-

‘রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাতের জ্ঞান, প্রয়োজনে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দান, আয়াতের শানে নুযূল এবং ফরয় বিষয়সমূহে আমি ‘আয়িশা (রা) অপেক্ষা অধিকতর পারদর্শী ও সুনিশ্চিত মতামতের অধিকারী আর কাউকে দেখিনি।

হযরত আমীর মু‘য়াবিয়া (রা) একদিন দরবারের এক ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলেন, আচ্ছা, আপনি বলুন তো, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় ‘আলিম কে? লোকটি বললোঃ আমীরুল মু’মিনীন! আপনি। আমীর মু‘য়াবিয়া (রা) বললেনঃ না। আমি কসম দিচ্ছি, আপনি সত্য কথাটি বলুন। তখন লোকটি বললোঃ যদি তাই হয়, তাহলে ‘আয়িশা (রা)

হযরত ‘উরওয়া ইবন যুবাইর (রা) বলেন, আমি হালাল-হারাম, জ্ঞান, কবিতা ও চিকিৎসা বিদ্যায় উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশা (রা) অপেক্ষা অধিকতার পারদর্শীন কাউকে দেখিনি।
অপর একটি বর্ণনায় হযরত ‘উরওয়ার কথাগুলি এভাবে এসেছে, কুরআন, ফারায়েজ, হালাল-হারাম, ফিকাহ, কাব্য, চিকিৎসা, আরবের ইতিহাস ও নসব বিদ্যায় আমি ‘আয়িশার (রা) চেয়ে বড় ‘আলিম আর কাউকে দেখিনি।

প্রখ্যাত তাবে‘ঈ হযরত মাসরূক (রা)-যিনি হযরত ‘আয়িশার (রা) তত্ত্বাধনানে লালিত-পালিত হন, একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হলোঃ উম্মুল্ মু’মিনীন ‘আয়িশা (রা) কি ফারায়েজ শাস্ত্র জানতেন? তিনি জবাব দিলেন, সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন! আমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বড় বড় সাহবীদেরকে তাঁর নিকট ফারায়েজ বিষয়ে প্রশ্ন করতে দেখেছি। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীস ও সুন্নাতের হিফাজত ও প্রচার-প্রসারের দায়িত্ব ও কর্তব্য রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য বেগমগণও করেছেন। তবে তাঁদের কেউই হযরত ‘আয়িশার (রা) স্তরে পৌঁছতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে মাহমুদ ইবন লাবীদ মন্তব্য করেছেন-

“রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগমগণ বহু হাদীস স্মৃতিতে ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু কেউ ‘আয়িশা (রা)উম্মু সালামার (রা) সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেননি।”

এ ব্যাপারে ইমাম যুহরী (রা) সাক্ষ্য দিচ্ছেনঃ
-যদি সকল মানুষ ও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগমদের ইল্ম (জ্ঞান) একত্র করা যেত তাহলে তাদের মধ্যে ‘আয়িশার (রা) ইলম বা জ্ঞান অধিকতর প্রশস্ত ও বিস্তৃত হতো।

অপর একটি বর্ণনা মতে ইমাম যুহরী বলেনঃ গোটা নারী জাতির ‘ইলম (জ্ঞান) এবং ‘আয়িশার (রা) ‘ইলম যদি একত্র করা যেত তাহলে ‘আয়িশার (রা) ‘ইলমই শ্রেষ্ঠ হতো।’
উপরের বর্ণনাসমূহের প্রেক্ষিতে ‘আল্লামা জাহাবী বলেনঃ ‘তিনি ছিলেন বিশাল জ্ঞান ভান্ডার।’ তিনি আরো বলেনঃ ‘উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে, সার্বিকভাবে মহিলাদের মধ্যে তাঁর চেয়ে বড় জ্ঞানী ব্যক্তি আর কেউ নেই।’

কোন কোন মুহাদ্দিস ‘আয়িশার (রা) ফযীলাত বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি হাদীস বর্ণনা করেন, তোমাদের দীনের একটি অংশ তোমরা হুমায়রা হতে গ্রহণ কর। ইলম ও ইজাতিহাদ বা জ্ঞান ও গবষেণায় হযরত ‘আয়িশা (রা) কেবল মহিলাদের মধ্যেই নন, বরং পুরুষদের মধ্যেও বিশেষ স্থান অধিকার করতে সক্ষম হন। কুরআন, সুন্নাহ, ফিকাহ ও আহকাম বিষয়ক জ্ঞানে তাঁর স্থান ও মর্যাদা এত ঊর্ধ্বে যে ‘উমার (রা), ‘আলী (রা), ‘আবদুল্লাহ ইবনে মাস‘উদ (রা), ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আববাস (রা) প্রমুখের সাথে তাঁর নামটি নির্ধ্বিধায় উচ্চারণ করা যায়। এখানে সংক্ষেপে আমরা বিভিন্ন শাস্ত্রে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে একটি আলোচনা উপস্থাপন করছি।

আল কুরআনে আয়িশা (রা) এর পান্ডিত্য

আমরা জানি পবিত্র কুরআন দীর্ঘ তেইশ বছর নাযিল হয়। হযরত ‘আয়িশা (রা) নুযূলে কুরআনের চতুর্দশ বছরে মাত্র নয় বছর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে আসেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে তাঁর সহঅবস্থানের সময়কাল দশ বছরের ঊর্ধ্বে নয়। নুযূলে কুরআনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত হয় তাঁর জ্ঞান-বৃদ্ধি ও বয়োপ্রাপ্তির পূর্বে। কিন্তু এমন অসাধারণ মেধা ও মননের অধিকারী সত্তা তাঁর শৈশব কালকেও বৃথা যেতে দেয়নি। মক্কায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন সময় হযরত সিদ্দীকে আকবরের (রা) গৃহে আসতেন। সিদ্দীকে আকবর (রা)ও নিজ গৃহে একটি মসজিদ বানিয়েছিলেন। সেখানে বসে তিনি অত্যন্ত বিনয় ও ভয়-বিহবল চিত্তে কুরআন পাক তিলাওয়াত করতেন।

হযরত ‘আয়িশার (রা) অস্বাভাবিক স্মৃতিশক্তির জন্য এ সকল পরিবেশ ও অবস্থা থেকে কোন ফায়দা লাভ না করাটা অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তাই আমরা তাঁকে সূরা ‘আল-কামার-এর ৩য় আয়াত সম্পর্কে বলতে শুনি-

“আয়াতটি মক্কায় মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর নাযিল হয়। আমি তখন একটি ছোট্ট মেয়ে, খেলা করি।”

ইফক (বানোয়াট দোষারোপ)-এর ঘটনা যখন ঘটে তখন হযরত ‘আয়িশার (রা) বয়স ১৩/১৪ বছর হবে। তখন পর্যন্ত কুরআনের খুব বেশি অংশ হিফজ করেননি। তিনি নিজেই বলেছেন, “সেই সময় আমি একটি কম বয়সী মেয়ে, খুব বেশি কুরআন পড়িনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তখনই কুরআনের উদ্ধৃতি পেশ করতেন।”

আবূ ইউনুস নামে হযরত ‘আয়িশার (রা) একটি দাস ছিল। সে লেখাড়পা জানতো। তিনি এই আবু ইউনুসকে দিয়ে নিজের জন্য কুরআন লিখিয়েছিলেন।

অনারবদের সাথে মেলামেশার কারণে কুরআন পাঠে তারতম্য সবচেয়ে বেশি দেখা দেয় ইরাকে। একবার ইরাক থেকে এক ব্যক্তি হযরত ‘আয়িশার (রা) সাথে দেখা করতে আসে। সে বলে, উম্মুল মু’মিনীন! আমাকে আপনার কুরআনটি একটু দেখান। হযরত ‘আয়িশা (রা) কারণ জানতে চাইলে সে বললো, আমাদের ওখানে লোকেরা এখনো পর্যন্ত কুরআন পাঠে কোন ক্রমধারা অনুসরণ করে না। আমি চাই, আমার কুরআনটি আপনার কুরআনের অনুরূপ সাজিয়ে নিই। তিনি বললেন, সূরা সমূহের বিন্যাস আগ–পিছে হওয়াতে কোন ক্ষতি নেই। তারপর নিজের কুরআনটি বের করে প্রত্যেক সূরার আয়াতসমূহ থেকে পাঠ করে লিখিয়ে দেন।

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বৈবাহিক জীবনে হযরত ‘আয়িশার (রা) অভ্যাস ছিল যদি কোন আয়াতের অর্থ বোধগম্য না হতো, স্বামী রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশ্ন করে জেনে নিতেন। সহীহ হাদীসসমূহে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট বহু আয়াত সম্পর্কে তাঁর প্রশ্নের কথা বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগমগণ উম্মাহাতুল মুমিনীনের প্রতি নির্দেশ ছিল-

“হে নবী পরিবরের সদস্যবর্গ! আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানগর্ভ কথা, যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয় তোমরা সেগুলো স্মরণ করবে।”

তাঁরা এই নির্দেশ অনুযায়ী নিজ নিজ যোগ্যতা ও সাধ্যমত ‘আমল করতেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাজাজ্জুদের নামাযে অত্যন্ত নিবিষ্ট মনে এবং বিনয় ও বিনম্র চিত্তে কুরআনের বড় বড় সূরা তিলাওয়াত করতেন। সেই সব নামাযে হযরত ‘আয়িশা (রা)ও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছনে ইকতাদা করতেন। একমাত্র হযরত ‘আয়িশা (রা) ছাড়া আর কোন বেগমের বিছানায় কুরআনের নুযূল হয়নি। এমতাবস্থায় নাযিলকৃত আয়াতের প্রথম ধ্বনিটি তাঁর কানেই যেত। তিনি বলছেনঃ ‘সূরা আল-বাকারা ও সূরা আন-নিসা যখন নাযিল হয় তখন আমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছেই ছিলাম।

মোটকথা, এ সকল পরিবেশ ও অবস্থার কারণে হযরত ‘আয়িশা (রা) কুরআনের প্রতিটি আয়াতের পাঠ পদ্ধতি, ভার ও তাৎপর্য এবং হুকুম-আহকাম বের করার পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেন। এ কারণে, কোন বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে সর্বপ্রথম তিনি কুরআন পাকের প্রতি দৃষ্টি দিতেন। আকায়েদ, ফিকাহ, আহকাম ছাড়াও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সীরাত ও আখলাক-যা মূলত ইতহাসের সাথে সম্পর্কিত, সবকিছুই তিনি কুরআন পাক দ্বারা বুঝার চেষ্টা করতেন। 

একবার কিছু লোক তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলো। তারা বললোঃ উম্মুল মুমিনীন! আপনি আমাদের কাছে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু আখলাকের কথা বর্ণনা করুন! তিনি বললেনঃ তোমরা কি কুরআন পড় না? তাঁর আখলাক হলো আল-কুরআন। তারা আবার প্রশ্ন করলোঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাত্রিকালীন ইবাদাতের পদ্ধতি কেমন ছিল? বললেনঃ তোমরা কি সূরা ‘মুয্যাম্মিল’ পড়নি?
সহীহ সনদে সাহাবায়ে কিরাম থেকে কুরাআন কারীমের তাফসীর খুব কমই বর্ণিত হয়েছে। যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তার মধ্যে হযরত ‘আয়িশার (রা) তাফসীর মূলক বর্ণনা একেবারে কম নয়। এখানে তার কয়েকটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলোঃ

সাফা ও মারওয়ার পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে দাঁড়ানো হজ্জের একটি অন্যতম প্রধান কাজ। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে নিম্নের আয়াতটি এসেছেঃ

“নিঃসন্দেহে ‘সাফা ও ‘মারওয়া’ আল্লাহ তা‘য়ালার নির্দশনগুলোর অন্যতম। সুতরাং যারা কা‘বা ঘরে হজ্জ বা ‘উমরা করে, তাদের পক্ষে এ দুইটির তাওয়াফ করাতে কোন দোষ নেই।”

একদিন ‘উরওয়া বললেনঃ খালাআম্মা! এই আয়াতের অর্থ তো এটাই যে, কেউ যদি সাফা-মারওয়ার তাওয়াফ না করে তা হলেও কোন দোষ নেই। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ ভাগ্নে! তুমি ঠিক বলোনি। যদি আয়াতটির অর্থ তাই হতো যা তুমি বুঝেছো, তাহলে আল্লাহ এভাবে বলতেনঃ

-অর্থাৎ ওদের তাওয়াফ না করাতে কোন দোষ নেই। মূলত আয়াতটি আনসারদের শানে নাযিল হয়েছে। মদীনার আউস ও খায়রাজ গোত্রের লোকেরা ইসলাম-পূর্ব জীবনে ‘মানাত’ দেবীর উপাসনা করতো। মানাতের মূর্তি ছিল কুদাইদ-এরকাছে ‘মুশাল্লাল’ পাহাড়ে। এ কারণে তারা সাফা-মারওয়ার তাওয়াফকে খারাপ মনে করতো। ইসলাম গ্রহণের পর তারা রাসূলুল্লারহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট জিজ্ঞেস করে, ইসলামের পূর্বে আমরা এমন করতাম, এখন এর বিধান কি? এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেন, সাফা ও মারওয়ার তাওয়াফ কর, এতে দোষের কিছু নেই। এরপর তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাফা ও মারওয়ার তাওয়াফ করেছেন। এখন তা ত্যাগ করার অধিকার কারো নেই।

হযরত ‘আয়িশার (রা) এই তাফসীর দ্বারা যে মূলনীতিটি বেরিয়ে আসে তা হলো, কুরআন বুঝতে হলে আরবদের বাকবিধি ও ব্যবহৃত শব্দের ভিত্তিতে বুঝতে হবে। সূরা ইউসূফের ১১০তম আয়াতে আল্লাহ পাক বলেনঃ

“অবশেষে যখন রাসূলগণ নিরাশ হলেন এবং লোকে ভাবলো যে, রাসূলগণকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তখন তাদের নিকট আমার সাহায্য আসলো।”

হযরত ‘উরওয়া হযরত ‘আয়িশাকে (রা) প্রশ্ন করলেন- আরবী হবে। (অর্থাৎ রাসূলগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে) হবে, না-আবরী হবে। (অর্থাৎ তাঁদেরকে মিথ্যাবাদী বলা হয়েছে) হবে? ‘আয়িশা (রা) বললেন-আরবী হবে। (মিথ্যাবদী বলা হয়েছে) ‘উরওয়া বললেনঃ রাসূলগণের তো দূঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাঁদেরকে মিথ্যাবদী বলা হয়েছে এবং তাঁদের স্বজাতির লোকেরা তাঁদের নবুওয়াতের দাবিকে মিথ্যা বলেছে তখন আরবী হবে অর্থাৎ তাঁরা ধারণা বা অনুমান করলো-কথাটির তাৎপর্য কি? এ কারণে আবরী হবে (তাঁদেরকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে) হওয়াই শুদ্ধ হবে। হযরত ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ মা‘য়াজ আলাহ! আল্লাহর নবী-রাসূলগণ কি আল্লাহ সম্পর্কে এমন ধারা পোষণ করতে পারেন যে, তাঁদেরকে সাহায্যের মিথ্যা প্রতিশ্রুটি দেওয়া হয়েছে? হযরত উরওয়া তখন জানতে চাইলেনঃ তাহলে আয়াতটির অর্থ কি হবে? বললেন? কথাটি বলা হয়েছে রাসূলদের অনুসারীদের সম্পর্কে। যখন তারা ঈমান আনলো, তাঁদের নবুওয়াতকে সত্য বলে স্বীকার করলো তখন স্বাজাতির লোকেরা তাদের উপর অত্যাচার উৎপীড়ন চালালো। সেই সময় আল্লাহর সাহায্য আসতে বিলম্ব হচ্ছে বলে তারা এরূপ মনে করলো। এমন কি রাসূলগণ স্বাজাতির অস্বীকারকারীদের ঈমানের ব্যাপারে হতাশ হয়ে গেলেন। তাঁদের ধারণা হলো আল্লাহর সাহায্যের এই বিলম্বের কারণে ঈমানদারগণ আমাদের মিথ্যাবদী বলে না দেয়। এমন সময় হঠাৎ আল্লাহর সাহায্য এসে যায়।

স্ত্রীর যদি স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে সে ক্ষেত্রে কুরআনের নির্দশ হলোঃ “কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর দুর্ব্যবহার ও উপেক্ষার আশঙ্কা করে তবে তারা আপোষ-নিষ্পত্তি করতে চাইলে কোন দাষ নেই, এবং আপোষ-নিস্পত্তিই শ্রেয়।”

অসন্তুষ্টি দূর করার জন্য আপোষ-মীমাংসা করে নেওয়া তো একটি সাধারণ ব্যাপার। এর জন্য আল্লাহ পাকের এক বিশেষ হুকুম নাযিলের কি প্রয়োজন ছিল? হযরত আয়িশা (রা) বলেন, এ আয়াত সেই স্ত্রীর সম্পর্কে নাযিল হয়েছে যার স্বামী তার কাছে তেমন আসে না। অথবা স্ত্রীর সম্পর্কে নাযিল হয়েছে যার স্বামী তার কাছে তেমন আসে না। অথবা স্ত্রীর বয়স বেশি হওয়ার কারণে স্বামীকে-তৃপ্ত করতে সক্ষম নয়। এমন বিশেষ অবস্থায় স্ত্রী যদি তালাক নিতে না চায় এবং স্ত্রী অবস্থায় থেকে স্বামীর নিকট প্রাপ্য নিজের অধিকার ছেড়ে দেয়, তাহলে এমন আপোষ-নিষ্পত্তি খারাপ নয়। বরং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চেয়ে তা উত্তম।

আল্লাহ তা‘য়ালা সূরা আল-বাকারার ২৩৮তম আয়াতে বলেছেনঃ “তোমরা সমস্ত নামাযের প্রতি যত্মবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাযের ব্যাপারে। ‘মধ্যবর্তী নামায’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে, সে সম্পর্কে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হযরত যায়িদ ইবন সাবিত (রা) ও হযরত ‘উসামার (রা) মতে, মধ্যবর্তী নামায হলো জুহরের নামায। কোন কোন সাহাবীর মতে ফজরের নামায। হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেন, মধ্যবর্তী নামায বলতে আসরের নামায বুঝানো হয়েছে। তিনি নিজের এই তাফসীরের উপর এতখানি দূঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন যে, নিজের মাসহাফখানির পার্শ্বটীকায় আরবী হবে কথাটি লিখিয়ে দিয়েছিলেন। হযরত আয়িশার (রা) দাস আবু ইউনুস বলেন, তিনি আমাকে একখানি কুরআন লেখার নির্দেশ দিয়ে বলেন, যখন এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছবে, আমাকে জানাবে। আমি যখন এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলাম, তখন তিনি আবরী হবে কথাটি লেখান।

তারপর বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট থেকে এমনই শুনেছি। মূলত আরবী হবে কুরআনের আয়াত নয়, রবং আবরী হবে এর তাফসীর। সূরা আল-বাকারার ২৮৪তম আয়াতে আল্লাহ তা‘য়ালা বলেনঃ “তোমরা তোমাদের মনে যা কিছু আছে তা প্রকাশ কর বা গোপন রাখ, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে হিসাব নেবেন। তারপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দিবেন।”

এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায় মানুষের অন্তরে মুহূর্তের জন্য যে সকল ভাব ও কল্পনার উদয় হয় আল্লাহ তার সবকিছুরই হিসাব নিবেন। কিন্তু অনিচ্ছাকৃত যে সকল ওসওসা এবং কল্পনার উদয় হয় তারও পাকড়াও যদি আল্লাহ করেন তাহলে মানুষের পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব হবে। হযরত ‘আলী (রা)ইবন ‘আববাস (রা) বলেন, এ আয়াতের হুকুম একই সূরার ২৮৬তম, আয়াত দ্বারা রহিত করা হয়েছে। আয়াতটির অর্থ নিম্নরূপঃ “আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনকাজের ভার দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার উপর বর্তায় যা সে করে।”

হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা)ও উপরোক্ত মত পোষণ করেন। কোন এক ব্যক্তি হযরত ‘আয়িশার (রা) নিকট উপরোক্ত আয়াতের অর্থ জিজ্ঞেস করে। সাথে সাথে যে সূরা আন-নিসার ১২৩তম আয়াতটি পেশ করে। আয়াতটির অর্থঃ ‘যে কেউ মন্দ কাজ করবে, সে তার শাস্তি পারে।’ প্রশ্নকারীর বক্তব্য ছিল, এই যদি অবস্থা হয় তাহলে আল্লাহর মাগফিরাত ও রহমত বান্দা কিভাবে লাভ করবে এবং সে মুক্তির আশাই বা কেমন করে করবে? হযরত ‘আয়িশা (রা) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট এ আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞেস করার পর সর্বপ্রথম তুমিই আমার কাছে প্রশ্ন করেছো। আল্লাহর বাণী সত্য। তবে আল্লাহ তা‘য়ালা তার বান্দাদের ছোট ছোট ভুল-ত্রুটি নানা রকম মুসীবত ও বিপদের বিনিময়ে ক্ষমা করে দেন। এখন মুমিন ব্যক্তি যখন অসুস্থ হয় অথবা তার উপর কোন বিপদ আসে, এমন কি পকেটে কোন জিনিস রেখে ভুলে যায় এবং তা তালাশ করতে করতে অস্থির হয়ে পড়ে এর সবকিছুই তার মাগফিরাত ও রহমত লাভের কারণ ও বাহানা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, সোনা আগুনে পুড়ে যেমন নিখাঁদ হয়ে যায় তেমনি মুমিন ব্যক্তিও পাক-সাফ হয়ে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।

সূরা আন-নিসার ষষ্ঠ আয়াতে ইয়াতীমের মাল সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “যারা সচ্ছল তারা অবশ্যই ইয়াতীমের মাল খরচ করা থেকে বিরত থাকবে। আর যে অভাবগ্রস্ত সে সঙ্গত পরিমাণ খেতে পারে।”

এ আয়াতের নির্দেশ ইয়াতীমদের ওলীদের সম্পর্কে। হযরত ইবন ‘আববাস (রা) বর্ণনা করেন যে, উল্লেখিত আয়াতের হুকুম নিম্নোক্ত সূরা নিসার ১০ম আয়াত দ্বারা রহিত হয়েছেঃ “যারা ইয়াতীমের অর্থসম্পদ অন্যায় ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে।”

কিন্তু পরবর্তী আয়াতে তো তাদের জন্য শাস্তির কথা বলা হয়েছে যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমের মাল খায়। এ কারণে হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেন, যে আয়াতে খাওয়ার অনুমতি এসেছে সেইসব লোকদের জন্য যারা ইয়াতীমের বিষয় সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য দেখা শোনা করে। এমন ওলী যদি সচ্ছল হয় তাহলে তাদের বিনিময় গ্রহণ করা উচিত নয়। আর যদি দরিদ্র হয় তাহলে তার মর্যাদা অনুযায়ী কিছু গ্রহণ করতে পারে। মূলত হযরত ‘আয়িশার (রা) এ তাফসীরের ভিত্তিতে দুইটি আয়াতে অর্থে কোন বিরোধ থাকে না। উপরের উদ্ধৃত আয়াতসমূহের মত আরোবহু আয়াতের তাফসীর হযরত ‘আয়িশা (রা) থেকে হাদীস ও তাফসীর গ্রস্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে।

হযরত আয়িশা (রাঃ) এর ১২ পর্বের পুরো জীবনী পড়ুন-




*****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url