সাহাবাগণের জীবনকথা-২৪ || হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর জীবনী (৮ম পর্ব)






হযরত আয়িশা (রা)-এর জীবনী ৮ম পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

আয়িশা (রা) এর দৈহিক আকৃতি ও পোশাক-পরিচ্ছদ

হযরত ‘আয়িশা (রা) ছিলেন খুব দ্রুত বেড়ে ওঠা মেয়েদের একজন। নয়-দশ বছর বয়সে তিনি বেশ বেড়ে উঠেছিলেন। ছোটবেলায় একেবারেই হালকা-হাতলা ছিলেন। কিছু বয়স হলে শরীর কিছুটা ভারী হয়ে যায়। গায়ের বর্ণ ছিল সাদা লালের মিশ্রণ। উজ্জ্বল চেহারা ও সৌন্দর্যের অদিকারিণী ছিলেন। এ কারণে তাঁকে আল-হুমায়রা বলা হতো।

মিতব্যয়িতা ও অল্পেতুষ্টির কারণে মাত্র এক জোড়া পরিধেয় বস্ত্র রাখতেন। তাই একখানা ধুয়ে অন্যখানা পারতেন। একটি জামা ছিল, যার মূল্য পাঁচ দিরহামের মত হবে। কিন্তু তা সেই আমলে এত মূল্যবান ছিল যে, বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠানে কনেকে সাজানোর জন্য চেয়ে নেওয়া হতো। কখনো কখানো জাফরান দিয়ে রাং করা কাপড় পড়তেন, আবার মাঝে মধ্যে অলঙ্কারও পরতেন। ইয়ামনের তৈরি সাদা-কালো মোতির একটি বিশেষ ধরনের হার গলায় পরতেন। আঙ্গুলে সোনার আংটি পরতেন। কাসিম ইবন মুহাম্মাদ বর্ণনা করেন, ‘আমি হযরত ‘আয়িশাকে (রা) ইহরাম অবস্থায় সোনার আংটি এবং হলুদ বর্ণের পোশাক পরতে দেখেছি।’ মাঝে মাঝে একটি রেশমী চাঁদরও ব্যবহার করতেন। পরে সেটি ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরকে দান করেন।

পোশাকে ব্যাপারে শরীয়াতের বিধিবিধানের প্রতি অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। একবার ভাতিজী হাফসা বিনত ‘আবিদর রহমান মাথায় একটি পাতলা ওড়না দিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি সেটা নিয়ে ফেঁড়ে ফেলেন এবং বলেন, তুমি জান না, আল্লাহ তা’য়ালা সূরা নূর-এ কি বলেছেন। তারপর একটি পুরু ওড়না আনিয়ে তাকে দেন। একবার তিনি এক বাড়িতে মেহমান হিসাবে অবস্থান করেন। গৃহকর্তার বাড়ন্ত বয়সের দুইটি মেয়ে ছিল। তিনি দেখলেন, চাঁদর ছাড়াই তারা নামায পড়ছে। তিনি তাকিদ দিয়ে বললেন, ভবিষ্যতে আর কোন মেয়ে চাদর ছাড়া নামাজ না পড়ে।

আয়িশা (রা) এর অভ্যাস ও চারিত্রিক গুণাবলী

উম্মূল মু’মিনীন হযরত ‘আয়িশার (রা) শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত সময়কাল এমন এক পবিত্র ব্যাক্তি-সত্তার সাহচর্যে কাটে, এই ধরাধামে যাঁর আগমন ঘটেছিল মহোত্তম নৈতিকতার পূর্ণতা বিধানের জন্য। এই সাহচর্য তাঁকে নৈতিকতার এমন আদর্শ স্তরে পৌঁছে দেয় যা আধ্যান্তিক উন্নতির চূড়ান্ত পর্যায় বলে বিবেচিত। সুতরাং তাঁর নৈতিকতার মান ছিল অতি উঁচুতে। তাঁর হৃদয় ছিল অতি প্রশস্ত। তাছাড়া তিনি ছিলেন দানশীল, মিতব্যয়ী, ইবাদাতকারিণী এবং দয়াময়ী।

নারী ও অল্পে তুষ্টি-এ যেন পরস্পর বিরোধী দুইটি বিষয়। হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আমি দোযখে সবচেয়ে বেশি মহিলাদেরকে দেখেছি। এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলো। বললেন, স্বামীদের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করা এর কারণ। তবে হযরত ‘আয়িশার (রা) সত্তায় এই দুইটি গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি তাঁর বৈবাহিক জীবন প্রচন্ড অভাব ও দারিদ্রের মধ্যে অতিবাহিত করেছেন, কিন্তু কখনো অভিযোগের একটি বর্ণও জিহবায় আনেননি। সুন্দর সুন্দর পোশাক, মূল্যবান অলঙ্কার, আলীশান ইমারাত, মুখরোচক খাদ্য সামগ্রী-এর কোন কিছুই তিনি স্বামীর ঘরে পাননি। অথচ তিনি প্রতক্ষ্য করেছেন যে, গণীমাতের অর্থ-সম্পদ প্লাবনের মত একদিকে আসছে আর অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও তা থেকে কিছু পাওয়ার বিন্দুমাত্র লোভ ও ইচ্ছা কখনো তাঁকে পেয়ে বসেনি। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওফাতের পরে একবার তিনি খাবার আনতে বলেন। তারপর বলেন, কখনো আমি পেট ভরে খাইনে। যাতে আমার কান্না না পায়। তাঁর এক শাগরিদ জিজ্ঞেস করলো, কেন? বললেন, আমার সেই অবস্থার কথা মনে পড়ে যায়, যে অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে যান। আল্লাহর কসম! দিনে দুইবার কখনো তিনি পেট ভরে রুটি ও গোশত খাননি!

আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে সন্তান থেকে মাহরুম করেছিলেন। তবে তিনি সাধারণ মুসলমিদের সন্তানদেরকে, বিশেষতঃ ইয়াতীমদেরকে এসে প্রতিপালন করতেন। তাদেরকে শিক্ষা দিতেন এবং তাদের বিয়ে-শাদী দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন।

স্বামী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্ণমাত্রায় আনুগত্য করা এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টাই ছিল হযরত ‘আয়িশার (রা) প্রতি মুহূর্তের চিন্তা ও কাজ। তাঁর চেহারা সামান্য মলিন ও বিমর্ষ দেখলে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আত্নীয়-স্বজনদের প্রতি এত যত্নবান ছিলেন যে তাঁদের কোন কথা উপেক্ষা করতেন না। একবার বোনের ছেলে ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর খালার সীমাহীন দানশীলতা দেখে শংকিত হয়ে পড়েন এবং বলেন, এখন তাঁর হাত থামানো দরকার। এ কথায় হযরত ‘আয়িশা (রা) এতই রেগে যান যে, ‘আবদুল্লাহর সাথে কথা না বলার কসম করে বসেন। কিন্তু যখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাতুল গোত্রের লোকেরা সুপারিশ করলো তখন তিনি আর প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বন্ধুদেরকেও তিনি অতি সমাদর ও সম্মান করতেন এবং তাঁদের কোন কথাও উপেক্ষা করতেন না। যথাসম্ভব কারো কোন হাদিয়া-তোহফা ফিরিয়ে দিতেন না।

মুহাম্মদ ইবন আশ’য়াস (রা) ছিলেন একজন সাহাবী। একবার তিনি হযরত ‘আয়িশাকে (রা) একটি পোস্তীন (চামড়ার তৈরি জামা) হাদিয়া দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং বলেন, এটি গরম, আপনি পরবেন। হযরত ‘আয়িশা (রা) গ্রহণ করতে রাজি হন এবং প্রায়ই সেটি পরতেন।

আয়িশা (রা) এর পর্দানশীলতা

আয়াতে হিজাব’ নাযিলের পর থেকে কঠোরভাবে পর্দা পালন করতেন। ইসহাক নামে একজন অন্ধ তাবে’ঈ ছিলেন। একবার তিনি এলেন দেখা করতে। হযরত ‘আয়িশা (রা) পর্দা করলেন। ইসহাক বললেন, আপনি আমার থেকে পর্দা করছেন! আমি তো আপনাকে দেখতে পাইনে। তিনি বললেন, তুমি আমাকে দেখতে পাওনা তাতে কি হয়েছে, আমি তো আমাকে দেখতে পাচ্ছি। একবার হজ্জের সময় অন্য মহিলারা বললেন, উম্মূল মুমিনীন! চলুন, হাজারে আসওয়াদে চুমু দেবেন। বললেনঃ তোমরা যেতে পার। আমি পুরুষদের ভিড়ের মধ্যে যেতে পারিনে। কখনও দিনের বেলায় তাওয়াফের প্রয়োজন হলে কা’বার চত্বর থেকে পুরুষদের সরিয়ে দেওয়া হতো। শরীয়াতে মৃতদের থেকে পর্দার হুকুম নেই। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারেও অতিমাত্রায় সতর্ক ছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাশে ‘উমারকে (রা) দাফন করার পর, সেখানে পর্দা ছাড়া যেতেন না।

অন্যদের প্রতি আয়িশা (রা) এর সুধারণা

হযরত ‘আয়িশা (রা) কক্ষনো কারো গীবত করতেন না বা কালো সম্পর্কে কোন অশোভন উক্তিও না। তাঁর বহু কথা হাদীসের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তার একটিতেও কোন মানুষের প্রতি খারাপ উক্তি বা কারো সম্মানহানি ঘটে এমন একটি কথাও পাওয়া যায় না। সতীনের নিন্দামন্দ করা নারীদের অনেকেরই স্বভাব। কিন্তু তিনি সতীনদের কেমন উদারচিত্তে প্রশংসা করতেন তা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। কবি হযরত হাসসান ইবন (রা), যিনি ইফক-এর এর ঘটনায় জড়িয়ে হযরত ‘আয়িশার (রা) দুঃখকে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তিনিও হযরত ‘আয়িশার (রা) মজলিসে আসতেন এবং তিনি খুব হৃষ্টচিত্তে তাঁকে বসার অনুমিত দিতেন। একদিন হযরত হাসসান (রা) এসে তাঁর শানে রচিত একটি কাসীদা শুনাতে শুরু করেন। যার একটি শ্লোকের অর্থ ছিল এরূপ-

শ্লোকটি শুনতেই হযরত ‘আয়িশার (রা) বহু পূর্বের সেই ইফক-এর ঘটনা স্মরণ হলো। তারপর তিনি শুধু এতটুকু মন্তব্য করলেন যে, ‘কিন্তু আপনি এমন নন। হযরত আয়িশার (রা) প্রিয়জনদের অনেকে তাঁর দরবারে হযরত হাসসানের (রা) এভাবে উপস্থিতি সহজে মেনে নিতে পারতেন না। তাঁরা অনেক সময় হাসসানকে (রা) কটু কথা শুনাতে চাইতেন কিন্তু হযরত ‘আয়িশা (রা) অত্যন্ত শক্তবাবে নিষেধ করতেন। হযরত মাসরূক (রহ) বলেন, ‘একবার আমি উম্মূল মু’মিনীনকে বললাম, আপনি এভাবে তাঁকে আপনার কাছে আসার অনুমতি দেন কেন? বললেন, এখন সে অন্ধ হয়ে গেছে। আর অন্ধত্বের চেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে! তাছাড়া সে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পক্ষ থেকে মক্কার পৌত্তলিক কবিদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের জবাব দিত।’

একবার এক ব্যক্তির আলোচনা চলছিল। প্রসঙ্গক্রমে হযরত ‘আয়িশা (রা) সেই ব্যক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা প্রকাশ করলেন না। লোকেরা বললোঃ উম্মূল মুমিনীন! সেই ব্যক্তি তো মারা গেছে। একথা শুনতেই তিনি তার মাগফিরাত কামনা করে দু’আ করতে শুরু করলেন। লোকেরা তখন বললো, আপনি তো এইমাত্র তাকে ভালো বলেননি, আর এখন তার মাগফিরাত কামনা করে দু‘আ করছেন। জবাবে তিনি বললেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা মৃতদের সম্পর্কে শুধু ভালো কথাই বলবে।

আয়িশা (রা) ছিলেন নিরহঙ্কারী

অহংকারের লেশমাত্র তাঁর মধ্যে ছিল না। নিজেকে অতি সাধারণ ও তুচ্ছ মনে করতেন। কেউ তাঁর মুখের উপর প্রশংসা করুক তা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। এ প্রসঙ্গে অন্তিম শয্যায় হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আববাসের (রা) সাথে তাঁর আচরণটি আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। চূড়ান্ত পর্যায়ের বিনয়ী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে আত্মমর্যাদবোধ ছিল পূর্ণমাত্রায়। তাই স্বামী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে তাঁর কোন কোন আচরণ প্রেয়সীর মান-অভিমানের রূপ নিত। যেমন, ইফক-এর ঘটনায় যখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর নির্দোষ বিষয়ক আয়াত পাঠ করে শোনান এবং মা বলেন, মেয়ে স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। তখন তিনি যে জবাব দেন, তাতে একদিকে প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি প্রিয়তমের নিকট অভিমানের এক চমৎকার দৃশ্য ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু আমার পরোয়ারদিগারের শুকরিয়া আদায় করবো, অন্য কারো নয়- যিনি আমাকে আমার নির্দোষিতা ও পবিত্রতার ঘোষণা দিয়ে সম্মানিত করেছেন। তাছাড়া আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, যখন তিনি স্বামীর প্রতি ক্ষুব্ধ হতেন তখন তাঁর নাম নিয়ে কসম খাওয়া ছেড়ে দিতেন। এ সবই ছিল প্রেয়সীর মান-অভিমানের এক অনুপম দৃশ্য।

আয়িশা (রা) এর আত্মমর্যাদা

আমরা তাঁর আত্মমর্যাদাবোধের চূড়ান্ত রূপ দেখতে পাই অপর একটি ঘটনায়। যে ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরকে (রা) তিনি মাতৃস্নেহে লালন পালন করেন, আর তিনিও খালা ‘আয়িশাকে (রা) মায়ের মত সম্মান ও সেবা করতেন। তিনি খালার সীমাহীন দানের হাত দেখে একবার মন্তব্য করে বসেন, এখন তাঁর হাতে বাঁধা দেওয়া উচিত। তাঁর এমন মন্তব্যে হযরত ‘আয়িশার (রা) আত্মসম্মান বোধ আহত হয়। তিনি কসম খেয়ে বলেন, ভাগ্নের কোন জিনিসিই আর স্পর্শ করবেন না। ভাগ্নে ‘আবদুল্লাহ (রা) পড়ে গেলেন মহা বিপদে। অবশেষে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সুপারিশ ও মধ্যস্থতায় তিনি সদয় হন।

হযরত ‘আয়িশার (রা) মধ্যে প্রবল আত্মমর্যদাবোধ ও ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে তীক্ষ্ণ ন্যায়বোধও ছিল। একবার মিসরের এক ব্যক্তি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। তিনি লোকটির নিকট জানতে চাইলেন, যুদ্ধের ময়দানে তথাকার তৎকালীন শাসকদের আচরণ তাদের সাথে কেমন হয়ে থাকে। লোকটি জবাবে বললেন, প্রতিবাদ করার মত তেমন কোন আচরণ তাঁদের দৃষ্টিতে পড়েনা। কারো উট মারা গেলে তিনি তাকে অন্য একটি উট দেন, কারো চাকর না থাকলে চাকর দেন, কারো খরচের অর্থের প্রয়োজন হলে তার সে প্রয়োজন পূরণ করেন। তাঁর এ জবাব শুনে হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেন, মিসরবাসীরা আমার ভাই মুহাম্মদ ইবন আবী বকরের সাথে যত খারাপ আচরণ করুক না কেন, তাদের সেই খারাপ আচরণ তোমাদের কাছে আমাকে এ সত্য কথাটি বলতে বিরত রাখতে পারে না যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার এই ঘরের মধ্যেই দু‘আ করেছিলেন- ‘হে আল্লাহ! যে আমার উম্মাতের উপর কঠোরতা করে তুমিও তার উপর কঠোরতা কর, আর যে সদয় হবে, তুমিও তার প্রতি সদয় হও।

আয়িশা (রা)-এর দানশীলতা

হযরত ‘আয়িশা (রা) ছিলেন দানের ক্ষেত্রে খুবই দরাজ হস্ত। অন্তরটাও ছিল অতি উদার ও প্রশস্ত। বোন হযরত আসমাও (রা) ছিলেন খুবই দানশীল। দুই বোনের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল দানশীলতা। ‘আবদুল্লাহ ইবন যবাইর (রা) বলেন, তাঁদের দুইজনের চেয়ে বড় দানশীল ব্যক্তি আর কাউকে দেখিনি। তবে দুইজনের মধ্যে পার্থক্য এই ছিল যে, হযরত ‘আয়িশা (রা) অল্প অল্প করে জমা করতেন। যখন কিছু জমা হয়ে যেত, তখন সব এক সাথে বিলিয়ে দিতেন। আর হযরত আসমার (রা) অবস্থা ছিল, হাতে কিছু এলে জমা করে রাখতেন না, সাথে সাথে বিলিয়ে দিতেন। অধিকাংশ সময় তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পরতেন। বিভিন্ন জনের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতেন। লোকেরা যখন বলতো, আপনার এত ঋণ করার প্রয়োজন কি? তিনি বলতেন, ঋণ পরিশোধের যার ইচ্ছা থাকে আল্লাহ তাতে সাহায্য করেন। আমি আল্লাহর এই সাহায্য তালাশ করি। তিনি দান-খয়রাতের ব্যাপারে কম-বেশির চিন্তা করতেন না। হাতে যা কিছু থাকতো তাই দিয়ে দিতেন। একবার এক মহিলা ছোট ছোট দুই বাচ্চা কোলে করে এসে কিছু সাহায্য চায়। ঘটনাক্রমে সেই সময় তাদেরকে দেওয়ার মত ঘরে কিছুই ছিল না। খুঁজে খুঁজে একটি মাত্র খেজুর পেলেন। সেটি দুই ভাগ করে বাচ্চা দুইটির হাতে দিলেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে এলে তাঁকে ঘটনাটি শুনালেন। আর একবার এক ভিক্ষুক এসে সাহায্য চাইলো। হযরত ‘আয়িশার (রা) সামনেই ছিল কিছু আঙ্গুরের দানা। সেখান থেকে তিনি একটি দানা নিয়ে ভিক্ষুকের হাতে তুলে দেন। ভিক্ষুক দানাটির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে দেখতে থাকে যে, একটি দানা কি কেউ কারো হাতে দেয়! তখন তিনি ভিক্ষুককে লক্ষ্য করে বলেন, দেখ, এই একটি দানার মধ্যে কত দানা রয়েছে। মূলত তিনি সূরা যিলযাল-এর এই আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করেন, “যে ব্যাক্তি একটি অণু পরিমাণ নেক কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে।”

হযরত ‘উরওয়া (রা) বর্ণনা করেন, একবার হযরত ‘আয়িশা (রা) তাঁর সামনে পুরো সত্তর হাজার দিরহাম এক সাথে আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিয়ে চাঁদরের কোণা ঝেড়ে ফেলেন।হযরত আমীর মু‘য়াবিয়া (রা) একবার এক লাখ দিরহাম হযরত ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠালেন। সন্ধ্যা হতে হতে একটি পয়াসও থাকলো না। সবই গরীব-মিসকনীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। ঘটনাক্রমে সেদিন তিনি রোযা ছিলেন। দাসী বললো, ইফতারীর খাদ্য-সামগ্রী কেনার জন্য কিছু রেখে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। বললেনঃ একথা যদি আগে স্মরণ করিয়ে দিতে। এ রকম ঘটনা আরো আছে। একবার হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা) বড় বড় দুইটি থলিতে ভরে এক লাখ দিরহাম পাঠালেন। তিনি সবগুলি একটি খাঞ্চায় ঢেলে বিলাতে শুরু করেন। সেদিও তিনি রোযা রেখেছিলেন। সন্ধ্যার সময় দাসীকে ইফতারী আনার জন্য বলেন। দাসী বলেন, উম্মূল মু’মিনীন! এই অর্থ দিয়ে কিছু গোশত ইফতারের জন্য আনাতে পারতেন না? বললেন, এখন তিরস্কার কারো না। তখন কেন স্মরণ করে দাওনি? একদিন তিনি রোযা আছেন। ঘরে একটি রুটি ছাড়া কিছুই নেই। এমন সময় এক মহিলা ভিক্ষুক এসে কিছু খাবার চায়। তিনি দাসীকে বলেন রুটিটি তাকে দিয়ে দিতে। দাসী বলেন, রুটি দিয়ে দিলে সন্ধ্যায় ইফতার করবেন কি দিয়ে? বললেন, এখন রুটিটি দিয়ে দাও তো তারপর দেখা যাবে। সন্ধ্যার সময় কেউ একজন খাসীর গোশত পাঠালো। তিনি দাসীকে বললেন, এই দেখ, তোমার রুটির চেয়েও ভালো জিনিস আল্লাহ পাঠিয়েছেন। নিজের থাকার ঘরটি তিনি আমীর মু’য়াবিয়ার (রা) নিকট বিক্রি করে যে অর্থ পান তা সবই আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দেন।

আয়িশা (রা) ছিলেন নির্ভীক ও সাহসী

স্বভাবগতভাবেই হযরত ‘আয়িশা (রা) ছিলেন নির্ভীক ও সাহসী। তাঁর জীবনের বহু ঘটনায় এ সাহসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। রাতে ঘুম থেকে জেড়ে একা একাই কবরস্থানে চলে যেতেন। যুদ্ধের ময়দানে এসে দাঁড়িয়ে যেতেন। উহুদ যুদ্ধে যখন মুসলিম বাহিনীতে অস্থিরতা বিরাজমান তখন তিনি পিঠে করে মশকভর্তি পানি নিয়ে আহত সৈনিকদের পান করিয়েছেন। খন্দক যুদ্ধের সময় যখন পৌত্তলিক বাহিনী চতুর্দিক থেকে মদীনা ঘিরে রেখেছিল এবং নগরীর ভিতর থেকে ইহুদীদের আক্রমণের আশঙ্কা ছিল তখনও তিনি নির্ভীক চিত্তে কিল্লা থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম মজাহিদদের যুদ্ধ কৌশল প্রত্যক্ষ করতেন। একবার তো তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট জিহাদে গমনের অনুমতি চেয়েই বসেন; কিন্তু অনুমতি পাননি। উটের যুদ্ধে তিনি যে দক্ষতার সাথে সৈন্য পরিচালনা করেন, তাতে তার স্বভাবগত সাহসিকতার চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায়।

আয়িশা (রা) এর আল্লাহ-ভীতি

হযরত ‘আয়িশার (রা) অন্তরে ছিল তীব্র আল্লাহ-ভীতি। অন্তরটিও ছিল অতি কোমল। খুব তাড়াতাড়ি কাঁদতে শুরু করতেন। বিদায় হজ্জের সময় যখন নারী প্রকৃতির কারণে হজ্জের কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে পারলেন না তখন নিজের দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে অকুলভাবে কান্না শুরু করেন। পরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সান্ত্বনায় স্থির হন। একবার তো দাজ্জালের ভয়ে অস্থির হয়ে কাঁদতে থাকেন। পরবর্তী জীবনে যখনই উটের যুদ্ধের কথা স্মরণ হতো, অস্থির হয়ে কাঁদতেন।

একবার কোন একটি কথার উপর কসম করে বসেন। পরে মানুষের পীড়াপীড়িতে কসম ভাংতে বাধ্য হন এবং কাফফরা হিসেবে ৪০টি দাস মুক্ত করেন। কিন্তু বিষয়টি তাঁর হৃদয়ে এত গভীর ছাপ ফেলে যে, যখনই স্মরণ হতো চোখের পানি মুছতে মুছতে আঁচল ভিজে যেত। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, ইফকের ঘটনায় তিনি মুনাফিকদের দোষারোপের কথা জানতে পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পিতামাতার সান্ত্বনা দান সত্ত্বেও চোখের পানি বন্ধ হচ্ছিল না।

একবার এক দরিদ্র মহিলা তার দুইটি ছোট্ট শিশুসন্তান নিয়ে কিছু সাহায্যের আশায় হযরত ‘আয়িশার (রা) নিকট আসে। তখন ঘরে তেমন কিছু ছিল না। তিনি তিনটি খেজুর মহিলার হাতে দেন। মহিলা একটি করে খেজুর তার দুই সন্তানের হাতে এবং একটি নিজের মুখে দেয়। সন্তান দুইটি নিজেদের খেজুর খেয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকাতে থাকে। তখন মহিলা নিজের মুখ থেকে খেজুর বের করে দুই ভাগ করে দুই সন্তানের মুখে দেয়। নিজে কিছুই খেল না। তিনি মাতৃস্নেহের এমন দুঃখজনক দৃশ্য এবং তার অসহায় অবস্থা দেখে ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে।

রাত-দিনের বেশিরভাগ সময় ইবাদাতে নিমগ্ন থাকতেন। চাশতের নামায নিয়মিত পড়তেন। বলতেন, আমার আববাও যদি কবর থেকে উঠে এসে এ নামায পড়তে বারণ করেন তুবুও আমি ছাড়বো না। রাতে ঘুম থেকে জেগে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে তাহাজ্জুদের নামায পড়তেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওফাতের পরও এই নামাযের এত পাবন্দি ছিলেন যে, সকাল সকাল উঠে ফজরের নামাযের পূর্বে পড়ে নিতেন। একদিন তিনি এ নামায আদায় করছেন, এমন সময় ভাতিজা কাসেম এসে উপস্থিত হন। তিনি প্রশ্ন করেনঃ ফুফু এ আপনি কোন নামায পড়ছেন? বললেনঃ রাতে আমি পড়তে পারিনি; কিন্তু এখন আমি ছেড়ে দিতে পারিনে।

তিনি বছরের অধিকাংশ সময় রোযা রাখতেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি সর্বদা রোযা অবস্থায় থাকতেন। একবার গরমকালে আরাফাতের দিনে রোযা রাখেন। গরম ও সূর্যের তাপ এত তীব্র ছিল যে, মাথায় পানির ছিটে দেওয়া হচ্ছিল। এ অবস্থা দেখে তাঁর ভাই ‘আবদুর রহমান (রা) ছিলেন, এই প্রচন্ড গরমে রোযা রাখার এত কি দরকার। ইফতার করে ফেলুন। বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখ থেকে শুনেছি যে, আরাফাতের দিনে রোযা রাখলে সারা বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তারপরেও আমি রোযা ভেঙ্গে ফেলবো?

অত্যন্ত কঠোরভাবে হজ্জের পাবন্দ ছিলেন। এমন বছর খুব কমই যেত, যাতে তিনি হজ্জ আদায় করতেন না। খলীফা হযরত ‘উমার (রা) তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে হযরত ‘উসমান (রা) ও ‘আবদুর রহমান ইবন ‘আওফকে (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধর্মিণীদের সাথে হজ্জে পাঠান। হজ্জের সময় তাঁদের অবস্থানের স্থানসমূহ নির্দিষ্ট ছিল। প্রথমে ওয়াদিনামির-এর শেষ প্রান্তে অবস্থান করতেন। সেখানে যখন মানুষের ভিড় হতে লাগলো তখন তার থেকে একটু দূরে আরাফ নামক স্থানে তাবু স্থাপন করতেন। কোনবার ‘জাবালে সাবীর’-এর পাদদেশে অবস্থান নিতেন। আরাফাতের দিন রোযা রাখতেন। মানুষ যখন আরাফা ছেড়ে চলতে শুরু করতো, তখন তিনি ইফতার করতেন।

আয়িশার (রা) দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ছিলেন

দাস-দাসীদের প্রতি খুবই সদয় ছিলেন। তিনি সুযোগ পেলেই নানা অজুহাতে দাস মুক্ত করতেন। একবার তো একটি মাত্র কসমের কাফফারায় চল্লিশজন দাস মুক্ত করে দেন। তাঁর মুক্ত করা দাস-দাসীর সংখ্যা সর্বমোট ৬৭ (সাতষট্টি) জন। তামীম গোত্রের একটি দাসী ছিল তাঁর। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখে তিনি শুনতে পান যে, এই গোত্রটি হযরত ইসমাঈলের (আ) বংশধর। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইঙ্গিতে তিনি দাসীটিকে মুক্ত করে দেন। মদীনায় বুরায়রা নাম্মী এক দাসী ছিলেন। তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে মুক্তি লাভের ব্যাপারে তাঁর মনিবের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। তারপর তিনি মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে থাকেন। সে কথা হযরত ‘আয়িশার (রা) কানে গেলে তিনি একাই সব অর্থ পরিশোধ করে তাঁকে মুক্ত করে দেন। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। লোকেরা বলতে লাগলো, কেউ হয়তো জাদু-টোনা করেছে। তিনি এক দাসীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জাদু করেছো? সে স্বীকার করলো। তিনি আবার পশ্ন করলেনঃ কেন? দাসীটি বললোঃ যাতে আপনি তাড়াতাড়ি মারা যান, আর আমি মুক্ত হই। হযরত ‘আয়িশা (রা) নির্দেশ দেন, তাকে একটি মন্দ লোকের নিকট বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে একটি দাস ক্রয় করে মুক্ত করে দাও। তাঁর এ নির্দেশ কাযকরী করা হয়। মুসতাদরিকে হাকেম-এর আত-তিবব অধ্যায়ে এসেছে যে, দাসীকে এ শাস্তি তিনি দিয়েছিলেন তার শরীয়াত বিরোধী কাজের জন্য।

দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্য তাদের মর্যাদা অনুযায়ী করা উচিত। হযরত ‘আয়িশা (রা) সর্বদা এদিকে দৃষ্টি রাখতেন। একবার একজন সাধারণ ভিক্ষুক তাঁর নিকট আসলো। তিনি তাকে এক টুকরো রুটি দিয়ে বিদায় করলেন। তারপর একটু ভালো কাপড়-চোপড় পরা একজন ভিক্ষুক আসলো। তাকে দেখে একজন মর্যাদাবান মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। তিনি লোকটিকে বসিয়ে আহার করিয়ে বিদায় দেন। উপস্থিত লোকেরা দুইজন ভিক্ষুকের সাথে দুই রকম আচরণের কারণ জানতে চাইলো। বললেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মানুষের সাথে তাদের মর্যাদা অনুযায়ী আচরণ করা উচিত।

শরীয়াতের অতি সাধারণ আদেশ-নিষেধের প্রতি অত্যাধিক গুরুত্ব দিতেন। ছোট ছোট নিষিদ্ধ কাজও এড়িয়ে চলতেন। পথ চলতে যদি ঘণ্টা ধ্বনি শোনা যেত, সাথে সাথে থেমে যেতেন, যাতে কানে যায়। তাঁর একটি বাড়ীতে একজন ভাড়াটিয়া ছিল। সে দাবা খেলতো। তিনি তাকে বলে দেন, যদি এ কাজ থেকে বিরত না হও, ঘর থেকে বের করে দেব।

‘আয়িশা বিনত তালহা বলেন, একটি জিন বার বার হযরত ‘আয়িশার (রা) ঘরে প্রবেশ করতো। তিনি তাকে এভাবে ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করতে থাকেন। এমন কি তাকে হত্যার হুমকি দেন। তবুও সে আসতো। একদিন তিনি লোহার একটি দন্ড দিয়ে জিনটিকে আঘাত করে হত্যা করেন। এরপর তিনি স্বপ্নে দেখেন, কেউ একজন তাঁকে বলছেন, আপনি অমুককে হত্যা করেছেন, অথচ তিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আপনি যখন পর্দা অবস্থায় থাকতেন তখন ছাড়া তিনি তো আপনার ঘরে ঢুকতেন না। তিনি যেতেন আপনার নিকট রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীস শোনার জন্য। হযরত ‘আয়িশা (রা) তাঁর এই স্বপ্নের কথা পিতাকে বললেন।’ তিনি তাঁকে দিয়াত (রক্তপণ) হিসেবে বারো হাজার দিরহাম সাদাকা করে দেওয়ার জন্য বলেন। ইমাম জাহাবী এ ঘটনা তাঁর সিয়ারু আ‘লাম আননুবালা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমাদ তার মুসনাদ গ্রন্থে এই ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, জিনটি সাপের রূপ ধরে আসতো এবং তার অছিয়াত হিসেবে হযরত আয়িশা (রা) একটি দাস মুক্ত করেন।

আয়িশা (রা) এর ইনতিকাল

হযরত ‘আয়িশা (রা) হিজরী ৫৮ সনের ১৭ রমযান মুতাবিক ১৩ জুন ৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৬৬ বছর বয়সে মদীনায় ইনতিকাল করেন। তখন হযরত আমীর মু’য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকালের শেষ পর্যায়। মৃত্যুর পূর্বে কিছুকাল রোগগ্রস্ত অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। অসংখ্য মানুষ সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে দরজায় ভিড় করতো। কেউ কুশল জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ভালো আছি। এ সময় একদিন হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আববাস (রা) সাক্ষাতের অনুমতি চান। হযরত ‘আয়িশা (রা) এ কথা চিন্তা করে তাঁকে সাক্ষাৎ দানে ইতস্তত করতে থাকেন যে, তিনি হয়তো এসেই তাঁর প্রশংসা শুরু করে দেবেন। কিন্তু বোনের ছেলেরা তাঁকে বুঝান যে, আপনি হচ্ছেন উম্মূল মুমিনীন, আর তিনি হচ্ছেন ইবন ‘আববাস। আপনাকে সালাম এবং বিদায় জানাতে এসেছেন। তখন বললেন, তোমরা যদি চাও, ডেকে আন। হযরত ইবন ‘আববাসকে (রা) ডাকা হলো। উম্মূল মুমিনীনের ধারণা সত্য হলো। ইবন ‘আববাস (রা) বসার সাথে সাথে বলতে শুরু করলেন, ‘সেই আদিকাল থেকেই আপনার নাম উম্মূল মু’মিনীন ছিল। আপনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রিয়তমা স্ত্রী। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে মিলিত হওয়ার জন্য আপনার দেহ থেকে প্রাণটি বের হয়ে যাওয়ার সময়টুকু শুধু অপেক্ষা। যে রাতে আপনার হারটি হারিয়ে যায়, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পানি তালাশ করেন এবং লোকেরা পানি পেলনা, তখন আপনারই কারণে আল্লাহ তা’য়ালা তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল করেছেন। আপনার নির্দোষিতা ও দোষ মুক্তির কথা জিবরীল আমীন (আ) আসমান থেকে নিয়ে এসেছেন। এসব আয়াত কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি মসজিদে পাঠ করা হবে। এতটুকু শোনার পর তিনি বলেনঃ ইবন ‘আববাস, আমাকে আপনি এই প্রশংসা থেকে মাফ করুণ। আমার তো এটাই পছন্দ ছিল যে, আমার যদি অস্তিত্বই না হতো।

মৃত্যুর পূর্বে অসীয়াত করে যান যে, আমাকে জান্নাতুল বাকীহতে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য স্ত্রীদের সাথে দাফন করবে। মৃত্যু যদি রাতের বেলায় হয় তাহলে রাতেই দাফন করে দিবে। তাঁর ওফাত হয় রাতে বিতর নামাযের পরে। সুতরাং তখনই তাঁকে অসীয়াত মত জান্নাতুল বাকী’তে দাফন করা হয়। তাঁর ওফাতের খবর ছড়িয়ে পড়লে মদীনায় কান্নার রোল পড়ে যায়। আনসাররা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। জানাযায় এত লোকের সমাগম হয় যে, রাতের বেলা এত জনসমাগম পূর্বে আর কখনও দেখা যায়নি বলে লোকেরা বর্ণনা করেছেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, মহিলাদের ভিড় দেখে ঈদের দিন বলে মনে হচ্ছিল। হযরত উম্মু সালামা (রা) কান্নার আওরায শুনে বলেনঃ ‘আয়িশার (রা) জন্য জান্নাত অপরিহার্য। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী।

হযরত আবু হুরাইরা (রা) ছিলেন তখন মদীনার গভর্নর। তিনি জানাযার নামায পড়ান। কাসিম ইবন মুহাম্মদ ইবন আবী বকর (রা), ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আবদির রহমান ইবন আবী বকর, ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আতীক, ‘উরওয়া ইবন যুবাইর (রা) এবং ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা)-ভাই ও বোনের এই ছেলেরা তাঁকে কবরে নামান। তাঁর অন্তিম অসীয়াত অনুযায়ী জান্নাতুল বাকী’ গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

উম্মূল মুমিনীনের ইনতিকালে প্রতিটি মুসলমান গভীরভাবে শোকাভিভূত হন। প্রখ্যাত তাবে’ঈ হযরত মাসরূক (রহ) বলেন, আমার যদি একটি কথা স্মরণ না হতো, আমি উম্মূল মুমিনীনের জন্য মাতমের মাজমা’ বসাতাম। ‘উবাইদ ইবন ‘উমাইর এক ব্যাক্তিকে প্রশ্ন করেন, হযরত ‘আয়িশার (রা) মৃত্যুতে কারা দুঃখ পান? লোকটি জবাব দেয়, তিনি যাদের মা ছিলেন তারা সবাই দুঃখ পায়। এ সকল কথা ইবন সা’ত বর্ণনা করেছেন।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত ‘আয়িশা (রা) কোন সন্তান জন্মদান করেননি। বোন হযরত আসমার (রা) ছেলে হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরকে (রা) নিজের ছেলের মত লালন পালন করেন। ‘আবদুল্লাহও মায়ের মত খালাকে ভালোবাসতেন। হিজরাতের পরে মদীনায় মুহাজিরদের ঘরে সর্বপ্রথম এই ‘আবদুল্লাহর জন্ম। মদীনার কাফির-মুনাফিকরা বলাবলি করতো যে, মুসলিম নারীরা মদীনায় এসে বন্ধ্যা হয়ে গেছে। এমনি এক সময়ে তাঁর জন্ম হলে মুসলিমদের মধ্যে খুশীর জোয়ার বয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খেজুর চিবিয়ে নিজ হাতে তার গালে দিয়ে ‘তাহনীক’ করেন। এই ‘আবদুল্লাহকে হযরত ‘আয়িশা (রা) ছেলে হিসেবে মানুষ করেন। এক আনসারী মেয়েকে লালন-পালন করে তিনি বিয়ে দেন বলে হাদীসে উল্লেখ আছে। তাছাড়া মাসরূক ইবন আজদা’ ‘উমরা বিনত ‘আয়িশা বিনত তালহা, ‘উমরা বিনত ‘আবদির রহমান আনসারিয়্যা, আসমা বিনত ‘আবদির রহমান ইবন আবী বকর, ‘উরওয়া ইবন যুবাইর, কাসিম ইবন মুহাম্মদ ও তাঁর ভাই, ‘আবদুল্লাহ ইবন ইয়াযিদ ও আরো অনেক ছেলে-মেয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হয়। মুহাম্মদ ইবন আবী বকরের (রা) মেয়েদেরকে তিনিই লালন পালন করে বিয়ে শাদী দেন।


হযরত আয়িশা (রাঃ) এর ১২ পর্বের পুরো জীবনী পড়ুন-



****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url