সাহাবাগণের জীবনকথা-১৮ || হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর জীবনী (২য় পর্ব)






হযরত আয়িশা (রা) এর জীবনীর ২য় পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

আয়িশা (রা) এর শিক্ষা-দীক্ষা


দিবা-রাত্র ইলম ও হিকমাত বা জ্ঞান-বিজ্ঞারে অসংখ্য বিষয়ের আলোচনা তাঁর কানে আসতো। তাঁর নিজেরও অভ্যাস ছিল, প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীন চিত্তে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে উপস্থাপন করা। তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তিনি শান্ত হতেন না। একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ কিয়ামতের দিন যার হিসাব নেওয়া হবে, সে শাস্তি ভোগ করবে।
‘আয়িশা (রা) বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ তো বলেছেন- অর্থাৎ তার থেকে সহজ হিসাব নেওয়া হবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এ হলো আমলের উপস্থাপন। কিন্তু যার আমলের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে তার ধ্বংস অনিবার্য।
 
একবার ওয়াজ-নসীহতের সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ কিয়ামতের দিন সকল মানুষ নগ্ন অবস্থায় উঠবে। ‘আয়িশার (রা) মনে খটকা লাগলো। তিনি বলে উঠলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! নারী-পুরুষ এক সঙ্গে উঠবে। তাহলে একে অন্যের প্রতি কি দৃষ্টি পড়বে না? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ সময়টা হবে অতি ভয়ংকর। অর্থাৎ একজনের অন্যজনের ব্যাপারে কোন খবরই থাকবে না।
 
একদিন ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, কাফির-মুশরিকরা যে ভালো কাজ করে তার সাওয়াব তারা পাবে কিনা? ‘আবদুল্লাহ ইবন জাদ‘আন নামে মক্কায় একজন সৎ স্বভাব ও কোমল অন্তরের মুশরিক ছিল। সে ইসলাম-পূর্ব যুগে কুরাইশদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-ফাসাদ মীমাংসার উদ্দেশ্যে কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে একটি বৈঠকে সমবেত করে। তাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন। ‘আয়িশা (রা) প্রশ্ন করেনঃ ‘‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আবদুল্লাহ ইবন জাদ‘আন জাহিলী যুগে মানুষের সাথে সদয় ব্যবহার করতো। দরিদ্র ও অনাহারক্লিষ্টদেরকে আহার করাতো। তার এ কাজ কি উপকারে আসবে না?’’ তিনি জবাব দিলেনঃ না, ‘আয়িশা। সে কোনদিন একথা বলেনি যে, হে আল্লাহ! কিয়ামতের দিন তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
 
জিহাদ ইসলামের একটি অন্যতম ফরয। ‘আয়িশার (রা) ধারণা ছিল, অন্য ফরযের ক্ষেত্রে যেমন নারী-পুরুষের কোন প্রভেদ নেই, তেমনি এ ক্ষেত্রেও তাই হবে। একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশ্ন করেই বসলেন। উত্তর পেলেনঃ হজ্জ হলো নারীদের জিহাদ।
 
আর একদিন প্রশ্ন করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! জিহাদ হচ্ছে সর্বোত্তম আমল। আমরা নারীরা কি জিহাদ করবো না? রাসূলুল্লাহ বললেনঃ না। তবে সর্বোত্তম জিহাদ হচ্ছে হজ্জে মাবরূর।
 
বিয়েতে বর-কনে উভয়ের সম্মতি থাকা শর্ত। কুমারী মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে লজ্জায় মুখে সম্মতি প্রকাশ করে না। এ কারণে ‘আয়িশা (রা) একদিন প্রশ্ন করেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! বিয়েতে তো মেয়ের সম্মতি প্রয়োজন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ, প্রয়োজন। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ মেয়েরা তো লজ্জায় চুপ থাকে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তার চুপ থাকাই সম্মতি।
 
একদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাহাজ্জুদ নামায আদায়ের পর বিতর না পড়েই বিশ্রামের জন্য একটু শোয়ার ইচ্ছা করলেন। ‘আয়িশা (রা) বলে উঠলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি বিতর না পড়েই শুয়ে যাচ্ছেন? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমার চোখ তো ঘুমায়, কিন্তু অন্তর ঘুমায়না। বাহ্যত ‘আয়িশার (রা) এ ধরনের প্রশ্ন বেয়াদবী বলে মেন হয়। কিন্তু তিনি সাহসিকতা না দেখালে উম্মাতে মুহাম্মাদী নুবুওয়াতের গূঢ় রহস্য থেকে অজ্ঞ থেকে যেত।
 
ইসলামে প্রতিবেশীর বহু অধিকারের কথা এসেছে। আর এই অধিকারের সুযোগ আসে বেশীর ভাগ মেয়েদেরই। কিন্তু প্রতিবেশী একাধিক হলে কাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে? তাই ‘আয়িশা (রা) একদিন প্রশ্ন করলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেনঃ যে প্রতিবেশীর দরজা তোমার ঘরের অধিক নিকটবর্তী, তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে না, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন না। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে কেউ তো মৃত্যুকে পছন্দ করে না।? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমার কথার এই অর্থ নয়। অর্থ হলো, মুমিন ব্যক্তি যখন আল্লাহর রহমত, রিজামন্দী এবং জান্নাতের অবস্থার কথা শোনে তখন তার অন্তর আল্লাহর জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। আল্লাহও তার আগমনের প্রতীক্ষায় থাকেন। আর কাফির ব্যক্তি যখন আল্লাহর আজাব ও অসন্তুটির কথা শোনে তখন সে আল্লাহর সামনে যেতে অপছন্দ করে। আল্লাহও তার সাক্ষাৎ অপছন্দ করেন।
 
একবার এক ব্যক্তি যখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো, তিনি অনুমতি দিয়ে বললেনঃ ‘তাকে আসতে দাও। সে তার গোত্রের খুব খারাপ লোক।’ লোকটি এসে বসলো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত ধৈয্য, মনযোগ ও আন্তরিকতা সহকারে তার সাথে কথা বললেন। আয়িশা (রা) খুব অবাক হলেন। লোকটি চলে গেলে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তো লোকটিকে ভালো জানতেন না। কিন্তু সে যখন এলো, তার সাথে এমন আন্তরিকতা ও নম্রভাবে কথা বললেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘আয়িশা! সবচেয়ে খারাপ মানুষ ঐ ব্যক্তি যার ভয়ে মানুষ তার সাথে মেলামেশা ছেড়ে দেয়।
 
একবার এক ব্যক্তি এসে কিছু সাহায্য চাইলো। হযরত ‘আয়িশার (রা) ইঙ্গিতে দাসী কিছু জিনিস দিতে চললেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘আয়িশা! গুনে গুনে দিবে না। তাহলে আল্লাহও তোমাকে গুনে গুনে দিবেন। আর একটি টুকরাও যদি হয়, ভিক্ষুককে তাই দিয়ে জাহান্নাম থেকে বাঁচ। সেটি একজন ক্ষুধার্ত মানুষ খেলে তো কিছু হবে এবং তার পেট ভরবে। এর থেকে আর ভাল কি হতে পারে।
 
আর একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’আ করলেনঃ হে আল্লাহ! আমাকে দরিদ্র অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখ, দরিদ্র অবস্থায় মৃত্যু দাও এবং কিয়ামতের দিন দরিদ্রদের সাথেই উঠাও। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ কেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ সম্পদহীনরা সম্পদশালীদের চেয়ে চল্লিশ বছর পূর্বে জান্নাতে যাবে। ‘আয়িশা, কোন ভিক্ষুককে কিছু না দিয়ে ফিরিয়ে দিবে না। তা সে খোরমার একটি টুকরাই হোক না কেন। দরিদ্রদের ভালোবাসবে এবং তাদেরকে নিজের পাশে বসাবে।
 
হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাসমূহ হযরত ‘আয়িশা (রা) এ জাতীয় অসংখ্য জিজ্ঞাসা ও তার জবাব বর্ণিত হয়েছে। মূলতঃ এগুলিই ছিল তাঁর নিত্যদিনের পাঠ। বিভিন্ন নৈতিক উপদেশ ছাড়ও নামায, হজ্জ, যাকাত, তথা দীন ও দুনিয়ার অসংখ্য কথা রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত ‘আয়িশাকে (রা) অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে শেখাতেন। ‘আয়িশাও (রা) অতি আগ্রহ সহকারে শিখতেন এবং অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তা আমল করতেন।
 
হযরত ‘আয়িশার (রা) মধ্যে জানার আগ্রহ ছিল অতি তীব্র। যে সকল মুহূর্তে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো তখনও তিনি জিজ্ঞসা করা থেকে বিরত থাকতেন না। মূলতঃ তিনি স্বামী হযরত রাসূলে পাকের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বভাব-প্রকৃতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। তাই তাঁর ক্ষেত্রে খোলামেলা ও দুঃসাহসী হতে পারত। একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন কারণের স্ত্রীদের উপর বিরক্ত হয়ে অঙ্গীকার করেন যে, আগামী একমাস কোন স্ত্রীর কাছেই যাবেন না। ঊনত্রিশ দিন এই অঙ্গীকারের উপর অটল থাকেন। ঘটনাক্রমে সেই চন্দ্র মাসটি ছিল ঊনত্রিশ দিনের। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরের মাসের প্রথম তারিখ অর্থাৎ ৩০তম দিনে ‘আয়িশার (রা) নিকট যান। আপতঃদৃষ্টিতে ‘আয়িশা (রা) উল্লাসিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রশ্ন করেছেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি বলেছেন, একমাস আমাদের কাছে আসবেন না। একদিন আগে কিভাবে আসলেন? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘আয়িশা! মাস ঊনত্রিশ দিনেও হয়।
 

আয়িশা (রা) এর সংসার জীবন

হযরত ‘আয়িশা (রা) পিতৃগৃহ থেকে বউ হয়ে যে ঘরে এসে ওঠেন তা কোন আলিশান অট্টালিকা ছিল না। মদীনার বনু নাজ্জার মহল্লার মসজিদে নববীর চারপাশে ছোট্ট ছোট্ট কিছু কাঁচা ঘর ছিল, তারই একটিতে তিনি এসে ওঠেন। ঘরটি ছিল মসজিদের পূর্ব দিকে। তার একটি দরজা ছিল পশ্চিম দিকে মসজিদের ভিতরে। ফলে মসজিদ ঘরের আঙ্গিনায় পরিণত হয়। হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। তিনি যখন মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন, মাথাটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন, আর আয়িশা (রা) চুলে চিরুনী করে দিতেন। কখনো মসজিদে বসেই ঘরের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কোন কিছু ‘আয়িশার (রা) নিকট থেকে চেয়ে নিতেন।
 
ঘরটির প্রশস্ততা ছিল ছয় হাতেরও বেশি। দেয়াল ছিল মাটির। খেজুর পাতা ও ডালের ছাদ ছিল। তার উপরে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য কম্বল দেওয়া যেত। এতটুকু উঁচু ছিল যে, একজন মানুষ দাঁড়ালে তার হাতে ছাদের নাগাল পাওয়া যেত। এক পাল্লার একটি দরজা ছিল, কিন্তু তা কখনো বন্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি। পর্দার জন্য দরজায় একটি কম্বল ঝুলানো থাকতো। এই ঘরের লাগোয়া আর একটি ঘর ছিল-যাকে ‘মাশরাবা’ বলা হতো। একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের থেকে পৃথক থাকা কালে এক মাস এখানেই কাটান।
 
ঘরে আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল-একটি খাট, একটি চাটাই, একটি বিছানা, একটি বালিশ, খোরমা-খেজুর রাখার দুইটি মটকা, পানির একটি পাত্র এবং পান করার একটি পেয়ালা। এর বেশি কিছু নয়। বিভিন্ন হাদীসে একাধিক স্থানে এইসব জিনিসের নাম বাসিন্দাদের রাতের বেলা একটি বাতি জ্বালানোর সামর্থ ছিল না। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ একাধারে প্রায় চল্লিশ রাত চলে যেত ঘরে বাতি জ্বলতো না।
 
ঘরে সর্বসাকুল্যে দুইটি মানুষ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ‘আয়িশা (রা)। কিছুদিন পর ‘বুরায়রা’ (রা) নাম্নী একজন দাসী যুক্ত হন। যতদিন ‘আয়িশা ও সাওদা মাত্র দুই স্ত্রীই ছিলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন পর পর আয়িশার (রা) ঘরে রাত কাটাতেন। পরে আরো কয়েকজনকে স্ত্রীর মর্যাদা দান করলে এবং হযরত সাওদা (রা) স্বেচ্ছায় স্বীয় বারের দিনটি আয়িশাকে (রা) দান করলে প্রতি নয় দিনে দুই দিন ‘আয়িশার (রা) ঘরে কাটাতেন।
 
ঘর-গৃহস্থালীর গোছগাছ ও পরিপাটির বিশেষ কোন প্রয়োজন পড়তো না। খাদ্য খাবার তৈরি ও রান্নাবান্নার সুযোগ খুব কমই আসতো। হযরত ‘আয়িশা (রা) নিজেই বলতেনঃ কখনো একাধারে তিন দিন এমন যায়নি যখন নবী পরিবারের লোকেরা পেট ভরে খেয়েছেন। তিনি আরো বলতেনঃ মাসের পর মাস ঘরে আগুন জ্বলতো না। এ সময় খেজুর ও পানির উপরই কাটতো। খায়বার বিজয়ের পর হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আযওয়াজে মুতাহহারাতের (পবিত্র সহধর্মিণীগণ) প্রত্যেকের জন্য বাৎসরিক ভাতা নির্ধারণ করে দেন। আবদুর রহমান আল-আ‘রাজ মদীনায় তাঁর মজলিসে বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) জীবিকার জন্য খায়বারের ফসল থেকে আশি ওয়াসাক খেজুর এবং বিশ ওয়াসাক যব মতান্তরে গম দিতেন। কিন্তু তাঁর দানশীলতার কারণে এই পরিমাণ খাদ্য সারা বছরের জন্য কখনো যথেষ্ট ছিল না।
 
সাহাবায়ে কিরাম (রা) সব সময় নবী-পরিবারে উপহার-উপঢৌকন পাঠাতেন। বিশেষ করে যেদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) ঘরে অবস্থান করতেন, লোকেরা ইচ্ছা করেই সেই দিন বেশি করে হাদিয়া-তোহফা পাঠাতেন।
 
অনেক সময় এমন হতো যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইরে থেকে এসে জিজ্ঞেস করতেনঃ ‘আয়িশা! কিছু আছে কি? তিনি জবাব দিতেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিছুই নেই। তারপর সবাই মিলে রোযা রাখতেন। অনেক সময় কোন কোন আনসার পরিবার দুধ পাঠাতো। তাই পান করেই পরিতৃপ্ত থাকতেন। উম্মু সালামা (রা) বলেনঃ রাসূলুল্লারহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সময় আমাদের অধিকাংশ দিনের খাবার ছিল দুধ।
 
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘর-গৃহস্থলীর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল হযরত বিলালের (রা) উপর। তিনি সারা বছরের খাদ্যশস্য বণ্টন করতেন। প্রয়োজন পড়লে ধার-কর্জ করতেন।

হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ওফাত পান তখন গোটা আরব ইসলামের ছায়াতলে এসে গেছে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ এসে বাইতুলমালে জমা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেদিন ওফাত পান সেদিন হযরত ‘আয়িশার (রা) ঘরে একদিন চলার মতও খাবার ছিল না।
 
হযরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা) খিলাফতকালেও হযরত ‘আয়িশা (রা) খায়বারে উৎপাদিত ফসল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্য পেতেন। খলীফা হযরত ‘উমার (রা) সবার জন্য নগদ ভাতার প্রচলন করেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের প্রত্যেকের জন্য বাৎসরিক দশহাজার দিরহাম নির্ধারণ করেন। কিন্তু ‘আয়িশার (রা) জন্য নির্ধারণ করন বারো হাজার। এর কারণ স্বরূপ তিনি বলতেনঃ ‘আয়িশা ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রিয়তমা স্ত্রী। একটি বর্ণনায় এসেছে, খলীফা ‘উমার (রা) তাঁর সময়ে খায়বারে উৎপন্ন ফসলের অংশ অথবা ভূমি গ্রহণের এখতিয়ার দান করেন। হযরত ‘আয়িশা (রা) তখন ভূমি গ্রহণ করেন।
 
অর্থ-সম্পদ যা কিছু তাঁর হাতে আসতো-গরীব-মিসকীনদের মধ্যে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন। খলীফা হযরত উসমান (রা) থেকে নিয়ে আমীর মু‘য়ারিয়া (রা) পর্যন্ত উপরে উল্লেখিত ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা) ছিলেন হযরত আয়িশার (রা) ভাগ্নে-যিনি আমীর মু‘য়াবিয়ার (রা) পরে হিজাযের খলীফা হন। তিনি খালার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন। কিন্তু যেদিন বাইতুল মাল থেকে ভাতা না আসতো সেদিন তাঁর গৃহে অভূক্ত থাকার উপক্রম হতো।
 
স্বাভাগত ভাবে হযরত ‘আয়িশার (রা) তীক্ষ্ম বুদ্ধি ও বোধ থাকা সত্ত্বেও বয়স কম হওয়ার কারণে মাঝে মধ্যে ভুল-ত্রুটি হয়ে যেত। ঘরে গম পিষে আটা বানিয়ে ঘুমিয়ে যেতেন, ছাগল এসে তা খেয়ে ফেলতো। একদিন তিনি নিজ হাতে আটা পিষে রুটি তৈরি করেন। তারপর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসার প্রতীক্ষায় থাকেন। সময়টি ছিল রাতের বেলা। এক সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসলেন এবং নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। ঘুমে হযরত ‘আয়িশার (রা) চোখ দুইটি বন্ধ হয়ে এলো। এই ফাঁকে প্রতিবেশীর একটি ছাগল ঘরে ঢুকে সবকিছু খেয়ে ফেললো। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স্কা স্ত্রীদের তুলনায় তিনি খাদ্য-খাবার ভালো পাকাতে পারতেন না।

আয়িশা (রা) এর দাম্পত্য জীবন

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ‘আয়িশার (রা) যুগল জীবন এবং তাঁদের মধ্যের মধুর সম্পর্কের একটি চিত্র আমাদের সামনে থাকা দরকার। ইসলাম নারীকে না অতি পবিত্র মনে করে দেবীর আসনে বসিয়েছে, আর না তাকে কেবল পুরুষের ভোগের বস্ত্ত বলে মনে করেছে। নারী সম্পর্কে প্রাচীন ও আধুনিক কালের পৃথিবীর মানুষের ধারণা মূলত এমনই। তাই কোনকালেই কোন সমাজে নারী সঠিক মর্যাদা লাভ করেনি। একমাত্র ইসলামই সঠিক মর্যাদা দিয়েছে। ইসলাম নারীর সর্বোত্তম যে পরিচিতি তুলে ধরেছে তা হচ্ছে, এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বিশ্বের নারী হলো পুরুষের প্রশান্তি ও সান্ত্বনার উৎস। কুরআন ঘোষণা করেছেঃ
 
"আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পার এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা আর রূম-২১)
 
আল্লাহ পাকের এই ঘোষণার বাস্তব চিত্র আমরা দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ‘আয়িশার (রা) দাম্পত্য জীবনের মধ্যে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন-

'তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বোত্তম। আমি আমার স্ত্রীদের নিকট তোমাদের সকলের চেয়ে উত্তম।"
 
তাঁদের নয় বছরে দাম্পত্য জীবনে ছিল গভীর ভালোবাসা, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সীমাহীন আবেগ ও নিষ্ঠা। কঠিন দারিদ্র্য, অনাহার, তথা সকল প্রতিকূল পরিবেশেও তাঁদের এ মধুর সম্পর্কে একদিনের জন্যও ফাটল দেখা যায়নি। কোন রকম তিক্ততা ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়নি।
 
হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশাকে (রা) গভীরভাবে ভালোবাসতেন। এ কথা গোটা সাহাবী সমাজের জানা ছিল। এ কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেদিন ‘আয়িশার (রা) ঘরে কাটাতেন সেদিন তাঁরা বেশি বেশি হাদিয়া তোহফা পাঠাতেন। এতে অন্য স্ত্রীরা ক্ষুব্ধ হতেন। তাঁরা চাইতেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেন লোকদের নির্দেশ দেন, তিনি যেদিন যেখানে থাকেন লোকেরা যেন সেখানেই যা কিছু পাঠাবার, পাঠায়। কিন্তু সে কথা বলার হিম্মত কারো হতো না। এই জন্য তাঁরা সবাই মিলে তাঁদের মনের কথা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাসূলে পাকের কলিজার টুকরো ফাতিমাকে (রা) বেছে নেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতিমার (রা) বক্তব্য শুনে বললেন, ‘মা, আমি যা চাই, তুমি কি তা চাও না? ফাতিমা পিতার ইচ্ছা বুঝতে পারলেন। তিনি ফিরে এলেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীরা আবার তাঁকে পাঠাতে চাইলেন; কিন্তু তিনি ছিলেন একজন বয়স্কা, বুদ্ধিমতী ও রসিক মহিলা। তিনি বেশ কায়দা করে তাদের মনের কথা রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বললেনঃ উম্মু সালামা! আয়িশার ব্যাপারে তোমরা আমাকে বিরক্ত করবে না। কারণ ‘আয়িশা ছাড়া আর কোন স্ত্রীর লেপের নীচে আমার উপর ওহী নাযিল হয়নি। ইমাম জাহাবী বলেন, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই জবাব দ্বারা প্রতীয়মান হয়, অন্যদের তুলনায় ‘আয়িশাকে (রা) সর্বাধিক ভালোবাসার অন্যতম কারণ হলো, আল্লাহর  নির্দেশ। আল্লাহর নির্দেশেই তিনি ‘আয়িশাকে (রা) এত ভালোবাসতেন।
 
হযরত ‘আমর ইবনুল ‘আস (রা) ‘জাতুস সালাসিল’ যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেনঃ 'ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ পৃথিবীতে আপনার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে?' বললেনঃ আয়িশা। তিনি আবার বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ আমার জিজ্ঞাসা পুরুষ সম্পর্কে। বললেনঃ ‘আয়িশার পিতা।
 
একবার ‘উমার (রা) মেয়ে উম্মুল মুমিনীন হাফসাকে (রা) উপদেশ দিতে গিয়ে বললেনঃ তুমি ‘আয়িশার সাথে পাল্লা দিতে যেও না। কারণ, সে তো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রিয়তমা।
 
একবার এক সফরে চলার পথে ‘আয়িশার (রা) উটনীটি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তাঁকে নিয়ে দৌড় দেয়। এতে রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতই অস্থির হয়ে পড়েন যে, তাঁর মুখ দিয়ে তখন উচ্চারিত হতে শোনা যায়ঃ ‘ওয়া আরূসাহ!’ হায়! আমার বধূ!
 
হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তিম রোগ শয্যায় বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেনঃ আজ কি বার? কক্ষের সবাই বুঝলো, তিনি ‘আয়িশার বারির দিনটির অপেক্ষা করছেন। সুতরাং তাঁকে ‘আয়িশার (রা) ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ওফাত পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। ‘আয়িশার (রা) রানের উপর মাথা রেখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তেরো দিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসুস্থ ছিলেন। তার মধ্যে পাঁচ দিন অন্য স্ত্রীদের ঘরে এবং আট দিন ‘আয়িশার (রা) ঘরে কাটান।
 
পরবর্তীকালে ‘আয়িশা (রা) বলতেনঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার ঘরে আমার বারির দিনে এবং আমারই বুকে ইনতিকাল করেন। জীবনের একেবারে অন্তিম মুহূর্তে ‘আবদুর রহমান ইবন আবী বকর (রা) একটি কাঁচা মিসওয়াক হাতে করে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখতে আসেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই মিসওয়াকটির দিকে বার বার তাকাতে লাগলেন। বুঝলাম, তিনি সেটা চাচ্ছেন। আমি সেটা নিয়ে ধুয়ে নিজে চিবিয়ে নরম করে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিলাম। তিনি সেটা দিয়ে সুন্দর করে মিওয়াক করলেন। তারপর আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালেন, কিন্তু হাতটি পড়ে গেল। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সেই মহান আল্লাহর প্রশংসা যিনি তাঁর রাসূলের পার্থিব জীবনের শেষ মূহুর্তটিতে তাঁর ও আমার থুতু মিলিত করেছেন।
 
অনেকে মনে করে থাকে ‘আয়িশার (রা) প্রতি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন আবেগ ও মুগ্ধতার কারণ তাঁর রূপ-লাবণ্য। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। রাসূলে পাকের সহধর্মিণীদের মধ্যে জুওয়াইরিয়া, যায়নাব ও সাফিয়্যা (রা) ছিলেন সর্বাধিক সুন্দরী। তাঁদের সৌন্দর্য্যের কথা হাদীস, সীরাত ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে বিদ্যমান। কিন্তু ‘আয়িশার (রা) রূপ লাবণ্যের কথা দুই একটি স্থান ব্যতীত তেমন কিছু উল্লেখ নেই। যেমন একবার উমার (রা) হাফসাকে (রা) উপদেশ দিতে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে একটি মন্তব্য করেন। আর তা শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটু হেসে দেন। মূলতঃ উমারের এ মন্তব্য দ্বারা এতটুকু প্রমাণিত হয় যে, ‘আয়িশা (রা) হাফসার (রা) চেয়ে প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য।
 
আসল কথা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বলেছেন, তাই তিনি বলেছেনঃ বিয়ের জন্য কনের নির্বাচন চারটি গুণের ভিত্তিতে হতে পারে।
 
১. ধন-সম্পদ
২. রূপ-সৌন্দর্য,
৩. বংশ মর্যাদা,
৪. দীনদারী।
 
তোমরা দীনদারীর সন্ধান করবে।  এ কারণে যাঁর দ্বারা দীনের বেশি খিদমাত হওয়া সম্ভব ছিল স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাধিক ভালোবাসার পাত্রী ছিলেন। ‘আয়িশার (রা) সমস্ত-বুঝ, চিন্তা-অনুধ্যান, হুকুম-আহকাম স্মৃতিতে ধারণ ক্ষমতা অন্য স্ত্রীদের তুলনায় অতিমাত্রায় বেশি ছিল। মূলতঃ এসব গুণই তাঁকে স্বামীর প্রিয়তমা করে তুলেছিল। আল্লামা ইবন হাযাম ‘আল-মিলাল ওয়ান নিহাল’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করে একথা প্রমাণ করেছেন। বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।
 
-পুরুষদের মধ্যে কামালিয়াত বা পূর্ণতা অর্জন করেছেন অনেকে, কিন্তু নারীদের মধ্যে মারইয়াম বিনত ইমরান এবং ফির‘আউনের স্ত্রী আসিয়া ছাড়া আর কেউ পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। তবে গোটা নারী জাতির উপর ‘আয়িশার মর্যাদা যাবতীয় খাদ্য সামগ্রীর উপর সারীদের মর্যাদার মত।
 
‘আয়িশাকে (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এত বেশি ভালোবাসার তাৎপর্য এই হাদীস দ্বারা বুঝা যায়। তাঁর মুগ্ধতা ‘আয়িশার (রা) রূপ-যৌবন ও সৌন্দর্য ছিল না; বরং তা ছিল তাঁর অন্তর্গত গুণাবলী ও পূর্ণতায়। আর এই অন্তর্গত গুণাবলীতে ‘আয়িশার (রা) পরে স্থান ছিল উম্মু সালামার (রা) এ কারণে বয়স্কা হওয়া সত্ত্বেও তিনিও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গভীর ভালোবাসার পাত্রী ছিলেন। হযরত খাদীজা (রা) পঁয়ষট্টি বছর বয়স লাভ করে ওফাত পান, অথবা তাঁর ভালোবাসা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হৃদয়ের এত গভীরে ছিল যে, তাতে ‘আয়িশাও (রা) ঈর্ষা পোষণ করতেন।
 

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি আয়িশা (রা) এর ভালবাসা

স্বামী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ছিল ‘আয়িশার (রা) বুকভরা পবিত্র ভালোবাসা। সেই ভালোবাসায় অন্য কেউ ভাগের দাবিদার হলে তিনি কষ্ট পেতেন। কখনো রাতে ‘আয়িশার (রা) ঘুম ভেঙ্গে গেলে পাশে স্বামীকে না পেলে অস্থির হয়ে পড়তেন। একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশে স্বামীকে পেলেন না। রাতে ঘরে বাতিও জ্বলতো না। অন্ধকারে এদিক ওদিক হাতড়াতে লাগলেন। অবশেষে এক স্থানে স্বামীর কদম মুবারাক খুঁজে পেলেন। তিনি সিজদায় পড়ে আছেন।
 
আরো একবার একই অবস্থায় অবতারণা হলো। ‘আয়িশা (রা) মনে করলেন, তিনি হয়তো অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে গেছেন। তিনি দিক ওদিক দেখতে লাগলেন। দেখলেন, স্বামী এক কোণে নীরবে তাসবীহ পাঠে নিমগ্ন আছেন। ‘আয়িশা (রা) নিজের অমূলক ধারণার জন্য লজ্জিত হলেন। তিনি আপন মনে বলে উঠলেনঃ আমার মা-বাবা উৎসর্গীত হোক! আমি কোন ধারণায় আছি, আর তিনি আছেন কোন অবস্থায়।
 
অন্য এক রাতের ঘটনা। ‘আয়িশা (রা) মধ্যরাতে জেগে উঠলেন। পাশে স্বামীকে না পেয়ে এখানে সেখানে খোঁজাখুঁজি করতে করতে কবরস্থানে পৌঁছে দেখলেন, তিনি দু‘আ ও ইসতিগফারে নিমগ্ন। তিনি আবার নীরবে ফিরে আসলেন। সকালে একথা স্বামীকে জানালে তিনি বললেনঃ হাঁ, রাতে আমার সামনে দিয়ে কোন একটা জিনিস যাচ্ছিল মনে হয়েছিল। তাহলে সে তুমিই হবে।’
 
একবার এক সফরে ‘আয়িশা (রা) ও হাফসা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফর সঙ্গিনী ছিলেন। রাতে চলার পথে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) বাহনের পিঠে বসে তাঁর সাথে কথা বলতে বলতে চলতেন।
 
একদিন ‘আয়িশা ও হাফসা (রা) পরামর্শ করে উট বদল করে নিলেন। রাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যথারীতি ‘আয়িশার (রা) উটের পিঠে উঠে এলেন এবং হাফসার (রা) সাথে কথা বলতে বলতে পথ চললেন। এদিকে ‘আয়িশা (রা) স্বামী সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে কাতর হয়ে পড়েন। পরবর্তী মানযিলে কাফেলা থামলে তিনি বাহনের গিনি থেকে নেমে পড়েন এবং ঘাসের মধ্যে নিজের চরণ দুইখনি ডুবিয়ে দিয়ে আপন মনে বলতে থাকেনঃ ‘হে আল্লাহ! আমি তো আর তাঁকে কিছু বলতে পারিনে। আপনি একটা বিচ্ছু অথবা সাপ পাঠিয়ে দিন, আমাকে দংশন করুন!

হযরত আয়িশা (রাঃ) এর ১২ পর্বের পুরো জীবনী পড়ুন-



*****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url