আল্লাহর উপর ভরসা (পর্ব-৩০) || আল্লাহর বিশ্বাসই মুক্তির উপায় || সাফল্যের জন্য চাই লৌহ-দৃঢ় ইচ্ছা ||






অবিশ্বাসী বোকারাই কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করে না


বোকাদের বিষয়ে কিছু কথা

অনেক বেশি বই পড়ে দুনিয়ার জ্ঞান অর্জন করলেই প্রকৃত জ্ঞানী হওয়া যায় না। নাস্তিকতা যাদের অন্তরে ও রক্তে মিশে রয়েছে তারা কখনোই প্রকৃত জ্ঞানের স্বাধ পাবে না। কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান যার মধ্যে নাই সেই নিতান্তই বোকা ও নির্বোধ। এইসব বোকাদের নিয়ে আসুন একটু আলোচনা করা যাক। 

পৃথিবীর কমিউনিষ্ট শাসিত দেশগুলোতেই অধিকাংশ বোকাদের বাস। আর রিসালাহ (الرسالة) নামক পত্রিকায় যাইয়াত (زيات) কর্তৃক লিখিত কমিউনিজমের উপর এক চমৎকার প্রবন্ধ আমি পেয়েছি। রাশিয়ানরা মহাবিশ্বে এক মহাকাশযান প্রেরণ করেছিল। এ মহাকাশ যানটি ফিরে আসার পর এক নভোচারী প্রাভদা (Pravd –البرافدا) নামক পত্রিকায় লিখেছিলেন- “আমরা আকাশে চড়লাম কিন্তু সেখানে কোন প্রভু, কোন বেহেশত, কোন দোযখ ও কোন ফেরেশতা পেলাম না।”

উত্তরে যায়্যাত লিখেছিলেন “হে লাল গাধারপাল! তোমরা বড়ই অদ্ভুত এবং বোকা! তোমরা কি ভাবছ যে তোমরা প্রকাশ্যে আল্লাহকে তার সিংহাসনে বসা দেখতে পাবে? তোমরা কি হঠকারিতা করে এ কথা ভাবছ যে তোমরা জান্নাতে রেশমী পোশাক পরা হুর দেখতে পাবে? বা বেহেশতে হাউজে কাওসারের প্রবাহের শব্দ শুনতে পাবে? বা জাহান্নাম যাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে তোমরা তাদের দুর্গন্ধ শুকতে পাবে? তোমরা যদি সত্যিই একথা ভেবে থাক তবে তোমাদের ক্ষতি ও ব্যর্থতা সবই প্রকাশ্যে দেখতে পাবে। তোমাদের গোমরাহী (বিপথগামিতা) ভ্রান্তি ও বোকামির কারণ ব্যাখ্যায় আমি যা বলতে চাই তা হলো কমিউনিজম ও তোমাদের মাথার নাস্তিকতাই এর মূল কারণ। কমিউনিজমের কোন ভবিষ্যৎ নেই এবং কোন আকাশ (ছাদ) নেই, এটা অন্তহীন (বেগার) খাটুনি ও সর্বদা নিষ্ফল পরিশ্রম মাত্র।”

“তুমি কি মনে কর যে তাদের অধিকাংশ লোকই শুনতে পায় বা বুঝতে পারে? তারাতো কেবল চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তারা এদের চেয়েও বেশি পথভ্রষ্ট।” (২৫-সূরা আল ফুরকানঃ আয়াত-৪৪)

“তাদের অন্তর আছে কিন্তু তারা তা দিয়ে বুঝতে পারে না, তাদের চক্ষু আছে কিন্তু তারা তা দিয়ে দেখতে পায় না এবং তাদের কান আছে কিন্তু তারা তা দিয়ে শুনতে পায় না (তারা তো কেবল চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তারা এদের চেয়েও বেশি বিভ্রান্ত।)” (৭-সূরা আল আরাফঃ আয়াত-১৭৯)

وَمَن يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِن مُّكْرِمٍ

“আর আল্লাহ যাকে অপমান করেন তাকে কেউ সম্মানিত করতে পারে না।”

“তাদের কাজ কারবার মরুভূমির মরীচিকার মতো।” (২৪-সূরা আন নূর: আয়াত-৩৯)

“তাদের কাজকর্ম ঝড়ের দিনের ঝঞ্জাবায়ুতে উড়ন্ত ছাইয়ের মতো (বা বালুর মতো) (বিক্ষিপ্ত)।” (১৪-সূরা ইবরাহীমঃ আয়াত-১৮)

“বহু খুঁতযুক্ত-ধর্ম” নামক পুস্তকে ‘আক্কাদ’ কমিউনিজমকে ও এর মিথ্যা নাস্তিকতার মতবাদকে নিন্দাপূর্ণ বাক্যবাণ ছুড়ে বলেনঃ “যে আত্মা স্বাভাবিকভাবেই সুস্থ তা ইসলামের এই সত্য ধর্মকে গ্রহণ করে। যাদের মন পঙ্গু বা যাদের ধারণা নিম্নমানের ও অদূরদর্শী তাদের কাছেই নাস্তিক হওয়া আপাত দৃষ্টিতে ন্যায় সঙ্গত।”

وَطُبِعَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ

তাদের অন্তরে মোহর এঁটে দেয়া হয়েছে তাই তারা বুঝতে পারে না।” (৯-সূরা তাওবাঃ আয়াত ৮৭)

নাস্তিকতা চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে এক মারাত্মক আক্রমণ। এটা শিশুদের কল্পরাজ্যের মতো এক কষ্টকল্পিত ধারণা মাত্র এবং এটা এমন এক ভুল যার নজির ভুলের ইতিহাসে নেই। এ কারণেই মহান আল্লাহ বলেন-

“আসমানসমূহ ও পৃথিবীর স্রষ্টা আল্লাহ সম্বন্ধে কি কোন সন্দেহ আছে?” (১৪-সূরা ইবরাহীমঃ আয়াত-১০)

ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন- ফেরাউন ছাড়া অন্য কেউ স্রষ্টার অস্তিত্বকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করেনি। এমনকি সেও মনে মনে স্রষ্টার অস্তিত্বের অনুভব করত। এ কারণেই মূসা (আঃ) বলেছেন-

“তুমি জান যে আসমানসমূহ ও পৃথিবীর প্রতিপালকই এসব নিদর্শনাবলিকে প্রত্যক্ষ প্রমাণস্বরূপ অবতীর্ণ করেছেন। হে ফেরাউন! আমি অবশ্যই তোমাকে ধ্বংসের মুখে পতিত মনে করি।” (১৭-সূরা বনী ইসরাঈলঃ আয়াত-১০২)

অবশেষে, অতি বিলম্বে (অর্থাৎ তওবার সময় শেষ হওয়ার পর) ফেরাউন তার অন্তরের কথা ঘোষণা করে বলেছিল-

“আমি ঈমান আনলাম যে, বনী ইসরাঈল যার প্রতি ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আমি একজন মুসলিম।” (১০–সুরা ইউনুসঃ আয়াত-৯০)

আল্লাহর বিশ্বাসই মুক্তির উপায়

“এবং আমি আমার ব্যাপার আল্লাহর নিকট সোপদ করছি।” (৪০-সূরা আল মু'মিনঃ ৪৪)

“আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদই আসে না, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে আল্লাহ তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন।” (৬৪-সূরা আত তাগাবুনঃ আয়াত-১১)

যে ব্যক্তি বুঝে যে দুর্যোগ ভাগ্যের পূর্ব নির্ধারণী বা তকদীর অনুসারেই আসে আল্লাহ তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন।

“তিনি (উম্মি নবী রাসূল আল্লাহর আদেশেই) তাদেরকে বোঝা মুক্ত করেন এবং সে শৃঙ্খল মুক্ত করেন যা তাদের উপর ছিল।” (৭-সূরা আল আ'রাফঃ আয়াত-১৫৭)

কার্সি মিয়ারসন, এলেক্সিস কারলাইল ও ডেল কার্নেগীর মতো কতিপয় পশ্চিমা লেখকগণও নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন যে, বস্তুবাদী মানসিকতা সম্পন্ন পতনশীল পাশ্চাত্যের রক্ষার একমাত্র উপায় হলো ইশ্বরের প্রতি ঈমান (বিশ্বাস)। তারা এ মতের ব্যাখ্যায় বলেন যে, পাশ্চাত্যের সদা বর্ধনশীল ভয়ংকর আত্মহত্যার ঘটনার পিছনে যে কারণ রয়েছে তা হলো নাস্তিকতা ও সব কিছুর প্রতিপালক ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের (বা ঈমানের) অভাব।

“যারা আল্লাহর পথ হতে বিপথগামী হয় তাদের জন্য রয়েছে ভীষণ শাস্তি, কেননা তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে।” (৩৮-সূরা ছোয়াদঃ আয়াত-২৬)

وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ

“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করে সে যেন আকাশ থেকে পড়ে গেল। পাখি তাকে ছো মেরে নিয়ে যাবে বা বাতাস তাকে দূরে কোথাও উড়িয়ে নিয়ে যাবে।” (২২-সূরা আল হাজ্জঃ আয়াত-৩১)

আশশারকুল আওসাত (الشرق الاوساط)-এর ১৯৯৪ সালের কোন এক সংখ্যায় (২২তম সংস্করণের মূল আরবী পুস্তক মতে ২১-৪-১৪১৫ হি:) প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের স্ত্রীর সাথে এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এতে তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি একাধিকবার আত্মহত্যা করার উদ্যোগ করেছিলেন। একবার তার আত্মহত্যার পদ্ধতি ছিল নিজেকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা, আরেকবার তার আত্মহত্যার পদ্ধতি ছিল দূরারোহ খাড়া পাহাড়ের গায়ে গাড়ি চালিয়ে আত্মহত্যা করা (কিন্তু উভয়বারই তিনি আত্মহত্যা করতে ব্যর্থ হন। -অনুবাদক)

কুযমান উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ করছিল। মুসলমানরা তার পক্ষে চিৎকার করে বলল, “তার জন্য রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ।” কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “নিশ্চয় সে জাহান্নামী”। কেন? যখন তার ক্ষতের ব্যথা সাংঘাতিক আকার ধারণ করল তখন সে ধৈর্য ধরতে পারল না, বরং নিজের তরবারী দিয়ে আত্মহত্যা করে ফেলল। (আর এভাবেই সত্য নবীর সত্য ভবিষ্যৎবাণী সত্যে পরিণত হলো ও সাথে সাথে একথাও স্পষ্ট হলো যে, “আত্মহত্যাকারী জাহান্নামী।" -অনুবাদক)

“এ দুনিয়ার জিন্দিগিতে তাদের প্রচেষ্টা বিনষ্ট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা মনে করে যে তারা ভালোকাজ করেছে।” (১৮-সূরা আল কাহাফঃ আয়াত-১০৪)

“যে ব্যক্তি আমার জিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল তার জন্য রয়েছে সংকটময় জীবন এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ অবস্থায় হাশরের মাঠে উঠাব।” (২০-সুরা ত্বাহাঃ আয়াত-১২৪)

সংকট বা কষ্ট যতই সাংঘাতিক হোক না কেন একজন প্রকৃত মুসলমান কিছুতেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় না।

অযু করে বিনয়-নম্রতা ও হুজুরী কলবের সাথে দুরাকাত (সালাতুল হাজত) সালাত আদায় করলে আপনার থেকে দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা দূর হওয়ার গ্যারান্টি আছে।

“অতএব, তারা যা বলে সে বিষয়ে তুমি ধৈর্যধারণ কর এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে (ফজর), সূর্যাস্তের পূর্বে (আছর) রাতের বেলায় (মাগরিব ও এশা) ও দিবসের প্রান্তে (সূর্য হেলার পর জোহর) (সালাতের মাধ্যমে) তোমার প্রভুর প্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। যাতে করে তুমি (এ কাজের ফলে তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে পুরস্কার পেয়ে) সন্তুষ্ট হতে পার।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত-১৩০)

পথভ্রষ্টদের প্রতি কুরআনে এক অকাট্য ও শক্তিশালী প্রশ্ন আছে।

“তাদের কি হলো যে তারা ঈমান আনে না?” (৮৪-সূরা আল ইনশিকাকঃ আয়াত-২০)

দলীল-প্রমাণ যখন স্পষ্ট তখন কিসে তাদেরকে ঈমান আনা থেকে পাশ কাটিয়ে (বিরত) রাখে?

“আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনসমূহ দিগন্তে দিগন্তে (অর্থাৎ গোটা বিশ্ব জগতে) দেখাব এবং তাদের নিজেদের মাঝেও দেখাব যাতে তাদের নিকট একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এ কুরআন সত্য।” (৪১-সূরা হা-মীম-আস-সাজদাহঃ আয়াত-৫৩)

“আর যে সৎকর্মপরায়ণ (অবস্থায়) আল্লাহর নিকট আত্মসম্পর্ণ করবে সে তো দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে এক মজবুত হাতল।” (৩১-সূরা লোকমানঃ আয়াত-২২)

কাফেররাও বিভিন্ন স্তরের হয়

জর্জ বুশ তার স্মারক গ্রন্থ “অগ্রসর হও” “Moving Ahead”-এ উল্লেখ করেছেন যে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ব্রেযনেভের সৎকারে উপস্থিত হয়েছিলেন। বুশ বলেছেন যে, “আমি সৎকার কাজকে অন্ধকার ও খারাপ দেখলাম, এটা ঈমানহীন এবং আত্মাহীন ছিল।” তিনি খ্রিষ্টান ছিলেন আর তারা ছিল নাস্তিক তাই তিনি একথা বলেছেন।

“এবং যারা বলে, আমরা খ্রিস্টান; আপনি তাদেরকে ভালোবাসার দিক থেকে ঈমানদারদের নিকটবর্তী পাবেন।” (৫-সূরা মায়িদাঃ আয়াত-৮১)

ভেবে দেখুন যে, যদিও তিনি পথভ্রষ্ট তবুও তিনি তাদের মিথ্যা বিষয় ও অসাড়তাকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এভাবেই বিষয়টি তুলনামূলক (হয়)। যদি তিনি আল্লাহর সত্য ধর্ম ইসলাম (সম্বন্ধে) জানতেন তবে ব্যাপার স্যাপার কতইনা ভিন্ন ধরনের হতো।

“আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম তালাশ করে, তার পক্ষ থেকে তা কখনই গ্রহণ করা হবে না এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-৮৫)

এ ঘটনায় ইমাম ইবনে তাইমিয়ার একটি কথা আমার মনে পড়ে গেল। তিনি এক ভণ্ড তাপসের (সুফীর) সাথে কথা বলতে ছিলেন। লোকটি ইবনে তাইমিয়াকে বলল “যখন আমরা তোমাদের আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের লোকদের নিকট আসি তখন কেন আমাদের যাদু বা আলৌকিক ক্ষমতা কাজ করে না। কিন্তু যখন আমরা মঙ্গোলিয়ান কাফের তাতারদের নিকট যাই তখন আমাদের আলৌকিক ক্ষমতা কাজ করে (কেন)?”

ইবনে তামিয়াহ বললেন- “তুমি কি তোমাদের তাতারদের ও আমাদের নমুনা জান? আমরা সাদা ঘোড়ার মতো, তোমরা সাদা কালো ছোপ ওয়ালা ঘোড়ার মতো আর তাতাররা কাল ঘোড়ার মতো। যখন কোন সাদা কালো ছোপযুক্ত ঘোড়া কালো ঘোড়ার পালে প্রবেশ করে তখন এটাকে সাদা দেখায় আর যখন এটা সাদা ঘোড়ার পালে প্রবেশ করে তখন এটাকে কালো দেখায়। এখন তোমাদের সামান্য আলোর (নূরের) লেশ আছে। যখন তোমরা কাফেরদের সাথে মিশ তখন তোমাদের সে নূরের লেশ দেখা যায়। কিন্তু যখন তোমরা আমাদের অধিকতর শক্তিশালী আলো সম্বলিত আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের লোকদের নিকট আস তখন তোমাদের অন্ধকার প্রকাশিত হয় (মৃদু আলো নিম্প্রভ হয়ে যায়। --অনুবাদক) আর এটাই তোমাদের, তাতারদের ও আমাদের উদাহরণ।”

“আর যাদের মুখমণ্ডলসমূহ উজ্জ্বল হবে তারা (জান্নাতে) আল্লাহর রহমতের মাঝে থাকবে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১০৭)

সাফল্যের জন্য চাই লৌহ-দৃঢ় ইচ্ছা

একটি মুসলিম দেশ থেকে একজন ছাত্র লন্ডনে পড়াশুনা করতে গিয়েছিল। তার ভাষাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সে এক ব্রিটিশ পরিবারের সাথে থাকত। সে তার ধর্মের মূলনীতির প্রতি একনিষ্ঠ ছিল এবং প্রতিদিন ভোররাত্রে ফজরের সালাত পড়ার জন্য উঠে পড়ত। সে অযু করত, সালাতের জায়গায় যেত, তার প্রভুর উদ্দেশ্যে সেজদা করত, তার (আল্লাহর) মহিমা গাইতো ও তার প্রশংসা করত। সে বাড়ির এক বৃদ্ধা মহিলা এ ছাত্রটির এ আজব (বৃদ্ধার নিকট) অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রবল আগ্রহী ছিল। কয়েকদিন পর বৃদ্ধা ছাত্রটিকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কি করছ?

“আমার ধর্ম আমাকে এরূপ করার আদেশ করে” উত্তরে ছাত্রটি একথা বলল। পুরাপুরি বিশ্রাম করে আরেকটু পরে তুমি এ সালাত পড়তে পার না?” ছাত্রটি এ কথার উত্তরে বলল, “কিন্তু আমি যদি সালাতের নির্ধারিত সময়ের পরে তা আদায় করি তবে আমার প্রভু আমার পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করবেন না।” তখন বৃদ্ধা মাথা নেড়ে বিস্ময়ে চিৎকার করে বলল, “এ এমন ইচ্ছা যা লৌহাকেও ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়।”

رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ

“এমন কিছু লোক আছে যাদেরকে না ব্যবসা, আর না বিক্রয়, কোনটাই আল্লাহর জিকির থেকে ও সালাত আদায় করা থেকে ভুলিয়ে রাখতে পারে না।” (২৪-সূরা আন নূরঃ আয়াত-৩৭)

এ ধরনের কাজ কেবলমাত্র দৃঢ় ঈমান থেকেই উৎসারিত হয় যা ফেরাউনের যাদুকরদিগকে (ঈমান আনতে) প্রণোদিত করেছিল। যখন মূসা (আঃ) ও ফেরাউন একে অপরের সাথে তর্ক করছিল তখন তারা সবকিছুর প্রভু আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে প্রণোদিত হয়েছিল। তারা ফেরাউনকে বলেছিল “আমাদের নিকট যে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে তার উপর এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তার উপর আপনাকে আমরা কখনই প্রাধান্য দিব না, সুতরাং আপনার যা মনে চায় সে ফয়সালাই করুন।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত-৭২)

এটা ফেরাউনের বিরুদ্ধে এমন এক চ্যালেঞ্জ ছিল যা সে মুহুর্তের আগ পর্যন্ত (কখনও) শুনা যায়নি। উদ্ধত নাস্তিকের নিকট ইসলামের সত্য ও শক্তিশালী বার্তাকে পৌঁছে দেয়াই হঠাৎ করে (তৎক্ষণাৎ) তাদের ব্রত হয়ে গিয়েছিল। হাবীব ইবনে যায়িদ (রাঃ) মুসাইলামাকে ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়েছিলেন। উত্তরে মুসাইলামা তরবার দিয়ে হাবীব (রাঃ)-এর দেহ থেকে একের পর এক অঙ্গ কেটে ফেলতে লাগল। সে হাবীব (রাঃ)-এর ভোগান্তি বাড়ানোর জন্য এরূপে ধীরে ধীরে তাকে কষ্ট দিতে ছিল। এ সময় হাবীব (রাঃ) কান্নাকাটি হৈ চৈ ও নড়াচড়া করেননি, অবশেষে তিনি শহীদ হয়ে তার প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ করতে চলে গেলেন।

وَالشُّهَدَاءُ عِندَ رَبِّهِمْ لَهُمْ أَجْرُهُمْ وَنُورُهُمْ

“আর শহীদগণ তাদের প্রভুর সান্নিধ্যে থাকবে, (সেখানে) তাদের জন্য রয়েছে তাদের পুরস্কার ও তাদের নূর।” (৫৭-সূরা আল হাদীদঃ আয়াত-১৯)

আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি বা জন্মগত স্বভাব-প্রকৃতি

যখন প্রচণ্ড ঝঞ্জাবায়ু বয়, বজ্র গর্জন করে ও অন্ধকারে আকাশ ছেয়ে যায় তখন সাহায্যের জন্য আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়ার মানুষের সহজাত প্রয়োজন সুপ্ত অবস্থা থেকে জেগে উঠে।

“তখন এর নিকটে (জাহাজের নিকটে) ঝঞ্জা ক্ষুব্ধ বায়ু আসে এবং তাদের নিকট সবদিক থেকে ঢেউ আসে। তারপর তারা ভাবতে থাকে যে, তারা এ সবের মাঝে আটকা পড়ে গেছে, তখন তারা আল্লাহকে তার আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে আহবান করে।” (১০-সূরা ইউনুসঃ আয়াত-২২)

তাছাড়া মুসলমানরা সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায়ই তাদের প্রভুকে আহবান করে।

“যদি সে (ইউনুস নবী) আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করত তবে তাকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত মাছের পেটে থাকতে হতো।” (৩৩-সূরা আল আহযাবঃ আয়াত-১৪৩, ১৪৪)

অধিকাংশ লোকই প্রয়োজনের সময় আল্লাহর নিকট সাহায্য চায়, আর যখন তাদের আশা শেষ হয়ে যায তখন তারা গর্বভরে তাদের পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। তারা কি মনে করে যে, আল্লাহকে ধোকা দেয়া সম্ভব।

“নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোকা দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তিনিই তাদেরকে ধোকায় ফেলেন।” (৪-সূরা আন নিসাঃ আয়াত-১৪২)

(আল্লাহ মুনাফিকদেরকে ধোকায় ফেলেন এর অর্থ হলো তিনি তাদেরকে তাদের ধোকাবাজির কারণে শাস্তি দিবেন। কেননা আল্লাহর পক্ষে ধোকা দেয়া শোভা পায় না। -অনুবাদক)

যারা কেবলমাত্র বিপদের সময়েই আল্লাহর মুখাপেক্ষী হয় তারা ভণ্ড ফেরাউনের শিষ্য। ফেরাউন যখন সময় পার হয়ে যাবার পর ঈমান এনেছিল তখন তাকে বলা হয়েছিল (সময় পার হয়ে যাবার পর) এখন তুমি ঈমান আনছ!

অথচ তুমি পূর্বে অবাধ্যতা করেছ (ঈমান আনতে অস্বীকার করেছ) এবং তুমি ফাসাদকারী ছিলে।” (১০-সূরা ইউনুসঃ আয়াত-৯১)

আমি BBC রেডিওতে খবর শুনেছি যে, ইরাক যখন কুয়েত দখল নিয়েছিল তখন মার্গারেট থ্যাচার কলোরেডোতে ছিল, তখন তিনি অতি দ্রুত চার্চে গিয়ে সেজদা করেছিলেন। এর একমাত্র ব্যাখ্যা আমি মনে করি যে, তার সহজাত প্রকৃতি জেগে গিয়েছিল ও তিনি কুফুরি ও পথভ্রষ্টতা সত্ত্বেও তার প্রভুর মুখাপেক্ষী হয়েছিলেন। মানুষের মাঝে স্বভাবজাত বলতে কিছু একটা আছে যা তাদেরকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে সাহায্য (বাধ্য) করে।

كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ

“প্রতিটি শিশুই স্বভাব ধর্মের উপর (ঈমান ও ইসলামের উপর) জন্মগ্রহণ করে; পরে তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী খ্রিস্টান বা অগ্নিউপাসক বানায়।”

আপনার রিযিক আপনার নিকট আসবেই

যে তার রিযিকের বিলম্বে অধৈর্য, কেন তার সম্পদ এত কম সেজন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং অন্যদের তুলনায় পার্থিব সম্পদ কম থাকার কারণে অসন্তুষ্ট সে তো ঐ ব্যক্তির মতো যে নাকি সালাতে ইমামের আগে সালাতের রোকনসমূহ (রুকু, সেজদা, কওমা, জলসা ইত্যাদি) আদায় করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ইমামের সালাম ফিরানোর আগে সালাম ফিরিয়ে সালাত শেষ করতে পারে না। অনুরূপভাবে, কেউ তার তকদীরের সব রিযিক ভোগ করার আগে মরতে পারে না। সকল সৃষ্টকে সৃষ্টি করার পঞ্চাশ হাজার (৫০,০০০) বছর আগেই তকদীর লিখা হয়ে গেছে।

“আল্লাহর বিধান আসবেই। সুতরাং এর জন্য তাড়াহুড়া করো না।” (১৬-সূরা আন নাহলঃ আয়াত-১)

“আর আল্লাহ যদি তোমার কল্যাণ চান তবে কেউ তার অনুগ্রহকে রদ করতে পারবে না।” (১০-সূরা ইউনুসঃ আয়াত-১০৭)

উমর (রাঃ) বলেছেন- “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট পাপীদের ধৈর্য থেকে ও আত্মবিশ্বাসের দুর্বলতা থেকে পানাহ চাই।”

এ কথার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থ আছে। আমি যখন ইতিহাসের প্রধান প্রধান ঘটনা নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখলাম, তখন দেখতে পেলাম যে, আল্লাহর অনেক শক্রদের আশ্চর্য রকম বীরত্বপূর্ণ সহিষ্ণুতা, কষ্ট সহিষ্ণুতা ও অধ্যাবসায় ছিল। পক্ষান্তরে, আমি এও দেখতে পেলাম যে, বহু মুসলমান নীরস, জড়াগ্রস্ত বা অলস ও দুর্বল ছিল। এসব কিছু তখনই দেখা দিয়েছিল যখন তারা ভুল করে ভাবতে ছিল যে, তারা আল্লাহর উপর নির্ভর করে আছে। আল্লাহর উপর সত্যিকার নির্ভরতা বলতে বুঝায় প্রচেষ্টা করা ও কাজ করা এবং তারপর কাজের ফলাফল আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া।


“আল্লাহর উপর ভরসা” শিরোনামের আকর্ষনীয় এই টপিকসের সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
১ম পর্ব    ২য় পর্ব    ৩য় পর্ব    ৪র্থ পর্ব    ৫ম পর্ব    ৬ষ্ট পর্ব    ৭ম পর্ব    ৮ম পর্ব    ৯ম পর্ব    ১০ম পর্ব    ১১-তম পর্ব    ১২-তম পর্ব    ১৩-তম পর্ব    ১৪-তম পর্ব    ১৫-তম পর্ব    ১৬-তম পর্ব    ১৭-তম পর্ব    ১৮-তম পর্ব    ১৯-তম পর্ব    ২০-তম পর্ব    ২১-তম পর্ব    ২২-তম পর্ব    ২৩-তম পর্ব    ২৪-তম পর্ব    ২৫-তম পর্ব    ২৬-তম পর্ব    ২৭-তম পর্ব    ২৮-তম পর্ব    ২৯-তম পর্ব    ৩০-তম পর্ব    ৩১-তম পর্ব    ৩২-তম পর্ব    ৩৩-তম পর্ব    ৩৪-তম পর্ব    ৩৫-তম পর্ব    ৩৬-তম পর্ব    ৩৭-তম পর্ব    ৩৮-তম পর্ব 




****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url