সাহাবাগণের জীবনকথা-২০ || হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর জীবনী (৪র্থ পর্ব)






হযরত আয়িশা (রা) এর জীবনীর ৩য় পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

আয়িশা (রা) এর যুদ্ধ-বিগ্রহ

ইমাম বুখারী বর্ণণা করেছেন। আনাস (রা) উহুদ যুদ্ধের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেনঃ আমি ‘আয়িশা ও উম্মু সুলাইমকে (রা) দেখলাম, তাঁরা কাঁধে করে মশক ভরে পানি এনে আহতদের মুখে ঢালছেন। পানি শেষ হয়ে গেলে আবার ভরে এনে ঢালছেন। উহুদ যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স দশ এগারো বছরের বেশি হবেনা। এই যুদ্ধে তিনি যোগদান করে আহতদের সেবা করেছেন।

ইমাম বুখারী বলেন, বনু মুসতালিক যুদ্ধই হলো আল-মুরাইসী ‘যুদ্ধ। এই যুদ্ধটি কোন্ সনে হয় সে সম্পর্কে অবশ্য সীরাত বিশেষজ্ঞদের একটু মতভেদ আছে। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, এটি হয় ষষ্ঠ হিজরীতে। মূসা ইবন ‘উকবা বলেন চতুর্থ হিজরীতে, আর ‘উরওয়া বলেন, এটা পঞ্চম হিজরীর শা‘বান মাসের ঘটনা। আল-মুরাইসী হলো বনু মুসতালিক গোত্রের একটি ঝর্ণা। তাদের নেতা ছিল আল-হারেস ইবন আবী দারবার। সে তার নিজ গোত্র ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য গোত্রের লোকদের রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সংগঠিত করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ খবর অবগত হয়ে তাদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে একটি বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হন। এই বাহিনীতে বিপুল সংখ্যক মুনাফিক (কপট মুসলমান) অংশগ্রহণ করে যা অন্য কোন যুদ্ধে কখনো করেনি। অবশেষে আল-মুরাইসী‘-এর পাশে দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। এই অভিযানে মুনাফিকরা হযরত ‘আয়িশাকে (রা) নিয়ে একটি কুৎসিত ষড়যন্ত্র পাকায় ঘটনাটি আরো একটু বিস্তারিতভাবে তুলে ধরছি।

আয়িশা (রা) এর পবিত্র চরিত্রের উপর চরম অপমানকর মিথ্যা দোষারোপ

হিজরী ৫ম অথবা ৬ষ্ঠ সনের শা‘বান মাসে নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতে পারলেন যে, মুরাইসী ‘এর পাশে বসবাসকারী লোকেরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এ কথা জানার পরপরই রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে এই লোকদের দিকে যাত্রা করলেন। মুনাফিক-শ্রেষ্ঠ ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাই বিপুল সংখ্যক মুনাফিক সঙ্গে নিয়ে এই যাত্রায় নবী কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সঙ্গে শরিক হলো। ইবন সা‘দ বলেন, ইতিপূর্বে কোন যুদ্ধেই এত সংখ্যক মুনাফিক যোগদান করেনি। অভিযান শেষে এমিুনাফিকরা নানাভাবে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে। আল্লাহ পাকের রহমত ও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দূরদৃষ্টি ও সুযোগ্য নেতৃত্বে ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাইয়ের সকল চক্রান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

এই সফরেই তারা উম্মুল মুমিনীন ‘আয়িশাকে (রা) কেন্দ্র করে এক ষড়যন্ত্র পাকায়। তারা হযরত ‘আয়িশার (রা) পবিত্র চরিত্রের উপর এক চরম অপমানকর মিথ্যা দোষারোপ করে বসে। মূল কাহিনীটি হযরত ‘আয়িশার (রা) ভাষায় সহীহ বুখারীসহ বিভিন্ন হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ

রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ম ছিল যখন দূরে কোথাও বের হতেন, কুর‘আ‘র মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে কে তাঁর সঙ্গী হবেন। বনী আল মুসতালিক যুদ্ধের সময় কুর‘আ‘য় আমার নামটি আসে। ফলে আমি তাঁর সফর সঙ্গী হই। ফিরে আসার সময় যখন আমরা মদীনার কাছাকাছি পৌছি, রাতের বেলা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মানযিলে তাঁবু গেড়ে অবস্থান করেন। রাতের শেষভাবে সেখানে থেকে যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করা হয়। আমি ঘুম থেকে জেগে স্বাভাবিক প্রয়োজন সারার জন্য বাইরে গেলাম। ফিরে আসার সময় অবস্থানের কাছাকাছি স্থানে আসতেই মনে হলো যে, আমার গলার হারটি কোথাও পড়ে গেছে। আতিপাতি করে তা খুজতে গিয়ে রেগে গেলাম। ইতিমধ্যে কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেছে। নিয়ম ছিল যে, রওয়ানা হওয়ার সময় আমি আমার ‘হাওদাজে’ (উঠের পিঠের পালকি) বসে যেতাম, তারপর চারজন লোক তা তুলে উটের পিঠের উপর বেঁধে দিত। এই সময় অভাব অনটনের কারণে আমরা মেয়েরা ছিলাম বড়ই হালকা-পাতলা। আমার ‘হাওদাজ’ উঠানোর সময় লোকেরা টেরই পেলনা যে, আমি ওর মধ্যে নেই। অজ্ঞাতসারে তারা হাওদাজ উটের পিঠে বসিয়ে রওয়ানা হলে গেল।

এদিকে আমি হার খুঁজে পেলাম এবং ফিরে এসে সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। ফলে আমি আমার গায়ের চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে সেখানেই পড়ে থাকলাম। চিন্তা করলাম, সামনে গিয়ে যখন আমাকে দেখতে পাবে না, তখন তারা আমার তালাশে ফিরে আসবে। এই অবস্থায় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলা সাফওয়ান ইবন মু‘য়াত্তাল আল-সুলামী যেখানে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, সেখানে উপস্থিত হলেন। আমাকে দেখেই তিনি চিনতে পারলেন। কারণ পর্দার নির্দেশ নাযিল হওয়ার আগে তিনি আমাকে কয়েকবার দেখিছিলেন। আমাকে দেখে তিনি উট থামালে এবং বিস্ময়ের সাথে তাঁর মুখে উচ্চারিত হলো-ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন! রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগম সাহেবা এখানে রয়ে গেছেন।

তাঁর কণ্ঠস্বর কানে যেতেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম এবং চাদর দ্বারা মুখ ঢেকে ফেললাম। তিনি আমার সঙ্গে কোন কথাই বললেন না। নিজের উটটি এনে আমার সামনে বসিয়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন। আমি উঠের পিঠে উঠে বসলাম, আর তিনি লাগাম ধরে হেঁটে চললেন। প্রায় দুপুরের সময় আমরা কাফেলাকে ধরলাম-যখন তারা এক স্থানে সবেমাত্র থেমেছে। আর আমি যে পিছনে রয়ে গেছি, সে কথা তাদের কেউ জানতেও পারেনি। এই ঘটনার উপর মিথ্যা দোষারোপের এক পাহাড় রচনা করা হলো। যারা এই ব্যাপারে অগ্রণী ছিল, তাদের মধ্যে ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাই ছিল সবার চেয়ে অগ্রসর। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে কি কি কথা বলা হচ্ছে, আমি তার কিছুই জানতে পারিনি।’

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, সাফওয়ানের উটের পিঠে সওয়ার হয়ে হযরত ‘আয়িশা (রা) যে সময় সৈনিকদের তাঁবুতে উপস্থিত হলেন এবং তিনি পিছনে পড়ে ছিলেন বলে জানা গেল, তখন ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাই চিৎকার করে বলে উঠলোঃ ‘আল্লাহর কসম! এই মহিলাটি নিজেকে বাঁচিয়ে আসতে পারেনি। দেখ, দেখ, তোমাদের নবীর স্ত্রী অপরের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে, আর এখন সে প্রকাশ্যভাবে তাকে সংগে নিয়ে চলে এসেছে।’

‘আয়িশা (রা) বলেন, ‘‘মদীনায় ফিরে আসার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রায় এক মাসকাল আমি শয্যাশায়ী হয়ে থাকলাম। শহরের সর্বত্র এই মিথ্যা দোষারোপের খবর উড়ে বেড়াতে লাগলো। নবী কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কান পর্যন্ত পৌঁছাতে দেরী হলো’ না। কিন্তু আমি কিছুই জানতে পারলাম না। একটি খটকা অবশ্য আমার মনে লাগছিলো। তা হলো, অসুস্থ অবস্থায রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে রকম লক্ষ্য দিতেন, এবার তিনি তেমন দিচ্ছেন না। তিনি ঘরে এলে ঘরের লোকদেরকে শুধু জিজ্ঞেস করতেনঃ ‘ও কেমন আছে’? আমার সংগে কোন কথা বলতেন না। এতে আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল, কোন কিছু ঘটেছে হয়তো। শেষ পর্যন্ত তাঁর নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আমি আমার মায়ের নিকট চলে গেলাম। যাতে মা আমার সেবা-শুশ্রুষা ভালোভাবে করতে পারেন।

একদিন রাতের বেলা প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে ঘরের বাইরে গেলাম। তখনও পর্যন্ত আমাদের সব বাড়ীতে পায়খানা নির্মিত হয়নি। আমরা প্রাকৃতিক প্রয়োজনের জন্য বনে-জঙ্গলেই যেতাম। আমার সংগে মিসতাহ ইবন উসাসা’র মাও ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার পিতার খালাতো বোন। তিনি পথ চলতে গিয়ে হোঁচট খান। তখন অকষ্মাৎ তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়! ধ্বংস হোক মিসতাহ’। আমি বললামঃ আপনি কেমন মা? নিজের ছেলের ধ্বংস কামনা করেন! আর ছেলেও এমন, যে বদর যুদ্ধে যোগদান করেছিল। তিনি বললেনঃ ‘‘মেয়ে! তুমি কি কোন খবরই রাখো না? তারপর তিনি আমাকে সকল কাহিনী বললেন। মিথ্যাবাদীরা আমার সম্পর্কে কি কি বলে বেড়াচ্ছিল, তা সবই শোনালেন।’’

উল্লেখ্য যে, মুনাফিকীন ছাড়ও মুষ্টিমেয় কিছু মুসলমান এই মিথ্যার অভিযানে শরিক হয়ে পড়েছিলেন। তাদের মধ্যে মিসতাহ ইবন উসাসা, ইসলামের প্রখ্যাত কবি হাসসান ইবন সাবিত ও হযরত যয়নাব (রা) এর বোন হামনা বিনত জাহাশ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ এই কাহিনী শুনে আমার রক্ত যেন পানি হয়ে গেল। যে জন্য এসছিলাম, সেই প্রয়োজনের কথাও ভুলে গেলাম। সোজা ঘরে ফিরে গেলাম এবং সারা রাত কেঁদে কাটালাম।
এদিকে আমার অনুপস্থিতিকালে রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আলীও উসামা ইবন যায়িদকে (রা) ডাকলেন এবং তাদের নিকট এই বিষয়ে পরামার্শ চাইলেন। উসামা (রা) আমার পক্ষে ভালো কথাই বললেন। বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ ! আপনার স্ত্রীর মধ্যে ভালো ছাড়া মন্দ কিছু কখনো দেখতে পাইনি। যা কিছু বলে বেড়ানো হচ্ছে, তা সবই মিথ্যা কথা, রচিত অভিযোগ মাত্র। আর ‘আলী বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের সমাজে মেয়ে লোকের কোন অভাব নেই। আপনি এর পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন। আর আসল ব্যাপার যদি জানতে চান, তাহলে দাসীকে ডেকে অবস্থা জেনে নিতে পারেন।

দাসীকে ডাকা হলো এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। সে বললোঃ ‘আল্লাহর কসম যিনি আপনাকে সত্য দীনসহ পাঠিয়েছেন, আমি তাঁর মধ্যে খারাপ কিছুই দেখিনি-যে সম্পর্কে আপত্তি করা যেতে পারে। দোষ শুধু এতটুকুই দেখেছি যে, আমি আটা মেখে রেখে যেতাম, আর বলতাম, একটু দেখবেন। কিন্তু তিনি ঘুমেয় পড়তেন, আর তৈরি আটা ছাগল এসে খেয়ে যেত।’

সেইদিন নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর এক ভাষণে বললেনঃ ‘হে মুসলমানরা, তেমাদের মধ্যে এমন কে আছে-আমার স্ত্রীর উপর মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাকে যে কষ্ট দিয়েছে-তার আক্রমণ হতে আমাকে বাঁচাতে পারে? আল্লাহর শপথ, আমি আমার স্ত্রীর মধ্যে কোন দোষ দেখতে পাইনি, না সেই লোকটির মধ্যে যার সম্পর্কে এই অভিযোগ তোলা হয়েছে। আমার অনুপস্থিতির সময় সে তো কখনই আমার ঘরে আসেনি।’ এই কথা শুনে হযরত উসাইদ ইবন হুদাইর, কোন কোন বর্ণনা মতে হযরত সা’দ ইবন মু‘য়াজ (রা) দাঁড়িয়ে বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ। অভিযোগকারী যদি আমাদের বংশের লোক হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তাকে হত্যা করবো। আর আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের লোক হলে আপনি যা বলবেন, তাই করবো।’ এই কথা শুনেই খাযরাজ গোত্র-প্রধান সা‘দ ইবন ‘উবাদা দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেনঃ ‘তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি কিছুতেই তাকে মারতে পারবে না। তুমি তাকে হত্যা করার কথা শুধু এই জন্য বলছো যে, সে খাযরাজ গোত্রের লোক। সে তোমাদের লোক হলে তুমি কখনই তাকে হত্যা করার কথা বলতে পারতে না।’ জবাবে তাকে বলা হয়েছিলঃ তুমি তো মুনাফিক, এই জন্য মুনাফিকদের সমর্থন দিচ্ছো।’

এই বাক-বিতন্ডায় মসজিদে নববীতে একটা হট্ট্রাগোলের সৃষ্টি হয়। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের লোকেরা মসজিদেই লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে ঠান্ডা করেন এবং পরে মিম্বরের উপর হতে নেমে আসেন।

অন্তত একমাস কাল এই মিথ্যা দোষারোপের বানোয়াট কথা সমাজে উড়ে বেড়াতে লাগলো। নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কঠিন মানসিক কষ্ট পেতে থাকলেন। আমি কান্নাকাটি করতে লাগলাম। আমার পিতা-মাতা সীমাহীন দুশ্চিন্তায় ও উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন আসলেন এবং আমার পাশে বসলেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি একবারও আমার কাছে বসেননি। আবু বকর ও উম্মু রুমান (আয়িশার পিতা-মাতা) মনে করলেন, আজ হয়তো কোন সিদ্ধান্তমূলক কথা হয়ে যাবে। এই কারণে তাঁরাও নিকটে এসে বসলেন। নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আয়িশা, তোমার সম্পর্কে এই সব কথা আমার কানে পৌঁছেছে। তুমি যদি নিষ্পাপ হয়ে থাক, তাহলে আশা করি আল্লাহ তোমার নির্দোষিতা প্রকাশ ও প্রমাণ করে দেবেন। আর তুমি যদি বাস্তবিকই কোন প্রকার গুনাহে লিপ্ত হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর নিকট তাওবা কর, ক্ষমা চাও। বান্দাহ যখন গুনাহ স্বীকার করে, তাওবা করে,তখন আল্লাহ মা‘ফ করে দেন।

এই কথা শুনে আমার চোখের পানি শুকিয়ে গেল। আমি পিতাকে বললাম, আপনি রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথার জনাব দিন। তিনি বললেনঃ মেয়ে! আমি কি বলবো তা বুঝতে পারছিনা।’ আমি আমার মাকে বললাম, আপনিই কিছু বলুন।: তিনি বললেনঃ আমি কি বলবো তা আমার বুঝে আসে না।’ তখন আমি বললামঃ আপনাদের কানে একটা কথা এসেছ অমনি তা মনের মধ্যে বসে গেছে। এখন আমি যদি বলি, আমি নির্দোষ-আল্লাহ সাক্ষী, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ-তবে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন না। আর যদি শুধু শুধুই এমনএকটা কথা স্বীকার করে নিই যা আমি আদৌ করিনি-আল্লাহ জানেন যে, আমি তখন হযরত ইয়াকুব (আ) এর নামটি স্বরণ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তা স্বরণে এলো না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, এমন অবস্থায় আমি সেই কথা বলা ছাড়া আর কোন উপায় দেখি না, যা হযরত ইউসুফ (আ) এর পিতা বলেছেনঃ

এই কথা বলে আমি অপরদিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। আমি মনে মনে বললামঃ আল্লাহ আমার নির্দোষিতা সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত। তিনি নিশ্চয়ই প্রকৃত ব্যাপার লোকদের সামনে উম্মোচিত করে দিবেন। তবে আমার সপক্ষে ‘ওহী’ নাযিল হবে, আর তা কিয়ামত পর্যন্ত পড়া হবে, এমন ধারণা আমার মনে কখনো আসেনি। আমি মনে করেছিলাম, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন স্বপ্ন দেখবেন, আর তাতে আল্লাহ আমার নির্দোষিতা প্রকাশ করে দিবেন। এরই মধ্যে নবী কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর ‘ওহী’ নাযিল হওয়াকালীন অবস্থা সৃষ্টি হলো। এমনকি তীব্র শীতের মধ্যে তাঁর চেহারা মুবারক হতে ঘামের ফোটা টপ টপ করে পড়তে লাগলো। এমন অবস্থা দেখে আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। আমি মনে মনে পূর্ণমাত্রায় নির্ভয় ছিলাম। কিন্তু আমার পিতা-মাতার অবস্থা ছিল বড়ই মর্মান্তিক। আল্লাহ কোন মহাসত্য উদঘাটন করেন, সেই চিন্তায় তারা ছিলেন অস্থির, উদ্বিগ্ন। ‘ওহী’ কালীন অবস্থা শেষ হয়ে গেলে রাসূলে কারীমকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুবই উৎফুল্ল দেখা গেল। তিনি হাসি সহকারে প্রথম যে কথাটি বললেন তা ছিল এইঃ ‘আয়িশা, তোমাকে সুসংবাদ। আল্লাহ তোমার নির্দোষিতা ঘোষণা করে ওহী নাযিল করেছেন। অতঃপর তিনি সূরা আন-নূর-এর ১১ আয়াত থেকে ২১ নং আয়তা পর্যন্ত পাঠ করে শুনালেন। আমার মা তখন আমাকে বললেনঃ ‘ওঠো, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুকরিয়া আদায় কর।’ আমি বললামঃ আমি না উনার শুকরিয়া আদায় করবো, আর না আপনাদের দুইজনের। আমি তো আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি আমার নির্দোষিতা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত নাযিল করেছেন। আপনারা তো এই মিথ্যা অভিযোগকে অসত্য বলেও ঘোষনা করেন নি।

হযরত ‘আয়িশার (রা) বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিন করা হয়েছিল, আল-কুরআনের ভাষায় তাকে ‘আল-ইফক’ বলা হয়েছে। এই শব্দ দ্বারা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার তরফ হতে এই অভিযোগের পরিপূর্ণ প্রতিবাদ করা হয়েছে। ‘ইফক’ শব্দের অর্থ মূল কথাকে উল্টিয়ে দেওয়া, প্রকৃত সত্যের বিপরীত যা ইচ্ছা বলে দেওয়া। এই অর্থের দৃষ্টিতে এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও মনপড়া কথা-অর্থে ব্যবহৃত হয়। কোন অভিযোগ সম্পর্কে শব্দটি প্রযোগ হলে তার অর্থ হয়, সুস্পষ্ট মিথ্যা অভিযোগ, মিথ্যা দোষারোপ।

হযরত ‘আয়িশার (রা) নির্দোষিতা ঘোষণা করে কুরআনের আয়াত নাযিল হওয়ার পর সুষ্পষ্ঠভাবে মিথ্যা দোষারোপ করার অভিযোগে দুইজন পুরুষ ও একজন নারীর উপর ‘হদ’ (নির্ধারিত শাস্তি) জারি করা হয়। তাঁরা হলেনঃ মিসতাহ ইবন উসাসা, কবি হাসসান ইবন সাবিত ও হামনা বিনত জাহাশ (রা)।

তায়াম্মুমের আয়াত নযিলের ঘটনা

আল্লাহ পাক হযরত ‘আয়িশাকে (রা) উপলক্ষ্য করে মানবজাতিকে বহুবিধ কল্যাণের পথ দেখিয়েছেন। ‘ইফকূ কে কেন্দ্র করে মানব সমাজে যৌনাচার ও অশ্লীলতা থেকে পবিত্র রাখার জন্য অনেকগুলি বিধি নিষেধ ও দন্তবিধি ঘোষণা করেছেন। তেমনি পাক-পবিত্র হওয়ার জন্য পানির বিকল্প হিসেবে তায়াম্মুমের সুযোগও তাঁকেই কেন্দ্র করে দান করেছেন। এখানে সে সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা বলে মনে করি।

একবার আর এক সফরে ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সংগে ছিলেন। ইবন সা‘দের মতে, এটাও ছিল ‘আল-মুরাইসী’ যুদ্ধ-সফরের ঘটনা। সেই একই হার এবারও তাঁর গলায় ছিল। কাফেলা যখন ‘জাতুল জাইশ’ অথবা আল-বায়দা নামক স্থানে পৌঁছে, তখন হারটি গলা থেকে আবার ছিঁড়ে কোথায় পড়ে যায়। পূর্বের ঘটনায় তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান হয়েছিল। তাই এবার সাথে সাথে ব্যাপারটি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবহিত করেন। সময়টি ছিল প্রভাত হওয়ার কাছাকাছি। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাত্রা বিরতির নির্দেশ সৈন্যরা যেখানে তাঁবু গেঁড়েছিল সেখানে বিন্দুমাত্র পানি ছিল না। এ দিকে ফজরের নামাযের সময় হয়ে গেল। লোকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে হযরত আবু বকরের (রা) নিকট ছুটে গিয়ে বললো, ‘আয়িশা (রা) সৈন্য বাহিনীকে কী বিপদের মধ্যে ফেলে দিল। আবু বকর (রা) তখন সোজা ‘আয়িশা (রা) কাছে দৌঁড়ে গেলেন। দেখলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) হাঁটুর উপর মাথা রেখে একটু আরাম করছেন। আবু বকর (রা) উত্তেজিত কণ্ঠে মেয়েকে বললেন, তুমি সব সময় মানুষের জন্য নতুন নতুন মুসীবত ডেকে আন। এ কথা বলে তিনি রাগে-ক্ষোভে মেয়ের পাঁজবে কয়েকটি খোঁচা মারেন। কিন্তু ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরামের ব্যাঘাত হবে ভেবে একটুও নড়লেন না।

এদিকে সকাল হলো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুম থেকে জেগে সবকিছু অবগত হলেন। ইসলামী বিধি-বিধানের এ এক বৈশিষ্ট্য যে, সর্বদা তা উপযুক্ত সময়ে অবতীর্ণ হয়েছে। ইসলামে এর আগে নামাযের জন্য ওযু ফরয ছিল। কিন্তু এই ঘটনার সময় পানি না পাওয়া গেলে কি করতে হবে, সে সম্পর্কে করণীয় কর্তব্য বলে দিয়ে নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হলঃ

‘‘আর যদি তোমরা অসুস্থ হয়ে থাক কিংবা সফরে থাক অথবা তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি প্রস্রাব-পায়খানা থেকে এসে থাকে কিংবা নারী-গমনকরে থাকে, কিন্তু পারে যদি পানি না পায়, তবে পাক-পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করেনাও। তাতে তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল ও হাতকে ঘষে নাও। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমাশীল।’’ (আন-নিসাঃ ৪৩)

মূলত তায়াম্মুমের হুকুম একটি পুরষ্কার বিশেষ-যা এ উম্মাতেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলার কতই না অনুগ্রহ যে, তিনি ওযু-গোসল প্রভৃতি পবিত্রতার নিমিত্তে এমন এক বস্তুকে পানির স্থালাভিষিক্ত করে দিয়েছেন, যার প্রাপ্তি পানি অপেক্ষাও সহজ। আর এ সহজ ব্যবস্থাটি পূর্ববর্তী কোন উম্মাতকে দান করা হয়নি, একমাত্র উম্মাতে মুহাম্মদীকেই দান করা হয়েছে।

যা হোক, মুসলিম মুজাহিদদের আবেগ-উত্তেজনায় টগবটে দলটি-যারা তখন পানি না পাওয়ার জন্য নিজেদেরকে বিপদগ্রন্থ মনে করছিল, আল্লাহর এ রহমত লাভে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। হযরত উসাউদ ইবন হুদাউর-যিনি একজন বড় মাপের সাহাবী ছিলেন, আবেগ ভরে বলে উঠলেনঃ‘ওহে আবু বকর সিদ্দীকের পরিবারবর্গ! ইসলামের এটাই আপনাদের প্রথম কণ্যাণ নয়।

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, উসাইদ ইবন হুদাইর ‘আয়িশাকে (রা) লক্ষ্য করে বলেনঃ ‘আল্লাহ আপনাকে ভালো প্রতিদান দিন! আপনার উপর যখনই কোন বিপদ এসেছে- যা আপনি পছন্দ করেন না, তখনই আল্লাহ তার মাধ্যমে আপনার ও মুসলমানদের জন্য কোন না কোন কল্যাণ দান করেছেন।

হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা) যিনি কিছুক্ষণ আগেই প্রিয়তমা কন্যাকে শিক্ষাদানের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, গর্বের সাথে এখন তিনি সেই কন্যাকে সন্বোধন করে বলছেনঃ ‘আমার কলিজার টুকরা! আমার জানা ছিল না যে, তুমি এতখানি কল্যাণময়ী। তোমার অসীলায় আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহকে এতখানি বরকত ও আসানী দান করেছেন।

উল্লেখ্য যে, ‘আয়িশা (রা) এই হারটি বোন আসমার (রা) নিকট থেকে পরার জন্য ধার নিয়েছিলেন। এরপর কাফেলা চলার জন্য যখন ‘আয়িশার (রা) উটটি উঠানো হয় তখন সেই উটের নিচে হারটি পাওয়া যায়।

ঈলা বা তাখঈর-এর ঘটনা

রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) যুগল জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা অনেক। তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুইটি হলোঃ তাহরীম ও ঈলা বা তাখঈর-এর ঘটনা। তাহরীম হলো মধু সংক্রান্ত সেই ঘটনা যা হযরত হাফসার (রা) জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে। অপর ঘটনাটির প্রতি পূর্বে কোথাও কোথাও ইঙ্গিত করা হলেও বিশদ আলোচনা হয়নি, তাই এখানে বর্ণনা করা হলো।

এটা হিজরী ৯ম সন, মতান্তরে আহযাব ও বনু কুরাইজার সমসাময়িক কালের ঘটনা। তখন আরবের দূর-দূরান্তের ইসলামের বাণী ছড়িয়ে পড়েছিল। ইসলামের বাইতুল মালে প্রতিনিয়ত সম্পদ জমা হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিবারের লোকরা যে অভাব-অনটন ও মিতব্যয়িতার ভিতর দিয়ে চলছিলেন, তার কিছু ইঙ্গিত পূর্বেই এসে গেছে। খাইবার বিজয়ের পর যে পরিমাণ শস্যদানা ও খেরারমা খেজুর আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের সারা বছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল, তা ছিল খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া তাঁদের প্রত্যেকের ছিল অতিথি সেবার অভ্যাস ও দান-খায়রাতের হাত। এ কারণে তাঁদের জীবন যাপনের মান ছিল অতি নিম্ন পর্যায়ের। তাদের প্রতিটি দিন কাটতো অনাহার-অর্ধাহারে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ের আগে তাঁরা নিজের পিতৃপৃহে অথবা পূর্বের স্বামীর ঘরে অত্যন্ত বিলাসী জীবন যাপন করতেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতে অর্থ-সম্পদের আধিক্য দেখে তাঁরা একযোগে তাঁদের জন্য নির্ধারিত বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধির দাবি জানান।

এ কথা ‘উমারের (রা) কানে গেলে প্রথমে তিনি নিজের মেয়ে হাফসাকে (রা) এই বলে বুঝালেন যে, তুমি তোমার জীবিকার পরিমাণ বৃদ্ধির দাবী জানাচ্ছো। তোমার যা প্রয়োজন হয় আমার কাছেই চাইতে পার। তারপর হযরত ‘উমার (রা) এক এক করে উম্মাহাতুল মুমিনীনের প্রত্যেকের দরজায় যেয়ে তাঁদেরকে বুঝান। হযরত উম্মু সালামা বলেনঃ উমার! আপনি তো প্রতিটি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেই থাকেন, এখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করা আরম্ভ করলেন।’ একথা শুনে উমার (রা) অপমাণিত হয়ে চুপ হয়ে গেলেন।’

একদিন আবু বকর ও উমার (রা) দু’জন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট উপস্থিত হয়ে দেখলেন, রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘিরে তাঁর স্ত্রীরা বসে আছেন এবং তাঁদের জীবিকার পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য তাঁকে চাপচাপি করছেন। উভয়ে নিজ নিজ মেয়ে-আয়িশা ও হাফসাকে মারতে উদ্যত হলেন। তখন তাঁরা এই অঙ্গীকার করে আপন আপন পিতার হাত থেকে রক্ষা পেলেন যে, আগামীতে তাঁরা আর জীবিকা বৃদ্ধির দাবী জানিয়ে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কষ্ট দেবেন না।

অন্য স্ত্রীরা তাঁদের দাবীর উপর অটল থাকলেন ঘটনাক্রমে এই সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান এবং পাঁজরে গাছের একটি মূলের সাথে ধাক্কা লেগে আহত হন।

হযরত ‘আয়িশার (রা) হুজরা সংলগ্ন আর একটি ঘর ছিল যাকে ‘আল-মাশরাবা বলা হতো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানেই অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, আগামী এক মাস কোন স্ত্রীর কাছেই যাবেন না। এই ঘটনাটি মুনাফিকরা প্রচার করে দেয় যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সকল স্ত্রীকে তালাক দান করেছেন। একথা শুনে সাহাবা-ই-কিরাম মসজিদে সমবেত হন। ঘরে ঘরে একটা অস্থিরতার ভাব বিরাজ করতে থাকে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধর্মিণীরা কান্নাকাটি শুরু করে দেন। সাহাবীদের মধ্যে থেকে কেউই রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট থেকে ঘটনাটির সত্যতা যাচাইয়ের সাহস করলেন না।

হযরত উমার (রা) খবর পেয়ে-মসজিদে নববীতে এসে দেখলেন, সাহাবায়ে কিরাম বিমর্ষ অবস্থায় চুপচাপ বসে আছেন। তিনি রাসূলে পাকের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে দুইবার কোন সাড়া পেলেন না। তৃতীয় বারের মাথায় অনুমতি পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি চৌকির উপর শুয়ে আছেন, তাঁর পবিত্র দেহে মোটা কম্বলের দাগ পড়ে গেছে। উমার (রা) ঘরের চার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখলেন, সেখানে কয়েকটি মাটির পাত্র ও শুকনো মাশক ছাড়া আর কোন জিনিস নেই। এ অবস্থা দেখে উমারের (রা) চোখে অশ্রু নেমে এলো। তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি আপনার স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন? জবাব দিলেনঃ না। উমার বললেনঃ আমি কি এ সুসংবাদ মুসলমানদের মধ্য প্রচার করে দিব? রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুমতি পেয়ে উমার (রা) গলা ফাটিয়ে আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে ওঠেন।

এই মাসটি ছিল ২৯ দিনের। আয়িশা (রা) বলেনঃ আমি একটি একটি করে দিন গুণতাম। ২৯ দিন পূর্ণ হলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।’ রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বপ্রথম আয়িশা (রা) ঘরে যান। তিনি আরজ করেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তো এক মাসের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আজ তো উনত্রিশ দিন হলো। তিনি বললেনঃ কোন মাস ২৯ দিনেও হয়।

যেহেতু আযওয়াজে মুহাহ্হারাত জীবন-যাপনের মান বৃদ্ধির দাবীদার ছিলেন অন্যদিকে নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধর্মিণীদের সন্তুষ্টির জন্য পার্থিব ভোগ-বিলাস দ্বারা নিজেকে কলুষিত করতে পারেন না। এই জন্য আল্লাহ তা‘আলা ‘তাখঈর’-এর আয়াত নাযিল করেন। ‘তাখঈর’ অর্থ ইখতিয়ার ও স্বাধীনতা দান করা। অর্থাৎ স্ত্রীদের মধ্যে যাঁর ইচ্ছা দরিদ্র্য ও অভাব-অনটর মেনে নিয়ে আল্লাহর রাসূলের সাথে সংসার ধর্ম পালন করেন। আর যাঁর ইচ্ছা তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। আয়াতটি নিম্নে উদ্ধৃত হলোঃ

‘‘হে নবী! তোমাদের স্ত্রীদের বলঃ তোমরা যদি দুনিয়া ও তার চাকচিক্যই পেতে চাও তবে এসো, আমি তোমাদের কিছু দিয়ে ভালোভাবে বিদায় করে নিই। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ও পরকালে ঘর পেতে চাও, তবে জেনে রাখ তোমাদের মধ্যে যারা নেককার, তাদের জন্য আল্লাহ বিরাট পুরষ্কার নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।’’ (আল আহযাব :২৯)

মুসলিম শরীফে উল্লেখিত হাদীসে হযরত জাবির ইবন ‘আবদিল্লাহ (রা) সেই সময়কার ঘটনা বর্ণনা করে বলেছেন যে, একদিন হযরত আবু বকর ও হযরত ‘উমার (রা) নবী কারীমের (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খিদমতে হাজির হয়ে দেখতে পেলেন যে, হযরতের পত্মীগণ তাঁর চারপাশে বসে আছেন, আর রাসূলও (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চুপচাপ বসে আছেন। তিনি হযরত ‘উমারকে (রা) লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমরা দেখছো, এরা আমার চারপাশে বসে আছে; আসলে এরা আমার নিকট খরচের টাকা চাচ্ছে।’ এই কথা শুনে উভয় সাহাবী নিজ নিজ কন্যাকে খুব করে শাসিয়ে দিলেন এবং তাঁদেরকে বললেনঃ ‘তোমরা রাসূলে কারীমকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কষ্ট দিচ্ছ এবং তাঁর নিকট এমন জিনিস চাচ্ছো যা তাঁর নিকট নেই।’ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, মারতে উদ্যত হলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদেরকে থামালেন। বস্তুত তখন নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে কতদূর আর্থিক অনটনের মধ্যে ছিলেন, তা উপরোক্ত ঘটনা হতে স্পষ্ট জানা যায়।

এই আয়াত যখন নাযিল হলো, তখন নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বপ্রথম হযরত ‘আয়িশার (রা) সাথে কথা বললেনঃ ‘তোমাকে একটি কথা বলছি।, খুব তাড়াতাড়ি করে জবাব দিও না। তোমার পিতা-মাতার মতামত জেনে নাও।’ তারপর নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে উল্লেখিত আয়াতটি পাঠ করে শোনালেন এবং বললেন, আল্লাহর নিকট থেকে এই হুকুম এসেছে। সাথে সাথে হযরত ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ এবিষয়ে আমার বাবা-মার নিকট কি জিজ্ঞেস করবো? আমি তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং পরকালের সাফল্যই চাই। ‘আয়িশার (রা) এমন জবাবে রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দারুণ খুশী হলেন। তিনি বললেনঃ বিষয়টি যেভাবে তোমার নিকট উপস্থাপন করেছি সেভাবে তোমার অন্য সতীনদের নিকটও করবো। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ অনুগ্রহ করে আপনি আমার সিদ্ধান্তের কথাটি অন্য কাউকে জানাবেন না। কিন্তু রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সে অনুরোধ রাখেননি। তিনি যেভাবে ‘আয়িশাকে (রা) কথাটি বলেছিলেন, ঠিক সইভাবে তাঁর সতীনদেরকেও বলেন। সাথে সাথে এ কথাটিও বলে দেন যে, ‘আয়িশা (রা) আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আখিরাতকে গ্রহণ করেছে। তাঁদের প্রত্যেকেই ‘আয়িশার (রা) মত একই জবাব দেন। সীরাতের গ্রন্থসমূহে এই ঘটনা ‘তাখঈর’ নামে অভিহিত হয়েছে। ‘তাখঈর’ অর্থ ইখতিয়ার দান করা। স্ত্রী স্বামীর সাথে থাকবে, নাকি তাঁর নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে-এই দুইটির কোন একটি গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণকরার ইখতিয়ার স্ত্রীকে অর্পণ করা।

সাইয়েদ আবুল আ‘লা মাওদূদী (রহ) ইবনুল ‘আরাবীর আহকামুল কুরআনের সূত্রে বলেছেনঃ ‘তাখঈর’ এর আয়াত নাযিল হওয়ার সময় হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারজন বেগম বর্তমান ছিলেন। তাঁরা হলেনঃ হযরত সাওদা (রা), হযরত ‘আয়িশা (রা), হযরত হাফসা (রা) ও হযরত উম্মু সালামা (রা)। তবে আল্লামা ইবন কাসীর হযরত ‘ইকরিমার (রা) সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, সেই সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মোট নয়জন বেগম ছিলেন। পাঁচজন কুরাইশ খান্দানের-‘আয়িশা, হাফসা, উম্মু হাবীবা, সাওদা ও উম্মু সালামা (রা) এবং অন্যরা হলেন-সাফিয়্যা, মাইমুনা, জুওয়াইরিয়া ও যয়নাব ইবনে জাহাশ আল-আসাদিয়্যা (রা)। ঘটনার সময়কাল নিয়ে মতভেদের কারণে এই পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে।

হযরত আয়িশা (রাঃ) এর ১২ পর্বের পুরো জীবনী পড়ুন-



****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url