সাহাবাগণের জীবনকথা-২১ || হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর জীবনী (৫ম পর্ব)





স্বামী রাসূলুল্লাহ ও পিতা আবু বকরের ইনতিকাল


আয়িশা (রা) এর স্বামী রাসূলুল্লাহর  ইনতিকাল

হযরত ‘আয়িশার (রা) বয়স যখন আঠারো বছর তখন স্বামী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকাল করেন। হিজরী ১১ সনের সফর মাসের পূর্বে কোন একদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) ঘরে এসে দেখেন, তিনি মাথার যন্ত্রণায় আহ উহ করছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর এ অবস্থা দেখে বললেনঃ তুমি যদি আমার সামনে মারা যেতে, আমি তোমাকে নিজ হাতে গোসল দিয়ে কাফন-দাফন করতাম। ‘আয়িশার (রা) সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া জানালেন এভাবেঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তো একথা বলছেন এ জন্য যে, যাতে এই ঘরে অন্য একজন স্ত্রীকে এনে উঠাতে পারেন। একথা শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের মাথায় হাত রেখে বলে ওঠেনঃ হায় আমার মাথা! বলা হয়েছে, মূলত তখন থেকেই রাসূলাল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। এরপর তিনি হযরত মায়মূনার (রা) ঘরে গিয়ে শয্যাশয়ী হয়ে পড়েন। এ অবস্থায়ও তিনি নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট স্ত্রীর ঘরে রাত কাটাতেন। কিন্তু প্রত্যেক দিনই জানতে চাইতেন, আগামী কাল তিনি কোথায় থাকবেন? স্ত্রীগণ বুঝতে পারলেন তিনি ‘আয়িশার (রা) কাছেই থাকতে চাচ্ছেন। তাই তাঁরা সবাই অনুমতি দিলেন। সেই দিন থেকে পার্থিবীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ‘আয়িশার (রা) ঘরে অবস্থান করেন।

এখন কারো মনে এ প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত ‘আয়িশার (রা) কাছে যাওয়ার জন্য এত ব্যাকুল ছিলেন কেন? তাঁকে অতিমাত্রায় ভালোবসার কারণে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তা নয়। মূলত আল্লাহ ‘আয়িশাকে (রা) যে পরিমাণ বুদ্ধি, মেধা, স্মরণশক্তি, স্বভাবগত পূর্ণতা এবং চিন্তাশক্তি দান করেছিলেন তা জন্য কোন স্ত্রীর মধ্যে ছিল না। সুতরাং এমন ধারণা অমূলক নয় যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উদ্দেশ্যে ছিল, তাঁর জীভনের শেষ দিনগুলির যাবতীয় কথা, কাজ ও আচরণ যেন পূর্ণরূপে সংরক্ষিত থাকে। বাস্তবে তাই হয়েছে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওফাতে সংক্রান্ত অধিকাংশ সহীহ বর্ণনা ‘আয়িশার (রা) মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছেছে।

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রোগের তীব্রতা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এক পর্যায়ে তিনি ইমামতির জন্য মসজিদে যেতে অক্ষম হয়ে পড়েন। সহধর্মিণীগণ সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। রাসূলুল্লারহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট থেকে শেখা কিছু দু‘আ পড়ে তাঁরা ফুঁক দিচ্ছিলেন। হযরত ‘আয়িশা (রা) কিছু দু‘আ পড়ে ফুঁক দিয়েছিলেন।

ফজরের নামাযে সমবেত মুসল্লীরা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অপেক্ষায় বসে ছিলেন। তিনি কয়েকবার ওঠার চেষ্টা করতেই অচেতন হয়ে পড়ছিলেন। অবশেষে তিনি আবু বকরকে (রা) ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন। ‘আয়িশা (রা) বলেন, আমার ধারণা হলো, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্থলে যিনিই দাঁবাবেন মানুষ তাঁকে অপাংক্তেয় ও অশুভ মনে করবে। এজন্য আমি বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু বকর একজন নরম দিলেন মানুষ। তাঁরা দ্বারা এ কাজ হবে না। তিনি কেঁদে ফেলবেন। অন্য কাউকে নির্দেশ দিন। কিন্তু তিদ্বিতীয়বার একই নির্দেশ দিলেন। তখন ‘আয়িশা (রা) হাফসাকে (রা) অনুরোধ করলেন কথাটি আবার রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মন্তব্য করলেনঃ ‘তোমরা সবাই ইউসুফের সঙ্গিনীদের মত। বলে দাও, আবু বকর ইমামতি করবেন।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসুস্থ হয়ে পড়ার পূর্বে কিছু নগদ অর্থ ‘আয়িশার (রা) নিকট রেখে খরচ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। এখন এই প্রবল রোগের মধ্যে সে কথা স্মরণ হলো। ‘আয়িশাকে (রা) বললেনঃ সেই দিরহামগুলি কোথায়? ওগুলি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে ফেল। মুহাম্মদ কি বিরূপ ধারণা নিয়ে আল্লাহর সাথে মিলিত হবে? তখনই সেই অর্থ দরিদ্র লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়।

এখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শেষ সময়। ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথার কাছে বসা এবং তিনিও ‘আয়িশার (রা) সিনার সাথে ঠেস দিয়ে বসে আছেন। ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুস্থতার জন্য দু‘আ করে চলেছেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাত তাঁর হাতের মধ্যেই। হঠাৎ তিনি টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলেনঃ

আরবী হবে (আল্লাহুমা ওয়ার রাফীকিল আ‘লা)
অর্থাৎ, আল্লাহ! আমি সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুকেই গ্রহণ করছি।
‘আয়িশা (রা) বলেনঃ সুস্থ অবস্থায় তিনি বলতেন, প্রত্যেক নবীর মরণকালে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনের যে কোন একটি বেছে নেওয়ার ইখতিয়ার দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই শব্দগুলি উচারণের পর আমি বুগগেলাম যে, তিনি আমাদের থেকে দূরে থাকেই কবুল করেছেন। তিনি আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার তো বড় কষ্ট হচ্ছে। বললেনঃ কষ্ট অনুপাতে প্রতিদানও আছে।

‘আয়িশার (রা) হযরত রাসূলে কারীমকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামলে নিয়ে বসে আছেন। হঠাৎ তাঁর দেহের ভার অনুভব করলেন। চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, তিনি আর নেই। আস্তে করে পবিত্র মাথাটি বালিশের উপর রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

হযরত ‘আয়িশার (রা) সবচেয়ে বড় সম্মান ও মর্যাদা এই যে, তাঁরই ঘরের মধ্যে, এক পাশে রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র দেহ সমাহিত করা হয়।

একবার হযরত ‘আয়িশা (রা) স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর ঘরে একের পর এক তিনটি চাঁদ ছুটে এসে পড়ছে। তিনি এই স্বপ্নের কথা পিতা আবু বকর সিদ্দীককে (রা) বলেন। যখন রাসূলে কারীমকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ঘরে দাফন করা হলো তখন আবু বকর (রা) মেয়েকে বললেন, সেই তিন চাঁদের একটি এই এবং সবচেয়ে ভালোটি। পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, তাঁর স্বপ্নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় চাঁদ ছিলেন আবু বকর (রা) ও ‘উমার (রা)।

হযরত ‘আয়িশা (রা) আঠারো বছর বয়সে বিধবা হন এবং এ অবস্থায় জীভনের আরো আটচল্লিশটি বছর অতিবাহিত করেন। যতদিন জীবিত ছিলেন, কবর পাকের পাশেই ছিলেন। প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরের পাশেই ঘুমাতেন। একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বপ্নে দেখার পর সেখানে ঘুমোনো ছেড়ে দেন। হযরত ‘আমারকে (রা) ‘আয়িশার (রা) ঘরে দাফন করার পূর্ব পর্যন্ত হিজাব ছাড়া আসা-যাওয়া করতেন। কারণ, তখন সেখানে যে দুই জন শায়িত ছিলেন, তাঁদের একজন স্বামী এবং অপরজন পিতা। তাঁদের পাশে ‘উমারকে (রা) দাফন করার পর বলতেন, এখন ওখানে যেতে গেলে হিজাবের প্রয়োজন হয়।

আল্লাহ পাক আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের (পবিত্র সহর্ধমিণীগণ) জন্য দ্বিতীয় বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ইবন ‘আববাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ এক ব্যক্তি ইচ্ছা করলো যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর তাঁর কোন এক স্ত্রীকে বিয়ে করবে। ইে হাদীসের বর্ণনা সূত্রের একজন বর্ণনাকারী সুফইয়ানকে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলোঃ তিনি কি ‘আয়িশা (রা)? সুফইয়ান বললেনঃ বর্ণনাকারীরা তাই উল্লেখ করেছেন। সুদ্দী বলেনঃ যে ব্যক্তি এমন ইচ্ছা করেছিলেন, তিনি হলেন তালহা ইবন ‘উবাইদিল্লাহ। এরই প্রেক্ষিতে নিম্নের আয়তাটি নাযিল হয়ঃ

‘আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়া এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁর পত্মীগণকে বিয়ে করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহর কাছে এটা গুরুতর অপরাধ।

অপর আয়াতে আল্লাহ পাক আযওয়াজে মুতাহ্হারাতকে মুসলমানদের জননী বলে ঘোষণা দেন।

‘নাবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতা।’

মূলকথা হলো, আযওয়াজে মুতাহ্হারাত-যাঁরা তাঁদের জীবনের একটি অংশে মহানবীর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবন সঙ্গিনী ছিলেন, তাঁদের বাকী জীবনটাও স্বামীর শিক্ষা ও কর্মের অনুশীলন এবং চার-প্রসারে অতিবাহিত করবেন। তাঁরা মুসলমানদের মা। তাঁদের দায়িত্ব হবে সন্তানদের তা‘লীম ও তারবিয়্যাত (শিখ্সা ও প্রশিক্ষণ) দান করা। তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্বয়ং আল্লাহ বলে দিয়েছেন এভাবেঃ

‘হে নবী পত্মীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পর পুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না। ফলে সেই ব্যক্তি কু-বাসনা করে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থানকরবে-প্রথম জাহিলী যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। যামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পুত-পবিত্র রাখতে। আল্লাহর আংাত ও জ্ঞানগর্ভ কথা, যা তোমাদের গৃহে সঠিত হয়, তোমরা সেগুলো স্মারণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সর্ব বিষখেবর রাখেন।’

হযরত ‘আয়িশার (রা) বাকী জীবন ছির উপরে উদ্ধৃত আল্লাহর বাণীর বাস্তব ব্যাখ্যাস্বরূপ। হযরত রাসূল কারীমের (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর উম্মুল মুমিনীন হযরত ‘আয়িশার (রা) সম্মাণিত পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) খলীফা নির্বাচিত হলেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফন-দাফন ও খলীফা নির্বাচনের ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়ার কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগমগণ চাইলেন, হরত উসমানকে (রা) তাঁদের পক্ষ থেকে খলীফার নিকট পাঠাবেন উত্তরাধিকারের বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য। তখন ‘আয়িশা (রা) তাঁদেরকে স্মরণকরিয়ে দিলেন যে, রাসূল কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জীবদ্দশায় বলেছিলেন, ‘আমার কোন উত্তারাধিকারী থাকবে না। আমার পরিত্যক্ত সবকিছু সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে। এ কথা শুনে সবাই চুপ হয় যান।

আসলে রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিষয়-সম্পত্তি এমন কী-ইবা রেখে গিয়েছিলেন, যা তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হতে পারতো? হাদীসে এসেছে, তিনি দিরহাম ও দীনার, চতুস্পদ জন্তু, দাস-দাসী কিছুই মীরাছ হিসেবে রেখে যাননি।

তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল হিসেবে কয়েকটি বাগ-বাগিচা তিনি নিজের অধীনে রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবদ্দশায় তার আয় যে যে খাতে ব্যয় করতেন, খিলাফতে রাশেদাও তা একই অবস্থায় বহাল রাখেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগমগণের ব্যয় নির্বাহ করতেন এরই আয় থেকে, আবু বকরও (রা) তা বহাল রাখেন।

আয়িশা (রা) এর পিতার মৃত্যু

হযরত আবু বকর (রা) মাত্র দুই বছর খিলাফত পরিচালনার সুযোগ পান। হিজরী তেরো সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর যখন অন্তিম দশা তখন মেয়ে ‘আয়িশা (রা) পিতার শিয়রে বসা ছিলেন। এর আগে সুস্থ অবস্থায় তিনি মেয়েকে কিছু বিষয়-সম্পত্তি ভোগ-দখলের জন্য দিয়েছিলেন। এখন অন্য সন্তানদেরও বিষয়-সম্মতির প্রয়োজনের কথা মনে করে বললেনঃ আমার কিলজার টুকরো মেয়ে! তুমি কি ঐ বিষয়-সম্পত্তি তোমার অন্য ভাইদের দিয়ে দিবে? মেয়ে বললেনঃ অবশ্যই দব। তারপর তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেসকরেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফনে মোট কতখানা কাপড় ছিল? মেয়ে বললেনঃ তিনখানা সাদা কাপড়। আবার জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কোন দিন ওফাত পান? বললেনঃ সোমবার। আবার জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি বার? বললেনঃ সোমবার বললেনঃ তাহলে আজ রাতে আমাকেও যেতে হবে। তারপর তিনি নিজের চাদরটি দেখেলেন। তাতে জাফরানের দাগ ছিল। বললেনঃ এইকাপড়খানি ধুয়ে তার উপর আরো দুইখানি কাপড় দিয়ে আমাকে কাফন দিবে। মেয়ে বললেনঃ এই কাপড় তো পুরানো। বললেনঃ মৃতদের চেয়ে জীবিতদেরই নতুন কাপড়ের প্রয়োজন বেশি।১৮৫ সেই দিন রাতেই তিনি ওফাত পান। হযরত ‘আয়িশার (রা) হুজরার মধ্যে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাশে, একটু পায়ের দিকে সরিয়ে তাঁকে দাফন করা হয়। হযরত ‘আয়িশার (রা) হুজরায় পতিত এটা হলো দ্বিতীয় চাঁদ। এত অল্প বয়সে স্বামী হারানোর মাত্র দুই বছরের মধ্যো তিনি পিতাকে হারালেন।

খিলাফতে ফারুকী বা হযরত উমারের (রা) এর খিলাফত কাল

হযরত ফারুকে আজমের (রা) খিলাফতে কালটি ছিল সর্বদিক দিয়ে উৎকর্ষমন্ডিত। তিনি প্রত্যেক মুসলমানের জন্য নগদ ভাতা নির্ধারণ করে দেন। একটি বর্ণনা মতে, তিনি আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের প্রত্যেকের জন্য বাৎসিক বারো হাজার করে দিতেন। অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, অন্য আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের প্রক্যেককে দশ হাজার এবং আয়িশাকে (রা) বারো হাজার দিতেন। এমন প্রাধান্য দানের কারণ উমার (রা) নিজেই বলে দিয়েছে। আমি তাঁকে দুই হাজার এই জন্য বেশি দিই যে, তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাধিক প্রিয়পাত্রী।

আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের সংখ্যা অনুযায়ী খলীফা উমার (রা) নয়টি পিয়ালা তৈরি করান। যখন কোন জিনিস তাঁর হাতে আসতো, নয়টি ভিন্ন ভিন্ন পিয়ালা সকলের নিকট পাঠাতেন। হাদিয়া-তোহফা বণ্টনের সময় এতখানি খেয়াল রাখতেন যে, কোন জন্তু জবেহ হলে তার মাথা থেকে পায়া পর্যন্ত তাঁদের নিকট পাঠাতেন।

ইরাক বিজয়ের এক পর্যায়ে মূল্যবান মোতি ভর্তি একটি কৌটা মুসলমানদের হাতে আসে। অন্যান্য মালে গনীমতের সাথে সেটিও খলীফার দরবারে পাঠানো হয়। এই মোতির বণ্টন সকলের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। খলীফা উমার (রা) বললেনঃ আপনারা সকলে অনুমতি দিলে এই মোতিগুলি আমি উম্মুল মুমিনীন ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠিয়ে দিতে পারি। কারণ, তিনি ছিলেন রাসূলুল্লারহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাধিক প্রিয় পাত্রী। পাত্রটি ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠানো হলো। তিনি সেটা খুলে দেখে বললেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে ইবন খাওাব আমার প্রতি অনেক বড় বড় অনুগ্রহ দেখিয়েছেন। হে আল্লহ! আগামীতে তাঁর এমন সব অনুগ্রহ লাভের জন্য আমাকে জীবিত রেখো না।

খলীফা হযরত ‘উমারের (রা) বাসনা ছিল, ‘আয়িশার (রা) হুজরায় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কদম মুবারকের কাছে দাফন হওয়ার। কিন্তু একথা বলতে পারছিলেন না। তাঁর কারণ, যদিও মাটির নীচে চলে গেলে শরীয়াতের দৃষ্টিতে পুরুষদের থেকে পর্দা করা জরুরী নয়, তবুও আদব ও শিষ্টাচারের দৃষ্টিতে দাফনের পরেও তিনি আয়িশার নিকট গায়ের মাহরামই মনে করতেন। একেবারে অন্তিম মুহূর্তে এসব চিন্তায় তিনি বড় পেরেশান ছিলেন। শেষমেষ ছেলেকে পাঠালেন এই বলে যে, ‘উম্মুল মুমিনীনকে আমার সালাম পেশ করে বলবে, ‘উমারের বাসনা হলো তাঁর দুই বন্ধুর পাশে দাফন হওয়ার।’ ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ ‘যদিও আমি ঐ স্থানটি নিজের জন্য রেখেছিরাম, তবে আমি সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি।’

উম্মুল মুমিনীন ‘আয়িশার (রা) এই অনুমতি পাওয়ার পরেও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে ‘উমার (রা) অসীয়াত করে গেলেন, আমার লাশবাহী খাটিয়া তাঁর দরজায় নিয়ে গিয়ে আবার অনুমতি চাইবে। যদি তিনি অনুমতি দান করেন তাহলে ভিতরে দাফন করবে। অন্যথায় দাফন করবে সাধারণ মুসলমানদের গোরস্থানে। খলীফার ইনতিকালের পর তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা হয়। ‘আয়িশা (রা) দ্বিতীয়বার অনুমতি দান করেন এবং লাশ ভিতরে নিয়ে দাফন করা হয়।

আর এভাবে তিনি হলেন হযরত ‘আয়িশার (রা) স্বপ্নের তৃতীয় চাঁদ-যাঁর মাধ্যমে তাঁর স্বপ্ন সত্যে পরিণত হয়।


হযরত আয়িশা (রাঃ) এর ১২ পর্বের পুরো জীবনী পড়ুন-



*****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url