সাহাবাগণের জীবনকথা-১৯ || হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর জীবনী (৩য় পর্ব)




আয়িশা (রাঃ) এর স্বামী সেবা, স্বামীর প্রতি আনুগত্য ও অনুসরণ


হযরত আয়িশা (রা) এর জীবনীর ৩য় পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

দীন-হীন অবস্থায়ও আল্লাহর রাসূলকেই বেছে নিয়েছিলেন আয়িশা (রা)

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধমির্ণীদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর মহিলা ছিলেন। কেউ কেউ ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ অভিজাত পরিবারের মেয়ে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে এমন দীন-হীন অবস্থায়  জীবন যাপন করতে গিয়ে তাঁদের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এ জন্য তাঁরা সমবেতভাবে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট জীবন যাপনের মান বৃদ্ধির আবদার করতে থাকেন। এরই প্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল হয়। যাতে তাঁদেরকে এ চূড়ান্ত কথা বলে দেওয়া হয় যে, যাঁরা ইচ্ছা স্বেচ্ছায় সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যেতে পারেন অথবা এই দীন-হীন অবস্থা মেনে নিয়ে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে জীবন যাপন করতে পারেন। আয়িশা (রা) ছিলেন যেহেতু কম বয়স্কা, তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে মা-বাবার সাথে পরামর্শ করে জানিয়ে দেন। বলেনঃ আমি আল্লাহর রাসূলকেই চাই।’ সবার আগেই তিনি এ সিদ্ধান্ত দেন এবং রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুরোধ করে বলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার এ সিদ্ধান্তের জন্য আপনি অন্য কাউকে বলবেন না।
 
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেক সময় ‘আয়িশার (রা) রানের উপর মাথা রেখে শুয়ে যেতেন। একদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছেন, এমন সময় আবু বকর (রা) কোন এক কারণে মেয়ের উপর উত্তোজিত হয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েন এবং তাঁর পার্শ্বদেশে ধাক্কা দেন। কিন্তু ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরামের ব্যাঘাত হতে পারে, তাই মোটেই নড়াচড়া করলেন না।
 
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে সকল বস্ত্রে ইনতিকাল করেন, ‘আয়িশা (রা) অতি যত্মের সাথে তা সংরক্ষন করেন। একবার এক সাহাবীকে তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি চাদর ও কম্বল দেখিয়ে বলেন, এই কাপড়ে তিনি ইনতিকাল করেন।
 
রাসূলে কারীমের গোটা জিন্দেগী মানবজাতির জন্য আদর্শ। এ কারণে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে খুশী করার জন্য কেমন আচরণ করবে, আমরা তাও ‘আয়িশা (রা) ও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনে দেখতে পাই। আমরা কখনো কখনো রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) সাথে দারুণ উদার ও খোলামেলা দেখতে পাই। ‘আয়িশার (রা) অতি তুচ্ছ কোন তামাশা বা খেলাধুলা দেখেও তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন আনসারী মেয়েকে প্রতিপালন করেন। খুব সাদামাটা ঘরে এসে বললেনঃ ‘আয়িশা! কোন গান-গীত তো নেই।
 
একবার ঈদের দিন কিছু হাবশী লোক মাযা হেলিয়ে দুলিয়ে পালোয়ানীর কসরত দেখাচ্ছিল। ‘আয়িশা (রা) স্বামীর নিকট এই খেলা দেখার আবদার করলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং ‘আয়িশা (রা) সেই খেলা উপভোগ করলেন। যতক্ষণ ‘আয়িশা (রা) ক্লান্ত হয়ে নিজেই সরে না গেলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
 
একবার ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে একটু উঁচু গলায় কথা বলছিলেন। এমন সময় পিতা আবু বকর (রা) এসে উপস্থিত হলেন। তিনি মেয়ের এমন বেয়াদবী দেখে রেগে গেলেন এবং মারার জন্য হাত উঁচু করলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্রুত মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে ‘আয়িশাকে রক্ষা করলেন। আবু বকর (রা) সরে গেলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশাকে বললেনঃ দেখলেতো, আমি তোমাকে কিভাবে বাঁচালাম?
 
একবার একটি মেয়েকে সঙ্গে করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) নিকট এসে বললেন, তুমি এই মেয়েটিকে চেন? আয়িশা (রা) বললেনঃ না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ সে অমুকের দাসী। তুমি কি তার গান শুনতে চাও? ‘আয়িশা (রা) শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। দাসীটি দীর্ঘক্ষণ গান গাইলো। এক সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সম্পর্কে মন্তব্য করলেনঃ শয়তান তার নাকের ছিদ্রে বাদ্য বাজায়। অর্থাৎ এ ধরনের গান রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অপছন্দ করেন। ‘আয়িশাকে (রা) খুশি করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাঝে মধ্যে তাঁকে গল্পও শোনাতেন। আবার কখনো কখনো ধৈর্যসহকারে ‘আয়িশার (রা) গল্পও শুনতেন। কিন্তু এমন ঘনিষ্ঠ ও আনন্দঘন মুহূর্তেও যদি আজানের ধ্বনি কানে আসতো, তিনি তখনি সোজা বেরিয়ে যেতেন, যেন কাকেও চেনেন না।
 
একবার এক সফরে ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফর সঙ্গি ছিলেন। চলার পথে এক পর্যায়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল সঙ্গীকে আগে চলার নির্দেশ দিলেন। তারপর ‘আয়িশাকে বললেনঃ এসো, আমরা দৌড়াই। দেখি কে আগে যেতে পারে। ‘আয়িশা (রা) ছিলেন হালকা পাতলা। তাই তিনি আগে চলে যান। তার কিছুকাল পরে এমন দৌড় প্রতিযোগিতার সুযোগ আরেকবার আসে। ‘আয়িশা (রা) বলেন, তখন আমি মোটা হয়ে গিয়েছিলাম। তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার আগে চলে যান। তখন তিনি বলেনঃ এ হচ্ছে ঐ দিনের বদলা।
 
রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) সাথে যখন পানাহারের সুযোগ হতো তখন একই দস্তরখানে এক থালায় আহার করতেন। একবার পর্দার হুকুমের আগে তাঁরা এক সাথে আহার করছেন, এমন সময় ‘উমার (রা) এসে উপস্থিত হলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে খেতে ডাকলেন এবং তিনজন এক সাথে খেলেন। পানাহারের মধ্যে প্রেম-প্রীতির অবস্থা এমন ছিল যে, ‘আয়িশার (রা) যেখানে মুখ লাগাতেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঠিক সেখানেই মুখ লাগিয়ে পান করতেন। রাতে যেহেতু ঘরে বাতি জ্বালতো না, তাই অন্ধকারে খেতে বসে মাঝে মাঝে উভয়ের হাত একই টুকরোর উপর গিয়ে পড়তো।
 
সীরাত ও হাদীসের গ্রন্থসমূহে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আয়িশার (রা) প্রেম-প্রিতিও মান-অভিমানের এক চমৎকার দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ইসলাম যে মানুষের স্বাভাবগত নির্মল আবেগ-অনুভূতিকে অস্বীকার করেনি তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁদের আচরণের মধ্যে। কখনো কখনো তাঁদেরকে দেখা যায় সাধারণ মানুষের মত আবেগপ্রবণ। আমাদের ভূলে গেলে চলবে না যে, ‘আয়িশা (রা) যেমন একজন নবীর স্ত্রী, তেমনি একজন নারীও বটে। আবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেমন একজন নবী ও রাসূল তেমনি একজন স্বামীও বটে সুতরাং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাঁদের এমন বহু আচরণ ও মান-অভিমানের কথা ও ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যা অতি চমকপ্রদ ও শিক্ষাণীয়।
 
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরলোকগত প্রথমা স্ত্রী খাদীজাকে (রা) প্রায়ই স্মরণ করতেন। একবার তিনি খাদীজার (রা) কথা আলোচনা করছেন, ‘আয়িশা (রা) বলে উঠলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এই বৃদ্ধার কথা এত স্মরণ করেন কেন? আল্লাহ তো আপনাকে তাঁর চেয়ে ভালো স্ত্রী দান করেছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ আমাকে তাঁর থেকে সন্তান দান করেছেন।
 
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন খাদীজার (রা) প্রশংসা শুরু করলেন এবং দীর্ঘক্ষণ প্রশংসা করতে থাকলেন। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ এতে আমার অন্তর্দাহ হলো। বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি একজন কুরাইশ বৃদ্ধা, যার ঠোঁট লাল এবং যার মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়েছে, এত দীর্ঘ সময় তার প্রশংসা করছেন। আল্লাহ তো তাঁর চেয়ে ভাল স্ত্রী দান করেছেন। একথা শুনে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেহারার রং পাল্টে গেল। তিনি বললেনঃ খাদীজা আমার এমন স্ত্রী ছিল যে, মানুষ যখন আমাকে নবী বলে মানতে অস্বীকার করে তখন সে আমার প্রতি ঈমান আনে, মানুষ যখন আমাকে সাহায্য করতে চায়নি তখন সে তার অর্থ-বিত্ত সহকারে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ তার মাধ্যমেই আমাকে সন্তান দিয়েছেন। যখন অন্য স্ত্রীরা আমাকে সন্তান থেকে বঞ্চিত করেছে।
 
একবার ‘আয়িশার (রা) মাথায় ব্যথা হলো। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন অন্তিম রোগলক্ষণ শুরু হতে চলেছে। তিনি ‘আয়িশাকে (রা) বললেনঃ তুমি যদি আমার সামনে মারা যেতে, আমি নিজ হাতে তোমাকে গোসল দিয়ে কাফন পরাতাম এবং তোমার জন্য দু’আ করতাম। আয়িশা (রা) বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার মরণ কামনা করছেন। যদি এমন হয় তাহলে আপনি তো এই ঘরে নতুন একজন স্ত্রীকে এনে উঠাবেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ কথা শুনে মৃদু হেসে দেন।
 
‘ইফক’ বা চরিত্রে কলঙ্ক আরোপের ঘটনার পর যখন ওহী দ্বারা ‘আয়িশার (রা) পবিত্রতা ঘোষিত হয় তখন তাঁর মা বললেনঃ যাও, স্বামীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। ‘আয়িশা (রা) ত্বরিৎ অভিমানের সুরে জবাব দিলেনঃ আমি এক আল্লাহ ছাড়া-যিনি আমার পবিত্রতা ঘোষণা করেছেন, আর কারো প্রতি কৃতজ্ঞ নই।
 
একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘আয়িশা! তুমি আমার প্রতি কখন খুশী বা অখুশী থাক, আমি তা বুঝতে পারি। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ কিভাবে? বললেনঃ অখুশি থাকলে কসম খাও ‘ইবরাহীমের আল্লাহর কসম’ বলে, আর খুশী থাকলে বলঃ ‘মুহাম্মাদের আল্লাহর কসম।
 

আয়িশা (রা) এর স্বামী সেবা

হাদীসের গ্রন্থাবলীর বিভিন্ন স্থানে ‘আয়িশার (রা) স্বামী-সেবার কথা ছড়িয়ে আছে। এখানে আমরা তার থেকে কিছু তুলে ধরছি। ঘরে খাদেম থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে সব কাজ করতেন। নিজ হাতে আটা পিষতেন, খাবার তৈরি করতেন, বিছানা পারতেন, ওযুর পানি এনে রাখতেন, স্বামীর কুরবারীন পশুর গলার রশি পাকাতেন, স্বামীর মাথায় চিরুনী করে দিতেন, দেহে আতর লাগিয়ে দিতেন, কাপড় ধুইতেন, রাতে শোয়ার সময় মিসওয়াক ও পানি মাথার কাছে এনে রাখতেন, মিসওয়াক ধুয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতেন।
 
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে মসজিদে যান। একজন সাহাবী বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! কম্বলে তো কোন ময়লার দাগ দেখা যাচ্ছে। সাথে সাথে তিনি কম্বলটি খুলে একজন খাদেমের হাতে ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠিয়ে দেন। আয়িশা (রা) পানি আনিয়ে নিজ হাতে কম্বলটি ধুয়ে, শুকিয়ে আবার রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট পাঠিয়ে দেন।
 
কায়স আল-গিফারী (রা) ছিলেন আসহাবে সুফফার অন্যতম সদস্য। তিনি বর্ণনা করেছেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তোমরা সবাই আজ ‘আয়িশার ঘরে চলো। তিনি আমাদের সঙ্গে করে ঘরে গিয়ে বললেনঃ ‘আয়িশা! আমাদের সকলকে আহার করাও। আয়িশা (রা) আমাদের সকলকে পাকানো খাবার খাওয়ালেন এবং দুধ ও পানি পান করালেন। সম্ভবত এটা হিজাবের হুকম নাযিলের আগের ঘটনা।
 
‘আয়িশা (রা) স্বামীর প্রিয়তমা স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও অতি আগ্রহ ভরে অন্যদের চেয়ে বেশি মাত্রায় স্বামীর সেবা করতেন। স্বামীর আরাম-আয়েশ ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি সর্বদা সজাগ থাকতেন। বার বার স্বামীর মিসওয়াকটি ধোয়ার প্রয়োজন পড়তো। এই কাজটির সুযোগ একক ভাবে ‘আয়িশা (রা) লাভ করতেন।
 

আয়িশা (রা) এর স্বামীর আনুগত্য ও অনুসরণ

ইসলামে স্ত্রীর অন্যতম গুণ হলো স্বামীর আনুগত্য ও অনুসরণ করা। ‘আয়িশা (রা) স্বামী সাহচর্যের দীর্ঘ নয় বছরে তাঁর কোন নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ বা অমান্য করা তো দূরের কথা, ইশারা-ইঙ্গিতেও যদি তিনি কোন অপছন্দের কথা বুঝিয়েছেন, তাও ‘আয়িশা (রা) সাথে সাথে পরিহার করেছেন। একবার তিনি অতি যত্ম সহকারে দরজায় একটি ছবিওয়ালা পর্দা টানালেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে ঢুকতে যাবেন, এমন সময় পর্দার প্রতি দৃষ্টি পড়লো। সাথে সাথে তাঁর চেহারা মুবারক বিবর্ণ হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে ‘আয়িশা (রা) সবকিছু বুঝে ফেললেন। তিনি বললেনঃ আমায় ক্ষমা করুন! আমার অপরাধ কোথায় বলবেন কি? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ যে ঘরে ছবি থাকে সেখানে ফিরিশতা প্রবেশ করে না। একথা শোনার পর ‘আয়িশা (রা) পর্দাটি ছিঁড়ে ফেললেন।

স্বামীর জীবদ্দশায় বহু স্ত্রীই স্বামীর পূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর আয়িশা (রা) যে পরিমাণ স্বামীর আনুগত্য এবং হুকুম তামীল করেছেন, তার কোন তুলনা খুঁজে পাওয়া কঠিন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকারের পর তিনি দীর্ঘকাল জীবিত ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে স্বামীর প্রতিটি আদেশ ও ইচ্ছা তেমনিভাবে পালন ও পূরণ করেছেন যেমন তাঁর জীবনকালে করতেন।

রাসূল কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশা (রা) দানশীলতা শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমরণ তিনি এ গুণটি অতি নিষ্ঠার সাথে ধারণ করে থাকেন। একবার তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট জিহাদের অনুমতি চাইলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ নারীদের জিহাদ হলো হজ্জ। এই বাণী শোনার পর থেকে এমন কঠোরতার সাথে আমল করতে থাকেন যে, তাঁর জীবনের খুব কম বছরই হজ্জ ছাড়া অতিবাহিত করেছে।

একবার এক ব্যক্তি কিছু কাপড় ও কিছু নগত অর্থ ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠালো। তিনি প্রথমে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ফেরত পাঠালেন। তারপর আবার লোকটিকে ডেকে এনে তা গ্রহণ করেন এবং বললেনঃ আমার একটি কথা মনে এসে গেল।

একবার ‘আরাফাতের দিন ‘আয়িশা (রা) রোযা রাখলেন। প্রচন্ড গরমের কারণে মাথায় পানির ছিটা দিচ্ছিলেন। একজন রোযা ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেনঃ আমি যখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট থেকে শুনেছি যে, আরাফাতের দিন রোযা রাখলে সারা বছরের পাপ মোচন হয়ে যায়,তখন তা কিভাবে ভাংতে পারি?

রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাশতের নামায পড়তে দেখে সারা জীবন তিনি এই নামায পড়েছেন। তিনি বলতেনঃ আমার পিতাও যদি কবর থেকে উঠে এসে আমাকে এ নামায পড়তে নিষেধ করেন, আমি তাঁর কথা মানবো না। একবার এক মহিলা ‘আয়িশাকে (রা) জিজ্ঞেস করলোঃ মেহেদী লাগানো কেমন? জবাব দিলেনঃ আমার প্রিয়তমের মেহেদীর রং খুব পছন্দ ছিল, তবে গন্ধ পছন্দ ছিল না। হারাম নয়। ইচ্ছা হলে তুমি লাগাতে পার।

গৃহ অভ্যন্তরে আয়িশা (রা) ও রাসুলুল্লাহর স্বামী-স্ত্রীর দীনী জীবন

‘আয়িশার (রা) ঘরটি ছিল একজন নবীর আবাসস্থল। সেখানে বিত্ত-বৈভবের কোন ছোঁয়া ছিল না। পার্থিব ঐশ্বর্যের প্রতি তাঁদের কোন পরোয়াও ছিল না। ‘আয়িশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভ্যাস ছিল যখন ঘরে আসতেন, একটু উঁচু গলায় নিম্নের কথাগুলি বার বার উচ্চারণ করতেন।

‘আদম সন্তানদের মালিকানায় যদি ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ দুইটি উপত্যকা হয়, তাহলে সে তৃতীয়টির লোভ করবে। তার লোভের মুখ শুধুমাত্র মাটিই ভরতে পারে। আল্লাহ বলেন, ধন-সম্পদ তো আমি নামায কায়েম এবং যাকাত দানের জন্য সৃষ্টি করেছি। যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, আল্লাহও তার দিকে ফিরে আসেন।’

মানুষের লোভের যে কোন শেষ নেই, এবং ধন-সম্পদ দানের মূল উদ্দেশ্য কি, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়াই ছিল তার আসল লক্ষ্য।

রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘ঈশার নামায আদায়ের পর ঘরে আসতেন। মিসওয়াক করে সাথে সাথে শয্যা নিতেন। মাঝ রাতে জেগে তাজাজ্জুদ নামায আদায় করতেন। রাতে শেষভাগে ‘আয়িশাকে (রা) জাগিয়ে দিতেন। তিনি উঠে স্বামীর সাথে নামাযে অংশগ্রহণ করতেন। সবশেষে বিতর নামায আদায় করতেন। সুবহে সাদিক হওয়ার পর রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের সুন্নাত আদায় করে কাত হয়ে একটু শুয়ে যেতেন এবং ‘আয়িশার (রা) সাথে কিছু কথা-বার্তা বলতেন। তারপর ফজরের ফরয আদায়ের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হতেন। কখনো কখনো সারা রাত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ‘আয়িশা (রা) আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগীতে কাটিয়ে দিতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইমাম হতেন, ‘আয়িশা (রা) হতেন মুক্তাদী। কুসূফ ও খুসূফ (সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ) এর অবস্থায় রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায়ের দাঁড়ালে তিনিও দাঁড়িয়ে যেতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে জামা’য়াতের ইমামতি করতেন, আর তিনি ঘরে ইকতিদা করতেন।

পাঞ্জেগানা নামায ও তাহাজ্জুদ ছাড়াও রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখে তিনি চাশতের নামাযও নিয়মিত পড়তেন। প্রায়ই রোযা রাখতেন। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে এক সাথে রোযা পালন করতেন। রমযানের শেষ দশদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে ইতিকাফ করতেন। ‘আয়িশাও (রা) এতে শরিক হতেন। মসজিদের আঙ্গিনায় তাঁবু টানিয়ে ঘিরে নিতেন। ফজর নাযমাযের পর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু সময়ের জন্য সেখানে আসতেন।

হিজরী ১১ সনে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের সফরসঙ্গী হন। হজ্জ ও উমরার নিয়ত করেন। কিন্তু স্বাভাবিক নারী প্রকৃতির কারণে যথাসময়ে তাওয়াফ করতে পাররেন না। দারুণ কষ্ট পেলেন। কাঁদতে শুরু কররেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাহির থেকে এসে কাঁদতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলেন এবং তাঁকে করণীয় মাসয়ালা বাতলে দিলেন। তিনি ভাই ‘আবদুর রহমান ইবন আবী বকরকে (রা) সাথে নিয়ে অসমাপ্ত আবশ্যকীয় কাজ সমাপন করলেন।

আমাদের মত সাধারণ মানুষ মনে এমন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি গৃহ অভ্যন্তরে আরাম ও বিশ্রামের সময় রিসালাতের দায়িত্ব পালনে একটু শিথিলতা (নাউজুবিল্লাহ) দেখাতেন? এমন ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। পূর্বেই আমরা ‘আয়িশার (রা) মন্তব্য উল্লেখ করেছি-‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের সাথে কথা বলতেন। আজানের ধ্বনি কানে যেতেই উঠে দাঁড়াতেন। তখন মনে হতো তিনি যেন আমাদের চেনেনই না।’ ‘আয়িশা (রা) খুব সাধ করে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুশী করার জন্য ছবিওয়ালা পর্দা টানালেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সন্তুষ্টির পরিবর্তে বিরক্তি প্রকাশ করলেন।

একবার ‘আয়িশা (রা) এক ইহুদীকে-যে তাঁকে মৃত্যুর অভিশাপ দিয়েছিল, কঠোর ভাষায় প্রত্যুত্তর করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাথে বলেনঃ আয়িশা! আল্লাহ অতি দয়াবান। তিনি দয়া ও কোমলতা পছন্দ করেন। আর একবার আয়িশা (রা) নিজ হাতে আটা পিষে রুটি বাণিয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। এই সুযোগে প্রতিবেশীর একটি ছাগল ঘরে ঢুকে সব খেয়ে ফেলে। ‘আয়িশা (রা) দৌড়ে ছাগলটি ধরে কয়েক ঘা বসিয়ে দিতে গেলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাধা দিয়ে বললেনঃ ‘আয়িশা! প্রতিববেশীকে কষ্ট দিও না।

সতীন ও তাদের সন্তানদের সাথে আয়িশা (রা) এর সম্পর্ক

আমাদের জানা মতে এ পৃথিবীতে একজন নারীর সবচেয়ে অসহনীয় বিষয় হলো সতীনের অস্তিত্ব। ‘আয়িশার (রা) এক সাথে সতীন ছিলেন একজন থেকে নিয়ে আটজন পর্যন্ত। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান সাহচর্যের দৌলতে তাঁদের সকলের হৃদয়ের যাবতীয় আবিলতা দূর হয়ে তা স্বচ্ছ আয়নায় পরিণত হয়। সতীন ও তাঁদের সন্তান-সন্তুতিদের সাথে ‘আয়িশার (রা) জীবন যাপনের যে চিত্র আমরা পাই তা বিশ্বের নারী জাতির জন্য এক অতুলনীয় আদর্শ হয়ে আছে।

খাদীজা (রা) যদিও ‘আয়িশার (রা) সময়ে বেঁচে ছিলেন না, তবে রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হৃদয় মাঝে তিনি সর্বদা জীবিত ছিলেন। তনি ‘আয়িশার (রা) কাছে সবসময় খাদীজার (রা) স্মৃতিচারণ করতেন। এ কারণে ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ ‘আমি যে পরিমাণ খাদীজাকে ঈর্ষা করতাম না। আর তা এই জন্য যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে খুব বেশি স্মারণ করতেন, অন্য কেউ তা করতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক খাদীজার (রা) নামে কুরবানী করা, খাদীজার বান্ধবীদের নিকট হাদীয়া-তোহফা পাঠানো, ইসলামের প্রথম পর্বে তাঁর যাবতীয় অবদান, যথাঃ স্বামীকে সান্ত্বনা ও ধৈর্য ধারণের উপদেশ দান, যাবতীয় উপায়-উপকরণ দিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি কর্মকান্ডের কথা কিন্তু আয়িশাই (রা) এই উম্মাতকে জানিয়েছেন। আল্লাহ পাক যে, খাদীজাকে (রা) জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন, সে কথাটিও তিনি জানিয়েছেন। এতেই তাঁর হৃদয়ের স্বচ্ছতা ও প্রশস্ততার কথা অনুমান করা যায়।

সাওদার (রা) প্রশংসায় ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ ‘একমাত্র সাওদা ছাড়া অন্য কোন নারীকে দেখে আমার মধ্যে এমন আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি যে, তাঁর দেহে যদি আমার প্রাণটি হতো।’ মায়মূনার (রা) মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ তিনি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরহেযগার ছিলেন।’ সাফিয়্যা (রা) চমৎকার খাবার তৈরি করতে পারতেন। তাঁর এই পারদর্শিতা তিনি স্বীকার করেন এইভাবে আমি তাঁর চেয়ে ভালো খাবার তৈরি করতে পারে এমন কাউকে দেখিনি।’ সতীনদের সাথে তাঁর উঠা-বসা ও আচার-আচরণের অনেক কথা হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে বিদ্যামান আছে-যাতে তাঁর উদারতা, মহানুভবতা ও উন্নত নৈতিকতার চিত্র ফুঠে উঠেছে। ‘আয়িশার (রা) মধুর ব্যবহার ও আচারণ সকলকে খুশী করেছিল। আর তাই ‘ইফক (কলস্কা আরোপ) এর ঘটনার সময়-যখন তাঁর দিশেহারা অবস্থা, তখন তাঁর অন্যতম সতীন যয়নাবকে (রা) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জবাব দিয়েছিলেনঃ আমি তো তাঁর মধ্যে শুধু ভালো ছাড়া কিছু জানিনে।’

‘আয়িশা (রা) নিঃসন্তান ছিলেন। তবে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য স্ত্রীদের বেশ কয়েকজন সন্তান ছিলেন। তাঁদের সাথে ‘আয়িশার (রা) সম্পর্ক ছিল আদর্শ মানের। যয়নাব, রুকাইয়্যা, উম্মু কুলসুম ও ফাতিমা-এই চার কন্যা ছিলেন খাদীজার (রা) সন্তান। ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে আসার পূর্বে একমাত্র ফাতিমা (রা) ছাড়া অন্যদের বিয়ে হয়ে যায় এবং সবাই নিজ নিজ স্বামীর ঘরে চলে যান। হিজরী ৬ষ্ঠ সনে রুকাইয়্যা এবং হিঃ ৮ম ও ৯ম সনে যথাক্রমে যয়নাব ও উম্মু কুলসুম ইনতিকাল করেন। হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে তাঁদের সাথে ‘আয়িশার (রা) তিক্ত সম্পর্কের একটি ঘটনাও পাওয়া যায় ন। বরং এ সকল কন্যা সম্পর্কে আয়িশার (রা) যে সব মন্তব্য ও আচারণের কথা পাওয়া যায় তাতে তাঁদের; সাথে তাঁর গভীর হৃদ্যতার কথা জানা যায়। যয়নাব, যিনি আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করেন, তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই বাণীটি ‘আয়িশা (রা) বর্ণনা করেছেনঃ সে আমার অতি ভালো মেয়ে ছিল, আমাকে ভালোবাসার কারণে তাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে।’ এই যয়নাবের মেয়ে উমামাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কী পরিমাণ স্নেহ ও আদর করতেন তা ‘আয়িশাই (রা) বর্ণনা করেছেন।

‘আয়িশা (রা) যখন স্বামীগৃহে আসেন তখন কুমারী মেয়ে ফাতিমা (রা) পিতার ঘরে। কিন্তু তিনি বয়সে ‘আয়িশার চেয়ে পাঁচ বছর অথবা ছয় বছরের বড়। এক বছর বা তার চেয়ে কিছু কম সময়ের জন্য এই মা-মেয়ে এক সাথে কাটান। হিজরী ২য় সনের মধ্যে আলীর (রা) সাথে এই মেয়ের বিয়ে হয়। এই বিয়ের উদ্যোগ আয়োজনে অন্য মা-দের সাথে ‘আয়িশার (রা) শরিক ছিলেন। শুধু তাই নয়, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশে তিনি বিশেষ গুরুত্বও প্রদান করেন। ঘর লেপেন, বিছানা তৈরি করেন, নিজের হাতে খেজুরের ছাল দুনে বালিশ বানান, খেজুর ও মানাক্কা অতিথিদের সামনে পেশ করেন এবং কাঠের একটি আলনার মত তৈরি করেন পানির মশক ও কাপড় চোপড় টানোনোর জন্য। ‘আয়িশা (রা) বর্ণনা করেছেনঃ ‘ফাতিমার বিয়ের মত এত চমৎকার বিয়ে আর দেখিনি।

ফাতিমার (রা) প্রশংসায় ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ আমি ফাতিমার চেয়ে একমাত্র তার পিতা ছাড়া আর কোন ভালো মানুষ কক্ষণো দেখিনি। একবার এক তাবে’ঈ আয়িশাকে (রা) প্রশ্ন করলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবচেয়ে প্রিয় কে ছিলেন? উত্তর দিলেনঃ ফাতিমা। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মত চাল-চলন, উঠা-বসায় মিলে যায় একমাত্র ফামিতা ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। ফাতিমা যখন তাঁর পিতার সাথে দেখা করতে আসতেন পিতা সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন। মেয়ের কপালে চুমু খেতেন এবং নিজের স্থানে বসাতেন। আবার পিতা তার ঘরে গেলে মেয়ে উঠে দাঁড়াতেন, পিতাকে চুমু দিতেন এবং নিজের স্থানে নিয়ে বসাতেন।

স্বামীগৃহে ফাতিমা (রা) নিজ হাতে যাবতীয় কাজ করতে করতে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। একদিন পিতার কাছে এসেছিলেন একটি দাসী প্রাপ্তির আবেদন নিয়ে। ঘটনাক্রমে পিতার দেখা পেলেন না। মা ‘আয়িশাকে এ ব্যাপারে কথা বলার দায়িত্ব দিয়ে তিনি ফিরে গেলেন।

আয়িশা (রা) বর্ণনা করেন। ‘‘একদিন আমরা সকল স্ত্রী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাশে বসে আছি। এমন সময় ফাতিমা সামনের দিক থেকে আসলো। তার চলন ছিল অবিকল রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মত, একটুও পার্থক্য ছিল না রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত আবেগের সাথে তাকে ডেকে পাশে বসালেন। তারপর চুপে চুপে তার কানে কিছু কথা বললেন। ফাতিমা কাঁদতে লাগলো। তার অস্থিরতা দেখে রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কানে কানে আবার কিছু বললেন। এবার ফাতিমা হাসতে লাগলো। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ আমি বললামঃ ফাতিমা! রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের বাদ দিয়ে তোমার কাছে গোপন কথা বলেন, আর তুমি কাঁদছো? রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উঠে গেলে আমি ফাতিমার নিকট বিষয়টি জানতে চাইলাম। সে বললোঃ আমি আমার আববার গোপন কথা ফাঁস করবো না।

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর ‘আয়িশা (রা) আবার একদিন বিষয়টি জানতে চান। ফাতিমা বলেন, আমার কান্নার কারণ হলো, তিনি আমাকে তাঁর মৃত্যুর কথা বলেছিলেন। হাসির কারণ হলো, তিনি আমাকে বলেনঃ ফাতিমা! এ কি তোমার পছন্দ নয় যে, তুমি সারা পৃথিবীর নারীদের নেত্রী হও?’

উপরে উল্লেখিত এ সকল ঘটনা দ্বারা ‘আয়িশার (রা) সাথে তাঁর সতীন-কন্যাদের কেমন মধুর সম্পর্ক ছিল তা বুঝা যায়। এ ধরনের আরো বহু ঘটনা হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান।

হযরত আয়িশা (রাঃ) এর ১২ পর্বের পুরো জীবনী পড়ুন-




*****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url