আল্লাহর উপর ভরসা || (পর্ব-৩৮) || সবাইতো সুখী হতে চায় || সংযমই সুখী জীবনের মূলমন্ত্র ||





আল্লাহর উপর ভরসাতেই চূরান্ত সাফল্য ও প্রকৃত সুখ


আল্লাহর উপর ভরসা ৩৮-তম পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

সবাইতো সুখী হতে চায়

সবাই সুখী হতে চায় কিন্তু সবার ভাগ্যে সমানভাবে সুখ আসে না। পৃথিবীতে আসলে সুখের কোন সার্বজনীন সঙ্ঘা নেই। সুখ জিনিসটা আসলে একেজনের কাছে একেক রকম। অর্থ সম্পদ কখনও প্রকৃত সুখ বয়ে আনে না। সুখ থাকে ঈমানে, সূখ থাকে অনুভবে, সুখ থাকে বিশ্বাসে। প্রকৃত সুখ পাওয়া যায় আল্লাহর উপর ভরসা করলে। যে পথে চললে সুখ পাওয়া যায় সে পথে খুব কম লোকই চলে। সুখের পথ সম্বন্ধে তিনটি বিষয় নিয়ে আপনাকে ভেবে দেখতে হবে।

১. যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিকে জীবনের প্রধান বিষয় বানায় না, সে অবশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শেষ হয়ে যাবে।

سَنَسْتَدْرِجُهُم مِّنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ

“আমি অচিরেই তাদেরকে ক্রমে ক্রমে শাস্তি দিয়ে এমনভাবে ধ্বংস করে ফেলব যে তারা টেরও পাবে না।” (৭-সূরা আল আ’রাফঃ আয়াত-১৮২)

২. সুখ লাভের আশায় মানুষেরা বিভিন্ন জটিল ও চাতুরীপূর্ণ পথ অনুসরণ করে। তারা খুব কমই জানে যে, ইসলাম ধর্মে তাদের জন্য একটি সহজতর পথ প্রস্তুত করাই আছে। সে পথ তাদের জন্য সর্বোত্তম ইহজীবন ও পরকাল বয়ে আনবে।

لَوْ أَنَّهُمْ فَعَلُوا مَا يُوعَظُونَ بِهِ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُمْ وَأَشَدَّ تَثْبِيتًا

“কিন্তু তোমাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল যদি তারা তা (অনুসারে কাজ) করত তবে অবশ্যই তা তাদের জন্য ভালো হতো এবং (চিত্তের) স্থিরতার জন্য তা দৃঢ়তর হতো।” (৪-সূরা আন নিসাঃ আয়াত-৬৬)

৩. এ পৃথিবীতে অনেক লোক আছে যারা মনে করে যে, তারা ভালো কাজ করছে। কিন্তু আসলে তারা ইহজীবনে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধুমাত্র এ কারণে যে, তারা সত্য ধর্মকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করছে।

وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا

“আর সত্য সত্যই এবং ন্যায়সঙ্গতভাবেই তোমার প্রভুর বাণী পূর্ণ হয়েছে।” (৬-সূরা আল আন’আমঃ আয়াত-১১৫)

সুদিনে কৃতজ্ঞ থাকা এবং দুর্দিনের জন্য প্রস্তুত থাকা

আরামে, শান্তিতে ও সুস্থ থাকাকালে প্রায়ই প্রার্থনা করুন। মুমিনের চরিত্র হলো যে, সে শোকরগুজার ও পাকা নিয়তকারী (কৃতজ্ঞ ও স্থির সঙ্কল্প)। সে ধনুক তীর থেকে নিক্ষেপ করার আগেই ওটাকে ধার দিয়ে নেয় এবং মুসিবতে পড়ার (দুর্দশাগ্রস্ত হবার) আগেই সে আল্লাহর মুখাপেক্ষী হয়। এ বিষয়ে মু’মিনদের বিপরীত হলো ইতর কাফের ও অবিবেচক (বোকা) মু’মিন।

“আর যখন মানুষকে কোন ক্ষতি স্পর্শ করে তখন সে বিনীতভাবে বা একনিষ্ঠভাবে তার প্রভুকে ডাকে; অতঃপর যখন তিনি তার পক্ষ থেকে তাকে কোন নেয়ামত দান করেন, তখন সে যে আগে তার নিকট আবেদন করত সে কথা সে ভুলে যায় এবং সে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করায়।” (৩৯-সূরা আয যুমারঃ আয়াত-৮)

অতএব, যদি আমরা সত্যিই নিরাপদ থাকতে চাই তবে আল্লাহর নিকট আবেদন (দোয়া) করায় এবং আল্লাহর প্রশংসায় আমাদেরকে অবশ্যই অটল থাকতে হবে। স্বাচ্ছন্দ্যের বা সুখের সময় আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করার উদ্দেশ্য হলো (ইমাম হালীমির মতে): আল্লাহর প্রশংসা করা, তার শোকরিয়া আদায় করা ও তার অগণিত করুণাকে অনুধাবন করা এবং একই সময়ে হেদায়েত ও সাহায্য চাওয়া। আপনার ক্রটি-বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা চাওয়াও জরুরি। আল্লাহর যে হক আপনার উপর আছে আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন তা আপনি কিছুতেই পুরাপুরিভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন না (এ কারণেই ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া জরুরি। -অনুবাদক)

নিরুদ্বিগ্ন ও নিরাপদ অবস্থায় যে ব্যক্তি সে অধিকার সম্বন্ধে অমনোযোগী থাকে সে নিম্নোক্ত আয়াতের মধ্যে উল্লেখিত লোকদের দলে পড়ে-

فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ

“আর যখন তারা নৌযানে চড়ে তারা আল্লাহর প্রতি তাদের বিশ্বাসকে খাটি করে তাকে ডাকে, কিন্তু যখনই তিনি তাদেরকে স্থলভাগে উত্তীর্ণ করেন তখনই তারা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করে।” (২৯-সূরা আনকাবূতঃ আয়াত-৬৫)

জান্নাত ও জাহান্নাম

জান্নাত ও জাহান্নাম হল নিজের আমল ও বিশ্বাসের ফল। আল্লাহর উপর ভরসা করে নেক আমল চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই জান্নাত লাভ সহজ হয়। অপর দিকে অন্য যত পথ ও মত আছে সবই জাহান্নামের পথ। মিতারান্দের শাসনামলে এক ফরাসী মন্ত্রীর আত্মহত্যার খবর বিশ্বব্যাপী সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। আত্মহত্যার পিছনে যে কারণ ছিল তা এই যে, ফরাসী সংবাদপত্রগুলো তার নাম ও সুনামকে কলঙ্কিত করে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এক চরম যুদ্ধ চালিয়েছিল। কোন বিশ্বাস না পেয়ে বা কোন আশ্রয়স্থল না পেয়ে বা কোন সমর্থন না পেয়ে সে তার নিজের জীবনটাকেই ধ্বংস করে দিল। নিজের ধ্বংসের মাঝে আশ্রয়গ্রহণকারী এ হতভাগা লোকটি নিম্নোক্ত আয়াতসমূহে বর্ণিত স্বর্গীয় সংক্ষিপ্তসার অনুসারে পথপ্রদর্শিত (হেদায়েতপ্রাপ্ত) হয়নি।

“এবং তারা যে ষড়যন্ত্র করে তাতে মনে কষ্ট নিবেন না।” (১৬-সূরা আন নাহলঃ আয়াত-১২৭)

لَن يَضُرُّوكُمْ إِلَّا أَذًى

“সামান্য কষ্ট দেয়া ছাড়া তারা কখনই তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”

وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيلًا

“আর তারা যা বলে তাতে ধৈর্য ধরুন এবং তাদেরকে সুন্দরভাবে এড়িয়ে চলুন।”

তার আত্মহত্যার কারণ এই ছিল যে, সে (সঠিক) পথ হারিয়ে ফেলেছিল ও সত্যের পথ থেকে বহুদূরে ছিল।

مَن يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ

“যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন তার কোন পথপ্রদর্শক নেই।”

অনেকে পরামর্শ দেন যে, নিপীড়িত ও দুর্ভাগাদের প্রাকৃতিক ভ্রমণে বের হওয়া, গান শোনা অথবা দাবা-পাশা খেলা উচিত।

কিন্তু ইসলামের অনুসারীগণ আরো কার্যকর ও আরোগ্যকর পন্থার দাবি করেনঃ তাহলো আযান ও জামায়াতের মাঝে আল্লাহকে স্মরণ (জিকির) করার জন্য, তার নিকট আত্মসমর্পণ করার জন্য এবং তার স্বর্গীয় বিধানে সন্তুষ্ট হওয়ার জন্য মসজিদে বসা। আর এর গুরুত্ব আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ তাওাক্কুল (নির্ভর) করার সমান।

আমি কি আপনার বক্ষকে প্রশস্ত করে দিইনি

أَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ

“(হে মুহাম্মদ!) আমি কি আপনার বক্ষকে প্রশস্ত করে দিইনি?” (৯৪-সূরা আল ইনশিরাহঃ আয়াত-১)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর এমন কিছু বাণী নাযিল হয়েছে যা চরিত্রে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। তার মন শান্তিতে ছিল এবং তিনি ছিলেন সাহসী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই ছিলেন আশাবাদী ও সহজভাবে তার কাজকর্ম করে যেতেন। তিনি মানুষের মনের মানুষ ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। যদিও তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনগণের কাছের মানুষ ছিলেন, সদা হাসি মুখে থাকতেন তবুও সর্বদা তার নিকট মর্যাদা ও সম্মানবোধ ছিল (অর্থাৎ তিনি সর্বদা মর্যাদা ও সম্মানজনকভাবে থাকতেন)। তার চরিত্র ছিল পূর্ণ ও অনুপম। তিনি অনেক কোমলতা দেখিয়ে শিশুদের সাথে খেলা করতেন এবং পরিদর্শককে প্রকাশ্যে স্বাগতম জানাতেন বা মেহমানকে খোলামনে অভ্যর্থনা করতেন। কেননা, তিনি আল্লাহর অনুকম্পা ও দয়ায় সুখী ছিলেন। হতাশা ও ব্যর্থতা তার নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। বরং তিনি অনুকূল আশাবাদকে সমর্থন দিতেন। জাঁক, বড়াই, কৃত্রিমতা, মুনাফেকি, অপচয় ও অসংযম তার নিকট খুবই ঘৃণার বস্তু ছিল। উপরোক্ত সকল চরিত্রের পরম পরাকাষ্ঠা তিনি ছিলেন– একথা সহজেই বলা যায়। সত্যিকার অর্থেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান অধিকারী। একটা গোটা জাতির জন্য আদর্শ এবং শিক্ষক, পারিবারিক ও সামাজিক মানুষ এবং বহুগুণের অধিকারী। সংক্ষেপে, তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন সকল কল্যাণের দিকে পরিচালিত ব্যক্তি।

وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ

“তাদের উপর যে বোঝা ও শৃঙ্খল ছিল তিনি তাদের থেকে তা সরিয়ে দিবেন।” (৭-সূরা আল আরাফঃ আয়ত-১৫৭)

رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

“সমগ্র বিশ্ব জগতের জন্য রহমতস্বরূপ।” (২১-সূরা আল আম্বিয়াঃ আয়াত-১০৭)

شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا

“সাক্ষী, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী, আল্লাহর হুকুমে তার দিকে আহবানকারী এবং আলো বিচ্ছুরণকারী বাতিস্বরূপ।” (৩৩-সূরা আহযাবঃ আয়াত-৪৫-৪৬)

ইসলামও এর সহজ অনুস্মরণীয় বাণীর বিপরীত হলো খারিজীদের বাড়াবাড়ি, সুফীদের বোকামী ও বাড়াবাড়ি, কবিদের আবেগতাড়িত অদম্য ভালোবাসা এবং ইহজীবন-পূজারীদের অসার দম্ভ।

فَهَدَى اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا لِمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِهِ وَاللَّهُ يَهْدِي مَن يَشَاءُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

“অতপর, মু’মিনরা যে সত্য বিষয়ে মতপার্থক্য করত আল্লাহ নিজ ইচ্ছায় (বা অনুগ্রহে) তাদেরকে সে বিষয়ে সত্য পথ প্রদর্শন করলেন। আর যাকে ইচ্ছা আল্লাহ তাকে সরল পথ প্রদর্শন করেন।” (২-সূরা বাকারাঃ আয়াত-২১৩)

সংযমই সুখী জীবনের মূলমন্ত্র

একজন পশ্চিমা চিন্তাশীল ব্যক্তি বলেছেন, “জেলখানায় থেকেও আকাশের পানে তাকানো ও গোলাপের গন্ধ শোকা আপনার পক্ষে খুবই সম্ভব। সমৃদ্ধি ও আরাম-আয়েশে ভরপুর প্রাসাদে থেকেও পরিবার ও সম্পদের বিষয়ে ক্রুদ্ধ ও অসন্তুষ্ট থাকাও চরমভাবে সম্ভব।

অতএব, সময় ও স্থানভেদে নয়, বরং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস বা আল্লাহর উপর ভরসা ও তার আনুগত্যের মাধ্যমেই সুখ নির্ধারিত। আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে বদ্ধমূল থাকে। এ বিষয়ে অন্তরের সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব রয়েছে। আল্লাহ অন্তরের দিকেই তাকান (অর্থাৎ তিনি অন্তর দেখেন) ও (অন্তরেরই) পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করেন। অন্তরে বিশ্বাস থাকলে দেহ-মনে সুখ-শান্তি বিরাজ করবে।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) একজন সম্মানিত আলেম ও মেধাবী হাদীস সংকলক ছিলেন। তিনি উৎপাদনশীল জীবন যাপন করতেন, তবুও ধনী ছিলেন না। তার পোশাকে বিভিন্ন স্থানে তালি ছিল এবং যখন এটা নতুন করে ছিড়ত তখনই তিনি হাতে এটাকে সেলাই করে নিতেন। তিনি মাটির তৈরি তিন-ঘরবিশিষ্ট একটি বাড়িতে থাকতেন। তিনি প্রায়ই শুধুমাত্র এক টুকরো রুটি খেতে পেতেন (আরবী পুস্তকে আছে রুটির সাথে একটু তেলও খেতেন। তার জীবনী লেখকগণ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি সতের বছর ধরে একই জুতা পরতেন আর তাতে ফাটল দেখা গেলে তিনি নিজ হাতে তাতে প্রায়ই তালি লাগিয়ে নিতেন বা তা সেলাই করে নিতেন। মাসে মাত্র একবার তার পাতে গোশত আসত এবং অধিকাংশ দিনই তিনি রোযা রাখতেন। হাদীসের সন্ধানে তিনি বহু স্থান ভ্রমণ করেছেন। তাকে এতসব কষ্ট পোহাতে হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন তৃপ্ত, তুষ্ট, স্বচ্ছন্দ, সৌম্য, শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন। তার বীরত্বসূচক ধৈর্য, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্বন্ধে তার জ্ঞান, আল্লাহর কাছ থেকে তার পুরষ্কার চাওয়া এবং আখেরাত ও জান্নাতের জন্য তার চেষ্টার কারণেই এসব গুণ সৃষ্টি হয়েছিল।

পক্ষান্তরে তার সময়ের শাসকগণ যেমন- আল-মামুন, আল ওয়াসিক, আল মু'তাসিম ও আল মুতাওয়াক্কিল এরা সবাই প্রাসাদে বাস করত। তারা সোনা-রূপার ভাণ্ডারের মালিক ছিল; একটা গোটা সেনাবাহিনী তাদের অধীনে ছিল; তারা যা চাইত তা সবই পেত। তাদের সকল পার্থিব সম্পদ সত্বেও তারা অশান্তিতে জীবন-যাপন করত। তারা তাদের জীবনকে উদ্বিগ্নতায় ও দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিদ্রোহ তাদের জীবনে দুর্দশা বয়ে এনেছিল। ইতিহাসের বর্ণনায় আমরা এও পাই যে, তাদের অনেকেই মৃত্যুশয্যায় তাদের অসংযম ও ক্রটি-বিচ্যুতি বুঝতে পেরে পৃথিবীকে তিক্তভাবে (অশান্তির স্থান বলে) ঘোষণা দিত।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ হলেন আরেক উদাহরণ; তিনি এ পৃথিবীতে পরিবারহীন, গৃহহীন, সম্পদহীন ও পদমর্যাদাহীন জীবন কাটিয়েছেন। তার যা ছিল তা হলো কেন্দ্রিয় মসজিদ সংলগ্ন একটি কক্ষ, সারা দিন কাটানোর জন্য এক টুকরো রুটি ও দু’টি জামা, মাঝে মাঝে তিনি মসজিদে ঘুমাতেন। কিন্তু, যেমনটি তিনি নিজেই নিজের অবস্থা সম্বন্ধে বলেছেন, তার অন্তরে তাঁর জান্নাত ছিল, তাঁর হত্যাদেশ ছিল তাঁর জন্য শাহাদাত, কারাবন্দী ছিল শান্তিপূর্ণ নির্জন বাস এবং স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হওয়া ছিল পর্যটক হিসেবে বিদেশ ভ্রমণ। তার অন্তরে কেবলমাত্র ঈমানের বৃক্ষের দৃঢ় শিকড় থাকার কারনেই তাঁর মাঝে এ ধরণের মানসিকতা জন্মাতে পেরেছিল। “এর তেল যেন আলো ছড়ায়, যদিও একে আগুন স্পর্শ করেনি। আলোর উপর আলো আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তার নূরের (আলোর) দিকে পথ প্রদর্শন করেন।”

كَفَّرَ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَأَصْلَحَ بَالَهُمْ

“তিনি তাদের থেকে তাদের পাপসমূহ মোচন করে দিবেন এবং তিনি তাদের অবস্থা ভালো করে দিবেন।” (৪৭-সূরা মুহাম্মদ আয়াত-২)

“আর যারা সৎপথ (হেদায়াত) গ্রহণ করে আল্লাহ তাদের সৎপথে থাকার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে তাদের তাকওয়া (খোদাভীতি) দান করেন।” (৪৭-সূরা মুহাম্মদঃ আয়াত-১৭)

“তুমি তাদের চেহারায় সুখের আভা দেখতে পাবে।” (৮৩-সূরা আল মুতাফফিফীনঃ আয়াত-২৪)

সাহাবী আবু যর গিফারী (রাঃ) তার সংযমী জীবনযাপন প্রণালীর জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি শহর ছেড়ে এক বিচ্ছিন্ন এলাকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। (সেখানে) তাবু গাড়ার পর তার অধিকাংশ দিন প্রধানত ইবাদত, কুরআন তেলাওয়াত ও গবেষণায় কেটেছে। অধিকাংশ দিন তিনি রোযা রাখতেন। তার পার্থিব সম্পদ বলতে ছিল একটি তাবু, কিছু ভেড়া ও অন্যান্য কিছু তুচ্ছ জিনিসপত্র। একবার তার কয়েকজন বন্ধু তাকে দেখতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “দুনিয়া কোথায় (অর্থাৎ দুনিয়ার আসবাবপত্র যা অন্যান্য মানুষের আছে তা কোথায়)?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “এ পৃথিবীর যা কিছু আমার দরকার সব আমার ঘরে আছে এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমাদের সামনে (বিচারের দিনে) এক অলঙ্ঘনীয় বাধা আছে এবং কেউ সে বাধা অতিক্রম করতে পারবে না, তবে শুধুমাত্র সে পারবে যার বোঝা হালকা।”

নিদারুণ দরিদ্র জীবনযাপন সত্ত্বেও (তিনি মনে করতেন যে) এ পৃথিবীর যা কিছু তার দরকার ছিল, তার সবকিছুই তার ছিল। প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ সম্বন্ধে তিনি মনে করতেন যে, এগুলো তাকে তার প্রধান উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে দিবে এবং শুধুমাত্র তার দুশ্চিন্তার কারণ হবে।


“আল্লাহর উপর ভরসা” শিরোনামের আকর্ষনীয় এই টপিকসের সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
১ম পর্ব    ২য় পর্ব    ৩য় পর্ব    ৪র্থ পর্ব    ৫ম পর্ব    ৬ষ্ট পর্ব    ৭ম পর্ব    ৮ম পর্ব    ৯ম পর্ব    ১০ম পর্ব    ১১-তম পর্ব    ১২-তম পর্ব    ১৩-তম পর্ব    ১৪-তম পর্ব    ১৫-তম পর্ব    ১৬-তম পর্ব    ১৭-তম পর্ব    ১৮-তম পর্ব    ১৯-তম পর্ব    ২০-তম পর্ব    ২১-তম পর্ব    ২২-তম পর্ব    ২৩-তম পর্ব    ২৪-তম পর্ব    ২৫-তম পর্ব    ২৬-তম পর্ব    ২৭-তম পর্ব    ২৮-তম পর্ব    ২৯-তম পর্ব    ৩০-তম পর্ব    ৩১-তম পর্ব    ৩২-তম পর্ব    ৩৩-তম পর্ব    ৩৪-তম পর্ব    ৩৫-তম পর্ব    ৩৬-তম পর্ব    ৩৭-তম পর্ব    ৩৮-তম পর্ব 



*****************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url