সাহাবাগণের জীবনকথা-২৩ || হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর জীবনী (৭ম পর্ব)





উটের যুদ্ধে হযরত আয়িশা (রা) এবং হযরত আলী (রা) কেউ দোষী ছিলেন না


উটের যুদ্ধে কূফাবাসীদের প্রতিক্রিয়া

মক্কা মু‘য়াজ্জামা, মদীনা মুনাওয়ারা ও বসরার পরে আরবের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল কূফা। হযরত আবু মূসা আল আশ‘য়ারী (রা) ছিলেন তথাকার ওয়ালী। উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা তাঁর কাছে নিজেরদর দাবীর যৌক্তিকতা তুলে ধরে তার সমর্থন কামনা করছিল। মহান সাহাবী হযরত আবু মূসা (রা) এই বিবাদের গুরুত্ব উপলদ্ধি করে নিজের প্রভাবের দ্বারা ও খুতবার মাধ্যমে এর থেকে দূরে থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানালেন। হযরত আয়িশা (রা) কূফার নেতৃবৃন্দের নামে পৃথক পৃথক চিঠি পাঠালেন। এদিকে হযরত আলীর (রা) পক্ষ থেকে হযরত আম্মার ইবন হয়াসির ও ইমাম আল-হাসান (রা) কূফায় পৌঁছলেন। হযরত আম্মার কূফার জামে‘ মসজিদে প্রদত্ত এক ভাষণে তৎকালীন ঘটনাবলী স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। সেই ভাষণে তিনি হযরত আয়িশার (রা) সম্মান ও মর্যাদা বর্ণনার পরে বলেন, এ সব কিছু সঠিক। কিন্তু আল্লাহও ব্যাপারে তাঁর পরীক্ষা নিচ্ছেন। আম্মারের (রা) এ ভাষণ কূফাবাসীদের উপর দারুণ প্রভাব ফেলে। কয়েক হাজার মুসলমান তাঁর আবেদনে সাড়া দেন। তা সত্ত্বেও কূফাবাসীর মনে এই দ্বিধা ও সংকোচ কাজ করতে থাকে যে, একদিকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগম উম্মুল মুমিনীন, আর অন্যদিকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যার স্বামী এবং চাচাতো ভাই-এই দুই জনের কার সাথে যাওয়া যেতে পারে।

এই দিকে হযরত আয়িশা (রা) বসরার সন্নিকটে পৌঁছে লোক মারফত শহরের আরব নেতৃবৃন্দের প্রত্যেকের নিকট চিঠি পাঠালেন। পরে বসরা পৌঁছে কোন কোন নেতার গৃহেও গেলেন। শহরের একজন নেতা তাঁর আহবানে সাড়া দিচ্ছিলেন না। তিনি নিজে তাঁর গৃহে যেয়ে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। সে বললোঃ ‘আমার মায়ের কথা না মানতে পেরে আমার লজ্জা হচ্ছে।’

হযরত আলীর (রাঃ) পক্ষ থেকে তখন বসরার ওয়ালী ছিলেন ‘উসমান ইবন হুনাইফ। তিনি প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য ইমরান ইবন হুসাইন ও আবুল আসওয়াদকে পাঠালন। তাঁরা হযরত আয়িশার (রা) নিকট উপস্থিত হয়ে ওয়ালীর পক্ষ থেকে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চান। আয়িশা (রা) তাঁদেরকে বলেন, ‘আল্লাহ কসম’ আমার মত ব্যক্তিরা কোন কথা গোপন রেখে ঘর থেকে বের হতে পারে না। আর না কোন মা প্রকৃত ঘটনা তার সন্তানদের কাছে লুকাতে পারে।’ তারপর তিনি তাদের সামনে মদীনার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন এবং উসমান (রা) হত্যাকারীদের শাস্তিদান ও উম্মাতের মধ্যে যে দ্বন্দ-সংঘাত দেখা দিয়েছে তা মিটিয়ে ফেলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সব শেষে তিনি বলেনঃ ‘তোমাদেরকে ভালো কাজের আদেশ করা এবং খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করা আমার কাজ।’ তারপর তিনি পাঠ করেনঃ

“তাদের অধিকাংশ সলা-পরামর্শ ভালো নয়; কিন্তু যে সলা-পরামর্শ দান-খয়রাত করতে কিংবা সৎকাজ করতে কিংবা মানুষের মধ্যে সন্ধিস্থাপন কল্পে করতো, তা স্বতন্ত্র।”

এই দুই ব্যক্তি হযরত আয়িশার (রা) নিকট থেকে উঠে হযরত তালহা ও যুবাইরের (রা) কাছে যান। তাঁদের থেকে বিদায় নিয়ে আবার হযরত আয়িশার (রা) নিকট যান। তখন তিনি বলেনঃ আবুল আসওয়াদ, তোমার প্রবৃত্তি যেন তোমাকে দোযখের দিকে নিয়ে না যায়। তারপর তাদেরকে এ আয়াতটি পাঠ করে শোনানঃ

‘তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে।’
‘আয়িশার (রা) বক্তব্যের প্রভাব এই হলো যে, প্রতিনিধিদ্বয়ের একজন সদস্য-ইমরান নিজেকে এই বিবাদ থেকে দূরে সারিয়ে নিলেন এবং বসরার ওয়ালীকেও তাঁর মত পরিবর্তন করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তিনি বিরত হলেন না; বরং সব রায় হযরত আলীর (রা) পক্ষে জনমত সৃষ্টি চেষ্ট চালিয়ে যেতে লাগলেন। এদিকে তালহা, যুবাইর ও আয়িশা (রা) বক্তৃতা-ভাষণের মাধ্যমে বসরার জনগণকে তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানাতে থাকলেন। একদিন এক সমাবেশে তালহা ও যুবাইর (রাঃ) বক্তৃতা করার পর শ্রোতাদের মধ্যে দ্বিধা-সংশয় লক্ষ্য করে হযরত আয়িশা (রা) অত্যন্ত ধীরস্থীর ও গম্ভীর গলায় হামদ ও না‘ত পেশ করার পর নিম্নোক্ত ভাষণটি দান করেনঃ

‘জনগণ উসমানের (রা) কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করতো, তাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দোষ-ত্রুটি প্রচার করতো। মানুষ মদীনায় এসে আমাদের কাছে পরামর্শ ও উপদেশ চাইতো। আমরা তাদেরকে সন্ধি ও আপোষ-মীমাংসার যে উপদেশ দিতাম তা মেনে নিত। উসমানের (রা) বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ ছিল, আমরা সে বিষয়ে গভীরভাবে খতিয়ে দেখে তাঁকে একজন নিষ্পাপ পরহেযগার ও সত্যবাদী ব্যক্তি হিসেবে পেতাম। আর শোরগোলকারীদেরকে দেখতাম তারা পাপাচারী ও ধোঁকাবাজ। তাদের অন্তরে ছিল এক কথা, আর মুখে ভিন্ন কথা। তাদের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পেল তখন তারা বিনা কারণে এবং বিনা দোষে উসমানের (রা) গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। অতঃপর যে রক্ত প্রবাহিত করা বৈধ ছিল না, তা তারা করেছে, যে ধন-সম্পদ লুটপাট করা সঙ্গত ছিল না, তা করেছে, আর যে পবিত্র ভূমির মর্যাদা রক্ষা করা তাদের উপর ফরয ছিল, তারা তার অমর্যাদা ও অসম্মান করেছে। সাবধান! এখন যে কাজ করতে হবে এবং যার বিরোধিতা করা উচিত হবে না, তাহলো ‘উসমানের (রা) হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা এবং শক্তভাবে আল্লাহর হুকুম ও বিধান বলবৎ করা। আল্লাহ বলেছেনঃ “আপনি কি তাদের দেখেছেন, যারা কিতাবের কিছু অংশ পেয়েছে-আল্লাহর কিতাবের প্রতি তাদের আহবান করা হয়েছিলো যাতে তাদের মধ্যে মীমাংসা করা যায়। অতঃপর তাদের মধ্যে একদল তা অমান্য করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”

ইবন আবদি রাবিবহি আল-আন্দালুসী হযরত আয়িশার (রা) এ সময়ের একটি ভাষণ তাঁর গ্রন্থে সংকলন করেছেন, যা ভাষা ও বাকশৈলীর দিক দিয়ে অতি চমৎকার। এখানে তাঁর অনুবাদ দেওয়া হলো-

‘ওহে জনমন্ডলী! চুপ করুন! চুপ করুন! আপনাদের উপর আমার মায়ের দাবী আছে। আপনাদেরকে উপদেশ দানেরও অধিকার আমার আছে। একমাত্র খোদা-দ্রোহী মানুষ ছাড়া কেউ আমার প্রতি কোন প্রকার দোষারোপ করতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার বুকে মাথা রেখে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আমি তাঁর প্রিয়তমা বেগমদের অন্যতম। আল্লাহ পাক অন্য মানুষ থেকে আমাকে সর্বেোতবে সংরক্ষণ করেছেন। আমার সত্তা দ্বারা মুমিন ও মুনাফিকের পরিচয় নির্ণিত হয়েছে এবং আমাকে উপলক্ষ্য করে আল্লাহ আপনাদের জন্য তায়াম্মুমের বিধান দান করেছেন।

আমার পিতা এ পৃথিবীর তৃতীয় মুসলমান এবং ছাওর পর্বতের গুহায় দুইজনের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘সিদ্দীক’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় এবং তাঁর গলায় খিলাফতের মালা পরিয়ে ইনতিকাল করেছেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওফাতের পর যখন ইসলামের রশি দুলতে থাকে তখন আমার পিতাই তা শক্ত হাতে মুট করে ধরেন। তিনিই নিফাক (কপটতা)-এর লাগাম টেনে ধরে, ধর্মত্যাগের ঝর্ণা লুকিয়ে ফেলেন, এবং ইহুদীদের আগুণে ফুঁ দেওয়া বন্ধ করে দেন। আমরা সেই সময় চোখ বন্ধ করে ধোঁকাবাজি, বিশ্বাসহীনতা ও ফিতনা-ফাসাদের প্রতীক্ষায় ছিলাম। …হ্যাঁ, এখন আমি মানুষের প্রশ্নের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছি। কারণ, আমি বাহিনী নিয়ে বের হয়েছি। আমার এ বের হওয়ার উদ্দেশ্য পাপ ও ফিতনার অনুসন্ধান নয়-যা আমি নিশ্চিহ্ন করতে চাই, যা কিছু আমি বলছি সত্য ও ন্যায়ের সাথে বলছি। আমার ওজর-আপত্তি তুলে ধরা এবং আপনাদেরকে জ্ঞাত করানোর জন্য বলছি। আল্লাহ পাক নবী মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর দরূদ ও সালাম নাযিল করুন।’

জনগণ নীরবে মনোযোগ সহকারে তাঁর ভাষণ শুনছিল। তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ প্রতিপক্ষের লোকদের অন্তরেও তীরের ফলার মত গেঁথে যাচ্ছিল। তাদের অনেকে স্বপক্ষ ত্যাগ করে আয়িশার (রা) সেনাক্যাম্পে এসে যোগ দেন।

বসরায় পেঁছে হযরত আয়িশা (রা) কূফার ওয়ালী এবং কূফা ও বসরার আশে পাশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিকট তাঁর এভাবে আগমনের উদ্দেশ্য ও তাদের করণীয় কর্তব্য বর্ণনা করে চিঠি লেখেন। উল্লেখ্য যে, ‘আলী (রা) আয়িশা (রা) চূড়ান্ত পর্যায়েরর মুখোমুখি-যাকে উটের যুদ্ধ বলা হয়-হওয়ার আগে উভয় পক্ষের লোকদের মধ্যে ছোটখাট অনেক সংঘর্ষ হয় এবং তাতে বহু লোক হতাহত হয়। অবশেষে বসরায় আয়িশার (রা) কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

এ দিকে হযরত আলী (রা) হযরত মু‘য়াবিয়াকে (রাঃ) নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মদীনা থেকে সিরিয়া যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় বসরার এই সমাবেশের কথা অবগত হয়ে এর একটা বিহিত ব্যবস্থা করার জন্য সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু বহু সংখ্যক সাহাবী এবং তাদের অনুগামী লোকেরা যারা মুসলমানদের এই গৃহযুদ্ধকে একটি ফিতনা বা পরীক্ষা বলে মনে করছিলেন, এ যাত্রায় আলীর (রা) সহগামী হতে রাজি হলেন না। হিজরী ৩৬ সনের রবী‘উস সানী মাসে হযরত আলী (রা) মদীনা থেকে বসরার দিকে যাত্রা করেন।সেদিন বহু সাহাবীর আলীর (রা) পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন না করার ফল এই হলো যে, সেই উসমান (রা) হত্যাকারীরা-যাদেরকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য আলী (রা) সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীর মধ্যে ঢুকে গেল। যা একদিকে যেমন তাঁর দুর্নামের কারণ হয়ে দাঁড়ালো, তেমনি নানা সমস্যারও। বসরা শহরের অদূরে যেদিন উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা) এবং আমীরুল মুমিনীন আলীর (রা) বাহিনীদ্বয় পরস্পর মুখোমুখি হন, সেদিন মুসলিম উম্মাহর প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষের বিরাট একটি দল আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালালেন ঈমানদার লোকদের এই দুইটি দলকে সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে বিরত রাখার জন্য। তাঁদের চেষ্টায় আপোষ মীমাংসার কথাবার্তা পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একদিকে আলীর (রা) বাহিনীতে উসমান (রা) হত্যাকারীরা বিদ্যমান ছিল-যারা বুঝেছিল, যদি আপোষ-মীমাংসা হয়ে যায় তাহলে তাদের রক্ষা নেই, অন্যদিকে উম্মুল মুমিনীনের বাহিনীতে সেই লোকেরা ছিল, যারা দুইটি দলকে লড়িয়ে উভয়কে দুর্বল করে ফেলতে চাচ্ছিল। এ কারণে সৎ লোকেরা যে যুদ্ধটিকে ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্ট করেছিলেন, উভয় পক্ষের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অপশক্তি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে শেষ পর্যন্ত তা বাধিয়ে দিল এবং উটের যুদ্ধ হয়েই গেল।

উটের যুদ্ধের হৃদয় বিদারক ঘটনাবলী ও যুদ্ধের ফলাফল

হযরত আলী (রা) মদীনা থেকে মাত্র সাতশো লোক সংগে করে যাত্রা করেছিলেন। কূফা থেকে আরো সাতহাজার লোক যোগ দেয়। একটি ছোট্ট বাহিনী নিয়ে তিনি বসরায় পৌঁছেন। উভয় বাহিনী রণক্ষেত্রে মুখোমুখি হলো। আরবের প্রতিটি গোত্রের লোক সেদিন দুই ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুদার গোত্রের এক ভাগ অন্য ভাগের সামনে দাঁড়ায়। এমনিভাবে আযদসহ অন্য সকল গোত্রও-একাংশ আরেক অংশের বিপক্ষে দাঁড়ায়। সত্যিই যে এটি একটি মর্মবিদারী দৃশ্য। সে দিন উভয় দলের, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রতিটি সদস্য ছিলেন সত্যের সিপাহী। প্রত্যেকে দূঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন যে তারা সত্যের উপর আছেন। কেউই নিজের অবস্থান থেকে বিন্দু মাত্র সরতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কুফার কোন কোন গোত্রের নেতারা তাদের স্বগোত্রীয় বসরী নেতাদের মসজিদে যান বেং তাঁদেরকে এই ঝগড়া থেকে দূরত্ব বজায় রাখার আহবান জানান। কিন্তু তাঁরা জবাব দেয়ঃ আমরা কি উম্মুল মুমিনীনকে একাকী ছেড়ে দেব?

তা সত্ত্বেও উভয় পক্ষের লোকদের দূঢ় বিশ্বাস ছিল, ব্যাপারটি যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াবে না। একটা নিষ্পত্তি শেষ পর্যন্ত হয়ে যাবে। একজন গোত্রীয় নেতা হযরত আলীর (রা) নিকট যেয়ে একটা আপোষ-মীমাংসায় পৌঁছার জন্য তাকিদ দিলেন। তিনি তো প্রথম থেকেই রাজি ছিলেন। আলীর (রা) নিকট থেকে উক্ত নেতা তালহা, যুবাইর ও মুমিনীন‘‘ এই কর্মকান্ডে আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি? বললেনঃ উসমানের (রা) হত্যকারীদের শাস্তি দান এবং আপোষ-মীমাংসার আহবান। গোত্রীয় নেতা বললেনঃ উম্মুল মুমিনীন! একটু ভেবে দেখুন তো, পাঁচ শো মানুষের শাস্তির জন্য পাঁচ হাজার মানুসের রক্ত ঝরিয়েছেন এবং পাঁচ হাজারের জন্য আপনাকে হাজার হাজার মানুষেল রক্ত ঝরাতে হবে। এ কেমন ইসলাহ ও সংশোধন হলো? লোকটির বক্তব্য এত স্পষ্ট ও শক্তিশালী ছিল যে, উম্মুল মুমিনীন নিরুত্তর হয়ে গেলেন। তিনি আপোষ করতে রাজি হলেন এবং সবাই মিলে সিদ্ধান্তে এসে গেলেন।

এখন উভয় পক্ষ নিশ্চিন্ত। যুদ্ধ-বিগ্রহের চিন্তা তাদের অন্তর থেকে দূর হয়ে গেল। সবকিছু ঠিকঠাক মত নিষ্পাত্তির ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ থাকলো না। কিন্তু উভয় পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান দুস্পৃতিকারীরা দেখলো, যদি আপোষ-মীমাংসা হয়ে যায় তাহলে তাদের বিপদের অন্ত নেই। তাছাড়া তাদের বহু বছরের পরিকল্পনা ও চেষ্টা সাধনা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তারা তখন সক্রিয় হয়ে উঠলো। সাবায়ী দলের বিরাট একটি সংখ্যা আলীর (রা) পক্ষে ছিল। আলাপ-আলোচনার পর উভয় দলের লোকেরা যখন রাতের শেষ প্রহরে ঘুমিয়ে ছিল তখন এই সাবায়ীরা আক্রমণ করে বসলো। এই কিছু সংখ্যক পাপাত্মা হঠাৎ করে চতুর্দিকে আগুন জ্বালিয়ে দিল। ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে প্রত্যেকে নিজের অস্ত্রটি হাতে তুলে নিল। প্রত্যেক গ্রুপ ও দলের নেতারা বিশ্বাস করলো, প্রতিপক্ষ তাদের নিদ্রার সুযোগে চুক্তি ভঙ্গ করে আক্রমণ করে বসেছে। হযরত আলী (রা) লোকদের থামাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন।
সকাল পর্যন্ত এ হৈ হাঙ্গামা চলতে থাকে। হৈ চৈ শুনে হযরত আয়িশা (রা) জিজ্ঞেস করেনঃ কি হয়েছে? জানতে পারলেন, লোকেরা যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। বসরার কাজী কা‘ব ইবন সুওয়ার হযরত আয়িশার (রা) নিকট এসে বললেন, আপনি উটের পিঠে চড়ে চলুন। হতে পারে লোকেরা আপনার মাধ্যমে সন্ধি করে নেবে। তিনি লোহার তৈরি হাওদা উটের পিঠে বেঁধে তাঁর মধ্যে বসে সৈন্যবাহিনীর মাঝ বরাবর চলে আসেন। এদিকে হযরত আলী (রাঃ) তাঁর প্রতিপক্ষ হযরত তালহা ও হযরত যুবাইরকে ডেকে আনেন। এই তিন মহান সাহাবী ঘোড়ার উপর বসা অবস্থায় কিছুক্ষণ এক স্থানে অবস্থান করেন। বদর-উহুদের সহযোদ্ধাত্রয়ীর আজ এমন অবস্থান! সত্যি সে এক পীড়াদায়ক দৃশ্য। আলী (রা) তাঁদের দুইজনকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁদেরও স্মারণ হলো। সাথে সাথে যুবাইর (রা) যুদ্ধের ইচ্ছা অন্তর থেকে মুছে ফেলেন। ছেলে ‘আবদুল্লাহ পাশেই ছিলেন। তিনি পিতাকে ভীরু, কাপুরুষ বলে তিরস্কার করেন। যুবাইর জবাব দেন, লোকেরা জানে আমি ভূীরু নই। তবে আলী (রা) আমাকে একটি কথা স্মারণ করে দিয়েছেন, যা আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি। আশি শপথ করছি, তাঁর বিরুদ্ধে আমি আর লড়বো না।

তিনি ঘোড়ার লাগামে টান দিয়ে মুখ গুরিয়ে রণক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে মদীনার দিকে যাত্রা করেন। ইবন জুরমূয নামক এক সাবায়ী তাকে অনুসরণ করে এবং পথিমধ্যে সে নামাযে সিজদারত অবস্থায় তরবারির এক আঘাতে তাঁর দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

হযরত তালহাও (রাঃ) রণক্ষেত্র থেকে সরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি উমাইয়্যা গোত্রের মারওয়ানের দৃষ্টিতে পড়ে যান। সে বুঝেছিল, যদি তালহা জীবিত ফেরে তাহলে উমাইয়্যা খান্দানের প্রতিষ্ঠা কঠিন হবে। সে তাঁকে তাক করে একটি বিষাক্ত তীর ছোড়ে। তীরটি তাঁর পায়ে বেধে। কোনভাবেই রক্ত পড়া বন্ধ করা গেল না। এই আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এদিকে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রা) কা‘ব ইবন সুওয়ারকে ডেকে তাঁর হাতে নিজের কুরআনের কপিটি দিয়ে বলেন, যাও এটি দেখিয়ে মানুষকে আপোষ-মীমাংসার আহবান জানাও। তিনি কুরআন খুলে উভয় দলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন। দৃষ্কৃতিকারীরা দূর থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়ে। ফলে তিনিও শাহাদাত বরণ করেন।

দুপুর হয়ে গেল। আক্রমণ ছিল অতর্কিত। হযরত আয়িশার (রা) বাহিনীর অধিনায়করা শেষ পর্যন্ত এই ফিতনা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিলেন। এ কারণে তাঁর বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়লো। এই যুদ্ধের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, উভয় পক্ষের গরিষ্ঠ অংশের বিশ্বাস ছিল, প্রতিপক্ষ আমাদের মুসলিম ভাই। এ কারণে, প্রত্যেকে তার প্রতিপক্ষের হাত পা বা অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আঘাত করার চেষ্টা করছিল। সবাই চেষ্টা করছিল যাতে মাথা ও বুকে আঘাত না লাগে। উদ্দেশ্য; হাত-পা কাটা গেলেও যাতে জীবনে বেঁচে থাকে। তারা আন্তরিকভাবে কামনা করছিল, যুদ্ধ বন্ধু হোক। রণক্ষেত্রের বিভিন্ন স্থানে সৈনিকদের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হাত-পায়ের স্তুপ হয়ে গিয়েছিল।

সাবায়ীদের বাসনা ছিল, আয়িশাকে (রাঃ) হাতের মুঠোয় পেলে চরমভাবে অবমাননা করা হবে। সুতরাং হযরত তালহা ও যুবাইরের (রা) শাহাদাতের পর কূফাবাসীরা তাঁর উপর আক্রমণের লক্ষ্যে এগিয়ে আসে। হযরত আয়িশার (রা) বাহিনীর লোকেরাও চতুর্দিক থেকে গুটিয়ে যায়। উম্মুল মুমিনীনের উটটি একই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল। চতুর্দিক থেকে নিক্ষিপ্ত তীর-বর্শা এসে আঘাত করছিল তাঁর বর্ম আচ্ছাদিত হাওদায়। সন্তানেরা ডানে-বামে সাম–পিছন থেকে আক্রমণ প্রতিহত করে চলচিল। তখন তাদের অনেকের মুখে এই দুইটি চরণ উচ্চারিত হচ্ছিল।

“হে আমাদের মা, হে আমাদের সেই মা-যাঁকে আমরা সর্বোত্তম বলে জানি! আপনি কি দেখছেন না, কত বীর সন্তানকে আহত করা হচ্ছে এবং তাদের হাত ও মাথা কাটা যাচ্ছে?”

এখন চতুর্দিক থেকে এ আওযায় উঠতে লাগলো যে, যতক্ষণ না উম্মুল মুমিনীনের উটটি আঘাত করে বসিয়ে দেওয়া যাবে, এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হবে না। বনু দাববা উটের চতুর্দিকে একটা বেষ্টনী করে রেখেছিল। কেউ উটের দিকে আগানোর চেষ্টা করলেই তাকে তারা জীবিত ছেড়ে দিচ্ছিল না। তারা তখন একটা আবেগ ও উত্তেজনাপূর্ণ সংগীত গেয়ে চলছিল। তার তিনটি শ্লোক নিম্নরূপঃ

-‘আমরা দাববার সন্তান, এই উটের রক্ষক। মৃত্যু আমাদের নিকট মধুর চেয়ে মিষ্টি।
-আমরা মৃত্যুর সন্তান-মৃত্যু যখন আসে। আমরা আফফানের ছেলে উসমানের মৃত্যুর ঘোষণা নিযার ফলার সাহায্যে করি।
-তোমরা আমাদের নেতাকে ফিরিয়ে দাও, তাহলে তোমাদের সাথে কোন দ্বন্দ্ব নেই।’

আবেগ ও উত্তেজনা এমন প্রবল ছিল যে, বনু দাববার একজন একজন করে এগিয়ে গিয়ে উটের লাগাম ধরছিল, প্রতিপক্ষের আঘাতে তার হাত বিচ্ছিন্ন হলে অন্য একজন ছুটে এসে লাগামটি মুঠ করে ধরছিল। এভাবে একই স্থানে উটের লাগাম ধরা অবস্থায় ৭০ (সত্তর) ব্যক্তির হাত বিচ্ছিন্ন হয়। এমনিভাবে উম্মুল মুমিনীনের প্রতিপক্ষের যে কোন হাত সে দিন উটের লাগামের প্রতি বাড়ানো হয়েছিল, তা আর আস্ত ফিরিয়ে নিতে পারেনি। হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা) নিকটেই দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি বলেনঃ কর্তিতহাত যেন তখন বাতাসে উড়ছিল। এ দৃশ্য দেখে হযরত আলী (রা) ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে আসেন। আশতার আন-নাখ‘ঈ আবদুল্লাহ বিন যুবাইয়ের কাছে পৌঁছে গেলেন। দুইজনই ছিলেন সাহসী বীর পুরুষ। উভয়ের মধ্যে অসির যুদ্ধ শুরু হলো। দুইজন আহত হলেন। এ অবস্থায় একে আপরকে জড়িয়ে ধরলেন। ইবন যুবাইর (রা) চেঁচিয়ে বলে উঠলেনঃ “মালিক ও আমাকে মেরে ফেল। আমার সাথে মালিককেও হত্যা কর।”

পরবর্তীকালে আশতার নাখ‘ঈ বলতেনঃ লোকেরা আমাকে মালিক নামে জানতো না, তাই সে দিন রক্ষা পেয়েছিলাম। অন্যথায় আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতো।

বনু দাববার কিছু লোক আলীর (রা) পক্ষেও ছিলেন। তাঁরা দেখলেন উট যদি তাঁদের দৃষিট আড়ালে না আনা যায় তাহলে যেভাবে লোক মারা যাচ্ছে তাতে তাঁদের গোত্র নির্মূল হয়ে যাবে। এমন চিন্তা মাথায় আসার পর দাববা গোত্রের বুজাইর ইবন দালজা’ নামক এক ব্যক্তি পিছন দিক থেকে এসে উটের পায়ে তরবারিরর এমন আঘাত হানেন যে, উট হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ে। আর সাথে সাথে উটকে কেন্দ্র করে আয়িশার (রা) পক্ষে যাঁরা লড়ছিলেন তারা সরে গেলেন। আলীর (রা) কোন রক্ম আঘাত পেয়েছেন কিনা। হাত দেখেই আয়িশা (রা) গর্জে ওঠেনঃ এ কোন মালউনের (অভিশপ্ত) হাত? আয়িশা বলেনঃ না, তুমি মুহাম্মদ (প্রশংসিত) নও, তুমি মুজাম্মম (নিন্দিত)। অন্য একটি বর্ণনা মতে আয়িশা প্রশ্ন করেনঃ কে? মুহাম্মাদ বলেনঃ আপনার অনুগত ভাই। আয়িশা (রা) বলেনঃ তুমি অনুগত নও, বরং অবাধ্য। মুহাম্মদ প্রশ্ন করেনঃ বোন! আপনি কি কোন আঘাত পেয়েছেন? আয়িশা (রা) জবাব দেনঃ তাতে তোমার কি?

এরই মধ্যে হযতর আলী (রাঃ) উটের কাছে এসে হাজির হলেন। তিনি জানতে চাইলেনঃ আম্মা, আপনি কেমন আছেন? আয়িশা (রা) বললেনঃ ভালো আছি। আলী (রা) বললেনঃ আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আয়িশা বললেনঃ আল্লাহ আপনাকেও ক্ষমা করুন।

হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির (রা) কাছেই ছিলেন। তিনি বললেনঃ মা, আপনার সন্তনদের এ লড়াই কেমন দেখলেন? আয়িশা (রা) বললেনঃ আমি তোমার মা নই। আম্মার (রা) বললেনঃ আপনার পছন্দ না হলেও আপনি আমার মা। আয়িশা (রা) বললেনঃ বিজয়ী হয়েছো বলে গর্ব করছো। যেভাবে বদলা নিয়েছো তাই সংগে নিয়ে এসেছো। জেনে রাখ, যাদের আচরণ এমন হয় তারা কখনও বিজয়ী হতে পারে না।

হযরত আয়িশা (রা) বসরা থেকে সোজা মক্কা মুকাররামায় চলে যান। পরবর্তী হজ্জ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তারপর মদীনায় ফিরে যান এবং আজীবন সেখানে বসবাস করেন। পরিশুদ্ধির যে পদ্ধতি তিনি অবলম্বন করেন, সারা জীবন তার জন্য আফসোস করেছেন।ইবন সা‘দ বর্ণনা করেছেন, হযরত আয়িশা (রা) বলতেনঃ হায়, যদি আমি বৃক্ষ হতাম,! হায়, যদি আমি পাথর হতাম! হায়, যদি আমি কিছুই না হতাম। একথা বলা দ্বারা তার আফসোসের পরিমণ অনুমান করা যায়।

একবার বসরার অধিবাসী এক ব্যক্তি আয়িশার (রা) সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। আয়িশা (রা) তাকে প্রশ্ন করেনঃ তুমি কি আমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলে? লোকটি জবাব দিলঃ হাঁ। আয়িশা (রা) প্রশ্ন করেনঃ তুমি কি সেই ব্যক্তিকে চেন, যে সেদিন এই চরণটি আবৃত্তি করেছিল।

লোকটি বললোঃ সে তো আমার ভাই। বর্ণনকারীর বলেছেন যে, তারপর হযরত আয়িশা (রাঃ) এত কাঁদলেন যে, আমার মনে হলো এ কান্না যেন আর থামবে না। ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন, মৃত্যুর সময় তিনি অসীয়াত করেন যে, আমাকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরের পাশে দাফন করবে না। বাকী‘ গোরস্থানে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য স্ত্রীদের সাথে দাফন করবে। ইবন সা‘দ বর্ণনা করেছেন। আয়িশা (রা) মৃত্যুর সময় বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে একটি নতুন কাজ করেছি। সুতরাং তোমরা আমাকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের সাথে দাফন করবে। একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি যখন আয়াত “তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে” তিলাওয়াত করতেন তখন এত কাঁদতেন যে, চোখের পানিতে আঁচল ভিজে যেত। উটের যুদ্ধের শেষ হওয়ার পর হযরত আয়িশা (রা) আল-কা‘কা ইবন আমরকে বলেছিলেনঃ আল্লাহর কসম! আমি যদি আজকের এ দিনটির আরো বিশ বছর পূর্বে মারা যেতাম, তাহলে কতনা ভালো হতো।’ আর সে কথা শুনে আলী (রা)ও ঠিক একই রকম মন্তব্য করেছিলেন।

‘আইন ইবন দুরাইয়া আল-মাজাশি’ নামক এক ব্যক্তি এসে হাওদার মধ্যে ইট মারতে থাকে। ‘ধায়িশা (রা) বলেনঃ সরে যাও। তোমার উপর আল্লাহর অভিশাপ। লোকটি বলেঃ আমি শুধু হুমায়রাকে এক নজর দেখতে চাই। হযরত ‘আয়িশা (রা) তখন লোকটির প্রতি অভিশাপ দিয়ে বলেনঃ ‘আল্লাহ তোমার আবরু-ইজ্জত উন্মুক্ত করুন, তোমার হাত বিচ্ছিন্ন করুন এবং তোমার লজ্জাস্থান প্রকাশ করুন’ পরে লোকটি বসরায় নিহত হয়। তার সকল জিনিসপত্র লুণ্ঠিত হয়ে। হাত-পা কর্তিত ও উলঙ্গ অবস্থায় আযদ গোত্রের একটি বিরান ভূমিতে তার লাশটি পাওয়া যায়।

হযরত ‘আলী (রা) মুহাম্মদ ইবন আবী বকরের নেতৃত্বে উম্মূল মুমিনীনকে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে তাঁরই পক্ষাবলম্নকারী বসরার এক নেতা- ‘আবদুল্লাহ ইবন খালাফ আল-খুযা’ঈ-এর গৃহে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। হযরত ‘আয়িশার (রা) বাহিনীর আহত সৈনিকরা সেই বাড়ির ঘর ও বাইরের প্রতিটি স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। অতপর হযরত ‘আলী (রা), হযরত ইবন ‘ধাববাস (রা) ও আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি উম্মুল মুমিনীনের সাথে সাক্ষাৎ করতে সেখানে যান। হযরত ‘আলী (রা) উম্মূল মুমিনীনকে সালাম করেন এবং কিছুক্ষণ তাঁর পাশে অবস্থান করেন। হযরত ‘আলী (রা) জানতেন যে, এই বাড়িতে প্রতিপক্ষের আহত সৈনিকরা আশ্রয় গ্রহণ করেছে। কিন্তু তিনি সে বিষয়ে কোন কথা উচ্চারণরণ করলেন না।

উম্মূল মুনিনীন কয়েকদিন বসরায় অবস্থান করেন। তারপর হযরত ‘আলী (রা) যথাযোগ্য মর্যাদায় ও সম্মানের সাথে মুহাম্মদ ইবনে আবী বকরের (রা) তত্ত্বাবধানে চল্লিশজন সম্ভ্রান্ত বসরী মহিলা সমভিব্যাহারে তাঁর হিজাযে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। বারো হাজার দিরহামও সাথে দিয়ে দেন। হযরত ‘আলী (রা) সহ অসংখ্য সাধারণ মুসলামান বহুদূর পর্যন্ত তাঁদেরকে এগিয়ে দেন। ইমাম হাসান (রা) বহু মাইল পথ সেই কাফেলার সাথে চলেন। হিজরী ৩৬ সনের ১লা রজব শনিবার উম্মূল মুমিনীর বসরা থেকে যাত্রা করেন। যাত্রাকালে জনগণকে তিনি বলেনঃ ‘আল্লাহর কসম, একজন নারীর তার জামাইদের সাথে যে রকম সম্পর্ক থাকে, তাছাড়া অন্য কোন বিদ্বেষমূলক সম্পর্ক তাঁর (‘আলী) ও আমার মধ্যে অতীতে ছিল না। আমার জানা মতে তিনি সৎ লোকদের একজন।’ জবাবে ‘আলী (রা) বলেনঃ ‘ওহে জনমন্ডলী! তিনি সত্য বলেছেন। আমার ও তাঁর মাঝে কোন রেষারেষি নেই। তিনি আপনাদের নবীর স্ত্রী- দুনিয়া ও আখিরাতে।

হিজরী ৩৬ সনের ১০ই জামাদি-উস-সানী বৃহস্পতিবার ভোর থেকে আসর পর্যন্ত উটের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে আহতের সংখ্যা অগণিত। নিহতের সংখ্যা কত, সে ব্যাপারে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতভেদ আছে। ইবনুল ইমাম-আল-হাম্বালী তাঁর ‘শাজারাতুজ জাহাব’ গ্রন্থে তেত্রিশ হাজার, মতান্তরে সতেরো হাজার উল্লেখ করেছেন। তবে ইবনুল আসীরসহ অধিকাংশ ঐতিহাসিক দশ হাজার উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে অর্ধেক আলীর (রা) ও অর্ধেক ‘আয়িশার (রা) পক্ষের। ইবনুল আসীর আরো উল্লেখ করেছেন’ একমাত্র বনু দাববার এক হাজার লোক নিহত হয় এবং উটের পাশেই শুধু বনী আদীর সত্তর (৭০) ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। এই যুদ্ধে ইসলামের এমন অনেক বীর পুরুষ শাহাদাত বরণ করেন, যাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাতে গড়ে তোলেন এবং যারা ছিলেন ইসলামের অতি পরীক্ষিত সন্তান। তালহা (রা), যুবাইর (রা) প্রমুখ তাঁদের অন্যতম। তাঁদের মৃত্যুতে মুসলিম উম্মাহর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল।

রণক্ষেত্রে হযরত ‘আয়িশার (রা) উট বসে যাওয়ার পর হযরত ‘আলী (রা) একজন ঘোষককে এই ঘোষণা দানের নির্দেশ দেনঃ ‘কেউ কোন পলায়ণাকারীকে ধাওয়া করবে না, কোন আহত সৈনিকের মালামাল লুট করবেনা এবং কোন সৈনিক কোন গৃহে প্রবেশ করবে। বিশেষতঃ নারীদের ব্যাপারে তিনি নির্দেশ দেন এভাবেঃ -‘তোমরা অবশ্যই কারো ইজ্জত আব্রু উন্মুক্ত করবেনা, কোন গৃহে প্রবেশ করবেনা, কোন নারীর উপর চড়াও হবে হবে না- যদিও সে তোমাদের মান-মর্যাদা, তোমাদের নেতা ও সৎ লোকদের নিয়ে উপহাস ও গালিগালাজ করে। নারীদের উপর হাত তুলতে (রাসূলুল্লাহর সা. সময়) আমাদেরকে নিষেধ করা হতো, যখন সেই নারীরা ছিল মুশরিক। তাহলে এখন এই মুসলিম নারীদের উপর হাত তোলা যায় কিভাবে?’

যুদ্ধ শেষে ‘আলী (রা) ময়দানে পড়ে থাকা লাশের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন এবং পরিচিত লাশের কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর পক্ষে তোক বা ‘আয়িশার (রা) পক্ষের-দুঃখ প্রকাশ করছিলেন। তারপর উভয় পক্ষের সকল লাশ এক স্থানে জমা করার নির্দেশ দিলেন। তিনি ইমাম হয়ে সকলের যানাযার নামায পড়ালেন এবং বড় বড় কবর খুঁড়ে এক সাথে অনেকের দাফনের ব্যবস্থা করলেন। তিনি হযরত তালহা ইবন ‘উবাইদুল্লাহর (রা) লাশের কাছে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেনঃ
তারপর বলেনঃ ‘আল্লাহর কসম! কোন কুরাইশকে এভাবে পড়ে থাকা আমি পছন্দ করতাম না।’ তারপর তিনি সৈনিকদের পরিত্যক্ত জিনিস সংগ্রহ করে বসরার মসজিদে জমা করার নির্দেশ দেন এবং ঘোষণা করেন যে, ‘শুধু অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া প্রত্যেকেই নিজ নিজ জিনিস সেখান থেকে নিয়ে যেতে পারে। অস্ত্র-শস্ত্র কোষাগারে জমা হবে।’

যুদ্ধের পর হযরত ‘আয়িশা (রা) উভয় দলের কে কে নিহত হয়েছে তা জানতে চাইতেন। যখন বলা হতো অমুক নিহত হয়েছে, বলতেন- (আল্লাহ তার প্রতি করুণা করুন)। এই যুদ্ধে নিহতদের সর্ম্পকে হযরত ‘আলী (রা) বলেতেনঃ ‘আমি অবশ্যই আশা করি এই লোকদের মধ্যে যার অন্তর আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ ছিল তারা সবাই জান্নাতে যাবে।’

এখানে একটি বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার যে, কিছু বিকৃতমনা মানুষের ধারণা, উটের যুদ্ধের মূল কারণ হলো, ‘আলীর (রা) একটি পুরানো ক্ষোভ ও বিদ্বেষ। ইফকের ঘটনায় ‘আলী (রা) রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, ‘আপনি ইচ্ছা করলে তাঁকে পরিত্যাগ করতে পারেন’। মূলতঃ তখন থেকেই হযরত ‘আয়িশা (রা)আলীর (রা) প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। আর তারই পরিণতি এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। কিন্তু আমাদের সামনে হাদীস ও ইতিহাসের যে সকল তথ্য রয়েছে, তাতে এমন ধারণা পোষণের কোন অবকাশ নেই। এটি সম্পূর্ণ অমূলক ধারণা। ইতিহাসে এমন বহু তথ্য রয়েছে যাতে বিপরীত চিত্রটিই ফুটে ওঠে। দীর্ঘ হয়ে যাবে বিধায় এখানে আমরা তা উল্লেখ করলাম না। ইতিহাসের সকল তথ্য পর্যালোচনা ষড়যন্ত্রকারী ছাড়া উভয় পক্ষের সকলেই ছিলেন সম্পূর্ণ নিরাপরাধ। তারা সংঘাত ও সংঘর্ষের করেননি। এক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র পূর্ণমাত্রায় সফল হয়েছে।


হযরত আয়িশা (রাঃ) এর ১২ পর্বের পুরো জীবনী পড়ুন-



*****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url